কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৪ মে, ২০২২

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

হে নেপথ্যচারিণী 




 (২) 


অনুপলব্ধি

 

ভোরবেলা প্রাতঃরাশের টেবিলে চোখ বন্ধ করে পাঁউরুটিতে কামড় দিতে দিতে গান শুনছিল আশুদা। 'যে ছিল আমার স্বপনচারিনী। ...'অর্ঘ্য সেনের মায়াময় কণ্ঠে ঘরের ভিতর এক মায়াবী স্বপ্নপৃথিবী নির্মাণ করেছে যা সত্যিই সহজে বুঝে ফেলা কঠিন। গানটি লুফে চার পাঁচবার শোনার পর অবশেষে চোখ মেলে  তাকাল আশুদা। সরাসরি আলোরঙের গোলকের দিকে তাকিয়ে বলল।

-থিয়েটারে একজন শিল্পীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ লাইটম্যানের হাতের দৈত্যটিকে বশ করা। আর সেই দৈত্যটি আসলে কে বল দেখি?

-কে?

-ওই কালার স্ফিয়ারের মধ্যিখানে আছে সেই দৈত্য। বিদ্যুৎ। ইলেকট্রিসিটি।

আমি অবশ্য ইতিমধ্যেই জরুরি কাজটুকু সেরে রেখেছিলাম। স্বপনচারিণীর মায়াডোরে ধরা দেবার আগেই তাই গতকালের অত্রি পালচৌধুরীর ঘটনার কথাটা আমি আশুদার কানে দিয়ে রেখেছিলাম। তারপর এতক্ষণের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে আশুদার এই প্রশ্নবাণের কারণ খুঁজতে হিমশিম খাচ্ছিলাম রীতিমতো। সেকথা আন্দাজ করেই বোধহয় আশুদা আমাকে বলল-

-অত্রি কে বল দেখি?

-আমার কলেজের ক্লিনিক্যাল টিউটর হিসেবে জয়েন করেছে দু মাস আগে। তোমাকে বললাম তো!

-ধুর হতচ্ছাড়া। 'অত্রি' বলতে আমি পুরাণের অত্রিমুনির কথা বলছি।

-অত্রি মুনি পৃথিবীতে গঙ্গাকে নিয়ে আসেন কথিত আছে।

-তা নিশ্চয়ই শিবপুরাণে আছে। তবে সেটাই তার আসল পরিচয় নয়। অত্রি হলেন রাতের আকাশের সপ্তঋষির একজন। আরও ইন্টারেস্টিং চরিত্র হল তাঁর স্ত্রী অনসুয়া। সাতসতীর একসতী তিনি। নিজ সতীত্ববলে আপন গর্ভে ধারণ  করেছিলেন ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর। এখন দেখার, যে আমাদের রঙ্গমঞ্চর অনসুয়া বা সুচন্দ্রা দেবী তার অবচেতনে কোন ত্রিদেব ধারণ করে আছেন!

-একবার কি আমাদের ওই ছেলেটির মুখোমুখি হওয়া উচিত নয়?

-অবশ্যই। তবে তার আগে আমাকে একটু প্রস্তুত হতে দে। আজ সান্ধ্যভোজে ডেকে নে না!

মাথা নেড়ে রাজি হয়ে যাই আমি। একটি চিরকুটে নিজের নম্বর গতকাল লিখে দিয়েছিল অত্রিপত্নী সুচন্দ্রা। ঠিক করলাম সেই নম্বরেই কথা বলে নেব। ফোন করতে ওপার থেকে ভেসে এল অত্রির গলা। সম্মতিও মিলে গেল তৎক্ষণাৎ। সন্ধ্যাবেলা ওরা দুজনেই আসছে আমাদের সাদার্ন এভিন্যিউর ডেরায়। আশ্চর্যর বিষয় ওর গলায় কোনও উৎকণ্ঠা বা অস্বাভাবিকতা শুনতে পেলাম না আমি। সব যেন অত্যন্ত অনুমেয়।

আশুদাকে ঘরে রেখে কর্মস্থলে বেরিয়ে পড়তেই হলো। দৈনন্দিন কর্মপ্রণালী ধীরে ধীরে আবার আগের মতো হয়ে উঠছে। কলেজে ছাত্রছাত্রীদের আসতে দেখে মন ভালো হয়ে গেল। তরতাজা ছেলেপুলেদের গুজগুজ প্রশ্ন খুনসুটিতে বারবার সেই  বাইশবছর আগেকার স্মৃতি ফিরে আসছিল। অত্রি অবশ্য আজও আসেনি কর্মস্থলে। কিন্তু তাকে নিয়ে সরফরাজ আর রঘুপতির কৌতূহলের অন্ত নেই। আর তাদের কথাবার্তার ভিতর বারবার ঘুরে ঘুরে আসছিল মনসুর গাজির ইবলিশ তাড়ানোর কথা। ওদের কথা শুনে আমার মনের ভিতরেও আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছিল। এই মানুষটির কথা শুনছি আজ বেশ কিছুদিন ধরে। রেললাইনের ওপারে কবরস্থানে রাতের বেলা লোকটা নাকি আত্মা জিনপরীদের সঙ্গে অনর্গল কথা বলে। বেশ রহস্যময় মানুষ। বিকেলের দিকে আমার ঘরে ফিজিওলজির দশরথবাবু এলেন খানিক গল্প করতে। বয়সে অনেকটা ছোট আমি। তাই তিনি 'তুমি তুমি' করেই কথা বলেন আমার সঙ্গে। কাকতালীয়ভাবেই বেনিয়াপুকুর থানা থেকে একটি লাশ ময়নাতদন্তর জন্য ঠিক সেই সময় এসে পড়ায় দশরথবাবুর আলাপচারিতা নয়া মোড় খুঁজে পেল। লাশটি একটি মহিলার। মাথা থেকে বুক, বুক থেকে কোমড়ের উপরিভাগ ও নিচের পা দুটো তিনভাগে বিভক্ত। আপাতভাবে রেললাইনে দুর্ঘটনাগ্রস্ত লাশের মতোই। লাশটি পাওয়াও গেছে রেললাইনের ধারেই। কিন্তু তদন্তরত পুলিশের অনুমান মেয়েটির স্বামী পরকীয়া সন্দেহে আগেই হত্যা করে রেললাইনে ফেলে গিয়েছিল দেহটা। আমি পরীক্ষা করে দেখলাম দেহে যেভাবে পোস্টমর্টেম লিভিডিটি এসেছে তাতে  পুলিশের অনুমান সঠিক হবার সম্ভাবনাই বেশি। চুপিসারে এইসব প্রত্যক্ষ করে দশরথবাবু খানিকটা দার্শনিকের মতো বললেন-

-এসব যত দিন যাচ্ছে আরও দূঢ় ধারণা হচ্ছে আমার।

-কোন ধারণা দাদা?

-এটাই যে কাম আর ক্রোধ। জগতের দুটি মাত্র ভাব যা মনের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের সিলেবাসে তো মনোবিজ্ঞান তেমন নেই। কিন্তু ছাত্র থাকাকালীন আমিও একটু একটু ফ্রয়েড পড়েছি। কী? ঠিক বললাম কিনা?

আমি তর্কে গেলাম না। এই দশরথ মানুষটি খুব ভালো মানুষ। মাটির মানুষ। আধুনিক মনোবিজ্ঞানে ফ্রয়েডসাহেব যে অনেকক্ষেত্রেই বিতর্কিত, সেই আলোচনা শুরু করলে শেষ হওয়া কঠিন। এদিকে ছেলেমানুষের মতো ঘড়ির দিকে নজর চলে যাচ্ছিল আমার। মন পড়ে আছে আশুদার কাছে। কখন সন্ধ্যে হয়।

ঘরে ফিরে দেখলাম আশুদা কোথা থেকে বড় বড় প্লাগপয়েন্ট আর লিভারের মতো হাতললাগানো কীসব যন্ত্রপাতি এনে জড়ো করেছে ঘরে। জিজ্ঞেস করতে খুব সংক্ষেপে আমাকে বলল-

-মহাজাতি সদনের কাছে আলো বাড়ানো কমানোর কয়েকটা পুরনো থার্ড ফোর্থহ্যাণ্ড রেজিস্ট্যিন্ট জ্যামার বিক্রি হচ্ছিল। তুই চলে যেতেই আমিও বেরিয়ে পড়লাম। আজ একটা পরীক্ষা করব ঘরে। আলো নিয়েই। দেখি কি ফলাফল পাই।

ঠিক ঘড়ির কাঁটা সাড়ে সাতটা ধরে অত্রি তার স্ত্রী সুচন্দ্রাকে নিয়ে আমাদের ঘরে উপস্থিত হলো।

নিপাট সহজসরল নিরীহ এক দম্পতি। বছরখানেক বিয়ে হয়েছে। বছরখানেক ধরেই অত্রির লক্ষ্মণগুলো ছিল। তবে এতো প্রকটভাবে প্রকাশে আসেনি এতোদিন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, অত্রি এই হঠাৎ তার স্ত্রীর গলা টিপে ধরাটাকে কিছুতেই মনে করে উঠতে পারেনি। তবে একটি কথা সে স্বীকার করে নিল। ঘুমের ভিতর সে স্বপ্নে এক রহস্যময়ীকে দেখতে পায়। সে রহস্যময়ী তাকে মোহিনীর মতো মোহাচ্ছন্ন করে। কিন্তু কোনওভাবেই সে নারীর মুখ দেখতে পারে না অত্রি।

কথা বলতে বলতে রাত বাড়তে থাকে। রাতে সামান্য নৈশাহারের আয়োজন ছিল। আশুদা ওদের আমন্ত্রণ করে নিল ভোজনের টেবিলে। কথাবার্তা সেই টেবিলেই হতে থাকল।

-আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?

-কেউ নেই। আমি আর সুচন্দ্রা।

-চালতাবাগানে আপনার বড় পুরনো বাড়ি বললেন। সেই বাড়িতে একলা দুজন থাকেন। ভয় করে না?

দুজনেই একসঙ্গে মাথা নাড়ে। দুজনেরই বক্তব্য এটাই যে সে একাকিত্বে তাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। সুচন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করল আশুদা-

-তোমার নামটা খুব শোনা শোনা লাগছে। তোমার বিয়ের আগে কী পদবী ছিল?

-মুখোপাধ্যায়।

-বেশ।

বুঝতে পারি। রহস্যর জট এক এক করে বুনতে শুরু করে দিয়েছে আশুদা। কিন্তু এটাও বুঝি যে সমান্তরালে তার মাথায় টেবিলে রাখা ওই রঙের গোলকের কাজ কর্ম ক্রিয়াশীল রয়েছে। ঘরে ফেরার সময় অত্রি একদৃষ্টিতে  তাকিয়ে রইল গোলকটার দিকে। সুচন্দ্রা খানিক 'এটা কী' 'ওটা কী' জিজ্ঞেস করছিল আশুদাকে। তারই মাঝে সে বলে বসল-

-আচ্ছা স্যার, আপনি ভুডুপুতুলে বিশ্বাস করেন?

-স্যার নয়, আশুদাই বলো। কিন্তু হঠাৎ এই প্রশ্ন?

-আসলে গতকাল অত্রিকে নিয়ে কলেজের কয়েকজন পাড়াতেই এক ওঝার কাছে গিয়েছিল। তিনি বলেছেন ওর ভিতর অশুভ জিন ভর করেছে। সেই জিনকে তাড়াতে উনি একটি পুতুল বানিয়েছেন। তাকে নানান কষ্ট দিয়ে তার হাত থেকে অত্রিকে উনি মুক্তি দেবেন বলেছেন। এতে ওর কোনও ক্ষতি হবে না তো আশুদা?

খানিক ভেবে আশুদা দুদিন সময় চেয়ে নেয়। তারপর ওরা চলে গেলে আবার মৃদু অর্ঘ্য সেন বেজে ওঠে ঘরে। 'এ নিরন্তর সংশয় হায় পারি না..."। আমি অধীর আগ্রহে বসে রইলাম আশুদার মুখোমুখি।

-কী বুঝলে?

-ধুস। অনেক হোমওয়ার্ক করতে হবে আমাদের। ওই ছেলেটা তো কিছুই বলল না নিজের সম্পর্কে। একটা সন্দেহ থাকবেই। টেমপোরাল লোব এপিলেপ্সি। ওটা রুল আউট করা তোর কাজ।

-বুঝলাম। আর?

-সুচন্দ্রা মুখোপাধ্যায়। মনে পড়েছে। আজ থেকে ঠিক ষোলো বছর আগে একটি আট বছরের বালিকার সামনে তার মাকে ধর্ষণ করে খুন করে কিছু দুষ্কৃতি। সেই ঘটনার পর সেই বালিকার বাবা মানসিক ভারসাম্য হারায়। কলকাতায় তখন সবে ডিজিটাল যুগ শুরু হচ্ছে। ভদ্রলোক বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের প্রফেসর। ওই দুষ্কৃতিদের একজন ছিল বিখ্যাত গায়ক মনোরঞ্জন শিকদারের আপন ভাই। লোকটি তাকে ইলেকট্রিক তার জরিয়ে অভিনব কায়দায় খুন করে ও আত্মসমর্পণ করে। এরপর বেশ কিছু মানসিক বিভাগে পুলিশি হেফাজতে থাকার পর তার রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। সেইসময় আমাকে তলব করেছিল লালবাজার। মাত্র কয়েকদিনের জন্য কলকাতা এসেছিলাম। তখন পরীক্ষা করে দেখেছিলাম আপাতভাবে মৃগীরোগে মৃত্যু মনে হলেও আসলে পুলিশ কাস্টোডিতে লোকটির উপর কেউ বিষ প্রয়োগ করেছিল। কী সেই বিষ আজও জানা যায়নি। আরও আশ্চর্যর বিষয় মৃত্যুর সময় লোকটির কানে ইয়ারফোন লাগানো ছিল। মানসিক হাসপাতালের জেলহেফাজতে ওই ইয়ারফোন কোথা থেকে এল কেউ বলতে পারেনি।

-ওই গণধর্ষণের একজন না হয় খুন হলো। কিন্তু বাকিরা?

-সেখানেও ধোঁয়াশা। ফাইলে সাসপেক্ট তালিকায় আর কোনও নাম ছিল না। পুলিশ ফাইল ক্লোজ করে দেয়। কিন্তু আজ একটা খটকা লাগছে আমার। সর্বানন্দকে বলে সেই ফাইলটা একবার দেখা যায় কিনা কাল দেখব।

-কিন্তু হঠাৎ এই কেসের কথা মনে এলো কেন তোমার?

-কারণ যতোদূর মনে পড়ছে অধ্যাপক ও অকালমৃত সেই লোকটির নাম ছিল অলোককৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। আর ওই বালিকা, যার সামনে ধর্ষণ ও হত্যা করা হল তার মাকে, তার নাম ছিল সুচন্দ্রা। এখন আমাদের দেখতে হবে সেই সুচন্দ্রা আর তোর জুনিয়র অত্রির স্ত্রী সুচন্দ্রা এক মানুষ কিনা!

রহস্য এইদিকে মোড় নেবে ভাবিনি। রাতে ভাবতে থাকলাম নিছক একটি মৃতদেহের ওপর ঝাঁপিয়ে 'কেন জ্বালাতন করছিস' বলে ওঠাটা কি অত্রির একটা ছোট্ট সাইকোটিক এপিসোড না মনোবৈজ্ঞানিক ক্যাথারসিস? কে সেই অন্ধকারে  ঢাকা নারী যে অত্রিকে মিলনে প্রলুব্ধ করেও নিজে নেপথ্যে থেকে যায়? এই সুচন্দ্রা মুখোপাধ্যায়ের আসল পরিচয়ই বা কী? ভাবতে ভাবতে বসবার ঘরে খুটখুট আওয়াজ শুনতে পাই। আশুদা পরীক্ষা করছে তার সদ্য আনা 'রেজিস্টেন্স জ্যামার'গুলো নিয়ে। আমাকে উঁকি দিতে দেখে আশুদা বলে-

-এদিকে আয়।

একটা হাতল ঘুরিয়ে আলো তীব্র থেকে ম্লান করে দিচ্ছে আশুদা। গোলকের ভিতরে একটি দুশো ওয়াটের বাল্ব ঢুকিয়ে এই কাজ করে চলেছে সে। পরীক্ষামূলক কাজ করতে করতেই আশুদা বলল-

-মানুষের অবচেতন আর চেতন ঠিক এই গোলকের ভিতরে থাকা আলোটার মতো। কখনও জ্বলে ওঠে। কখনও নিভে যায়। আর এর নেপথ্যে থাকে কিছু আলো। থিয়েটারের ক্ষেত্রে তাকে বলে 'ঘোস্ট লোডিং'। আর মনোবিজ্ঞানে প্রালব্ধ অভিজ্ঞতা। অত্রির এই নেপথ্যচারিণীকে ধরতে গেলে আমাদের তার মনের ভিতরের এই ঘোস্ট লোডিংকে খুঁজে বের করতেই হবে। আর সেটা তখনই সম্ভব যখন আমরা তার স্বপ্নর ভিতরে ঢুকতে পারব।

-কিন্তু সেটার সুযোগ তুমি পাবে কী করে?

-পাবো অর্ক। ঠিক পাবো। মন বলছে আমার। সে সুযোগ খুব দ্রুত আসছে।...

অনুপলব্ধিগত প্রমাণ বড় গোলমেলে বস্তু। আশুদার কথা শুনে আমি একরাশ ধোঁয়া মনের ভিতর পুরে নিজস্ব স্বপ্নে ডুব দিতে চললাম। কাল বের হতে হবে আবার। দেখি আশুদার অনুমান সত্য হয় কিনা।

 

(ক্রমশ)

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন