কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৪ মে, ২০২২

শিবাংশু দে

 

তকাই, তাতাবাবু ও ‘অনর্থে’র ভুবন - ১  



  

কতটা লেখা লিখলে তবে, লেখক বলা যায়

কতটা কথা বললে তবে, কথক হবে মানা...?

(১)

অনেক লিখে 'কালজয়ী' লেখক হবার প্রয়াস অবিরাম দেখা যায়। কখনও পেশা, কখনও নেশা, কখনও শুদ্ধ ভালোবাসা। লেখালিখি করার নানা কারণ থাকে। একজন অকালপ্রয়াত কবি, যাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিলো তাঁর মৃত্যুর পরে। হয়তো আরো কিছু লেখা আছে তাঁর। সেগুলোও পরবর্তীকালে কিংবদন্তি। কিন্তু যদি প্রথম কাব্যসংকলনটি ব্যতিরেকে তিনি আর অন্য কিছুই না লিখতেন, তবু এই বিপুল বাংলা সাহিত্যের পরিসরে একটা গুরুত্বপূর্ণ বড়ো জমিদারি তাঁর অধিকারে থাকতে পারতো। তিনি সেকালে তাঁর শৈলীর সঙ্গে অপরিচিত, অনভ্যস্ত বাংলা পাঠকদের  উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,

 "...বলবো যা মোর চিত্তে লাগে,

নাই বুঝি তার অর্থ হোক

নাই বা বুঝুক বেবাক লোক..."

(২)

'অর্থ' শব্দটার নানা অর্থ হয়। এমন কি 'অনর্থ' শব্দটিরও নানা পরিভাষা, বহু ব্যঞ্জনা। কোথাও লেখে এই শব্দের মানে, অমঙ্গল, অশুভ, অনিষ্ট, ভুল অর্থ, কুকাজ, দুর্ঘটনা। অন্যত্র কোথাও যোগ হয়, নিষ্প্রয়োজন, অনাবশ্যক, ব্যর্থ, অর্থহীন, যার 'অভিধ্যেয়' নেই। এইখানটিতে একটু মন দেওয়া যাক। 'অভিধ্যেয়' মানে চিন্তার বিষয়, যা ধ্যানের বিন্দু হতে পারে। অতএব 'অনর্থ' শব্দের একটা ব্যঞ্জনা পাচ্ছি, যেখানে 'চিন্তা'র পরিসর নেই। 'চিন্তা' মানে  অনুভব ও মননের একটা ক্রমপর্যায় শৃঙ্খল। যেখানে এক জায়গা থেকে শুরু করে অন্য এক জায়গায় মানসিক অবস্থানটিকে তুলে নেওয়া যায়। অর্থাৎ শাস্ত্র মতে মানুষের সরলরৈখিক, স্বীকৃত, নিয়মবদ্ধ, ব্যাকরণভিত্তিক যে আর্ষ মননপদ্ধতি, তার বাইরে বেরোতে গেলেই 'অনর্থে'র ঝুঁকি এসে যায়।

বাংলাকবিতার জন্মলগ্ন থেকে, অর্থাৎ চর্যাপদে'র সময় থেকেই কবিদের 'অনর্থ' নামক ট্যাবু চিহ্নের দায় বহন করতে হয়। শুধু বাংলা কেন? সারা পৃথিবীতেই কবিদের সামনেই এই চ্যালেঞ্জটি প্রবল। কতটা 'বুঝিয়ে' বলবো? কতটা মৌন ইশারার রাজত্ব? 'সাহিত্য' কি বেবাক লোকের মৌরসিপট্টা? বেবাক লোক যা বুঝতে পারে তা কি সত্যি শিল্প হয়ে ওঠে? বেবাক লোককে 'বোঝানো'র দায় শিল্পীর কতটা থাকে? অর্থাৎ সৃষ্টি করার সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য 'মানে বই' লিখে রাখাটি কি শিল্পীর দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে?

এই চির-জাগরূক পুরাতন প্রশ্নগুলির প্রাসঙ্গিকতা কখনও ফুরায় না। তাই একজন শিল্পী যখন তাঁর কবিতায় এক শতক আগে এই প্রশ্নটি করেছিলেন, সাধারণ বাঙালি পাঠকের পক্ষে তা ছিলো একটু বেশি অগ্রসর, স্মার্ট একটি প্রশ্ন। এ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা তাঁদের ছিলো না। কিন্তু যখন এই কবি একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ লিখে বাংলা কবিতার সমাকীর্ণ জগতে চিরস্থায়ী স্থান করে নেন তখন ঘটনাটি খুব মামুলি থাকে না। পরবর্তীকালে সেই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার প্রতিটি পংক্তি বাংলাভাষায় ইডিয়ম হয়ে স্বীকৃত হয়ে  যায় তখন তারও কোনও দ্বিতীয় নজির  আমরা ইতিহাসে খুঁজে পাই না। অতএব এটা ভাবা যেতে পারে,  যে লেখা দিনের শেষে 'কবিতা' হয়ে ওঠে তার কোনও মানেবই প্রয়োজন হয় না। পাঠকই এগিয়ে এসে নিজেকে তৈরি করে নেয়।

হ্যাঁ, সেই কবিতা সংকলনটির নাম 'আবোলতাবোল' আর কবির নাম না হয় নাই বললাম।

(৩)

সাহিত্য পাঠকের কি কোনও 'বয়স' থাকে? যেমন শিশু পাঠক, কিশোর পাঠক বা প্রাপ্তবয়স্ক পাঠক। এই ধরনের মাত্রাভেদকে মাথায় রেখে কি কোনো শাশ্বত সাহিত্য সৃষ্টি করা যায়? বোধ হয় এর উত্তর হবে 'না' । যেকোনো 'প্রাপ্তবয়স্ক' পাঠক তথাকথিত কিশোর সাহিত্য থেকে যথেষ্ট মনের খোরাক পেয়ে যান। সাহিত্য পাঠকের শুধু 'মন' থাকে। অর্থাৎ সাহিত্য উপভোগ করতে হলে 'প্রাপ্তবয়স্ক' নয়, ‘প্রাপ্তমনস্ক' হওয়া দরকার।  বুদ্ধদেব বসু একবার বলেছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বড়োদের জন্য লিখলেও পড়ে আনন্দ পায় ছোটোরা। আবার সুকুমার ছোটোদের জন্য লিখলেও তা আনন্দ দেয় বড়োদের। এই 'বড়ো' বলতে যেসব লোকজন তাঁরা মনস্কতার সূত্রে বড়ো, বয়সের গুণিতকে হয়তো 'প্রাপ্তবয়স্ক' নাও হতে পারেন। অর্থাৎ মননশীলতার পরিণতির বিচারে  সুকুমার ছিলেন বেশি পরিণত। তাঁর গুরু রবীন্দ্রনাথের মতো তাঁরও বিশ্বাস ছিলো, তিনি শিশু-বুড়ো সবারই সমবয়সি। আবোল-তাবোলের অনুরাগী পাঠকের বয়স আট থেকে অষ্টআশি সবই হয়। তাই শরীরের মৃত্যুর প্রায় একশো বছর পরেও সুকুমার একজন প্রাসঙ্গিক 'আধুনিক' কবি, উষ্ণ, জীবন্ত ও অসম্ভব জনপ্রিয়।    

শুধু 'আবোলতাবোল' নয়। আর একটি লেখার কথা স্মরণ করি, সেটি কিন্তু গদ্য।  নাতিদীর্ঘ এই গদ্যটি ব্যতিরেকে যদি এই কবি আর কিছুই না লিখতেন, এমন কি 'আবোলতাবোল'ও যদি না থাকতো, তবু বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের শীর্ষে কোথাও তাঁর স্বীকৃতি অমলিন থাকতে পারতো। সেই লেখাটি 'হযবরল'। তাতাবাবু এই লেখাটির একটি চরিত্র, হিজিবিজবিজ ওরফে তকাইয়ের মাধ্যমে তাঁর 'অনর্থ'যানকে রূপ দিতে চেয়েছেন। যার কাজ শুধু জগতের যাবতীয় 'অসঙ্গতি' দেখে হেসে যাওয়া। অথচ জাগতিক অসঙ্গতির সব অর্থকেই সেখানে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হচ্ছে। আপাতভাবে এই লেখা বালক-কিশোরদের জন্য। কিন্তু 'প্রাপ্তমনস্ক'রা যখন থেকে এই সব লেখার রস পেতে শুরু করেছেন, বাংলাসাহিত্যের রসগ্রাহিতার মানদণ্ডগুলো নতুনভাবে ব্যাখ্যাত হতে শুরু হয়েছে ।

(৪)

জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের অনুগামী। উনিশ শতকের শেষদিকে বেড়ে ওঠা ব্রাহ্ম আদর্শে 'নৈতিকতা'র বাড়াবাড়ি নিয়ে ঐ সমাজের অনেক মননশীল ব্যক্তি আশংকিত ছিলেন। সংখ্যাগুরু সনাতনধর্মীয় জনগণের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে 'পবিত্রতর' বিকল্প মূল্যবোধ স্থাপন করতে চাওয়া ব্রাহ্মপণ্ডিতেরা প্রায়শঃ অতিবাদী অবস্থান নিতেন। ফলশ্রুতি, ক্রমাগত দ্বন্দ্ব, স্ববিরোধ ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনাক্রম এই সংখ্যালঘু, কিন্তু প্রভাবশালী জনগোষ্ঠীটিকে মূলস্রোত থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছিলো। নিজের মুদ্রাদোষে আলাদা হয়ে যাওয়ার  দুর্ভাগ্য গ্রাস করে নিচ্ছিলো ব্রাহ্মসমাজকে। ততোদিনে তিনটি ভাগ হয়ে গেছে।  আদি, সাধারণ ও নববিধান। বাংলার চিরাচরিত 'তৈলাধার পাত্র'পন্থী পাণ্ডিত্যগর্বী প্রবীণদের আধিপত্য থেকে ব্রাহ্মসমাজ'কে মুক্ত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ  বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন। লেখালিখি ও অন্যান্য কার্যকলাপের সূত্রে এই  অবস্থানটিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি অবিশ্রাম কাজ করে যেতেন। তাঁর এই প্রয়াসে তৎকালীন ব্রাহ্ম যুবসমাজের যে অংশ সক্রিয়ভাবে তাঁর সঙ্গে থাকতেন, সুকুমার ছিলেন তাঁদের অগ্রগণ্য। ব্রাহ্মসমাজের পণ্ডিতমন্যতার বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ ও প্রায় বিদ্রোহ কবি'কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে।

আদি ও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য সুকুমার ও অমল হোমের মতো তরুণ ব্রাহ্মরা ১৯১১ সালের ২৬শে জানুয়ারি (মাঘোৎসবের পরদিন) সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উপাসনায় কবি'কে বেদীগ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানান। তৎকালীন পরিস্থিতিতে এটা যথেষ্ট দুঃসাহসিক বলা যেতে পারে। কারণ  প্রবীণ, প্রাচীনপন্থী ব্রাহ্মরা কবি'র 'ধর্মপ্রচার' প্রবন্ধ বা 'নৌকাডুবি' এবং 'গোরা' উপন্যাসে ব্রাহ্মসমাজের সংকীর্ণতার যে ছবি আঁকা হয়েছিলো, তা নিয়ে বিশেষ ক্ষুব্ধ ও বিরূপ ছিলেন। এই সভায় কবি তাঁর 'ব্রাহ্মসমাজের সার্থকতা' শীর্ষক প্রবন্ধটি পাঠ করেন। সেই সভায় সমবেত ব্রাহ্মদের মধ্যে এই অনুষ্ঠানটির সার্থকতা বিশেষভাবে অনুভূত হয়। সুকুমার নিজেও তাঁর ‘গুরু’র পথে 'চলচ্চিত্তচঞ্চরী' নাটকে ব্রাহ্মসমাজের 'নৈতিক' অচলায়তনকে প্রত্যক্ষভাবে আঘাত করেন, যা বহু ব্রাহ্ম প্রাচীনপন্থীর উষ্মার কারণ হয়েছিলো।

উপেন্দ্রকিশোর কবি'র রাজর্ষি উপন্যাসের দুটি চরিত্র, তাতা ও হাসি'র নামে তাঁর পুত্র সুকুমার ও কন্যা সুখলতার নামকরণ করেন। সুকুমার পরিজন মহলে 'তাতা' নামেই পরিচিত ছিলেন। ১৯১৩ সালের জুনমাসে কবি যখন লন্ডনে রোটেনস্টাইন সাহেবের বাড়িতে কবিতা শোনাতে গিয়েছিলেন, তখন সুকুমার লন্ডনেই থাকতেন। পিয়ারসন সাহেবের হ্যাম্পস্টেড হিথের বাড়িতে যখন কবি'কে নিয়ে একটি সভা আয়োজন করা হয়, তখন সুকুমার একটি প্রবন্ধপাঠ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর বোন পুণ্যলতা চক্রবর্তীকে ২১শে জুন একটি চিঠি লেখেন, "...পরশুদিন Mr. Pearson -তাঁর বাড়িতে আমার Bengali literature সম্বন্ধে একটা paper পড়ার নেমতন্ন। ...সেখানে গিয়ে (দেখি) Mr. & Mrs. Rothenstein, Dr.P.C.Ray, Mr. Sarbadhicary প্রভৃতি অনেক (পরিচিত) তা ছাড়া অনেক অচেনা সাহেব মেম সব উপস্থিত। শুধু তাই নয়, ঘরে ঢুকে দেখি রবিবাবু বসে রয়েছেন। বুঝতেই পারছিস আমার কি অবস্থা। যা হোক চোখকান বুজে পড়ে দিলাম। লেখাটার জন্য খুব পরিশ্রম করতে হয়েছে। India Office Library থেকে বইটই এনে material জোগাড় করতে হয়েছিল। তাছাড়া রবিবাবুর কয়েকটি poetry translate করেছিলাম। সেগুলো সকলেরই খুব ভালো লেগেছিলো।... রবিবাবু আমাকে দেখেই বললেন, "এখানে এসে তোমার চেহারা improve করেছে।" এছাড়া ২১শে জুলাই ১৯১৩'তে সুকুমার লন্ডনের ইস্ট-ওয়েস্ট সোসাইটিতে Spirit of Rabindranath Tagore শীর্ষক প্রবন্ধটিও পাঠ করেন। এই আলোচনাটিই বিদেশে  রবীন্দ্রনাথের রচনা সম্বন্ধে প্রথম সামগ্রিক মূল্যায়ন। সুকুমার এ বিষয়ে পথিকৃৎ। এই সব ঘটনাক্রম প্রমাণ করে তিনি বস্তুত  একজন সিরিয়স, মননশীল যুবক। সেকালের নামী পরিবারের ব্রাহ্ম যুবকরা যেমন হতেন। তাঁরা জাগতিক, মহাজাগতিক সব কিছুর অর্থ সন্ধান করতে সতত নিয়োজিত থাকতেন। তৎকালীন বাংলা ইন্টেলেনজেন্সিয়ার ('বুদ্ধিজীবী' শব্দটি গালাগালির পর্যায়ে চলে যেতে আর ব্যবহার করি না) যাঁরা অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন, সুকুমার তাঁদের অগ্রগণ্য। কিন্তু শিল্পী হিসেবে তিনি ছিলেন 'সৃষ্টিছাড়া'। এই সব কাজের মধ্যে থেকেই তাঁর ভিতরে জন্ম নিচ্ছিলো আবোলতাবোল বা হযবরলের বীজ। 'অনর্থ'শিল্পের অঙ্কুর। ১৯১৮-১৯ সাল নাগাদ তাঁর স্মৃতি খুড়তুতো বোন লীলা মজুমদারের স্মৃতিকথায় পরবর্তীকালে এই ভাবে এসেছিলো-  

'...বড়দা যেখানেই যেত একটা আনন্দের তুফান সঙ্গে সঙ্গে যেত। বড়দা যেখানে থাকতো, অন্য কারো দিকে লোকের চোখ পড়তো না। তাই বলে বড়দার কিছু কার্তিকের মতো চেহারা ছিলো না। তবে চেহারার মধ্যে কী একটা যেন ছিলো যার সঙ্গে মুখায়ববের কোনো সম্পর্ক ছিলো না, কিন্তু যা তার সর্বাঙ্গ থেকে আলোর মতো ঝরে পড়তো। এখন বুঝি সেটি তার ব্যক্তিত্ব।

লম্বা দোহারা মানুষটি, একমাথা কালো কোঁকড়া চুল, চোখ দুটি প্রায় সব সময় হাসতো, কিন্তু গম্ভীর হলে এমনি গম্ভীর হতো যে কাছে ঘেঁষতে ভয় পেতাম। বড়দা ছিলো যেমন আমুদে, তেমনি রাশভারি, অন্যায় সে কখনো সইতো না। যতদূর মনে পড়ছে, বড়দার গালে একটা বড়ো তিল ছিলো, আমাদের সেটিকে ভারি পছন্দ ছিলো।'

তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে লঘুরস ও গুরুপ্রত্যয়ের মেরু কখনও অচল অবস্থানে থাকতো না। তিনি স্বতস্ফূর্তভাবে স্বভাবের এই দুই প্রান্তে আসা-যাওয়া করতেন।  ব্যক্তিজীবন বা সৃষ্টিজীবনে, সমান মসৃণতায়। লীলা মজুমদারের মতো অনেকেই যেমন বলেছেন, সুকুমার যেখানে যেতেন একটা প্রসন্নতার আবহ তৈরি হয়ে যেত। জীবনের সর্বক্ষেত্রে রসবোধ প্রয়োগের যে কৌশল তাঁর আয়ত্ব ছিলো, তা বিরল। একটা গল্প আমরা শুনেছি যখন কবির সাতান্নতম জন্মদিন  শান্তিনিকেতনে আয়োজন করা হয়েছিলো। কালিদাস নাগের বর্ণনায় পাই এই উপলক্ষ্যে সস্ত্রীক রথীন্দ্রনাথ, সস্ত্রীক সুকুমার, সপরিবার রামানন্দ, কালিদাস নাগ, সবাই হৈ হৈ করে রেলগাড়িতে শান্তিনিকেতন যাত্রা করলেন। "...বিকেলে পৌঁছে দেখি, কবি দিনুবাবুর ঘরে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন - সকলকে খুব খাওয়ালেন, তারপর সন্ধ্যায় আশ্রমের ছেলেরা এক বাঙ্গাল সভা করলে - নানা প্রদেশের চলতি ভাষায় ঠাট্টা, বিদ্রূপ, গান চললো - চমৎকার হলো - সুকুমার মৈমনসিংহের বাঙ্গাল-সভাপতি হলেন।" (কালিদাস নাগ)। এই 'বাঙাল-সভা' অনুষ্ঠানটির আরেকটি বিশদ বর্ণনা আমরা সীতাদেবীর রচনাতেও পাই।

"...খোলা মাঠেই সভা হইতেছিল। মেয়েরা ও মান্যগণ্য অতিথিবর্গ তক্তপোষে বসিলেন, ছেলেরা মাটিতে শতরঞ্চি বিছাইয়া। সর্বসম্মতিক্রমে সুকুমারবাবু সভাপতি নির্বাচিত হইলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাব করিলেন যে সুকুমারবাবুর পত্নী শ্রীমতী সুপ্রভাকেই সভানেত্রী করা হোক, কারণ আজন্ম কলিকাতায় বাস বলিয়া সুকুমারবাবুর বাঙালত্ব খানিকটা লোপ পাইয়াছে। কিন্তু সুপ্রভা রাজী না হওয়াতে সুকুমারবাবুই সভাপতির পদে বাহাল রহিলেন।... সভার কার্য যথাসম্ভব বাঙালভাষাতেই হইতেছিল। ...অতঃপর সভাপতি তাঁহার অভিভাষণ দিলেন অতি কষ্টে। বেশ পুরাপুরি বাঙাল ভাষা হইলো না।" এর পরের দিন চব্বিশে বৈশাখ, "সভাস্থ সকলের অনুরোধে সুকুমারবাবু তাঁহার 'শব্দকল্পদ্রুম' কৌতুকনাট্যটি পাঠ করিলেন। ইহার গানগুলিও হইলো বটে, তবে তাঁহার দলের লোকেরা এখানে কিঞ্চিৎ সলজ্জভাবে গান গাহিলেন।" এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় সুশোভন সরকারের স্মৃতিচারণ। 'লক্ষ্মণের শক্তিশেল' নাটকে তাতাবাবু'র হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে "রাবণ রাজায় মারো, রাবণরাজায় মারো" স্ফূর্তির রসে উজ্জ্বল গান তাঁর মনে থেকে গিয়েছিলো আজীবন।

(ক্রমশ)

 

 

 

 


1 কমেন্টস্:

  1. প্রিয় কবিকে নিয়ে এমন লেখা, বড় ভালো লাগছে। পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।

    উত্তরমুছুন