কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ৮ জুন, ২০১৯

ঝুমা চট্টোপাধ্যায়




ধারাবাহিক উপন্যাস


প্রিয়দর্শিনী 





(ষষ্ঠ অধ্যায়)   


(১৪)         


আমাদের চেয়ারে বসে আছে হাজার বছর বয়সী কিছু ঘাস

মুকুন্দরাম নিজের আসনটিতে চুপ করে বসেছিল। সন্ধ্যা নামছে। গৃহের কাছাকাছি নতুন তৈরী হওয়া দেব মন্দিরটি থেকে ঘন্টাধ্বনির শব্দ শোনা যায়এছাড়া আর কোথাও কোনও শব্দ নেই। নিজের কুশের আসনটিতে যেমন ছিল তেমনই বসে রইল মুকুন্দরাম। এই আসনটি চারকোণা। ওপরে নরম ‘তুরান্দাম’ সুতোর কিছু ফুলদার নকশা। পুত্রবধু চিত্রলেখা এই আসনটি স্বহস্তে তৈরী করে দিয়েছে। চিত্রলেখার বয়স মাত্র আট, কিন্তু এই বয়সেই সে অতি উত্তম সেলাই  ফোড়াই-এর কাজ শিখে গেছে। কুশাসনটির ওপরে সন্ধ্যাকাল অবধি বসে  থাকতে দেখে অন্তঃপুর থেকে মুকুন্দপত্নী মৃদু ভৎর্সনা করে উঠল। সন্ধ্যাহ্ণিকের সময় উর্ত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে অথচ মুকুন্দরামের কোনও তাপ উত্তাপ নেই

মুকুন্দরাম ভাবছে দেবালয় থেকে বাতাসে ভেসে আসা ওই ঘন্টাধ্বনি কি ভগবানের কানে প্রবেশ করছে? ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে মানুষ ভগবানকে মনের দুঃখ কষ্টের কথা জানায় বটে, কিন্তু তাতে আখেরে লাভ কী হয়?  মুকুন্দরামের সম্মুখে একটি নাতিউচ্চ জলচৌকি। তার ওপরে পুঁথির স্তূপ।  আহারাদির সম্পন্ন করে সেই যে স্তূপ নিয়ে বসেছে, আপন মনে কী সব  হিজিবিজি লিখছে আর ভাবছে তা নিজেও ঠিক জানে না। বরং তার মনে হচ্ছে ঘন্টাধ্বনি, শঙ্খের আওয়াজ, প্রদীপের উজ্জ্বল আলো এসব নিতান্ত দীন ও অর্থহীন। যা কিছু এই মুহূর্তে বর্ত্তমান, যা কিছু চারিদিকে চলছে ফিরছে ঘুরছে  সবই কেমন হাস্যকর। দ্বিপ্রহর থেকে সন্ধ্যা অবধি তাল পত্রে সে কী কী লিখেছে জানে না, কিন্তু এটা জানে তার মন কোনও নির্দিষ্ট ভাবনায় কিছুতেই থিতু হতে  পারছে না। মুকুন্দরামের কাব্য পাঠ করলে ভবিষ্যতের পাঠক কী ভাববে? ভাববে রাঢ়ের শুকনো ডাঙায় বসবাস করেও মুকুন্দরাম কাব্যে হাত ফলাতে পারেনি।
দক্ষিণ রাঢ়ের গ্রীষ্মের দিনগুলি দীর্ঘ ও অলসরাত্রি দুই প্রহর অবধি বাতাস শীতল হতে চায় না। সূর্য অস্ত গেছে অনেকক্ষণ কিন্তু উত্তাপ একটুও কমেনি।  এর পাশাপাশি সময়ও যেন মুখভার করে রয়েছে। ভুর্জপত্রে মুকুন্দরাম অক্ষর ফুটিয়ে তুলতে চায় কিন্তু অক্ষর ফোটে না। শব্দেরা ফাঁকিবাজি শিখেছেকেবলই  তারা মুকুন্দরামের হাত ছাড়িয়ে অন্যদিকে দৌড় লাগায়। মুকুন্দরাম বাঙালি। কিন্তু তার শিরা ধমনীতে ‘বাঙালি এক আত্মবিস্মৃত জাতি’ এমন রক্ত প্রবাহিত হয় না। বাঙালির সমাজ-বিন্যাস এবং ধর্ম কর্ম জীবনের কথা যদি অক্ষরবৃত্তের মাঝে ফুটিয়েই না তোলা গেল তবে মুকুন্দরামের জীবন বৃথা। এ তো গেল তার নিজস্ব মতামত। এছাড়াও আরও একটি ব্যাপার রয়েছে। শতাব্দী প্রাচীন বঙ্গ-সভ্যতা কি কেবল কবিবৃন্দের মানস চর্চারই বিষয়? মুকুন্দরাম ভাবে, তার কাব্যে  এই প্রশ্নটি ঘুরে ফিরে বারম্বার তাকেই বিব্রত করবে! কাজেই কবি যা কিছু অনুভব করেন, কাব্য পিয়াসী পাঠক তারই সুধারস পান করবেন, অথচ কবির অতৃপ্তি পড়ে রইবে চিরকাল। তবে কাব্যচর্চায় কী প্রয়োজন? কালের গতি ক্রমশ  কুটিল হচ্ছে। মুকুন্দরামের মানস চক্ষে সময় দেশ কাল সব কেমন ঝাপসা হয়ে ওঠে।

আর্য্য সভ্যতার বহু পূর্বে এদেশে পুন্ড্রদেশ এবং বঙ্গদেশ বিদ্যমান ছিল। কিন্তু বৈদিক সাহিত্যে শুধু আর্য্য জাতির ইতিহাস-সৌকর্য্যই লিপিবদ্ধ। পুরাণে অঙ্গরাজগনের কথা আছে কিন্তু পুন্ড্র বঙ্গাদি দেশের রাজা ও রাজবংশের কোনও কথাই নেই। আর্যজাতিই প্রথম নগর সভ্যতা গড়ে তুলেছিল একথা ইতিহাস প্রমাণি, কিন্তু মুকুন্দরামের মনে হয় এখানে কিছু ফাঁকি থেকে গেছে। অঙ্গ মগধ  কাশী কোশল বজ্জি মল্ল চেদি বৎস কুরু পাঞ্চাল মৎস শূরসেন অশ্বক অবন্তী গান্ধার ও কাম্বোজ - এই মোট ষোলোটা রাজ্য। প্রত্যেকটাই ইতিহাস প্রসিদ্ধ নাম। অঙ্গরাজ্য কৌরবদের অধীন ছিল। বন্ধুত্বের চিহ্ণ স্বরূপ দুর্যোধন কর্ণকে এই রাজ্যটি দান করেছিলেন। তবে কর্ণ এখানে সব সময় উপস্থিত থাকতে পারতেন না। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ অবসানে কর্ণের পুত্রদ্বয় পান্ডব ভ্রাতাদের স্নেহচ্ছায়ায় পুনরায় অঙ্গরাজ্য লাভ করে ও বংশ পরম্পরায় বসবাস করতে থাকে। ইতিহাস বলছে এই অঙ্গদেশ থেকেই আর্য্য সভ্যতা পরবর্তী সময়ে পুন্ড্র বঙ্গ সুহ্ম ইত্যাদি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। রামায়ন পাঠ করলে বোধ হয় পূর্ব্বে অঙ্গদেশ কিছু পশ্চিম দিকে বিস্তৃত ছিল। মহাভারতের যুগে তা যেন পূর্ব্বে সরে আসে। বুদ্ধদেবের জন্মের অনেক আগে থেকেই মগধ ও অঙ্গরাজ্যের বিবাদ ছিল। অবশেষে অঙ্গরাজ্য মগধ সম্রাট অজাতশত্রুর অধীন হয়ে যায়। ভারতীয় ইতিহাসে এর অনেক প্রমাণ। মানুষে মানুষে ঝগড়া বিবাদ অশান্তি ইত্যাদির সবথেকে বড় সুবিধাটা হচ্ছে এতে করে ইতিহাসটা তরতর করে সামনে এগিয়ে চলে। লৌকিক ব্যক্তি জীবন ঘটনা বহুল ইতিহাস কেন্দ্রিক নায়কে পরিণত হয়।

কুশের আসনে বসে মুকুন্দরাম ভাবল এ ব্যবস্থাটা তত মন্দ নয়। কিছু না কিছু ঘটনা নিজস্ব জাগতিক নিয়মে ঘটবেই। মানুষের মধ্যে একদল অন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে, তারা তখন কাকুতি মিনতি ক’রে তাদের ভাল মন্দ বোঝাতে চেষ্টা করবে। বুদ্ধদেব যখন সংসার ত্যাগ করলেন, মহারাজ বিম্বিসার মগধের রাজা। বিশ বছর তপস্যা করার পর বুদ্ধ যখন ‘বুদ্ধ’ হলেন, অজাতশত্রু পিতৃহত্যা সাঙ্গ করে ততদিনে সিংহাসনে উপবিষ্ট। বুদ্ধদেব লোক প্রচলিত ভাষায় উপদেশ দিতেন। এতে আপামর জন সাধারণের বেশ সুবিধাই হত। ঠিক এজন্যই অজাতশত্রু দুচক্ষে বুদ্ধদেবকে দেখতে পারতেন না। তাহলে ব্যাপারটা অনেকটা এই দাঁড়ালো, মানুষের মন জয় করার অন্যতম প্রধান উপায় হল সাধার মানুষের সঙ্গে চলতি ভাষায় কথা বলা, ভাবের আদান প্রদান করা। ভাষাই মানুষকে এক সুত্রে বেঁধে রাখে। বুদ্ধ বারাণসীতে প্রথম ধর্ম প্রচার করেন। জায়গাটার তখন নাম ছিল মৃগদাব বা ঋষিপত্তন। এখন নাম সারনাথ। সে সময় অনেক ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় বুদ্ধর মতে দীক্ষিত হন। অনার্যদের প্রতি ঘৃণার ভাব কমে যায়। অনার্য মানেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা মানুষ।মুকুন্দরাম ডান হাঁটু মুড়ে বাঁ হাত গালে রেখে ভাবল বৈদিক সাহিত্য পুরাণ ইত্যাদিতে ঐ পিছিয়ে থাকা মানুষদের কোনও কাহিনী লিপিবদ্ধ করা নেই। ভাবেইনি কেউ! তাছাড়া সাধারণ মানুষের কথা কে কবে তলিয়ে ভেবেছে? বিন্দুসারের পর অশোক তবু অনেকটা ভেবেছিলেন। কিন্তু অশোকের পর? না, তেমন কেউ ছিল না যে অঙ্গ মগধ কাশী কোশলের বাইরে গিয়ে লোক সাধারণের ভাষা ও তাদের সহজ আরণ্যক জীবনকে খুঁজে বের করে। মুকুন্দরামের মনে পড়ল দামুন্যা গ্রামে কোথ্থেকে একবার এক চারণ কবি এসে জুটেছিল। মুখে মুখে পদ রচনা করে সুর লাগিয়ে লোকটা যখন খুশি গান গেয়ে উঠত। তারপর হাটে বাজারে নদীর  ধারে লোকটা যখন যেখানে যায়, পেছনে একদল মানুষ। গানের কথা ও সুর দুটোই গাইয়ের নিজস্ব। কিন্তু ভাব ও বিষয়বস্তু বৃহত্তর জনগণের গ্রামীন জীবন।  কোথাকার কোন গাঁয়ে এক দরিদ্র চাষা চারকুলা জমিতে তুলো চাষ করেছিল, কে কবে ক্ষেতের ফসল ও অন্যান্য শাক সবজি প্রতিবেশির কাছে দুপণ কড়িতে বেচে দিয়ে এসেছিল - এইই ছিল সেই গানের বিষয়বস্তু। গৃহস্থ ঘরে সন্তান জন্মের পর সাতদিন পরে ‘সাদিনা’, দশদিন পরে ‘দিশা’ ও ত্রিশ দিন পরত্রিশা’ উৎসব পালিত হয়, মুকুন্দরাম তা ঐ গায়কের গান শুনেই শিখেছিল। সময়ের  সঙ্গে সঙ্গে লোক সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু অজানিত কারণে হিতকামী মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। কোন জমিটা কার, কোন দেশের রাজ সিংহাসনে কার অগ্রাধিকার, এসব তর্কে আর বাদ বিতন্ডায় বেবাক সময় উধাও। ভাগবতে  সুহ্মদিগকে পাপী বলা হয়েছে। বোধহয় সুহ্মেরা সেই সময় বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ছিল। দক্ষিণ রাঢ়ের প্রাচীন নাম সুহ্ম। এরপর উৎকল দেশ। সুহ্মদেশের ইতিহাস বিখ্যাত জনপদ হল ‘তাম্রলিপ্ত’ বা ‘তাম্রলিপ্তম্’। তাম্রলিপ্ত হুগলী নদীর পশ্চিম হতে উত্তরে বর্ধমান কালনা পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মহাভারতে আছে তাম্রলিপ্তর রাজা দ্রৌপদীর স্বয়ংম্বর সভায় গমন করেছিলেন। এদেশের সন্নিহিত সমুদ্রে জলদস্যুর উপদ্রব ছিল। নানান দেশের বণিকেরা এখানে বাণিজ্যে আসতেন।  তাম্রলিপ্তর সঙ্গে উৎকল দেশ ও অঙ্গরাজ্যের প্রায়ই বিবাদ চলত। 

ফোঁস্ শব্দ করে মুকুন্দরাম একটি বড় দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। বাংলা বাংলাদেশ  বাংলাভাষা এগুলির মূল্য বা উপস্থিতির প্রভাব তার মগজকে দীর্ঘ মেয়াদী একটি চিন্তা প্রবাহে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। গত দশ বর ধরে ক্রমাগত এই একটি মাত্র  চিন্তাতেই মুকুন্দরাম দিনের পর দিন সময় অতিক্রান্ত করেছে। মুকুন্দরাম যশোপ্রাপ্ত কবি বটে কিন্তু যশোলোভী কিছুতেই নয়। একজন চিন্তাবিদ যেভাবে সমকালীন সময় দেশ রাজনৈ্তিক পরিস্থিতি লাভালাভ ও মানবিক মূল্যবোধগুলির ক্রমাগত পর্যালোচনা করে, মুকুন্দরামও ঠিক তেমনি ভাবেই এসব বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে ভেবে গিয়েছে। ভাবনা কালে তার মন যন্ত্রনায় ছটফট করেছে, হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়েছে। সর্বোপরি এই যে জীবন যন্ত্রণা,  ঠিক করেছে একেই তার কাব্যের বিষয়বস্তু করবে। বেঁচে থাকার নিষ্ঠুর জীবন যন্ত্রণা বাস্তব সংঘর্ষ এসবই যদি কাব্যে তুলে ধরতে না পারা গেল তো লেখালেখি নেহাৎই বৃথা!

সন্ধ্যা অতীত হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। দেব মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি আর শোনা যাচ্ছে না। ধারে কাছে মুকুন্দপত্নীরও কোনও শব্দ সাড়া নেই। মুকুন্দরাম স্থির করল আরও কিছুক্ষণ এই কুশাসনটির ওপরেই অধিষ্ঠান করা যাক। বারান্দার এক কোণে রেড়ীর তেলের প্রদীপ জ্বলছে, তার শিখাটি নির্ব্বাত নিষ্কম্প। সম্মুখে রাখা কাঁঠাল কাঠের জল চৌকির ওপর ভুর্জপত্রের স্তূপ তেমনই পড়ে। পুঁথির প্রথম পৃষ্ঠাটি ওলটালো মুকুন্দরাম। তার হস্তাক্ষর খুবই সুন্দর। শুধুমাত্র এই একটি কারণের জন্য সেদিন জমিদার বাঁকুড়া রায়ের জমিদারীতে রাতারাতি আশ্রয় জুটেছিল। জমিদার পুত্র শ্রীমন্ত্রর গৃহশিক্ষকের পদটি লাভ হয়েছিল। শ্রীমন্ত অত্যন্ত বাধ্য ছাত্র। তার মুখখানি মনে করলে মুকুন্দরামের মন আপনা থেকেই স্নিগ্ধ হয়ে পড়ে। সংস্কৃত ব্যকরণ মুগ্ধবোধ ইতিহাস দর্শন শাস্ত্র ইত্যাদি সমস্ত বিষয়েই তার সমান আগ্রহ। নানান প্রশ্ন ও কথা কথান্তরের মাধ্যমে শিক্ষক মহাশয়ের কাছ থেকে ছাত্র বিভিন্ন শিক্ষনীয় বিষয়গুলি দ্রুত শিখে নিতে চেষ্টা করে। বলা বাহুল্য, এই কর্মটিতে মুকুন্দরামের কোনও ক্লান্তি নেই। ছাত্রের  প্রতিটি প্রশ্নর সে খুঁটিয়ে উত্তর দিতে চেষ্টা করে। শ্রীমন্ত স্বভাবেও অত্যন্ত সুশীল। তার ছাত্র জীবনের প্রথম দিকে, মুকুন্দরাম তাকে পড়াতে এলে প্রথমেই সে এক দৌড়ে গিয়ে মাষ্টারমশায়ের হাতে মুখ হাত পা ধোবার জল ও গামছা এগিয়ে দিত। যদিও এ কাজের জন্য একজন গৃহভৃত্য মজুত থাকত, তবুও শ্রীমন্ত এসব কাজ সহস্তে করতেই ভালোবাসত। তারপর অত্যন্ত ক্ষিপ্রহস্তে সে মাষ্টারমশায়কে জলযোগের জন্য খাদ্য দ্রব্য সরবরাহ করত। কারণ পাঠের জন্য বরাদ্দ সময় অযথা ফালতু কাজে নির্বাহ তার একটুও পছন্দ না। মুকুন্দরাম যতক্ষণ আহারে ব্যস্ত থাকত সেই অবসরে শ্রীমন্ত তার পুরাতন পাঠগুলি আর একবার অভ্যাস করে নিত। এ কাজে একটি দিনও তার ভুল নেই। যে আসনটিতে বসে মুকুন্দরাম তার ছাত্র পড়ায় সেটি বেতের তৈরী। তার উপরে ‘ডুরিয়া’ সুতোর কাজ। দুই প্রকারের সুতো একসাথে পাকিয়ে এর টানা তৈরী হয়। বুনানী হলে ডুরিয়ার মত দেখায়।

শ্রীমন্ত একদিন প্রশ্ন করল, মাষ্টারমশায় গতকাল আপনি বলে গেছিলেন, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতি খন্ডের ১৯শ অধ্যায়ে লিখিত আছে যে, রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র বীরগণ শঙ্খাসুরের পক্ষে থাকিয়া যুদ্ধ করিয়াছিল। বরেন্দ্র ভূমি ও রাঢ়দেশ শব্দদুটির তাৎপর্য্য আজ পৃ্থক ভাবে আমাকে বুঝিয়ে দিন!
শ্রীমন্তর এহেন প্রশ্নে মুকুন্দরাম অতি উৎসাহিত হয়ে আলোচনা শুরু করল-

                                  গৌড়স্য পশ্চিমভাগে বীরদেশস্য পূর্ব্বতঃ
                                  দামোদরত্তরে ভাগে রাঢ় দেশ প্রকীর্তিতঃ’

কেউ কেউ বলেন, গঙ্গারাদ্ধ শব্দ থেকে গঙ্গারাঢ় শব্দ উৎপন্ন হয়েছে। রাঢ় তার সংক্ষিপ্ত আকার। মেগাস্থিনেসের গ্রন্থে রাঢ়ের গঙ্গাহৃদয় (ganga-ridai) নাম পাওয়া যায়। সেখানে গণকরের উল্লেখ আছে। গকর তৎকালীন রাঢ়ের অন্তর্গত একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম। খৃঃপূঃ দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত জৈন-অঙ্গ গ্রন্থে রাঢ়ের নাম  পাওয়া যায়। জৈন আচারাঙ্গ সূত্রে লেখা আছে - শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর স্বামী এখানে দ্বাদশবর্ষ অধিষ্ঠান করে বন্যজাতির মধ্যে ধর্ম প্রচার করেন। মহাবীরের অপর নাম বর্ধমান স্বামী। তাঁর নামানুসারে ঐ দেশটির নাম হয় বর্ধমান। আর, জৈনদিগের ত্রয়োবিংশ তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ ৭৭৭ খৃঃপূঃ মানভূম দেশে সমেত শিখরে মোক্ষলাভ করেন। সেই জন্য সমেত শিখরের নাম পার্শ্বনাথ বা পরেশনাথ।
রাঢ় দেশই কি বাঙালি জাতির আদি বাসভুমি ছিল মাষ্টারমশায়?
-হুম! তবে বাঙালি তো আর একদিনে একটি জাতিতে পরিণত হয়নি! বহু বছর  ধরে বহু জাতি ও বিভিন্ন ধরনের মানুষ মিলেমিশে আজকের বাঙালি হয়েছে।  আবার এটাও ঠিক বাংলাদেশে যারা বসবাস করেছে তারাই একদিন বাঙালি বলে  পরিচিত হয়েছে। গৌড় গৌড় মন্ডলী রাঢ় ইত্যাদি সব মিলিয়েই প্রাচীন কালের বাংলাদেশতবে গৌড়ের ইতিহাস আমরা জানতে পারি, রাঢ় এখনও অন্ধকারাচ্ছন্ন। কারণ রাঢ়ের অধিকাংশ স্থান ঘন অরণ্যাবৃত। বন্য জাতির আবাস স্থল। দামোদর নদী রাঢ়কে দুই ভাগে ভাগ করেছে। উত্তর রাঢ় আর দক্ষিণ রাঢ়। বহু বৎসর ধরে এইসব বন্য জাতিরা দামোদরকে মান্য করে এসেছে।
-কিন্তু আজকের বাঙালি জাতি কোথ্থেকে এল মাষ্টার মশায় তা বুঝিয়ে বলুন!
ছাত্রের প্রশ্নে মুকুন্দরাম অত্যন্ত খুশি হল। বলল, উত্তম! তুমি বাংলাদেশ ও  বাঙালি জাতির আদি তত্ত্ব জানতে আগ্রহী। তোমার কৌতূহল আমি যথাসাধ্য  নিবৃত্তি করছি। পুন্ড্রদেশ সুহ্ম উপবঙ্গ রাঢ় প্রভৃতি সমুদায় দেশকেই বঙ্গদেশ বলা হয়। কিন্তু পূর্ব্বে এমন ছিল না। তখন বঙ্গদেশ বলতে কেবল ঢাকা অঞ্চলকেই বোঝাতো। ঐতরেয় আরণ্যকে প্রথম বঙ্গ নাম পাওয়া গেছে।

                      ইমাঃ প্রজাস্তিস্রা অত্যায়মায় স্তানীমানি বয়াংসি
                      বঙ্গাবর্গধাশ্চের পাদান্যন্যা অকর্মভিতো বিবিস্র ইতি।।

অতএব বৈদিক সময়েও বঙ্গ আর্যদিগের পরিজ্ঞাত ছিল। তবে তখন সেখানে রাক্ষস প্রকৃতির লোকের বসবাস ছিল। মহাভারতের বনপর্বে আছে, পরশুরাম প্রথম বঙ্গদেশে লৌহিত্যতীর্থ সৃষ্টি করেন। সম্ভবত পরশুরাম সেখানে প্রথম একটি আর্য উপনিবেশ গড়ে তোলেন। পুরাণ অনুসারে রামায়ণের রচনাকাল খৃঃপূঃ  ২০০০ বৎসর। রামায়ণে দশরথ বলেছেন, অঙ্গ বঙ্গ কাশী কোশল প্রভৃতির রাজারা তাঁর অধীন ছিল

 (ক্রমশ)

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন