কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ৮ জুন, ২০১৯

তুষ্টি ভট্টাচার্য




পদাবলি ৬  



(আমি- আমি সামান্য শখের কলমচি। যা ইচ্ছে হয় তাই লিখি আর কী! আমার লেখার পাঠক খুবই কম যদিও। বড় বড় সাহিত্য সভায় আমাকে পাবেন না। পুরস্কারের বদলে তিরস্কারই পাই বরং। মনের দুঃখে ইচ্ছে জেগেছে পদাকে নিয়ে লিখতেযদি যুগান্তকারী কিছু লেখা হয়ে যায়, অন্তত পদার নাম করে।  

পদাপদাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। আমারই বয়সী বলে ওকে আমার বন্ধু ভাববেন না। গরীব নয়, কিন্তু গরীব সেজে থাকে। বিচ্ছিরি রকম ড্রেস সেন্স, হয় পাজামার ওপরে টিশার্ট, নয় লুঙ্গির ওপরে ফুল শার্ট! আর পায়ে হয় কাপড়ের জুতো নয় প্লাস্টিকের চটি। সময়ে, অসময়ে হুটহাট আবির্ভূত হয়। আমাদের সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। কথাবার্তার টপিক বিবিধ ভারতী থেকে বিলিতি আমড়া পর্যন্ত। গায়ে পড়ে এসে পিত্তি জ্বলানো কথা বলে। আমিও মাঝেমাঝে ওকে কিছু নিরীহ প্রশ্ন করে থাকি।

মাদাম তুভোঁআদপে ফরাসী হলেও এদেশের বাসিন্দা, রঙ জন্মসূত্রে সাদাই ছিল। এখন তাঁর তামাটে মোটা চামড়ায় খসখসে খড়ির দাগ। অত্যন্ত নাক উঁচু টাইপের। এবং জ্ঞানদা। এঁর কথা অর্থাৎ বাণী না শুনলে আমার আর পদার সম্পর্কটা ঠিক খোলসা হবে না। ইনি সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় এসে বাণী বিতরণ করে আমাদের আরও বিপাকে ফেলে প্রস্থান করেন)

দুর্গাপুজো শেষ হতে না হতেই লক্ষ্মীপুজো চলে এলো। কাল থেকে লক্ষ্মী আসবে। কাল থেকেই বা কেন, আজই দেখলাম কত লক্ষ্মী ঘরে এল। কাল থেকে আয়োজন। দে মা ছপ্পড় ফাড়কে দে এবার। আর কত ঘোরাবি আর ভোগাবি এই মধ্যবিত্ত বাঙালিকে! বাঙালি গণেশ পুজো শুরু করে দিয়েছে, লক্ষ্মী পুজোয় তেমন ফল মেলেনি বলেই তো? এবার অন্তত মান রাখ তোর। ওই ইএমআই-এর চক্করে যেন তাকে আর না যেতে হয়। কিছু কালা ধন দে, কিছু সাদাও রাখিস মুখ রক্ষা করতে। আর তো মাইনের গোনাগুনতিতে চলছে না গো! মধ্যবিত্তের এখন মার্বেল বাড়ি, হাইরাইজ ফ্ল্যাট, মদ্য মাংস, পার্টি, গাড়ি, এসি ডিসি কিছুরই অভাব নাই। শুধু তালপুকুরে এট্টু ঘটি ডোবে যেন দেখ রে মা! নাহয় তোকে আর দুটো বেশি নাড়ু দেব। শ্রী-র মতি ভ্রম হোক, রুচি, সম্ভ্রম, মান, মর্যাদা চুলোয় যাক। আর বিদ্যা, শিল্প তো তোমার এক্তিয়ারে না। সে নাহয় সময় এলে আরেক মাকে ডাক দেওয়া যাবে। আগে তো কিছু মুদ্রার ঝনঝন ফেলে যা তুই! এরপরেও লক্ষ্মী নির্বিকারে এলেন আর চলে গেলেন। ফলে আবার এফবির স্মরণাপন্ন হয়েছে সবাই। মায় পদাও। এদিকে আমার কাছে কিছুতেই স্বীকার করবে না সে কথা। সেদিন সাধু সাজার জন্য আমাকে বলল, ‘আরে! এইমাত্র এসে দেখলুম! ফেসবুক চলিতেছে নড়িতে নড়িতে! কী কাণ্ড! থামে না যে!’ তখন আমি বললাম, ‘গত কয়েকদিন এফবি কী কী শেখাল’? ‘যেমন পনিরের পুর ভরা ফুচকা কাঁটাচামচ দিয়ে খেতে হয়। মলের বাইরে লাইভ জিলাবি ভাজার বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, এক তরুণীর 'জিলাবি দিয়ে দাঁতমাজা'র ছবি। এতদিন এফবি যেমন শিখিয়েছে, যারা যারা লাইভ-এ আসছে তারা ফেক নয় এবং তারাই শুধু জীবিত। মৃত্যু নিয়ে বিলাসী ভাবনার জগতে যারা থাকে, কদিন আগে ওপার বাংলার এক কবির তাদের জন্য পরামর্শ- লাইভ-এ এসে মরুন প্লিজ। যাহাই হউক না কেন, এই এফবিতে নিজ ঢাক পিটানো ছাড়া আমি কিছুই করুম না, ঠিক করিয়াছি। খামুও না, দেখুমও না, বাঁচুমও না, মরিব তো নাই প্রাণ থাকিতে! দে, এবার তোরা আমায় বের করে দে এফবি থেকে!’




আমি বুঝলাম পদা খুবই প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়েছে। তা ভালো। আমি আর ঘাঁটালাম না ওকে। আপন মনে বকবক করে কিছুক্ষণ বাদে চলে গ্যাল সেদিন। তারপরে অনেকদিন তার কোন পাত্তা নেই। শুনলাম সারাদিন এফবি নিয়ে মশগুল হয়ে থাকে। তার এখন অনেক ফ্রেন্ড হয়েছে। রাত তিনটের সময়েও তাকে অনলাইন দেখাচ্ছে। কে জানে, প্রেমে পড়ল নাকি! কোন ফেকুর পাল্লায় না পড়ে আবার! যাক, আমার আর কী! নিশ্চিন্তে থাকা যাবে এখন কিছুদিন। কিন্তু নিশ্চিন্তি কী আর আমার ভাগ্যে আছে! সে আবারও একদিন এলোবিষণ্ণ, বিরহকাতর মনে হল দেখে। পরে বুঝলাম, এক নাগাড়ে রাত জাগার ফলে অম্লশূলে ভুগছে। ওসব বিরহ টিরহ নাকি ওর হয়নি। কারণ যাও বা প্রেমে পড়বার সুযোগ হয়েছিল, ও প্রান্তের তিনি পদার লুঙ্গি পরা ছবি দেখে কেটে পড়েছেন। অর্থাৎ পদাকে ব্লক করেছেন। পদাও আবার লুঙ্গিড্যান্স শুরু করেছে নির্বিকারে। তাই ওকে নিয়ে পড়লাম আবার। আমি শুরু করলাম প্রথমে-  
বাবা পদা এয়েচিস?
একী রে! এমন করে কথা বলছিস কেন?
সে তুই বুজবি না রে পদা! কী ছিরিয়ালটাই না কচ্চে ওইটুকু বাচ্ছা মেয়েটা! 
ছিরিয়াল কী রে?
থ্যাটার বুজিস? এ হল নব্য থ্যাটার। একজন এয়েচে আর একজন গিয়েচে। একজন এয়েচে আর একজন গিয়েচে...
কী ভাট বকছিস?
ডাঁড়া না এট্টু! নিকচি তো! এয়েচে আর গিয়েচে...এই এয়েচেন তো ওই গিয়েচেন...
নাহ! আমি যাই! আমার গান পাচ্ছে।
বাবা পদা, স্বয়ং ঠাকুর থ্যাটার দেকতে গিয়ে মুচ্ছো গেচিলেন, আর তুই থ্যাটার না দেকেই চলে যাবি? যেতে নাহি দিব আজ! বাবা পদা, এয়েচিস আবার?
ধড়াম করে পদা মুচ্ছো গেল, স্বচক্ষে দেখলাম!


মাদাম তুভোঁ আসিয়া পড়িলেন মূর্চ্ছার কিয়ৎক্ষণ পরেই। তদুপরি পদার গোঁ গোঁ শুনিয়া ঈষৎ ভড়কাইয়া যাইলেন প্রাথমিক ভাবে। ‘মরে, টরে যাবি নাকি রে?’ এই প্রশ্ন যাহার উদ্দেশ্যে বর্ষিত হইল, সে একটিই মাত্র শব্দ উচ্চারণ করিয়া চলিতেছে আধা ঘন্টা ধরিয়া। ফলে মাদাম প্রশ্নের উত্তরে গোঁ গোঁ ব্যতীত আর কিছুই পাইলেন না। পরে এইরূপ অবস্থার কারণ জানিয়া আমাকে দোষী সাব্যস্ত করিয়া চৌকির উপর উপনিবেশ করিলেন নিশ্চিন্তে। খানিক ঠ্যাঙ দোলাইয়া তাঁহার বাণী বিতরণের সময় উপস্থিত হইল। যেহেতু পদা আপাত বাহ্যজ্ঞান শূন্য (আমার ধারণা, পদা মাদাম প্রস্থান করিলে তবেই স্বীয় অবস্থায় ফিরিবে), আমায় লক্ষ্য করিয়া চলিল তাঁহার বাণীর ধামাকা। ‘শোন বাছা, হিংসা অতীব ভুল সিদ্ধান্ত। কারুর উদ্দেশ্যে কটুক্তি, ব্যাঙ্গ বা বিদ্রূপ করাও তাই। এই যে বাছা আমার গোঁগোঁ করছে, এর জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী তুমি। কোনরকম গিলটি ফিলিং-ও তোমার নেই এর জন্য। লজ্জা, লজ্জা!’ এই পর্যন্ত বলিয়া মাদাম গবাক্ষের বাহিরদেশে দুইজন ব্যক্তির কথোপকথন শুনিতে ব্যস্ত রহিলেন কিছুক্ষণ। আমি স্বস্তির শ্বাস ফেলিয়া বুঝিলাম, এ যাত্রা নিস্কৃতি মিলিল। পদা মেঝেতে শুইয়া চক্ষু পিটপিট করিতেছে দেখিয়া আমি কনফার্ম হইলাম, ব্যাটা দিব্যজ্ঞানী সাজিয়া রহিয়াছে। আর আমার ধোলাইকর্মটি উপভোগ করিতেছে। অথচ মাদামকে বলিলে কিছুতেই বিশ্বাস করিবেন না। এরপরেই মাদাম আবার কাশি পরবর্তী কফ নিক্ষেপ করিয়া এদিকে মনোযোগ দিলেন। ‘যাই হোক না কেন, অতি চালাকি করে কেউ আজ পর্যন্ত জয়ী হয়নি, যেমন মটকা মেরে পড়ে থাকলেই যে কেউ অজ্ঞান হয়েছে, এমনটাও ভাবার প্রয়োজন করি না আমি। ঈদে, বিজয়া দশমীতে কোলাকুলি করে সবাই, তেমনি সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি বলে একটা কথা আছে জান নিশ্চই! আবার বদমাইশে বদমাইশেও কোলাকুলি হয়। ভালোয় ভালোয় কোলাকুলি হয়। অথচ দেখবে উলটো চরিত্রের দুজন কখনই কোলাকুলি করছে না। আশা করি, এরপরে তোমরা ভালো হয়ে উঠবে। চলি, আজমাদামের প্রস্থানের পরেই পদা সটান উঠিয়া দৌড় দিল। আর আমিও অধোমুখে বসিয়া থাকিলাম।    


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন