যাবজ্জীবন...
সেই ভোরবেলা
থেকে ভাবছি, যাদের কারবার আলু আর পেঁয়াজ নিয়ে তাদের আবার
আলুথালু পথ, পলায়নের রাস্তা! কে যেন নতুন রাস্তায়
প্রতিস্থাপন করে গেছে যাবতীয় সৌন্দর্য। তীর্থযাত্রার নামে আর হাত পাতবো না কারো
দুয়ারে। এই ভিক্ষার ঝুলি নামিয়ে রাখলাম। এ এক নতুন খতিয়ান। বনপথে আর একটু সময় তারপর আমূল বদলে যাব। ঔষধের বোতল অথবা পৃথিবীর মতো ঘাড় কাত করে ঘুরতে
থাকা আবিরের লাটিমের মতো আর দিকভ্রান্ত নয়।
আমি অবিবাহিত
নই। বিয়ের সার্টিফিকেট তোলা আছে ড্রয়ারে। হয়ত হারিয়ে ফেলেছি অনুনাদ। স্বেচ্ছায়
কিংবা অনিচ্ছায়। এখন ভরসা
গ্রীষ্মের দাবানল, পোড়া তিতকুটে মিষ্টি আলু। দমকল কর্মীরা হারিয়ে
যাওয়া পুমাপাঙ্কুর নাম শোনেনি। তুমিও কানে হাত দাও। আমার ভীষণ দরকারের সময়
সাঙ্কেতিক চিহ্নগুলোকে মনে হয় হায়রোগ্লিফিক্স।
ভেবেছিলাম, পড়ালেখার ফাঁকে শিখে নেব যাদুমন্ত্র।
কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি যাবজ্জীবনের ডাকটিকেট হাতে গুঁজে দিয়ে বাবা চলে গেলেন ভিন
দেশে। সেই প্রস্থানের জল গায়ে লাগতেই ঘনঘোর অন্ধকার। বিষয়সম্পত্তি বলতে তৃতীয়
শ্রেণীর অহংকার। নরকতুল্য কাশি। দেবতুল্য হতাশা। শীতবস্ত্র যতই ছাড়তে চাই, বিরহ জাপ্টে ধরে। হাসপাতালে ছুটাছুটি করলেই কি ভর করে উল্লাসের ছায়া? প্রতিদিন দাদির কাছে শুনি আরবদেশের গল্প। এক বেদুইন
মেয়ে। খা খা মরুভূমি। জল নেই। হাওয়া নেই। রোদ আর হতাশায় শুকিয়ে যাওয়া শেষবিন্দু
রক্ত। তবুও পায়ে ঘুঙুর। এই নাচ চলছে। ঐ পূর্বকোণে মেঘ। লু হাওয়া।
এবার দাদির
সিন্দুক। আবিরের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। মায়ের গহনার বাক্স। প্রতিদিনের
মতো মা এক তাড়ি গালি দিয়ে বললেন, এই
ঘরে তোর কিছু নেই। আমার
প্রয়োজনের জলটুকু রাজুর ঘরে আছে কি? একসময় কি কোথাও ছিল? ঠাট্টাচ্ছলে অযত্নে ক্রমাগত গলে
যাচ্ছে মোমদুপুর। হাতের কাছে নিমগাছের ছাল বাকল...
তারপর
আলমারি, রান্নাঘর
এমনকি রঙিন কাচের বোতল। তন্নতন্ন করে হাতড়ে যাচ্ছি দেশ। অথচ
মনে পড়ছে না ঠিক কী চাইছি বৃত্তের বাইরে। চার দেয়ালের ওপাশে এমন কী থাকে, চালতাবন। সোনারূপার দিন। গোলমরিচের ডালপালা। আমি জানি, এসব থাকে স্বাতীর গোপন ড্রয়ারে। অথচ
আমি বিকল। এমন
কোন উৎসব নেই যার সন্ধান স্বাতীর কাছে নেই। আমারও
প্রয়োজন। সাইত্রিশ আটত্রিশ বছর কেটে গেছে। সে
গল্প ছাড়া দিব্যি কেটেছে রাতগুলি। কিন্তু
এখন চলছে না। ঐ বিচক্ষণ ছাত্রছাত্রী প্রদীপ জ্বেলেছে। তারপর থেকে ত্যাগ করেছি
গোপনীয়তা। আজই প্রথম সরবে চলছে অনুসন্ধান পর্ব। লজ্জা সুধা ঢালে। এই
লজ্জা শব্দটিকে কী করে বাদ দিল রাজু কিংবা স্বাতী? ডিভোর্স হয়ে যাবার পরেও কী সুন্দর সাজসজ্জা। চুড়ি।
টিপ। কলঙ্ক। ও প্রায় বলে, একটা দুইটা কলঙ্কের টিপ না পড়লে কি জীবন চলে? এই দেখ,
গলায় উল্কি। একে বলে লাভ বাইটস। কাল না দুর্জয় খুব চেপে ধরেছিল। না
করতে পারিনি।
-ইস!
কী অসভ্যতামি। চুপ কর।
যতীন
স্যার বলতেন, ইতরে ভরে গেছে দেশটা। আসলেও
রক্তপাত নাকি সময়ের প্রয়োজনে বদলটা অবশ্যম্ভাবী? রাজু তো তাই বলে। রাতবিরেতে ফেরত মদ্যপানরত এক মাতালের মুখে নীতির কথা
শুনতে বমি পায়। এ জীবনটাও অন্য কারো উগরে দেয়া পিচ্ছিল পদার্থের রঙ। স্বাতী যা
পারে আমি তা পারি না। আজকাল আবিরটাও রাজুর অঙ্কিত পথে। কেউ থামায় না। না দাদি। না
মা। যেন এটাই স্বাভাবিক এমনভাবে মা দরজা খুলে মা বলেন, টেবিলের
ওপর ভাত চাপা দেয়া আছে। খেয়ে
নিস।
ওদিকে
মঞ্চের পর্দা উঠছে। লোকজন বলাবলি করছে, রুমু এ পাড়ায় আর কতদিন?
আমি
চলে গেলেই কি সব অম্লতা ধুয়ে যাবে? আজ এ বাড়ির হারমোনিয়াম বাজে। কাল
শোনা যাবে ও বাড়ির ইটপাথরের কথা। কোন
পার্থক্য নেই। বৃত্ত
ভাঙার গান যেন স্বাতীর গলাতেই মানানসই। ছোটবেলায় ও গান ধরলে অনেক হাততালি। সেই
সংখ্যার আধিক্যই মনে করিয়ে দেয়, সবাই সব কিছু পারে না।
আমার দক্ষিণের
জানালা জানে, রাত স্থির। অসুস্থতার ভারী বাতাসে পর্দা দোলে না। বাবা বলতেন, খিদে থাকলে মানুষ লোহা হয়। আর মজবুত মানুষ সবকিছু পারে। আজকাল এই বাক্যটা
যেন অচল। খিদে
থাকলেও কিছু মানুষ ঠিক মানুষ হয়ে উঠে না। মধ্যবিত্ত এ জীবনে একজন মানুষের প্রয়োজন। যিনি
কথায় কথায় হাইকোর্ট দেখাবেন না।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন