কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

সমরেন্দ্র বিশ্বাস




ত্র্যস্ত বেলাভূমি, নিঃসঙ্গ সময়


ধূ ধূ করা বেলাভূমি নিঃসঙ্গ সময়
সফেদ পাখিরা কবে উড়ে চলে গেছে
বেলাভূমি জুড়ে লুকোনো পেরেক
জলে ভাসে রক্ত ছাপ!
দুচোখে জাহাজ স্বপ্ন পুরনো মাস্তুল
সমুদ্র সন্ধানীরা পাখি হয়ে আসে!
আজ সমুদ্র সফরে ভয়
হা-হুতাশ বাতাসের শিসে কুটিভাঙ্গা মুঠি
উড়ে আসে শাসক সন্ত্রাস
বালিয়াড়ি জুড়ে যুবকের মাথা  বিবেকের শব
জাহাজ জাহাজ স্বপ্ন চুরি করে
প্রতিশ্রুতিহীন মিউজিয়াম অর্থশালা প্রতিষ্ঠানগুলি
সরে সরে পড়ে  ভেঙ্গে যায় দেশের সময়
নীলতিমির চামড়ায় ঢাকা পড়ে জ্বলন্ত সফর কথা
এ ভাবেই কেটে যায় অনেকটা দশক
ত্র্যস্ত বেলাভূমি নিঃসঙ্গ সময়!


স্পার্টাকাসের মাথা

পথের উপর পড়ে আছে স্পার্টাকাসের মাথা। তার দুচোখের গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসছে লাভাময় আগ্নেয় হিংসা! কাটা মাথার উত্তপ্ত আঁচ পেরোতেই পৌঁছে গেলাম এরিণায় ! পরিত্যক্ত রোমান সাম্রাজ্য, যুদ্ধক্ষেত্র, এরিণার বিরাট ময়দান। স্টেডিয়ামের সুসজ্জিত গ্যালারি জনহীন, সেখানে দর্শকদের আসনে নির্দিষ্ট কয়েকটা মাত্র লোক, আচ্ছাদনের নিচে কয়েকটা সিংহাসন। মৃত্যুর খেলা দেখছে। আসল জনগনেরা মাঠে। এরিণায় হাজার হাজার লোক, তারাই খেলোয়াড় - একে অন্যের বিরুদ্ধে খেলছে।

দর্শকাসনে উপবিষ্ট কয়েকজন মাননীয়, হাতে তাদের বৈদিক-গ্রাম নির্মিত সুরা, সুসজ্জিত মনোহারী পাত্র ।পেছনের বিরাট ক্যানভাসে আঁকা রাজপরিবারের চলমান পটচিত্র। রাজ্যের যাবতীয় সুকীর্তির গুনগাথাময় বিজ্ঞাপন। মাননীয় উপবিষ্টদের চোখে অধিক সুরা জনিত ঘুমের আবেশ, থেকে থেকে দুচোখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে হিলহিলে সাপের ফনা!

ময়দানের বাদামী ঘাসে রুক্ষতা, হাজার হাজার দর্শক, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সবাই খেলা দেখাতে চায়, চিৎকার - সবাই জিততে চায়। একজন তার হাত খুলে নিয়ে ব্যাট বানায়, আরেকজন তার মুন্ডুটাকে ভাড়া দেয় বল হিসেবে! মুন্ডু হয়ে যায় বল, ধাক্কা মারে ময়দানে দাঁড় করিয়ে রাখা উইকেটের মতো তিনটে মৃত মানুষকে! বলের ধাক্কায় একজন উইকেট-মানুষ ছিটকে পড়লে আরো কিছু মানুষ ছুটে আসে; তারা হিংস্র এক প্রতিযোগিতায় চোখয়ালা ডিউজ-বল ভেবে  পতিতের মুন্ডুটা খুলে নেয়!ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে রক্ত। আয়ুধহীন প্ররোচনাহীন অনেক শান্তিপ্রিয় মানুষই স্টেডিয়ামের মাঠে স্ট্যাম্পেড!

আরেকটা মুন্ডু প্রচন্ড গতিতে গ্যালারীর আসন ছাড়িয়ে সজোরে উড়ে গিয়ে পড়ে ব্যস্ত রাজপথে ওভার বাউন্ডারি! দারুণ শট! দর্শকাসনের মহামান্য কতিপয়, সভাসদ, ডিরেক্টর, মন্ত্রী আর সেক্রেটারি তুমুল আনন্দে হাততালি দিতে থাকলে এরিণায় হাজার হাজার মানুষ মেতে ওঠে মৃত্যু মৃত্যু খেলায়! এক জন অন্য জনের উপর ব্যাট চালাতে গিয়ে মুন্ডুগুলো উড়িয়ে দেয় বাউন্ডারি সীমানার বাইরে।

মাঠ জুড়ে থাক্ থাক্ রক্ত। মাঠের বাইরে হলুদ, সবুজ, নীলফুলের গাছগুলো- কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, কেউ শিখ পদদলনে পিষ্ট হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। ময়দানের কোলাহল আর হাঙ্গামা বাড়তে থাকলে মহামান্য সাতজন দর্শকের হাতে উঠে আসে বিয়ারের ক্যানমৃত কিংবা আহত মানুষগুলোর চীৎকার অসহ্য হয়ে উঠলে দর্শকাসনের মহামান্য সভাসদেরা সুসজ্জিত শকটে সুরক্ষিত প্রস্থান করে। ময়দানের মানুষগুলো একে অন্যের বিরুদ্ধে তখনো তলোয়ার চালিয়ে যাচ্ছে। নিচে বয়ে যাচ্ছে রক্ত গঙ্গা মাথার উপর বিবর্ণ আকাশ আর ভাসমান মেঘের গায়ে আঁকা থাকে দেশের মানচিত্র! শান্তি মিছিলের প্রস্তাব সন্ত্রস্ত কবুতরের ডানায় উড়াল দেয় পুব থেকে পশ্চিমেকোলাহল, আর্তনাদ, আতঙ্ক, উল্লাস! রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকে অসংখ্য শরীর, স্পার্টাকাসের মাথা!


আত্মজাকে, অনাগত অন্ধকারে দাঁড়িয়ে

নদীর এপারে রাখা আমাদের সকাল সন্ধ্যা
সময়ের উজানে  জলস্রোত, তুই যাবি ওপারে
রাত এখন অন্ধকার
নদীর এপাশে কাশ ফুলের মতো মাথা দোলানো স্নেহ
আত্মীয় বৃক্ষের লতা পাতায় ভালোবাসা, বেঁধে-রাখা অনুশাসনের হাওয়া
মাথার উপর মেঘে মেঘে স্বপ্ন - এসব কিছুই তোর স্কুলব্যাগে ছেড়ে এলি
শুধু আজ সময়টাই বেখাপ্পা অন্ধকার রাত নিজেকেই নিজে ছিঁড়ে ফেলছে রাগে!
তবুও নদীর ওপারে দূরে দেখা যাচ্ছে নক্ষত্রের আলোর সারি,
পথভোলা নৌকার লন্ঠনেরা আলো জ্বালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দূরে, অনেক দূরে
নদীর মাঝে জেগে উঠেছে অজানা চর, সময়ের বুকে সাঁতারের ক্ষতচিহ্ন
ঘড়ি উড়ে চলেছে উজানের দিকে, হাওয়ার কানে কানে মা-পিসিদের গল্পকথা
নদীর ওপার তোকে ডাকছে? ডাকবেই তো!
ও আমার মেয়ে, অনাগত অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শুধু এটুকুই বলা-
রাত্রের ফিসফাসে চোরাগোপ্তা লুকিয়ে আছে চক্রান্ত
সঙ্গে নিয়ে যাস বাঘছাল পোষাক, স্রোতের মেধাবী টান, লাইটহাউসের আলো
যেতে তো হবেই। তুই তো জানিস, আমাদের কারো হাতেই অনেক বেশী সময় নেই!



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন