কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ১৪ মে, ২০২২

মধুবাণী ঘোষ

 

ভালোবাসার কথা বলতে এলাম : প্রাণের মানুষ ৭




মানকাটো বলে এই দেশে যে একটা শহর আছে তা আমি এই সফরের আগে জানতাম না। সেই যখন পাগলা দাশুর মত  চেহারা করে ম্যাপ আর টুরবুক ঘাঁটছিলাম, তখন দেখছিলাম যে শিকাগো থেকে ঘন্টা ছয় সাত পশ্চিমে, ইন্টারস্টেট ৯০র ওপরে কোন কোন শহর রয়েছে। সেই খোঁজ করতে গিয়ে দেখলাম যে ৪৩১ মাইল পশ্চিমে রয়েছে ছোট্ট শহর মানকাটো যেখানে কম খরচে হোটেল পাওয়া যাচ্ছে। তবে  সেখানে যেতে গেলে একটু ঘন্টাখানেকের জন্য U.S. ১৪ হাইওয়ে নিতে হবে। ১৯২৬ সনে তৈরী এই বহু পুরনো পথকে আগেকার দিনে বলা হতো  'Black and Yellow Trail' কারণ এটি মিনেসোটার ব্ল্যাক হিলস আর ইয়েলোস্টোন ন্যাশানাল পার্ককে যুক্ত করেছিল। নাম শুনেই মনে হয়েছিল... এ পথেই  যেতে হবে...

"How can I get there?" asked Dorothy.

"You must walk. It is a long journey, through a country that is sometimes pleasant and

sometimes dark and terrible. However, I will use all the magic arts I know of to keep you from

harm."

"Won't you go with me?" pleaded the girl, who had begun to look upon the little old woman as

her only friend.

"No, I cannot do that," she replied; "but I will give you my kiss, and no one will dare injure a

person who has been kissed by the Witch of the North."

She came close to Dorothy and kissed her gently on the forehead. Where her lips touched the

girl they left a round, shining mark, as Dorothy found out soon after.

"The road to the City of Emeralds is paved with yellow brick," said the Witch; "so you cannot

miss it. When you get to Oz do not be afraid of him, but tell your story and ask him to help you.

Good–bye, my dear."

শিকাগো শহর ছাড়িয়ে এসেছি বেশ কিছুক্ষণ হলো। গান শোনাচ্ছে বাজ বাহাদুর।  তার সঙ্গে ধীরে ধীরে আড়ষ্টতা ভাঙছে। আমার প্রিয় গানাগুলি বাজছে ইন্টারস্টেট ৯০ জুড়ে। পাশের সিটে একটা জিপলক ব্যাগে রয়েছে বাদাম, কিশমিশ, শুকনো ক্র্যানবেরি আর কাপ হোল্ডারে দু বোতল খাবার জল। মাঝে মাঝে দু ঢোঁক জল  আর কয়েকটি শুকনো ফল বাদাম। চারটি করে লেনে বিভক্ত আমার পথ। ঘণ্টাপ্রতি ৭০ মাইল স্পিড লিমিটের চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে ধাবমান গাড়িগুলি চলেছে একেবারে বাঁ দিকের লেনে। খেয়াল করলাম যে আমি মোটামুটি ঘণ্টাপ্রতি ৮০ মাইলে চালাচ্ছি। এটাই আমার হাইওয়েতে স্বাভাবিক চলন। কেবল যেখানে যেখানে ঘাপটি মারা ট্রাফিক পুলিশের আন্দাজ পাচ্ছি সেখানে সেখানে ভব্যিযুক্ত  সত্তুরে।  দুপাশে কেবল সবুজ ফসলের ক্ষেতের পূর্ণতা, মাথার ওপরে নীল আকাশের ঔদার্য এবং পায়ের তলায় তুফানী গতি। পাশের কাচ একটু নামলেই শনশন করে বইছে পাগল হাওয়া... বাজ বাহাদুর গাইছে…

'পাগল হাওয়া

কি আমার মতন তুমিও হারিয়ে গেলে

ফুলেরও বনে হাজারও রঙের মেলায়

সুরভি লুটের খেলায়

তারে নাহি পেলে

পাগল হাওয়া…’

পেরিয়ে যাচ্ছি কত না শহর আর ছোট ছোট অচেনা গ্রামগঞ্জ। পেরিয়ে যাচ্ছি বেলভিদের, রকফোর্ড, বেলইট, জেন্সভিল। পথের প্রান্তে খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেস্ট এরিয়াতে  নেমে, হাত পা মেলে, মুখ চোখ ধুয়ে, একটু হাঁটাহাঁটি করে আবার চলেছি পশ্চিমপানে। এর মধ্যে রাজ্যবদল হয়েছে। আমি একটা হালকা স্যান্ডুইচ খেয়েছি। ইলিনয় ছাড়িয়ে বাজ বাহাদুর চলেছে উইসকনসিনের পথ ধরে। ব্ল্যাক রিভার আর মিসিসিপি নদীর সংযোগস্থলে লা ক্রসের পাশ ঘেঁষে পেরিয়ে গেছি লেক ওনালাস্কা। ড্রেসবাক ব্রিজ ধরে পেরিয়ে গেছি সুন্দরী  মিসিসিপি নদী। আবার রাজ্যবদল করে মিনেসোটা। রোদ্দুরের আলোয় কাশ্মীরের ময়ূরকন্ঠী নীলার মতো উজ্জ্বল মিসিসিপির পাশ দিয়ে চলেছে ইন্টারস্টেট ৯০ আর আমি গাড়ির স্পিড কমিয়ে একেবারে ডানদিকের লেনে গিয়ে তাকে মুগ্ধ হয়ে দেখছি। মনে হচ্ছিল আমার চেনা পরিসর থেকে যেন বহুদূরে চলে এসেছি... আমার চেনা মধুবাণীর কাছ থেকে আমি বহুদূরে চলে এসেছি... এই জন্মে আমার যেন আর ফেরা হবে না...

'মনে মনে বহুদূর চলে গেছি

মনে মনে বহুদূর চলে গেছি –

যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়

জন্মেই হাঁটতে হয়

হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে

একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি

পথ তো একটা নয় –

তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা

নদীর দু-প্রান্তের মূল

একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূন্য

দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপড়েন –

দুটো জন্মই লাগে

মনে মনে দুটো জন্মই লাগে।'

ম্যারিয়ন পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে আসছিলো প্রায়। ইন্টারস্টেট ৯০ থেকে এবার উত্তর -পশ্চিম দিকে U.S. 52 হাইওয়ে ধরে খানিক গিয়ে, রচেস্টারে আর একটা পশ্চিমী  মোচড় দিলেই U.S. ১৪ হাইওয়ে। সেই ব্ল্যাক এন্ড ইয়েলো ট্রেল। সেটি ধরে ঘন্টা দেড়েক গেলেই আমার আজকের গন্তব্য মানকাটো, যার নাম কিনা কেউ কোনোদিন শোনেনি।

শহরটির  ভেতরে কয়েকটি ছোটোখাটো মোটেল, কিছু দোকান পসার, গাড়ির শোরুম ইত্যাদি চোখে পড়ল। তবে দীর্ঘ অতিমারীর প্রকোপে শহরটিকে যেন কেউ ঘুমের কাঠি  ছুঁইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। বাজ বাহাদুর আমাকে আমার সস্তা গন্ডার ছোট মোটেলটিতে পৌঁছে দিল। ছোট কার পার্কে গাড়ি রেখে, মালপত্র নিয়ে মোটেলের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। সকাল থেকে গাড়ি চালিয়ে বেশ শ্রান্ত হয়ে পড়েছি। খিদেও পেয়েছে খুব। মুখ চোখ রোদ্দুরে তেতে রয়েছে। দেখি মোটেলে কেউ  কোত্থাও নেই। কাউন্টারে একটা বেল আর একটা কার্ডে লেখা আছে: Ring bell for service.

বেল বাজালাম। চারিদিক চুপচাপ। আমি এদিক সেদিক চাইছি আর ভাবছি এবার যদি কেউ না আসে তাহলে কি করব! খানিক পরে নেপথ্য করিডোরে ভারী পায়ের আওয়াজ শুনলাম। কেউ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। এক ভদ্রলোক কাউন্টারের পেছনে এসে বেশ নিরাসক্ত মুখে আমাকে শুধোলেন

'Yes?'

' Er..I have a reservation for tonight. Here is my booking reference.'

উনি কাগজপত্র মিলিয়ে নিয়ে, টাকাকড়ি বুঝে নিয়ে বললেন

' Here's your room key.. Your room is on the second floor. We serve breakfast at 7 AM.'

' Is there a place nearby where I can grab some dinner?'

'Several food joints have shut down due to the pandemic. A good place nearby is Buffalo Wild Wings.'

'What? '

'Buffalo Wild Wings.'

'Eh…thank you. I will be leaving tomorrow morning. Are there places I could visit here?'

'There’s not much to see in Mankato. It is not a very touristy place.'

'Oh… ok… thank you.'

ভদ্রলোক অল্প কথার মানুষ। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে ঘরে গিয়ে, জিনিসপত্র রেখে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। দিব্যি ছিমছাম ঘর। একরাত  কাটাবার জন্য যথেষ্ট ভাল। এরপর মিনিট পাঁচেকের দূরত্বে Buffalo Wild Wingsএ গিয়ে  ডিনার। হাসিখুশি এক  কিশোরী এসে শুধোল 'Hi, I am Jenny. I will be your server today. What can I get for you?'

'I would like a Coke with one cube of ice and a plate of chicken wings and fries please.'

'Will that be all?'

'Yes, thank you.'

জেনি মিষ্টি হেসে খাবার আনতে গেল। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে চারিদিকে দেখছিলাম। বার কাউন্টরে  অনেকে বসে আড্ডা দিচ্ছে , বিয়ার খাচ্ছে আর বিশাল টিভি স্ক্রীনে খেলা দেখছে। বার কাউন্টর ছাড়া আমার মতো টেবিলে বসেছে ছোট, বড়, মাঝারি পারিবারিক বা বন্ধু বান্ধবের দল। আমার মত আর একটিও বাদামি বা একাকী মানুষ নেই। আর আমি হলফ করে বলতে পারি, এই রেস্তোরাঁয় কেউ আজ সকালে উঠে, গাড়ি চালিয়ে, শিকাগো থেকে আসেনি।

খিদের পেটে বাফেলো ওয়াইল্ড উইংস-এর চিকেন উইংস অমৃতের মতো  ঠেকল। দাম মিটিয়ে যখন বাইরে এলাম তখন প্রায় রাত সাড়ে আটটা বাজে। পশ্চিমের আকাশে আশ্চর্য এক কমলা রঙের সূর্য আচমকা ডুব দেবার পরিকল্পনা করছে। আমি  তার দিকে চাইতে চাইতে ধীরে ধীরে মোটেলে ফিরলাম। মোটেলের পাশটিতে একটা খালি জমি। জমিতে ঘাসগুলি সূর্যের আলো আর বর্ষার জল পেয়ে সতেজ। সেখানে তিনটে বাদামি খরগোশ খেলা করছে। জমি পেরিয়ে বড় রাস্তা, সেখান দিয়ে হেড লাইট জ্বালিয়ে দ্রুত ঘরে ফিরছে কয়েকটি গাড়ি... বড় রাস্তা পেরিয়ে গাছের সারি যেখানে রাতের মতো আশ্রয় নিয়েছে পাখির দল ...গাছের সারি পেরিয়ে ধূসর কমলা আকাশ নববধূর মত  সলাজ। আমি চোখ ভরে মন ভরে ছবিটা হৃদয়ে এঁকে নিলাম। যে শহরে কেউ বড় একটা আসে না, যে শহরের নাম কেউ বড় একটা শোনেনি, যে শহরে তেমন দেখবার মত  কিছুই নেই, সেই শহর, দিনের শেষে,  আমাকে এমন একটা  আশ্চর্য ছবি উপহার দিল।

(ক্রমশ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন