কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৪ মে, ২০২২

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


(১৭)

অনির্বেদ ক্রমেই যেন বুঝতে পারছিল এই জায়গাটা ঠিক ওর জন্য নয়। এরা সবাই স্বচ্ছল  ঘরের ছেলেমেয়ে। ওর লড়াইটা কেউই ঠিক ভেতর থেকে বোঝে না। এদের থেকে নিজের বিচ্ছিন্নতা সে তীব্রভাবে টের পেতে শুরু করেছিল।

একদিন পুতুলের মেলায় গিয়ে ঠিক এই ব্যাপারটাই টের পেল হৃদয়। অনির্বেদ তার দুজন বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছিল। ওকে আসতে দেখে চুপ করে গেল ওরা। হৃদয় শুধু শেষ বাক্যটা শুনতে পেল। হঠাৎ যেন সতর্ক হয়ে গিয়ে অনির্বেদ বলছে। চুপ কর, চুপ কর, ওর সামনে এসব বলতে যাস না। বহুদিন পর্যন্ত অনির্বেদের সেই ভঙ্গীটা মনে পড়ত হৃদয়ের। একদম গেঁথে গিয়েছিল। বাক্যটা ভুলে গিয়েছিল সে।

হৃদয় আসার কিছুক্ষণ পরই ছেলেদুটি চলে গেছিল। চেহারায় অভাব আর দারিদ্রের ছাপ। রুক্ষ ও অমার্জিত চেহারা। একটুও ভালো লাগল না হৃদয়ের। এরা কারা? ঠিক তখনই অনির্বেদ বলে উঠল আমার দুই বেস্ট ফ্রেণ্ড।

অনির্বেদ বুঝিয়ে দিল ফুলের বাগানের কেউ ওর বেস্ট ফ্রেণ্ড নয়। ওর নিজস্ব একটা বৃত্ত আছে। সেখানকার বন্ধুত্ব ওর কাছে আরো বেশী জরুরী। সেই বন্ধুত্ব অনেক বেশী খাঁটি। এই বৃত্তের তুলনায় ফুলের বাগানের সকলেই বাইরের লোক। সেই কারণেই এখানকার কোনো গোপনীয়তার অংশীদার তাদের সে করতে চায় না। এ এমন এক বৃত্ত, যেখানে কেউ ওকে করুণা করে না, হাসির খোরাক বানাতে চায় না। এখানে ও অনেক বেশী স্বস্তি ও স্বচ্ছন্দ বোধ করে।

অনির্বেদ খুব যতন করে ওর দুই বন্ধুর গুণাবলীর বর্ণনা দিচ্ছিল। হৃদয়কে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছিল সে। বুঝিয়ে দিতে চাইছিল, তোমাদের বাইরেও আমার কিছু বন্ধু আছে। আর তাদের আমি তোমাদের চেয়ে মোটেই খাটো চোখে দেখি না। বরং অনেক উঁচু চোখেই দেখি। ওরা তোমাদের চেয়ে অনেক ব্যাপারেই এগিয়ে আছে। আর হৃদয় ছেলেদু-টোর চেহারার সঙ্গে অনির্বেদের বর্ণনা মিলিয়ে ভাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুতেই মিলছিল না। ছেলেদুটির বাইরের আচরণ অমার্জিত ও রুচিহীন। তাদের অন্তরে হয়ত অনেক সম্পদ আছে। হৃদয় জানে না। কিন্তু কিছুতেই আর মন বসাতে পারল না সে। ফুলের বাগানের বাইরে তার কোনো বন্ধু নেই, কোনো নিজস্ব বৃত্তও নেই। অথচ তার প্রায় সব বন্ধুরই সেটা আছে। সেইসব বৃত্তে সে একজন বাইরের লোক। ফুলের বাগানের ওপরে সে মানসিকভাবে অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। সে অনুভব করছে এটা তার পক্ষে ভালো হচ্ছে না।

আগ্নেয় যে রবিবারের আড্ডাগুলোয় প্রকাশ্যেই হৃদয়ের সমালোচনা করতে শুরু করেছিল, সেটা কেন জানি ভালো লাগত অনির্বেদের। এটা ঠিক, হৃদয় সবার জন্য ভাবে, তাদের ভালো চায়। সাধ্যমতো তাদের উপকার করার চেষ্টা করে। কিন্তু তার বিনিময়ে ও বড়ো বেশী দাম চায়। ওর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য দেখাতে হবে। সব কিছুতেই ওকে সমর্থন করতে হবে। ও কোনো ভুল করলেও সমালোচনা করা যাবে না। তখনই ওর ভুরু কুঁচকে যাবে। এগুলো মোটেই ঠিক নয়।

একদিন ও বলেই ফেলল বিশ্রুতকে, হৃদয়ের মধ্যে কোনো নমনীয়তা নেই, শুধুই শাসন।

বিশ্রুত হেসে বলল, আসলে শাসনটা তোদের পছন্দ নয়। তাই এত বেশী লাগে। ওর উদারতাটা তোরা হিসাবের মধ্যে ধরিস না। ওতে তোরা অভ্যস্ত হয়েই গেছিস। প্রাপ্য বলেই ধরে নিয়েছিস ওসব।

একটু ভুরু কুঁচকে যায় অনির্বেদের। তারপর বলে, আগ্নেয় যা বলে তার মধ্যে কিন্তু যুক্তি আছে...

বিশ্রুত বলে, তা তো আছেই। অবশ্য যুক্তিই শুধু আছে, কোনো উদারতা নেই। তা থাকলে বোধহয় কোন সম্পর্কটা দামী, দুর্লভ, আর কোনটা নিতান্ত মামুলি, হেলাফেলার যোগ্য তার তফাতটা বুঝতে পারত। যুক্তি দিয়ে মানুষের দোষত্রুটি বেশ ধরা যায়। তার মহত্ব আর উদারতাকে বুঝতে গেলে যে হৃদয়ের বিস্তৃতি প্রয়োজন। অবশ্য এখানেও আমার একটা প্রশ্ন আছে। অনির্বেদ এবার জিজ্ঞাসুচোখে বিশ্রুতর দিকে তাকায়। সে বলে, আমি জানি ভালোবাসার নামে হৃদয় মাঝে মাঝে অত্যাচার করে। সেটা কারো সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু যারা ওর সমালোচনা করছে, তারা নিছক সমালোচনার জন্যই ওর সমালোচনা করছে না তো? হয়তো ওর বিরোধিতা করে, ওর মনে আঘাত দিয়ে তারা আনন্দ পাচ্ছে। কিন্তু তাদের কাছে কোনো বিকল্প রয়েছে কি? শুধু ধ্বংসের মোহেই তারা ধ্বংস করছে না তো? তারা নিজেরা কি জানে আসলে তারা কী চায়? নতুন কিছু সৃষ্টির ভাবনা তাদের আছে তো, যা হবে আরও উন্নত, আরও সুন্দর, আরও উদার?

এই বিকল্পের খোঁজেই অতলান্তের সঙ্গে বন্ধুত্ব জমিয়ে ফেলল অনির্বেদ। অতলান্তেরও সেই সময়ে খুব দরকার ছিল অনির্বেদকে। ওরা একে অপরের খুব কাছের হয়ে উঠল। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলত। মনের ভাব বিনিময় করত। অনির্বেদের মতো অতলান্তের পরিবারেও আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। অভাব ছিল তার নিত্যসঙ্গী। এই ব্যাপারটাও ওদের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল।

সেই সময় ওদের ফুলের বাগানে সাংস্কৃতিক উৎসব হয়েছিল। বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল হৃদয়পুর দ্বীপের ফুল ব্যবসার সবচেয়ে বড়ো প্রাইভেট কম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টরের এক নম্বর প্রাইভেট সেক্রেটারিকে। এই লোকটির অসীম প্রভাব। রোগা, লম্বা, মুখভর্তি দাড়ি, মাথায় টাক। সাদা পাজামা, পাঞ্জাবি। আকাশছোঁইয়া জনপ্রিয়তা। মানবদরদী বলে খ্যাতি। দেখলেই সম্ভ্রম জাগে।

লোকটি তার ভাষণে বলেছিল, গোটা পৃথিবীতেই ফুল এখন অপরিহার্য পণ্য। ফুলের সৌন্দর্য আছে, সুগন্ধ আছে, তাই চাহিদাও আছে। গোটা বিশ্বে এমন মানুষের অভাব নেই যারা ফুলের কাঙাল। সেই কাঙাকদের কাঙালপনাকেই আমাদের কাজে লাগাতে হবে। যাদের অর্থ আছে, ক্ষমতা আছে, যশ আছে, তারা সবাই ফুলের প্রতি দুর্বল। ফুলের সৌন্দর্য আর সুগন্ধকে কাজে লাগিয়ে তারা নানাভাবে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে। বহু বহু অর্থব্যয়ে ফুলের সৌন্দর্যে আর সুগন্ধে তারা মানুষকে সম্মোহিত, মোহগ্রস্ত ও বিভ্রান্ত করে। আর তলে তলে অন্ধকারে অন্তরালে কত যে খেলা চলে তার কোনও শেষ নেই। এটাই আমাদের কাছে সুযোগ। সুবিধাবাদী না হলে সফল ব্যবসায়ী হওয়া যায় না। আমরা আমাদের সুবিধা দেখবই, তাতে মানবজাতি উচ্ছন্নে গেলে যাবে। ফুলের দুরকম ব্যবহারই আমরা জানি। সৌন্দর্যলোভী মানুষের কাছে ফুল পৌঁছে দিয়ে আমরা তাদের সৌন্দর্যের তৃষ্ণা মেটাই। আবার ফুলকে যারা স্রেফ আড়াল হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, আর সেই আড়ালের পিছনে বিস্তার করতে চায় অন্ধকারের রাজত্ব, তাদেরও অফুরন্ত চাহিদা আমরা মেটাই। হৃদয়পুর দ্বীপে গত এক বছর ধরে কোনো ফুল জন্মায় না। কিন্তু তাতে আমাদের কোম্পানির কোনো ক্ষতি হয়নি। আমরা নকল ফুলের কারবারি। আমরা এমনভাবে নকল ফুল বানাই, তার সুগন্ধ আর সৌন্দর্যে তাক লাগিয়ে দিই, কেউ ধরতে পারে না। অতি বিচক্ষণ চোখও ফেল মেরে যায়। খুব কঠিন বিচারকের বিচার কাজে আসে না। এ ব্যাপারে আমরা এক অলৌকিক দক্ষতা অর্জন করেছি। এই ফুলগুলোর গায়ে সুন্দর সুন্দর কথা লিখে আমরা বিক্রি করি। এতে ক্রেতারা আরও বিভ্রান্ত হয়। এইসব কথা লিখে দেওয়ার লোক খুঁজছে আমাদের কোম্পানি। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ আগ্রহী থাকো আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারো। একটা ছোট্ট পরীক্ষা দিতে হবে। যারা সফল হবে, তাদেরই নিয়ে নেবে কোম্পানি। মাইনে অবশ্য বেশি নয়, তবে চাকরি তো একটা।

পরে হৃদয়কে আলাদা করে ডেকেও কথাটা বলেছিল লোকটি। হৃদয় বলেছিল, আপনি সবার সামনেই না হয় আরেকবার বলুন।

লোকটি হেসে বলেছিল, আমি তো সবাইকে নিতে পারব না।

হৃদয় নাছোড়, কিন্তু সবারই সমান সুযোগ পাওয়া উচিত।

লোকটি এবার ঝেড়ে কেশেছিল। তারপর বলেছিল, তোমাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। তুমি একবার আসতে পারো কি?

হ্যাঁ নিশ্চয়ই যাবো, তবে একা নয়।

লোকটির ভুরু কুঁচকে গেছিল।

বিশ্রুত পরে একদিন দিশারীকে বলেছিল, তোর মনে আছে সেই প্রভাবশালী লোকটি চলে যাওয়ার পরে কী দক্ষযজ্ঞ কাণদই না বাধিয়ে দিয়েছিল হৃদয়!

দিশারী বলেছিল মনে থাকবে না! সবাইকে ডেকে ও বলল, এ আমাদের কাছে একটা দারূণ সুযোগ। আমরা সবাই পরীক্ষা দিতে যাবো। আমাদের সবারই চাকরির দরকার। আঃ এই জন্যেই তো হৃদয়কে এত পছন্দ করি।

(ক্রমশঃ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন