কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ৮ জুন, ২০১৯

পারমিতা চক্রবর্ত্তী




মা 



‘মা’ শব্দর থেকে পৃথিবীতে পবিত্র ও সুখকর শব্দ  আর কিছু নেই মা ডাক শোনার জন্য হাজার হাজার কিমি পথ অতিক্রম করা যায় মা এমনই এক শব্দ  যার কোন বিকল্প হয় না মা হওয়ার জন্য প্রতিবছর কত নারী মারা যান কত যে মা, মা-হতে না পেরে আত্মঘাতী হয়! কথায় আছে ‘মা হওয়া মুখের কথা না’!  সত্যিই তাই মা হতে গেলে অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় সেই যন্ত্রণা শুধু নাড়ি ছেঁড়া / প্রসব যন্ত্রণা নয়, মাকে অনেক সামাজিক,অর্থনৈতিক পীড়া বহন করতে হয়সন্তানের সাথে মা'র নাড়ির টান মা'র শরীর থেকে প্রোটিনের যে নির্যাস,  যাকে বলে দুধ, সেই দুধ পান করে একটি সন্তান পৃথিবীর আলো দেখে একটা শিশু যখন জন্মায় তখন খিদে ছাড়া আর কোন প্রবৃত্তি তার মধ্যে থাকে নাঠিক সেই সময় মা তার আদরের বুকখানি এগিয়ে দেয় সন্তানের মুখে একজন মা পরম স্নেহে, যত্নে নিজের শরীরের সবটুকু দিয়ে লালন করে সন্তানকে, যাকে বলে আত্মিক বন্ধন

তবে মা হওয়া নিয়ে বর্তমানে অনেক পদ্ধতি চালু হয়েছেটেস্টটিউব বেবির কথা আমরা সবাই জানিএখন গর্ভ ভাড়া দেওয়া হচ্ছে যে মা নিজে সন্তান ধারণে অক্ষম, সে সারোগেসি পদ্ধতিতে  সন্তান লাভ  করতে পারেএকটা সময় ছিল, যখন দক্ষিণ এশিয়াতে বাণিজ্যিক সারোগেসি বলতেই উঠে আসত ভারতের নাম২০০৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এই পদ্ধতির মাধ্যমে হাজারো ভারতীয় দম্পতি, সন্তানহীন নারী ও পুরুষ সন্তানলাভ করেছিলেন এছাড়া মার্কিন  যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলোতে সারোগেসির খরচ মাত্রাতিরিক্ত হওয়ার কারণে, অথবা কোথাও কোথাও এই প্রথা আইনত নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে, বহু সন্তানহীন দম্পতিই গর্ভ ভাড়া করার জন্য উপস্থিত হতেন ভারতেকিন্তু ২০১৫-র নভেম্বরে গর্ভ ভাড়া করে ইন-ভিট্রো-ফার্টিলাইজেশন' বা আইভিএফ-এর  মাধ্যমে সন্তান নেওয়ার এই প্রক্রিয়া বিদেশিদের জন্য আইনত নিষিদ্ধ হয়ে যায় শুধু তাই নয়, ২০১৬ সালে বাণিজ্যিক সারোগেসি নিষিদ্ধ করতে সারোগেসি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৬' নামে সংসদে একটি বিল আনা হয় তাতে গর্ভ ভাড়া  করার এই প্রক্রিয়াকে অনৈতিক' হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং বলা হয়, আইন না থাকায় গরিব ও অশিক্ষিত মহিলাদের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে ধনবানরাঅর্থাৎ সারোগেসি ক্লিনিকগুলি ধনীদের জন্য নিছক বেবি-ফ্যাক্টরি' হয়ে দাঁড়িয়েছে 

মা হওয়া নিয়ে যতরকম পদ্ধতি চালু থাকুক না কেন অসম্ভব ভাবে কমে যাচ্ছে কন্যা অনুপাত ভারতবর্ষের মত দেশে যতই নিয়ম করে লিঙ্গনির্ধারণ বন্ধ হোক  না কেন কন্যাভ্রুণ হত্যা হচ্ছে অহরহ দেশের ২১টি বড় রাজ্যের মধ্যে  ১৭টিতেই লিঙ্গ অনুপাত পড়ে গিয়েছে আশঙ্কাজনক হারে।  গুজরাটের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ২০১২-২০১৪ সালের মধ্যে যেখানে প্রতি ১০০০ পুত্রসন্তান  জন্মালে, কন্যার জন্ম ছিল ৯০৭, তা ২০১৩-১৫ সালের মধ্যে কমে হয়েছে ৮৫৪, একলাফে ৫৩ পয়েন্ট পড়েছে। গুজরাটের পরেই রয়েছে আরেক  রাজ্য হরিয়ানা৩৫ পয়েন্ট কমেছে সেখানে অনুপাততারপরেই  রাজস্থান (৩২ পয়েন্ট)উত্তরাখণ্ড (২৭ পয়েন্ট)  কর্নাটকে লিঙ্গ অনুপাত পড়েছে ১১ পয়েন্ট। রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, লিঙ্গ অনুপাত বেড়েছে পাঞ্জাব, উত্তপ্রদেশ ও বিহারে। 

গবেষকরা বলছেন, বছরে প্রায় কুড়ি লক্ষ ভারতীয় মহিলা স্রেফ হারিয়ে যাচ্ছেন! বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ১৯৯০ সালে প্রথম এই হারিয়ে যাওয়া নারীদের কথা বলেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, গত কয়েক বছরে ভারত এবং চিন থেকে দশ কোটি নারী হারিয়ে গিয়েছেন। অমর্ত্য সেনের গবেষণার ভিত্তিতে অর্থনীতিবিদ সিয়ান অ্যান্ডারসন এবং দেবরাজ রায় ভারতের হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের উপর একটি বিশেষ গবেষণাপত্র ২০১২ সালের মার্চ মাসে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশ করেন। সেখানেই বলা হয়, বছরে কুড়ি লক্ষ মহিলা ভারত থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছেন। ২০১১ সালে ভারতের সর্বশেষতম জনগণনার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা গিয়েছে, শিশুকন্যার জন্মের হার শিশুপুত্রের তুলনায় ক্রমশ কমছে। ২০১১ সালে প্রতি এক হাজার শিশুপুত্রের অনুপাতে ৯১৪ জন শিশুকন্যা জন্মগ্রহণ করেছে। শিশুপুত্র ও শিশুকন্যার এই অনুপাতটি স্বাধীনতার পর থেকে এখনও পর্যন্ত সবথেকে খারাপ অনুপাত। ২০০১ সালে এই অনুপাত ছিল হাজারে ৯২৭ জন। আদর্শ পরিস্থিতিতে শিশুপুত্র ও শিশুকন্যার অনুপাত হওয়া উচিত ১০২০ : ১০০০কারণ সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ছেলেদের জন্মের সময় মৃত্যুহার বেশি হয়। ছয় বছর বয়সের পর পুত্র ও কন্যার অনুপাতের পার্থক্য কমে আসে। অ্যান্ডারসন ও দেবরাজ রায়ের পেশ করা গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, জন্মানোর পর ও শিশু অবস্থায় হারানোর চেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা অনেক বেশি মাত্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। নিখোঁজদের মধ্যে ৪৫ শতাংশই প্রাপ্তবয়স্ক। আরও জানা গিয়েছে, পাঞ্জাবে কিন্তু হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের মধ্যে ৬০ শতাংশ মারা যায় জন্মের সময়। ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ পরীক্ষা ওই রাজ্যেই সবথেকে বেশি হয়। ১৫ বছরের কমবয়সী মেয়েদের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি (১৫%) ঘটে হরিয়ানা ও রাজস্থানে। যে রাজ্যে সব থেকে কম (১০%) মেয়েদের হারিয়ে যাওয়ার কথা জানা যায়, সেগুলি হল কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ু। 

২০১৭ সাল নাগাদ, বিশ্বে মাতৃমৃত্যুর হার ১৯৯০ সাল থেকে ৮৮% হ্রাস পেয়েছিল, কিন্তু এখনও প্রতিদিন ৮৩০ জন মহিলারা গর্ভাবস্থায় বা সন্তানের জন্মের কারণে মারা যান। ইউনাইটেড নেশনস জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ২০১৭-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এটি প্রতি দুই মিনিটে এক মহিলার এবং যারা মারা যায় তাদের প্রত্যেকের ২০ বা ৩০টি কারণ থাকে, যা গুরুতর বা দীর্ঘস্থায়ী সমস্যায় সম্মুখীন করে। এই মৃত্যুর অধিকাংশই এবং সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধযোগ্য।

ভারতের গ্রামাঞ্চলের অনেক মেয়েই অল্প বয়সে বিয়ের কারণে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়এখনও অনেক শিক্ষিত পরিবার  মুখে শিক্ষার বুলি আওড়ালেও  পুত্র সন্তান জন্ম না নিলে বউমার উপর শুরু করে অত্যাচার সুষ্ঠু পরিবার  পরিকল্পনার অভাবে এক গর্ভধারণের ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই মেয়েদের একটার পর একটা সন্তান  হয়ে যায় পরিবারের মানুষজন ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবাটুকুও দেয় না ৷ হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বাদ দিয়ে বাড়িতেই জন্ম নেয় বহু শিশু ফলে সংক্রমিত হচ্ছে মা ও শিশু১৯৯১ সালে প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর হার ছিল প্রতি লাখে ৫২৩ জন, আজ এই হার প্রতি লাখে ২৫৪ জন সংখ্যাটি যদিও আশ্বস্ত করে আমাদের, তবুও এই সংখ্যাটি আরও কমে যাওয়া কাম্য

ইউনিসেফের হয়ে শিশু উন্নয়ন ক্ষেত্রে কাজ করেছেন গীতাঞ্জলি চতুর্বেদী ভারতে প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর সমস্যাটি নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন তিনি তাঁর ভাষায়,  ‘‘এ ক্ষেত্রে তিনটি মূল সমস্যা রয়েছে, কিছু কিছু সমস্যা স্পষ্টতই রাজনেতিক, কিছু সমস্যা সামাজিক, এবং আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যাও রয়েছে” অল্পবয়সে মেয়েদের বিয়ে হওয়াটা একটা সামাজিক সমস্যা এর ফলে টিন-এজ- থাকতেই বাচ্চা হয়ে যায়ে অনেক মেয়ের, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ আমাদের মায়েদের স্বাস্থ্যের দিকে আরও নজর দেওয়া উচিত, কিন্তু পরিস্থিতি  হয় এর বিপরীতটাই ভারতীয় নারীদের মধ্যে বেশির ভাগ নারী নিজেকে অবহেলা করে সন্তানকে বড় করতে গিয়ে হারিয়ে যায় অনেকটা সময়
একজন মা  নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে যে সন্তানকে মানুষ করে পরবর্তীতে তার ঠিকানা যেন না  হয় বৃদ্ধাশ্রম সন্তানের প্রতি দায়িত্ব যেমন মা'র তেমন সন্তানের কিছু দায়িত্ব থেকে যায় যে ভালোবাসার বীজ বোনা থাকে  সন্তানের মধ্যে সেই সন্তান  মাকে প্রতারণা করেবর্তমানে বহু মা নিজের অধিকার, নিরাপত্তার জন্য আদালত অবধি পৌছে যাচ্ছেন আমরা স্বাধীন হচ্ছি  ঠিকই কিন্তু চিন্তাভাবনায় নেই কোন মৌলিকতা আমাদের সংস্কৃতি শেখায় আমাদের অতীতকে আঁকড়ে ধরতে‘মা’ শব্দটির যেন ভুল ব্যাখা কখনই না  হয় অনেকেই বলেন, কর্মব্যস্ত জগতে মার গুরুত্ব কিছুটা প্রশ্ন চিহ্নের মুখেWrking womenদের ঘর-বার সামলে সন্তানকে উৎকর্ষ সময় দেওয়াটাই এক বড় চ্যালেঞ্জ তবুও ‘মা’র প্রতিশব্দ ‘মা’ই যার কাছে কোন মিথ্যা কথা বলা যায় না, নিজের দুঃখকে চাপতে হয় না কারণ মা সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সবটুকু বুঝে যান সন্তানের শত অপরাধটুকু প্রশ্রয় দেয় একমাত্র মা তাই কোন একদিন নয়, রোজই হওয়া উচিত ‘মা দিবস’ 



1 কমেন্টস্:

  1. অবশ্যই প্রতিদিন ই "মা"দিবস। মায়ের তুলনা মা নিজেই।তাই প্রতিটি মূহুর্ত ই মা তোমার জন্য।

    উত্তরমুছুন