কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ৮ জুন, ২০১৯

সুবীর সরকার




উত্তরকথা




(৭৯)


হাটের ভিতর দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে ফাগুন চোতের রোদ হাওয়া অতিক্রম করতে করতে রতিকান্তকে কখন কীভাবে যেন মহামহিম এক হাটখন্ডই হয়ে উঠতে  হয়! হাট থেকে হাটের দিকে যেতে যেতে সে তার ঢোল, ঢোলের কাঠি সমেত কত কত খেত পাথারবাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ে। অনুপ্রবেশের হাল হকিকত থেকে নতুন ধানের চিড়া খইয়ের সুঘ্রাণ তাকে আমোদিত করলে রতিকান্ত ঈষৎ অন্যমনস্ক হয়ে  পড়ে, কিন্তু মগজের কোষে কোষে গান ঘুম আর স্বপ্ন নিয়ে সে অনুপ্রবেশের  চিরকালীনতাকে হাটগঞ্জের বাতাসেই যেন উড়িয়ে দিতে চায়।




(৮০)


জীবনের উজানে কি যাওয়া হয় মানুষের! জন্ম জন্ম ধরে জন্মান্তরের পাকে পাকে ভাটির দিকে এগিয়ে যাওয়াই যেন গাঁথা হয়ে যায়। রতিকান্ত বয়াতি ঢোল বাজাতে বাজাতে মাথাভর্তি বাবড়ি চুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কখন বুঝি চলেই যায় হাওড়  বাওড় বাওকুমটা বাতাসের নৈরাজ্যের ভিতর। তার কাঠিঢোল নিয়ে সে জীবনভর যেতেই থাকে সোনাপুর মথুরা নিমতি তপসিখাতা বঞ্চুকুমারী দেওডাঙ্গা শালকুমারের হাটে হাটে। ধুলোর ঘূর্ণী তাকে ঢেকে ফেললেও সে কবেকার যেন বংশ পরম্পরা সূত্রেই ভীষণভাবে ঢোল দোতরা আর নাচগান নিয়ে হাটের ভিতর চলে আসে; চলেই আসতে হয় তাকে। বুঝি রতিকান্ত বয়াতি ছাড়া, বয়াতির ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি বিনা হাট শেষাবধি কিছুতেই হাট হয়ে উঠতেই পারে না! রতিকান্তের গান, নাচের বিবিধ মুদ্রা, কাঠি ঢোল দীন দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে নদী জঙ্গল জনপদের ফাঁকে ফাঁকে অনবরত হাটখন্ডগুলি পাশ ফিরতেই থাকে।




(৮১)


ভাঙা হাটের হাটফিরতি মানুষের চোখেমুখে চলন বিচলনের ভিতর আকুলতা বিকুলতা থাকে বুঝি! তেমনভাবে রতিকান্তের কথা কেউ না জানলেও রতিকান্তের বয়াতি হয়ে ওঠার গল্পগাথা টুকরোগুলি হাটের পরতে পরতে আঠার মত আটকে থাকে। রতিকান্তর গুরু ঝাম্পুরা, কিংবা তারও গুরু নালচান সব যেন আইলে আইলে হাটতে থাকে। হোঁচট খায় আইল কাশিয়ার থোপে থোপে। সবজিহাটার পথে কুঁপির আলোয় চতুর শেয়ালের চোখের ভিতর আগিলা দিনের গান বাজে। বাজতেই থাকে। যেভাবে ঢোলের লোকজতা নিয়ে সর্বশরীরে বিষাদ মেখে নেয় রতিকান্ত বয়াতি। বাতাসের খুব নিকটে কান পাতলেই পাখিদের ডাক, পাতা খসে পড়া; আর সব ছাপিয়ে হু হু হাহাকার হয়ে বেজে ওঠা গান,
     ‘ও মুই কং তোমার আগে
     ও মোর কইতে শরম নাগে
     সগায় যাছে মেলা দেখিবার
     মোক না নিগান কেনে’





(৮২)


গান বলি নাচ বলি কালখণ্ড বলি সবেরই ভিতর যাপিত জীবনের প্রবহমানতা গল্পের পর গল্প জুড়ে যেন ঘাসের স্তূপ বেরিয়ে আসা বাঘেরা বুঝি জল খেতে চলে আসে দিনকাল ভুলতে বসা হাটবাজারের ভিতর! এতসব ঘটে, ঘটেই চলে; রতিকান্ত বয়াতির বিশ্বাসযোগ্য কোন বৃত্তান্ত রচিত হয় না। গান শুরু হয় নাচ শুরু হয়। বাদল মেঘের নিচে রতিকান্ত দাঁড়িয়ে থাকে। রতিকান্তর কোন বৃত্তান্ত রচিত হয় না। বরং রতিকান্তই নতুন নতুন সব বৃত্তান্তের জন্ম দিতে থাকে জলহাওয়া জনপদের ভিতর।







0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন