কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ৮ জুন, ২০১৯

শিবাংশু দে




হরীতকী ফলের মতন



অমৃতসর এক্সপ্রেস দুপুর দিকে ছাড়ে টাটানগর থেকে। গত পাঁচদিনে পর্ণা অনেক চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করার জন্য। আমি এড়িয়ে গেছি। জানি, সেই এক কথা বলবে, তোমাকে ছেড়ে দুমাসের জন্য আমি যাবো না। এত্তো ছেলেমানুষ রয়ে গেছে এখনও, বাবার আদরের দুলালি! পৃথিবীর মাটিতে এখনও ঠিক করে পা ফেলেনিতার দুনিয়ায় সব কিছু অন্যের। অন্যের দুঃখ, অন্যের সুখ, অন্যের অপমান, অন্যের সার্থকতা, তাই নিয়ে তার জীবন। পৃথিবীর থেকে অনেক আঘাত পাবে সে, যদি একটু নিজের দিকে ফিরে না দেখে। জানি না আমি তাকে এই নিষ্ঠুর দুনিয়ার ঝড় ঝঞ্ঝা থেকে কতোটা আড়াল করে রাখতে পারবো।

আমি দূর থেকে দেখি ওর বাবা-মা এসেছেন স্টেশনে ছাড়তে। আমি ওঁদের সামনে আর যাইনি। ট্রেন ছাড়লো যথাসময়ে। গাড়ির আশিভাগ যাত্রী সর্দারজি। গাম্হারিয়া পেরোতেই এস-ফোর কামরার দিকে এগিয়ে যাই। আমার সিট এস  থ্রি-তে। সাবধানে এগোতে এগোতে দেখি কামরার মাঝামাঝি একটা ক্যুপে জানালার ধারে উদাসিনী পূর্বমেঘ হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। উড়ন্ত চুল আর ওড়নার ব্যাকড্রপ ছাপিয়ে মেলানকোলি পার্সোনিফায়েড একটি রূপসী তরুণী। সামনের সিটে একটি শিখ পরিবার। পাশটি খালি। রামগড় থেকে উঠবে।
 

এগিয়ে গিয়ে বলি, নমস্কার আজ্ঞা...
তুমি... তুম...ই, তু...
-আরে হচ্ছেটা কী? সর্দারজি খুব মন দিয়ে দেখছে। জানো তো ওদের শিভালরি জাগলে একেবারে বেণীর সঙ্গে মাথা। হাত ফাত চালালে তোমারই ক্ষতি। তবে সর্দারনি যদি হাত চালায় তবে কন্সিডার করা যেতে পারে। কী ধারালো ফিচার দেখেছো?
 -তুমি কখনো শুধরাবে না, তোমার মার খাওয়াই উচিৎ...
-যদি তাই সাব্যস্ত হয় দেবি, তবে আমা হেন অসুরকে বধ করার দায়িত্ব  আপনিই নিন...
-তুমি এখানে কী করছো?
-আজ্ঞে, আমি আমার হৃদয়েশ্বরীর সঙ্গে এই মুহূর্তে রহস্যালাপ করছি...
-হেল, এই ট্রেনে তুমি কেন...
-আজ্ঞে, টিকিট কাইট্যা উঠসি, নামাইতে পার্বা না...
-ইন্করিজিবল...
-কিসু কইলেন নাকি?
 
-ইম্পসিবল...
-দ্যাখেন ঠাইরেন, ইংরাজিতে গালাগালি দিয়েন না, আমিও এ-বি-সি-ডি সব পরসি...



কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে, অপাঙ্গে দেখে। মতলব বোঝার চেষ্টা করে। শেষে একেবারে হাল ছেড়ে দেয়।
-তোমার যদি আসারই ছিলো, তবে আমায় বললে না কেন?
-দ্যাখো তুমি হইলে গিয়া 'স্টুডেন্ট'
তোমাগো কাইজ ল্যাখাপড়া করা। zদি আমি কইতাম, তয় তোমার সিত্ত সন্সল হইতো। তাই কই নাই।
-তুমি একটু ভদ্রলোকের মতো কথা বলবে?
-অ্যাঁ, অপমান, আমাগো মামাবাড়ির ভাসারে অপমান... লন্ডভন্ড অইয়্যা zআইবো গিয়া...
-মুখটা বন্ধ করে একটু বসো। সর্দারনিকে দেখে মাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি?
-ঠিক ধরেছো, তাই তো তোমায় এতো ভালোবাসি... তবে শোনো, আমি চলেছি ইলাহাবাদ। কুম্ভক্ষেত্রে
আমার বন্ধু রাজীব সিং পাটনা থেকে আসবে। ওর একটা ঠেক আছে ইলাহাবাদে। আমরা দিনকয়েক থাকবো ওখানে
- আমায় বলোনি কেন?
- সব কি বলে দিতে আছে? কিছু তো বোঝার জন্যও রাখতে হয়। শুনেছি কুম্ভতে অনেক মেমসাহেবরাও আসে। তোমার বিরহ ভুলতে এ ছাড়া আমার কিছু করার ছিলো না।
 
-তুমি কোথায় সিট পেয়েছো?
-পাশের কামরায়...
-এখানে আসতে পারবে না? অন্তত ইলাহাবাদ পর্যন্ত সঙ্গে যাওয়া যেতো।
-হ লা সুন্দরী, শুধু কি ইলাহাবাদ? বহুদূর পাড়ি দিতে হবে একসাথে, হিংলাজ মরুতে গিয়া গেয়ে যাই কচুরির গান...
-মানে?
-ঐ হিং শুনলেই কচুরি মনে পড়ে যায় কিনা... যাকগে দেখি মামাকে বলে যদি এদিকে ম্যানেজ হয়...

ম্যানেজ হয়ে গেলো দুটো সাইড বার্থ। ইলাহাবাদ পৌঁছোয় সকালবেলা। তার মানে রাতের ঘুম গয়া। পাগলি ঘুমোতে দেবে না রাতভর। সেই রাতে যতো কথা, আজে কথা, বাজে কথা, সব যেন খেয়ালের স্থায়ীর মতো বারবার ঘুরে আসে ভালোবাসা হয়ে। ভালোবাসা যেন সেই শাশ্বত চাকা, যাকে রোজ নতুন করে আবিষ্কার করতে হয়। রোজ দূরে ঠেলে দিই, এই বলতে বলতে, ফিরে এসো ফিরে এসো চাকা...
আমাদের ব্যক্ত, অব্যক্ত সব সংলাপ, ফুলের ভিতর মধুর মতন, বিনয়ের নীরব স্বগতোক্তি যেন-
'আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমিষেই
গলাধঃকরণ তাকে না-ক'রে ক্রমশ রস নিয়ে
তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে।
অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে
জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল-
আকাশের, হৃদয়ের; কাকে বলে নির্বিকার পাখি।
অথবা ফড়িং তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়।
উড়ে যায়, শ্বাস ফেলে যুবকের প্রাণের উপরে।
আমি রোগে মুগ্ধ হয়ে দৃশ্য দেখি, দেখি জানালায়
আকাশের লালা ঝরে বাতাসের আশ্রয়ে-আশ্রয়ে।
আমি মুগ্ধ; উড়ে গেছো; ফিরে এসো, ফিরে এসো, চাকা,
রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হ'য়ে এসো।
আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন
সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে।'
 



ভোরবেলা যখন ইলাহাবাদে নামছি, বললুম, সাবধানে থেকো, ভালো থেকো...
সারা রাত ট্রেনজার্নি করে কেউই খুব দর্শনধারী থাকে না। কিন্তু পর্ণাকে খুব ফ্রেশ লাগছিলো, তার হাজার ওড়া চুলের চালচিত্র, কাজলমোছা চোখ আর স্বভাবলাল ঠোঁট বলছিলো ভালো থেকো, খুব ভালো থেকো। কিন্তু মুখে বললো, সাবধানে থেকো, মধুরিমাকে নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না।

আবার, আবার, সেই ফিরে এসো চাকা। এ গল্প বোধহয় আর ফুরোনোর নয়...
 

(শেষ হলো)

-----------------------------------
 
(এই লেখার কোনও উপসংহার হয়না। নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু লেখাটির দ্বিতীয় কিস্তি পর্যন্ত পড়ে আমার বাল্যবন্ধু কবি সৌমিত্র সেনগুপ্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে জানিয়েছিলো, 'দারুণ লিখছিস। কন্টিনিউ কর। ভালো থাকিস।'
 

আমি তো আছি একরকম। তুই লেখাটা পুরো না পড়েই কোথায় চলে গেলি মুন্না। শেষ করে তোকে পাঠালুম। পড়িস।)



(সৌজন্যস্বীকার ঃ গুরুচন্ডালী) 

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন