কা তব কান্তা
কাল সারা সন্ধ্যা আপনার অপেক্ষায় ছিলাম আমি চাতক ঠোঁটে। আপনি এলেন না, ফোন করলেন না।
আপনি ভালো লেখেন জানি। বৃষ্টি নিয়ে আপনার লেখা পড়লে মনে হয় কাগজের
পাতায়, চোখের পাতায় বৃষ্টির নূপুর। সেদিন আপনার লেখায় খাবারের বর্ণনা পড়লাম, এতো সুনিপুণ বর্ণনা যে
প্রতিটা লাইন আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। মুচমুচে পরোটা, ভুনা মাংস, ধোঁয়া উড়ছে পতাকার মতো, পিরিচে লাজ লজ্জাহীন গুলটু টুবলু রসগোল্লা।
রান্নাঘরে চায়ের কাপে টুংটাং আওয়াজ। চা হচ্ছে...
আপনি এতো নিখুঁত বর্ণনা করেন যে আমার খিদে পায়। মা যেমন বাচ্চাদের
খাবার সময় কত কী বাহানা করে, টিভিতে কার্টুন ছেড়ে দেয়। আমারও তেমনি। খাবার সময়
আপনার যাদুকরী লেখাটা পড়তে শুরু করি। সামন্ত প্রভুর মতো খিদে এসে হানা দেয়, খেতে শুরু করি।
একবার আপনার লেখায় নায়িকাটা চশমা পরে সম্পাদককে টেক্সট করে।
কতদিন টিভির একদম সামনে চোখ বড় করে বসে থেকেছি যাতে আমার চোখ খারাপ হয়, যেন আমি ওরকম ঝকঝকে চশমা
পরি। ঘোড়াড্ডিম
আমার চোখ একদম ৬/৬।
সেদিন এক সম্পাদককে আপনার লেখার প্রশংসা করাতে সম্পাদক মুখ
গোমড়া করে রইলেন। আশ্চর্য! ব্যাটা ছেলেরা এরকম ঈর্ষাক্রান্ত হয়!
গত মাসে মানিকগঞ্জ গিয়েছিলাম। একটা চায়ের স্টল দেখে চা খেতে
ইচ্ছা করল। আচানক চোখ পড়ে একটা কিশোর ছেলের দিকে, যত্নে চায়ে পাউরুটি ডুবিয়ে
খাচ্ছে। আমার
চট করে আপনার ‘শালিক যখন হলুদ ঠোঁটে সুষমা খায়’ গল্পটার কথা মনে পড়ল। আমিও চা-পাউরুটি
অর্ডার করলাম। এতো গরমে, ভিড়ে সেই কাজল কিশোরের মতো আমিও চায়ে পাউরুটি ডুবিয়ে খেতে
শুরু করলাম।
পাউরুটিতে চা ভিজে গেলে কী যে নরম আর পেলব হয়, টুপ করে গিলে ফেললেই হয়। মুখে
চায়ের ঘন দুধের স্বাদ লেগে রইল।
কাল খবরের কাগজে পড়লাম, আপনার স্ত্রী দিনাজপুরে বেড়াতে
গিয়ে একটা হোটেলে উঠে আত্মহত্যা করেছে। আপনার
স্ত্রী নামী অভিনেত্রী ছিলেন। কী চমৎকার তার ক্যারিয়ার! সমস্ত বাংলাদেশ
আপনাদের জুটির কতো প্রশংসা করত, মানিকজোড় আপনারা।
এক সময় আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করত, লেখার সময় আপনার মুখ চোখ
কেমন হয় জানতে ইচ্ছা করত। এখন আর দেখতে ইচ্ছা করছে না। কতো কী অদেখা থাকে এক জীবনে!
নিয়ম করেই রোদ পড়বে হাঁসের ডানায়, নদী ঘাটে একাকী মাঝি
বিমর্ষ বসে থাকবে। ধারালো শাবলের মতো বিক্রম ঢেউ হানা দেবে ঘাটে। ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে
বেঁচে থাকবে আমার বোন।
চোখের জল আড়াল করব আমিও, টেবিলের উপর ধুলো পড়বে
আপনার বইয়ে। আমার না-দেখা আপনি হয়তো শূন্য ছবির হাট ঘুরে আসবেন। চোখের কোণায় ঈগলের পায়ের ছাপের মতো বেড়ে
যাওয়া একেকটি বয়সী দিনের মতো।
হয়তো মানিকগঞ্জে আবারও যাব রোদরঙ শাড়ি পরে। সেই কাজল
কিশোর বা আপনাকে আর দেখব না।
নিয়ম করেই অনিয়মগুলো।
উত্তরমুছুনঅনিয়মগুলোই নিয়ম।
অপারগতাটুকুই ভালো লাগা।
অপারগ বলেই থেকে যায় পরাণে।