ধারাবাহিক উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(২৬)
রাতের খাওয়া শেষ, শোভন ওষুধ খেয়েছে, একটু পরে শুয়ে পড়বে। চুল আঁচড়াচ্ছিল লিপিকা, চুপ করে কী ভাবে, ইতস্তত করে বলবে কী বলবে না। তারপরে জানতে চায়,
--কাল
তুমি যাবে?
--দেবিকাদের
ওখানে?
--না,
ইচ্ছে না করলে যেয়ো না। দেবী গত সপ্তাহে দু-বার ফোন করল, এবার দেখছি অনেকবার করে তোমাকে
নিয়ে যেতে বলল। বললাম তো তোমার শরীর বিশেষ—
--ঠিক
আছে যাবো।
উত্তর
শুনে লিপিকা তাকিয়ে হেসে ফেলে। কেন সে এই মানুষটির মতো সহজ হতে পারে না? প্রত্যেক বিষয়
নিয়ে অতিরিক্ত বিশ্লেষণ করা বদভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। মাথা থেকে সে সব ঝেড়ে দিতে চেষ্টা
করে। তার চিন্তিত নীরবতা শোভনকে ভাবায়। বলে,
--না
হলে ছেড়ে দাও। সব সময়েই বড্ড অসুবিধায় ফেলি তোমাকে, ফ্রি-লি ঘুরে চলে এসো। আমি ঠিকই
থাকবো, টেনে ঘুম দেবো।
লিপিকা
শোভনের দিকে তাকিয়ে আনমনে মাথা নাড়ে, কথাগুলো শোনে কি না বোঝা যায় না। শোভন হাই তোলে,
--ঘুম
পাচ্ছে, আমি শুতে গেলাম। রাত কোরো না, রোজ রাত অবধি জেগে থাকো কেন জানি না।
--যাচ্ছি।
সে
ভাবে শোভনকে নিয়ে গেলে মন্দ হয় না। মানুষটা ঘরবন্দীই বলা যায়, দেখা-সাক্ষাৎ কথাবার্তা
হলে ভালো লাগবে যদিও যাওয়া-আসাটাই সমস্যা।
দুপুর-দুপুর
বেরোলে নিজে ড্রাইভ করে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু ফেরার সময়ে সন্ধে হয়ে যাবে —
ওই
ব্যস্ত রাস্তায় চালানোর ধক নেই। দেবিকার ওখানে পার্কিং-এর জায়গা নেই, কলোনীর সরু অলি-গলিতে
গাড়ি ঢোকানোও মুখের কথা নয়। খালি অংশগুলোতে ছুটকো-ছাটকা চা-চপ-মুদী-দশকর্মার দোকান,
লণ্ড্রি, ক্লাব, আড্ডা, পার্টি অফিস। দেড়কাঠা জমি থাকলে পোয়া বারো, প্রমোটারকে দিয়ে
চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি! বর্তমান ঘিঞ্জি চেহারা কল্পনা করে লিপিকা বিরক্ত হয়, জোরে নিঃশ্বাস
ফেলে সেটা বের করে দিতে চায়। ক্যাব ডাকলে একগাদা ভাড়া শুধু নয়, ফেরার সময়ে এদিকে আসতে
ঝামেলা করে।
বরং
সুবোধকে ডেকে নেওয়া যায় — ভালো, ঠাণ্ডা
মাথার ড্রাইভার। কাছাকাছি সেন্টার থেকে পেয়েছিল। তাদের নামিয়ে কোথাও একটা চেপে পার্কিং
করিয়ে দেবে।
কাঁকড়ভর্তি
চালের মতো বিষয়গুলো মাথার ভেতরে গড়াতে গড়াতে চোখ জড়িয়ে আসে।
অন্যরকম দেখাচ্ছে শ্রুতিকে। সবুজরঙের সরু-পাড় তাঁতের শাড়ি, কপালে ছোট্ট কালো টিপ, কাজল মোটা করে পরে রুক্ষ বিষণ্ণ চৌকোণা মুখখানা শেষ বিকেলে গাছের পাতায় লেগে-থাকা তেলতেলে রোদের মতো কমনীয়। লিপিকা চিবুক ছুঁয়ে বলে,
--ও-মা
কী মিষ্টি দেখাচ্ছে রে!
শোভনকে
দেখে শ্রুতি যত না খুশী তার চেয়ে বেশী অবাক! হাত বাড়িয়ে আগলে নিয়ে যায় নিজের ঘরখানাতে,
--চলো
আমার আঁকা দেখাবো, ওরা ওদের মতো কথা বলুক।
সস্নেহে
তাকায় লিপিকা, দেবিকাও হাসিমুখ। কৌশিক ফ্রিজ থেকে দুগ্লাস শরবৎ এনে সামনে রাখে,
--আরে
শোভনদা কই?
লিপিকা
উত্তর দেয় না। দেবিকা হাসতে হাসতে বলে,
--মেসোরে
পাকড়াও করে নিয়া গ্যাছে, ছবি দেখাবে। দিদি তোর ড্রাইভার কই? ও শরবৎ দিয়ে আসুক।
--না
দরকার নেই, ও দুঘন্টা বাদে এসে আমাদের নিয়ে যাবে।
--দুইঘন্টার
জন্যে মোটে আসা? রাত্তিরে খাইয়া যাবি না? আমি ভাবলাম অ্যাদ্দিন বাদে আইলি!
লিপিকা
কৌশিকের দিকে তাকায়, তার চোখেও অনুরোধ। লিপিকা প্রশ্রয় দেয় না, শীতল হাসিমুখে বলে,
--না
রে। আমাদের বিশেষ করে তোর শোভনদার খাওয়ার অনেক রেস্ট্রিকশন্স মানতে হয়।
--অ।
তা যা ভালো মনে করবি—!
--বল
এবার আসল কথাটা, কেন ডাকলি?
--না
ডাকলে আসেন না কিনা, তাই!
কৌশিকের
স্বরে স্পষ্ট শ্লেষ। লিপিকা উত্তর দেয় না, কিছুক্ষণ এদের সঙ্গে কাটালে রাগের পারদ বাড়তে
থাকে। অতিথি বলেই আপাতত চুপ করে থাকে। দেবিকা কৌশিককে বলে,
--মামপিরে
ডেকে আনো না।
আস্তে আস্তে সময় নিয়ে মামপির আঁকা ছবি ক-খানা দেখছিল শোভন — অয়েল পেইন্টিং, ওয়াটার-ওয়াশ, প্যাস্টেল-ওয়ার্ক। মামপির প্রফুল্লমুখে তৃপ্তি ছড়িয়ে পড়েছে। কথা সে-ও কম বলে, শোভনও, তাসত্বেও আশ্চর্য যোগসূত্র তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে শোভন পরম মুগ্ধভাবে বলে,
--হ্যাঁরে
মামপি, আমাকে শেখাবি? আমি শুধু পেন্সিল কালার ছাড়া কিছুই পারি না!
সরল
স্তুতিতে মামপির চোখ ভিজে ওঠে। সামলে নিয়ে বলে,
--সব
পারবে তুমিও। এবারে প্যাস্টেল ক্রেয়ন ব্যবহার করে দেখতে পারো, ভালো লাগবে।
শোভন
মাথা নাড়ে। কৌশিক দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকে, শোভন আর মামপি তাকায়। কৌশিক বলে,
--চলুন
দাদা ওই ঘরে, মামপি আয়।
মামপির
চোখে বিরক্তির রেখা খেলে যায়, নতুন করে হিংসে হয় বাবুলকে। আজ সে অবাধ্যতা করে না। শোভনকে
নিয়ে পায়ে পায়ে বাবা-মায়ের ঘরে এসে বসে। লিপিকা মামপির মুখ দেখে, কিছু আঁচ করে সস্নেহে
বলে,
--দু-দুটো
ভালো খবর একসাথে, খুব খুশী হয়েছি রে।
--দু-টো?
মা বললো বুঝি? একটাই তো খবর মাসিমণি!
লিপিকা
কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে যায়। মামপি নিজেই বলে,
--দুটো
খবর কন্ট্রাডিকটরি, একটা হলে আরেকটা হবে না। প্রব্লেম হল, মা-র আর আমার প্রায়োরিটি
আলাদা—!
ব্যাপারটা
দেবিকার কাছ থেকে জেনেছে লিপিকা। হায়দারাবাদের শ্রুতির চাকরির অফার লেটার এসেছে, তিনমাসের
প্রবেশন পিরিয়ড শেষ হলে কনফার্মেশন, বছরে সাড়ে সাত লাখ। লিপিকা আন্তরিক খুশী হয়েছে,
প্রদর্শন করা মাত্র দেবিকা বলে,
--বাবুল
মাসে কত পায় রে?
চমকে
ওঠে লিপিকা, এটা কি কোনো প্রতিযোগিতা? বাবুল প্রায় আড়াইগুণ বেশী পায়, শুনলে কী খুশি
হবে দেবিকা? লিপিকা নিরুত্তর দেখে দেবিকা আবার বলে,
--আরো
একখান আছে, মামপির বিয়ে ঠিক হইছে।
মোবাইলে
দেবার্ঘ্যর ছবি দেখিয়ে উচ্ছ্বসিতভাবে খুঁটিনাটি বিস্তারিত বলে ফেলে। অবশ্য মামপির ডেটিং-এর
খবর দেবিকা জানে না। মামপির দিকে চোখ রেখে সাবধানী গলায় বলে,
--অরে
বুঝা মেজদি, আমার একটা কথা মানতে চায় না।
আগুন
দৃষ্টিতে তাকায় মামপি, সন্ধেবেলার লাবণ্যটুকু সরে যায়। তর্কে ঢুকবে না তাই উঠে যায়
রান্নাঘরে, খানিক পরে দুখানা প্লেটে খাবার সাজিয়ে আনে।
--খাও
মাসিমণি-মেশো। আমার চাকরি পাওয়ার ট্রিট, ভালো দোকান থেকে এনেছি। নেক্সট উইক এণ্ডে যাচ্ছি
হায়দরাবাদ, তার পরের উইকে জয়েনিং।
--ও-মা
তাই নাকি? কিন্তু, তোর মা যে—?
--পরে
ওসব—। এখানে যে
আমার কিছু হবেনা বুঝে গেছি। তাই আপাতত চাকরিটা ভাবছি, পে-প্যাকেট যদিও অতো ভালো নয়
আমার একার জন্যে সাফিশিয়েন্ট—দেখা যাক। অ্যাকচুয়ালি
আমার টানা এক্সপিরিয়েন্সও নেই।
সারা রাস্তা শোভন বালকের মতো উচ্ছল। সন্ধের পরের আলো, প্রাণবন্ত পথঘাট, লোকজন, গাড়ির জ্যাম, ঝলমল দোকানপাট—গাড়ির জানালা থেকে চোখ সরাতে পারে না। লিপিকা মামপির কথা ভাবছিল। বাড়িতে মেয়ে ভালো থাকে না, আনন্দে থাকে না, বোঝা যায়। তাই হয়ত পালাতে চায়। দেবিকা নালিশ করছিল, যখন খুশী ফেরে, খায়। কিছু বললে দরজা বন্ধ করে সারারাত না খেয়ে কাটিয়ে দেয়।
বেরোনোর
আগে সে মাথায় হাত বুলিয়ে এসেছে। বলতে ইচ্ছে করছিল, পায়ের তলার মাটি শক্ত রাখিস। কখন
কী ঘটবে, কেউ আগে থেকে জানতে পারে না।
উপদেশগুলো
দেবিকা কীভাবে নেবে চিন্তা করে কিচ্ছু বলেনি। মামপিও কথা বাড়াতে চায় নি। জানতে চেয়েছে,
--মাসিমণি,
আমি কাল-পরশু তোমার বাড়িতে গেলে অসুবিধা?
লিপিকা
সম্মতি জানিয়েছে। কী বলতে চায় কে জানে? তবে যতটা দেখেছে তাকে বেশ পরিণতবুদ্ধি, নিজস্ব
চিন্তাভাবনা আছে, ব্যক্তিত্ব আছে। মায়ের মতো হঠকারি কাজ করবে বলে মনে হয়না। বিয়ের ব্যাপারে
কী ভাবছে, মা-বাবাকে বলে না। তাকে বলতে চায়? তার মতামতের ওপরে মামপির পরবর্তী পদক্ষেপ
নির্ভর করবে? ভীষণ অস্বস্তি হয় লিপিকার। বিয়ে না দূরের চাকরি – এই উভয়সঙ্কট সম্ভবত
মেয়েটাকে ভেতরে অশান্ত করে রাখছে। বিয়ে করতে চায় না? আচমকা বাবুলের কথা মনে এল, সে-ও
উভয়সঙ্কটে? লিপিকাকেও বলতে পারছে না?
দমকা
হাওয়ার সঙ্গে একরাশ ধুলো উড়ে এল গাড়ির জানালা দিয়ে। শোভন বলে উঠল,
--ওঃ
ঝড় উঠবে!
--এ
বাবা, তাই তো দেখছি! সুবোধবাবু প্লিজ কাচ তুলে এ-সি অন করে দিন না।
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন