কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৪ মে, ২০২২

রামশরণ শর্মা

 

প্রাচীন ভারতে শূদ্রেরা


(অনুবাদ: চন্দন দত্ত)


(নিম্নতর বর্গের আনুমানিক ৬০০ খৃষ্টাব্দের পূর্বেকার এক সামাজিক ইতিহাস। ভারতের প্রথম সারির ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম, প্রয়াত শ্রদ্ধেয় রামশরণ শর্মা দ্বারা লিখিত ‘SUDRAS IN ANCIENT INDIA -- A Social history of the lower order down to circa AD 600’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ।)




অধ্যায় – ২ / ১ 

১৮৪৭ সালে, রথ (Roth) প্রস্তাবিত করেছিলেন যে, শূদ্রদের অবস্থান হয়ত আর্য সমাজের পরিসরের বাইরে ছিল। তখন থেকে সাধারণ ভাবে এটি ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, ব্রাহ্মণ্য সমাজের চতুর্থ বর্ণ গঠিত হয়েছিল প্রধানত অনার্য জনগোষ্ঠীকে নিয়ে, যাঁদের সেই দুরবস্থায় নামিয়ে এনেছিল (reduced) বিজেতা (conqueror) আর্যরা। এই অভিমত সমর্থন লাভ করতে থাকে বাবু-শ্রেণীর ইউরোপীয় এবং এশিয়া ও আফ্রিকার অশ্বেত অধিবাসীদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের সমরূপ অবস্থানকে কেন্দ্র করে।

এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বিজেতা আর্যরা বিবেচিত হয়েছিল উচ্চ জাতির (race) সমার্থক হিসেবে এবং অনার্যরা দাস বা দস্যু'র জাতির (race) সমগোত্রীয় হিসেবে। কিন্ত এইচ ডব্লিউ বেইলি (H. W. Bailey) দেখিয়েছেন যে, ঋগবেদে ব্যবহৃত ও উল্লেখিত 'আর্য (arya) শব্দটি থেকে জাতিগত প্রভাবের বিষয়টি নির্বিচারে টেনে আনা যায় না। শব্দটি টেনে আনা হয়ে থাকতে পারে এর গোড়ায় (base-এ) স্থিত 'আর' (ar) থেকে, যার অর্থ -- প্রাপ্ত করতে (to get)। ইরানীয় উল্লেখসমূহ (references) অনুযায়ী 'আর্য শব্দের অর্থ অধিষ্ঠাতা বা আর্যা  (possessor or noble), এবং এর সম্প্রসারণে (extension) 'আর্য শব্দটির  ভিন্ন কোনো অর্থের উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যে নেই, বৈদিক-সংস্কৃতি পরবর্তী সভ্য বৌদ্ধ এবং জৈন যুগের সাহিত্যে আর্যা বা মহদ্বংশীয় শব্দের ব্যবহারের কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া যাক। আর্য-রা হচ্ছেন কবিদের সমার্থক এবং এটি অবশ্যই একটি স্তুতিবাচক বিশেষণ। এইসব কিছু থেকে এটা অনুমিত হতে পারে যে,  ঋগবেদ অনুগামীরা বা ঈশ্বরেরা, যারা 'আর্য' হিসেবে স্তবগানের মাধ্যমে বন্দিত হতো, তারা হয় সম্পত্তির অধিকারী ছিল বা উচ্চবংশজাত (Noble) ছিল অথবা দুই-ই ছিল। যদিও তাদের ধনসম্পদ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলা হয়নি। মূলত একটি মেষপালক সমাজে, বিদ্যমান সম্পত্তির পরিমাণ কোনো মাপদন্ডেই বিশ্লেষণ করা যায় না। সেইজন্য সেই ঋগবেদীয় সমাজ সংঘবদ্ধ হয়েছিল, না শ্রমের সামাজিক বিভাজনের ভিত্তিতে, না সম্পত্তির বিভিন্নতার ভিত্তিতে। ঋগবেদীয় সমাজ প্রধানত সংঘবদ্ধ হয়েছিল জ্ঞাতিত্ব, কুল ও বংশের ভিত্তিতে। বিভিন্ন ধরনের জ্ঞাতি-ভিত্তিক পরিবারের পদবিগুলি (terms) ঋগবেদে বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে। এইভাবে 'জন' (jana) উল্লেখিত হয়েছে ২৭৫ বার এবং 'ভিস' (vis) ১৭০ বার। একইভাবে, গণ (gana) এবং ব্রত (vrata) উল্লেখিত হয়েছে অনেকবার। এই পরিবারগুলি সম্ভবত মোটামুটি বৃহৎ আকারের ছিল, কারণ 'কুল' (kula), যেটি প্রথমে পরিবার এবং পরে উচ্চ বংশজাত পরিবারের সমার্থক ছিল, সেটি ঋগবেদে উল্লেখিত হয়েছে কেবল একবার মাত্র এবং তাও কুলাপা'র (kulapa) অংশ হিসেবে। এতদসত্ত্বেও যদি ঘ্রাহা (grha) শব্দটিকে পরিবারের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণ করা হয়ে থাকে, ঋগবেদে সেটির উল্লেখ হয়েছে অনেকবার, যদিও সেটি ঘটেছে একশ'র চেয়ে কম সংখ্যক বার এবং সুতরাং সেটি 'জন' এবং 'ভিস'-এর তুলনায় কম পৌনঃপুনিক (frequent) ভাবে উল্লেখিত হয়েছে। ঋগবেদে উল্লেখিত 'আর্য' (Aryan) জাতিটি একই বংশগত উৎসের অধীন নাও হয়ে থাকতে পারে, কিন্ত তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল একটি সাধারণ ভাষা এবং একটি সাধারণ জীবনপ্রণালীর দ্বারা। সেইজন্য আর্য শব্দটির ব্যবহার বুঝতে হবে সেই অর্থেই।

যদিও এটি একটি বিতর্কিত বিষয় যে, দাস এবং দস্যুরা জাতিগত বিচারে অনার্য ছিল না, আমাদের মতে সেটি অনেক বেশি সত্য ছিল দাসেদের ক্ষেত্রে। যেমন পরবর্তীতে দেখানো হবে যে, দস্যুরা সম্ভবত একটি ভিন্ন ভাষা ব্যবহারকারীদের  প্রতিনিধিত্ব করতো এবং তাদের জীবনপ্রণালীও ছিল আলাদা, যেটা মনে হয়  দাসেদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। অধিকন্তু দাসেরা 'ভিস' (vis) নামক উপজাতির মধ্যে সংগঠিত ছিল, যে শব্দটি বৈদিক জনসাধারণ বা উপজাতিদের দ্বারা ব্যবহৃত হতো। সেই দৃষ্টিতে বিচার করলে, আর্য ও দাসেদের পারস্পরিক সঙ্ঘাত বা বিরোধকে মনে হবে মোটামুটি তেমনই, যেমন পারস্পরিক সঙ্ঘাত বা বিরোধ নিয়ে বৈদিক উপজাতিরা জীবন অতিবাহিত করছে। ঋগবেদের অসংখ্য স্তবগান, যেগুলির পুনরাবৃত্তি দেখা গিয়েছে অথর্ববেদে, সেগুলিতে আর্য-দেবতা ঈন্দ্র, দাসেদের বিজেতা হিসেবে প্রতীত হয়েছেন, যিনি প্রধানত মানুষ ছিলেন বলেই মনে হয়ে। কথিত আছে যে ঈন্দ্র, অধম দাসেদের গুহায় চালান করেছিলেন। বিশ্বের নিয়ন্ত্রক হিসেবে তিনি দাসেদের পরাভূত করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন এবং তাদের ধ্বংসসাধনের জন্য নিজে প্রবৃত্ত হওয়ার কথা বলেছিলেন। ঋগবেদের প্রার্থনায় পৌনঃপুনিক স্তবগুলির বিষয়বস্ত ছিল ঈন্দ্রের কাছে দাস উপজাতিকে উৎপাটিত করার অনুরোধ সংক্রান্ত। ঈন্দ্র নিজেও প্রতীয়মান হয়েছেন, দাসেদের সমস্ত রকমের উৎকৃষ্ট গুণাবলী থেকে বঞ্চিত করার এবং তাদের বশে আনার ভূমিকায়।

দাসেদের চেয়েও অনেক বেশি উল্লেখ রয়েছে ঈন্দ্র দ্বারা দস্যুদের উৎপাটিত করার এবং বশে আনার বিষয়টির। বলা হয়েছে যে, দস্যুদের হনন করে ঈন্দ্র, আর্য বর্ণকে রক্ষা করেছেন। দস্যুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার উদ্দেশ্যে আর্যদের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, দস্যুদের সংহারের উদ্দেশ্যে অন্তত বারোটি স্তোত্রের উল্লেখ রয়েছে, বেশিরভাগই ঈন্দ্রের দ্বারা। অপরপক্ষে, যদিও ব্যক্তি দাসেদের হত্যা করার কথা উল্লেখিত হয়েছে, তবুও 'দাসহত্যা' কথাটির উল্লেখ কোথাও নেই। এটি ঈঙ্গিত করে যে, দাস এবং দস্যু শব্দদুটি সমার্থক নয় এবং সূচিত করে যে, আর্যরা দস্যুদের নির্দয়ভাবে সংহার করার নীতি অনুসরণ করেছিল, কিন্ত দাসেদের ক্ষেত্রে তারা সংযমী মনোভাব নিয়েছিল।

আর্য ও তাদের প্রতিপক্ষের মধ্যেকার যুদ্ধ, প্রধানত  প্রতিপক্ষের দূর্গ ও প্রাচীর বেষ্টিত পরিসরসমূহের ধ্বংস সাধনের রূপ নিয়েছিল। দাস এবং দস্যু উভয়েরই দখলে ছিল অসংখ্য সুরক্ষিত দূর্গ সদৃশ পরিসরসমূহ, যেগুলির সাথে সাধারণভাবে সংযুক্ত ছিল আর্যদের অন্যান্য শত্রুরাও। এটি স্বাভাবিকভাবেই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বিলম্বে আবিষ্কৃত হরপ্পা সভ্যতার আত্মরক্ষার্থে নির্মিত দূর্গ সদৃশ পরিসরসমূহের কথা, যদিও আর্যদের ও হরপ্পাবাসীদের মধ্যে সঙ্ঘটিত বৃহদাকার সংঘর্ষের কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ আমরা এযাবত পাইনি। এটি থেকে প্রতিভাত হয় যে, যাযাবর বৃত্তি সম্পন্ন আর্যরা ঈপ্সিত হয়েছিল জনবসতিগুলিতে তাদের শত্রুদের দ্বারা সঞ্চিত ধনসম্পদে, যেগুলি দখল করার জন্য তাদের মধ্যে নিয়মিত চলমান যুদ্ধের অবতারণা হয়েছিল। উপাসকদের মনোভাব ছিল এইরূপ যে, যারা নৈবেদ্য উৎসর্গীকৃত করে না, তাদের হত্যা করা উচিত এবং তাদের ধনসম্পদ জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করা উচিত। দস্যুরা বর্ণিত হয়েছে ধনশালী কিন্ত আত্মত্যাগে অনীহা সম্পন্ন শত্রু হিসেবে। দুজন দাস সর্দারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের বলা হয়েছে ধনাকাঙ্ক্ষী। অভিলাষ ব্যক্ত  করা হয়েছিল যে, ঈন্দ্র দ্বারা সেই সমস্ত দাসেদের দমিত করা হোক এবং তাদের সংগৃহীত ধনসম্পদ জনসাধারণের মধ্যে বন্টন করা হোক। দস্যুরা মণিরত্ন ও সোনা ইত্যাদি অধিকৃত করে রেখেছিল, যা সম্ভবত আর্যদের লালসাকে উত্তেজিত করেছিল। কিন্ত পশুপালক সংস্কৃতির ধারক-বাহক আর্যদের কাছে প্রাথমিকভাবে শত্রুদের পশু-সম্পদের প্রতিই ছিল সর্বাধিক প্রলোভন। তাই যুক্তি দেওয়া হল যে, কাইকাটা-রা (Kikatas), যারা সম্ভবত হরিয়ানার বাসিন্দা ছিল, তারা যেহেতু নৈবেদ্য স্বরূপ দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি নিবেদন করে না, সুতরাং তারা গবাদি পশু পালনের যোগ্য নয়। অপরদিকে, তাদের শত্রুরা কিন্ত স্বভাবসিদ্ধ্ব ভাবেই আর্যদের ঘোড়া এবং রথ-কে যথাযোগ্য গুরুত্ব অর্পণ করতো। একজন ঋগবেদীয় কিংবদন্তীর বয়ান অনুযায়ী, দস্যুরা দধিচি নামক রাজকীয় ঋষিদের একটি নগর দখল করেছিল, কিন্ত পশ্চাদপসরণের সময় ঈন্দ্র তাদের অবরোধ ক'রে পরাজিত করেন এবং গবাদিপশু, ঘোড়া ও রথগুলিকে পুনরুদ্ধার ক'রে রাজাকে প্রত্যার্পণ করেন।

দস্যুদের জীবনপ্রণালী আর্যদের অত্যধিক বৈরি মনোভাবাপন্ন করে তুলেছিল। আপাতদৃষ্টিতে, পশুপালনের ওপর ভিত্তি করা আর্যদের উপজাতীয় অর্ধ-স্থায়ী (semi-settled) জীবনপ্রণালী, সুস্থির ও শহুরে সংস্কৃতির দেশীয় মানুষদের জীবনপ্রণালীর সাথে বেমানান ছিল। পূর্বেকার প্রধানত সেকেলে উপজাতি জীবনের অধিকারীরা নিজেদের অভিব্যক্ত করেছিল নানান সাম্প্রদায়িক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যেমন গণ-সভা, সমিতি এবং বিদাথা প্রভৃতিতে, যেগুলির মধ্যে ত্যাগের (sacrifice) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্ত দস্যুদের ত্যাগ-এর সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না। এটি সত্য ছিল দাসেদের ক্ষেত্রেও, কারণ ঈন্দ্রের আগমন হয়েছে ত্যাগের আদর্শ নিয়ে এবং সেটিই স্বতন্ত্র করেছিল দাস ও আর্যদের। ঋগবেদের সপ্তম খন্ডে একটি সম্পূর্ণ রচনাংশ (passage), 'আক্রাতুন'(akratun), 'অশ্রদ্ধা' (asraddhaa) এবং 'আয়োজন' (ayojan) প্রভৃতি একগুচ্ছ বিশেষণে পরিপূর্ণ হয়ে আছে, যেগুলি দস্যুদের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের ত্যাগ-হীন চরিত্রকে লক্ষ্যনীয় করে তুলতে। ঈন্দ্রের কাছে মিনতি করা হয়েছে, ত্যাগ পরায়ণ আর্য ও ত্যাগ-হীন দস্যুদের মধ্যে পার্থক্যকে তুলে ধরতে। তাদের 'আয়োজভানাহ'-ও (ayajvanah) বলা হয়েছে। অনীন্দ্র (anindra) (ঈন্দ্র-বিহীন) শব্দটিও অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে এবং সেটি সম্ভবত দস্যু, দাস ও আর্যদের অননুগামী কিছু ব্যক্তিদের নির্দেশিত করে। আর্যদের দৃষ্টিতে, দস্যুরা কালা-জাদুর (black magic) অভ্যাস করতো। এই ধরনের একটি বিশ্বাস, বিশেষ করে পরিলক্ষিত হয়েছিল অথর্ববেদ-এ, যার মধ্যে দস্যুরা  প্রতীয়মান হয়েছিল পিশাচ হিসেবে, যারা ত্যাগে ভীত হয়ে দূরে সরে থাকে। কথিত আছে যে, একটি সর্বশক্তিমান রক্ষাকবচ ঋষি অঙ্গিরা-কে দস্যুদের নগর দূর্গে বলপূর্বক প্রবেশ করতে সমর্থ করে তুলেছিল। অথর্ব বেদে প্রদত্ত দস্যুদের পৈশাচিক চরিত্র, মনে হয় ঋগবেদীয় পর্যায়ে তাদের যুদ্ধের নথির ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। অথর্ব বেদ অনুসারে, দেবতা-নিন্দুক দস্যুদের অর্পণ করতে হবে জীবন্ত-বলি হিসেবে। বিশ্বাস করা হয় যে, দস্যুরা বিশ্বাসঘাতক, তারা আর্যদের ধর্মানুষ্ঠানের অনুশীলন করতো না এবং কষ্টসহকারেও তারা মনুষ্যোচিত ছিল না।

আর্য ব্রত (vrata), যার সাধারণ অর্থ আইন বা আইনী বিধান (ordinance), তার থেকে দস্যুরা কীভাবে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছিল, সেটি আর্য এবং দস্যুদের জীবনপ্রণালীর মধ্যেকার পার্থক্যকে নির্দেশিত করার মধ্য দিয়ে পুনরায় প্রকাশ্যে এসেছে। এই বক্তব্যটি এবং 'ব্রত', যেটি উপজাতীয় সৈন্য বা গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত, এদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক স্থাপন করা যদি সম্ভবপর হয়, তবে প্রস্তাবিত করা যেতে পারে যে, ব্রত শব্দটির অর্থ খুব সম্ভবত উপজাতীয় আইন  অথবা তার ব্যবহার। দস্যুরা সাধারণভাবে বর্ণিত হয়েছে 'অভ্রত' ও 'অন্যব্রত' হিসেবে। 'অপব্রত' শব্দটি দু'জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে এবং সম্ভবত সেটি প্রযুক্ত হয়েছে দস্যু এবং আর্যদের মধ্যেকার ভিন্নমত পোষণকারীদের ক্ষেত্রে। এটি লক্ষ্যণীয় যে, এই ধরনের বিশেষণগুলি দাসেদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়নি, যা  পুনরায় নির্দেশিত করে যে, তারা দস্যুদের তুলনায় আর্যদের জীবনপ্রণালীর প্রতি বেশি নমনীয় ছিল।

এটি মনে করার কারণ আছে যে, আর্য ও তাদের শত্রুদের মধ্যে বর্ণগত পার্থক্য ছিল। এটি প্রতীয়মান হয় যে আর্যরা, যাদের মনুষ্যোচিত (manusi praja) বলা হয়েছে, এবং যারা 'অগ্নি বৈশ্বনর'-এর পূজা করতো, তারা আবশ্যকতা অনুসারে কৃষ্ণ বর্ণ-বিশিষ্ট মানুষদের (asiknivisah) বসতি সমূহে অগ্নি সংযোগ ঘটিয়েছিল, যারা কোনো প্রতিরোধ ব্যতিরেকেই নিজেদের অধিকৃত দ্রব্য-সামগ্রী পরিত্যাগ করে পলায়ন করেছিল। আর্যদের দেবতা 'সোমা' (Soma), কালো চামড়ার মানুষদের, যারা আপাতদৃষ্টিতে দস্যু ছিল, তাদের হত্যাকারী হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন। অধিকন্তু ঈন্দ্রকে, কালো চামড়ার রাক্ষসদের সাথে যুঝতে  হয়েছিল এবং একটি ক্ষেত্রে তিনি পঞ্চাশ হাজার কালো মানুষকে হত্যা করে প্রশংসিত হয়েছেন, যাদের সায়ানা (Sayana), কৃষ্ণ বর্ণের রাক্ষস মনে করা হতো। ঈশ্বর নিজেও কালো চামড়ার অসুরদের  বিচ্ছিন্নকরণ-কারী হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন। ঈন্দ্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যার কিছু ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে, সেটি নির্দেশিত করে কৃষ্ণ নামে খ্যাত এক আদর্শ বীরের সাথে যুদ্ধের প্রতি। কথিত আছে যে, কৃষ্ণ যখন অংশুমতি বা যমুনা নদীর তীরে দশ হাজার সৈন্য নিয়ে শিবির স্থাপন করেছিলেন, ঈন্দ্র তখন মারুতদের (Aryan vis) নিয়ে সৈন্য সমাবেশ করেছিলেন এবং যাজক-দেবতা বৃহস্পতি'র সাহায্যে অদেভিহ ভিসাহ'র (adevih visah) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। সায়ানা (Sayana) অদেভিহ ভিসাহ'র ব্যাখ্যা করেছেন কৃষ্ণবর্ণের অসুরসেনা রূপে (Krisnarupa asurasena)।  বলা হয়েছে যে কৃষ্ণ ছিলেন যাদব উপজাতির অনার্য কালো বর্ণের বীর (Dark hero)। এটি বিশ্বাস্য বলেই মনে হয়, কারণ পরবর্তী প্রজন্মগুলিও ঈন্দ্র ও কৃষ্ণের মধ্যেকার শত্রুতার কথা বিবৃত করেছে। কৃষ্ণগর্ভ'র (krsnagarbha) হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত বিষয়টিও উল্লেখিত হয়েছে, সন্দেহজনক ভাবে, সায়ানা (Sayana) যাদের উদ্ধৃত করেছেন, --- কৃষ্ণ নামক অসুরের গর্ভবতী স্ত্রীলোক বলে। একই  ভাবে ঈন্দ্র দ্বারা কৃষ্ণায়নী দাসীদের (krsnayanih dasih) পতন ঘটানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, কল্পনাপ্রসূত ভাবে সায়ানা যাদের বলেছেন -- নিকৃষ্ট রাক্ষসী সদৃশ বাহিনী (nikrstajatih ...asuri senah), কিন্ত উইলসন, কৃষ্ণকে গ্রহণ করেছেন কালো বর্ণের অনুভূতি হিসেবে। শেষোক্ত অর্থটি যদি সঠিক হয়, তবে এটি অধিষ্ঠিত হয় যে দাসেরা বর্ণগতভাবে কালো ছিল। কিন্ত তাদের ক্ষেত্রে 'কালো' শব্দটির বর্ণন হয়ত করা হয়েছে নির্বিচারে, যেভাবে সেটি করা হয়েছে দস্যু ও আর্যদের অন্যান্য শত্রুদের ক্ষেত্রে। যাইহোক, উপরোক্ত সম্পর্কস্থাপন সমূহ নিঃসন্দেহে ন্যূনতম সন্দেহের অবকাশ রাখে যে, ঈন্দ্রের আর্য অনুগামীদের,  অগ্নি এবং সোমা-কে, ভারতের কালো লোকেদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল। একটি বিবরণে, ঋগবেদীয় বীর ত্রসাদস্যু (Trasadasyu), পুরুকুৎসা'র (Purukutsa) পুত্র, বর্ণিত হয়েছেন 'কৃষ্ণ বর্ণীয় মানুষদের' নেতা হিসেবে। এটি হয়ত ইঙ্গিত করে যে, তিনি তাদের ওপর  নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

যদি দস্যুদের ক্ষেত্রে অনাসা (anasa) শব্দটি নাসিকাহীন অর্থে অথবা চ্যাপ্টা নাক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং দাসেদের ক্ষেত্রে 'উরসাশিপ্রা (ursasipra) শব্দটি ষাঁড়ের অধরোষ্ঠবিশিষ্ট অথবা সম্মুখে প্রসারিত বৃহৎ অধরোষ্ঠবিশিষ্ট অর্থে  প্রযুক্ত হয়ে থাকে, তাবে এটি প্রতীয়মান হবে যে, আর্যদের শত্রুদের শারীরিক গঠন ছিল ভিন্ন প্রকৃতির।

'ম্রাহরাবাক' (mrahravak) শব্দটি, যেটি ঋগবেদের নানান জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন রূপে উপস্থাপিত হয়েছে, সেটি আর্য ও তাদের শত্রুদের বাচনপদ্ধতির পার্থক্য সম্পর্কিত কিছু ধারণা প্রদান করে। এটি দুরকমভাবে দস্যুদের বৈশিষ্ট্যযুক্ত করেছে। সায়ানা, এটিকে বর্ণিত করেছেন 'প্রতিকূল বাচনপদ্ধতি' হিসেবে, এবং গেল্ডনার (Geldner) এটিকে উপস্থাপিত করেছেন 'ভুল বাচনপদ্ধতি' হিসেবে। ম্রাহরাবাক শব্দটিকে যদি ‘দুর্বোধ্য ভাষণপদ্ধতি অর্থে গ্রহণ করা না হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে এটি আর্য ও দস্যুদের মধ্যেকার ভাষাবিদ্যাগত কোনো পার্থক্যকে  নির্দেশিত করে না, বরং কেবলমাত্র দর্শায় যে, দস্যুরা তাদের অপ্রকৃত ভাষণপদ্ধতি দ্বারা আর্যদের অনুভূতিতে আঘাত করেছিল। এইভাবে, যদিও আর্য ও তাদের শত্রুদের মধ্যেকার যুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল গবাদিপশু, রথ সমূহ এবং অন্যান্য সম্পত্তির ওপর দখল কায়েম করা, তথাপি জাতি, ধর্ম ও বাচনপদ্ধতির পার্থক্য প্রভৃতিও সম্পর্ক তিক্ত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছিল।

(ক্রমশ)

  


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন