ঘোড়ারোগ
কথায় বলে গরীবের ঘোড়া রোগ! আমারও ঘোড়া রোগ আছে বটে, আর গরীবও নিশ্চিত জানি, কিন্তু তাতে কার কী
ক্ষতি হল সেটাই মগজের অ্যান্টেনায় ধরতে পারলাম না। আমি বাপু একবারই রেস দেখেছি, আর সেখানে থেকে বেরিয়ে
এসে অ্যামেরিকানদের মত করে বলেছি – ইন্টারেস্টিং! রেস আমায় টানে নি, টেনেছে ঘোড়া। সেই কবে প্রথম ঘোড়া দেখেছিলাম, এখন আর মনে নেই। তবে বিহারে থাকাকালীন টাংগায় চড়তে গিয়ে যে ‘ঘোড়া’গুলো দেখেছি, তাদের আমার একদমই পছন্দ হয়নি। যেমন বদখৎ দেখতে আর তেমনই গায়ে গন্ধ। পরে জেনেছিলাম, ওরা খচ্চর। তবে ওই টাংগার যে অদ্ভুত একটা টকটক
ছন্দ আছে, ওইটাই বোহহয় প্রথম টানে ঘোড়ার প্রতি। যতদূর মনে পড়ে প্রথমবার কলকাতায় এসে হঠাৎ করে এক মাউন্টেড পুলিশের ঘোড়ার গায়ে পড়েছিলাম
আচমকাই। গায়ে না বলে পায়ে বলাই উচিৎ আসলে। আমি তখন এইটুকু পুচকি মেয়ে আর সামনে বিশাল চারটে পা’ওলা ঘোড়া! পুলিশটাকে মনে হচ্ছিল পাহাড়ের ওপরে বসে আছে। অবাক হয়ে হাঁ করে সেদিন ওই ঘোড়ার চলে যাওয়া দেখেছিলাম। এবং বলতে গেলে সেদিনই ঘোড়া রোগের শিকার হই।
তা রোগটা যখন গরীবের, তার দাওয়াইও গরীব মার্কাই হবে। প্রথম একবার আস্ত ঘোড়ায় চড়ে ফেলি পুরী বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রের ধারে। সেই ঘোড়ার মালিকের সঙ্গে অনেক দরদাম করে ঠিক হয়, গুনে গুনে কুড়ি পা গিয়ে ফিরে আসবে আর ঘোড়ার পিঠে ছবি তুলতে দেবে দশ টাকায়। একটা টুল ফিট করে দিল, আমি টুল থেকে রেকাবে
পা দিয়ে সেই প্রথম উঠে পড়লাম ঘোড়ার পিঠে। মালিক মুখে একটা বিচিত্র আওয়াজ করে
ওর গায়ে একটা হালকা চাপড় দিল। আর ঘোড়া চলতে লাগল দুলকি চালে। আমি বেশ বাগিয়ে লাগামটা ধরে নিজেকে ঝাঁসির রাণী ভাবতে না ভাবতেই ঠুস করে ঘোড়া দাঁড়িয়ে
গেল। তখন একটু বড় মত হয়েছি, ভ্যাঁ করে তো আর কেঁদে ফেলতে পারি না। কান্না কান্না চোখে হাসিমুখ করে ঘোড়ার
পিঠে চড়া ছবি তুললাম। এখনও মনে আছে, সেবার স্কুলে
গিয়ে সবাইকে বেশ ঢাক পিটিয়ে দেখিয়েছিলাম ছবিটা।
এরপরে যখনই দীঘা বা পুরী গেছি, ঘোড়ায় চাপাটা রুটিন হয়ে গেছিল। আস্তে আস্তে সময় বেড়েছে, মাহুতকে সরিয়ে একাই
লাগাম ধরে ছুটেছি আস্তে আস্তে। যাঁরা হর্স রাইডিং জানেন, তাঁরা বুঝবেন, ঘোড়ায় পিঠে চেপে দৌড়োবার একটা তাল আছে, একটা নেশা আছে। ঘোড়ার গলায় হাত বুলিয়ে বা ওর চোয়াল ছুঁয়ে একটু আদর করলে, ও যে কী খুশি হয়, দেখেছেন কখনও? ভাষাহীন ওর চোখের
দিকে তাকিয়ে দেখবেন,
বুঝতে পারবেন। বাড়িতে কুকুর পোষা সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু আগেকার আর সেই দিন নেই, তাই ঘোড়া আমার অধরাই
রয়ে গেল। কুকুরও খুব আদুরে, প্রভুভক্ত ঠিকই,
কিন্তু ঘোড়া নিজের ক্ষমতাবলে গার্জেনি
করার অধিকার আদায় করে নিতে জানে। আবার সবটুকু প্রশ্রয়, আদর কেড়ে নিতেও
জানে। যাঁরা আগের রাস্তায় কেদারনাথ গেছেন, তাঁরা জানেন, ওই পথের শেষটুকু খুব একটা খাড়াই ছিল না, রাস্তা বেশ চওড়া আর ফ্ল্যাট। সেবার আমার ভাগ্যে যে চ্যাংড়া ঘোড়ামার্কা
খচ্চর জুটেছিল, তাকে ওই রাস্তায় বেশ জোরেই ছুটিয়ে দিয়েছিলাম। আর পেছন পেছন ছুটতে থাকা তার মাহুতের ভয়ার্ত গলা ভেসে আসছিল – ‘অ্যায়সা মাত করনা মেমসাব, ধীরে চল…!’ আর ধীরে চল, তখন আমি সত্যিই মুক্ত বিহঙ্গ, রাণী ঝাঁসি, আমার হাতে ঢাল-তলোয়ার নেই, তবু মন্দিরের সামনে পৌঁছে গেছিলাম বিরাট
একটা যুদ্ধ জয় করে। ওই খচ্চরটা তখন আর খচ্চর ছিল না আমার কাছে, ও হয়ে গেছিল অরণ্যদেবের ‘হিরো’ বা ‘তুফান’। ও হয়ে গেছিল রাণাপ্রতাপের ‘চেতক’। যাইহোক, প্রতক্ষ্যভাবে ঘোড়ার সাথে এই গরীবের
যোগাযোগ এইটুকুই।
আর পরোক্ষভাবে? ধান ভানতে শিবের গাজন গাইতে হয় তাহলে। আমি এক
মা-ঘোড়ার কথা ভাবি। ৩২০-৩৭০ দিন তার বাচ্চা পেটে ধরে
মা-ঘোড়ার কেমন অনুভূতি হয়! মানুষ-মায়ের মতই কি? হবু মা-ঘোড়া যখন ছোটে, মিস ক্যারেজের
ভয় পায়? আচ্ছা কখনো তো যমজ ঘোড়া জন্মাতে দেখিনি বা শুনিনি। কেন হয় না একই রকম দেখতে দুটি ঘোড়া? ‘Equus ferus caballus’ ঘোড়ার বৈজ্ঞানিক নাম, মোটামুটি ভাবে ২৫-৩০ বছর এরা বাঁচে। গড় দেড়
মিটার উচ্চতার ও ৫০০ কেজি ওজনের এই প্রাণীর ছুটই সম্বল। গ্যালপিং, ক্যানটার, ট্রট –
কত নামেই যে ডাকে মানুষ ওর ছুটকে! আর কত কত দামেই না কেনে এক একটা ঘোড়াকে। মাঝে মাঝে
যখন ওইসব গর্বিত মালিকদের হাসি হাসি মুখের ছবি দেখি কোনো রেস বা ট্রফি জয়ের পর,
এত্ত গা জ্বালা করে! ওরকম এক ঘোড়ার লাগাম আমার হাতে আসবে না ঠিকই, কিন্তু বাঙালির স্বপ্নে
বিশ্বজয় করা আটকাচ্ছে কে? সেইজন্যই প্রায়ই এক বাদামী ঘোড়া আমার কাছে আসে। ছুটতে
ছুটতে আসে। তার কেশর উড়ছে, তার লেজ উড়ছে, গ্যালপের সেই দুরন্ত মূর্তি আমার কাছে
আসে স্টিল ফোটোগ্রাফী হয়ে। আমি ওর
উড়ন্ত কেশর আরো একটু ঘেঁটে দিই। ওর লেজ
মুচড়ে বলি – যাহ আরো জোরে ছোট ... আমি ওর ফোঁস ফোঁস শ্বাস নেওয়া, শ্বাস ছাড়া শুনতে
শুনতে চেপে বসি ওর পিঠে, নিজেরই অজান্তে। ওই স্টিল
ফোটোগ্রাফীর ভেতর বন্দী হয়ে যাই কখন যেন!
আমি আমার
বাদামী ঘোড়ার চোখের দিকে তাকাই আর কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে পড়ি। এমন সুন্দর
চোখ নিয়ে কেন যে বেশি কবিতা লেখে নি কবিরা, তাই ভাবি! যে কোনো স্থলের প্রাণীর চেয়ে
ঘোড়ার চোখ বড়। মাথার দুধারে দুটো চোখ থাকায় ওরা প্রায়
৩৫০ডিগ্রির বেশি এলাকা দেখতে পারে! দিনে ও রাতে সমানভাবে চোখ কাজ করে ওদের। শুধু রঙ
চিনতে ভুল করে অনেক রঙকানা মানুষের মতই। যেসব মানুষ
লাল বা লালের শেডের রঙকে সবুজ বলে ভুল করেন, তাদের মতই ঘোড়াদের রঙ চেনার ক্ষমতা। তবে রঙে আর
কি যায় আসে! যার এমন সুন্দর চোখ, যে চোখের দিকে তাকালে স্বয়ং ঈশ্বরও আনমনা হয়ে
পড়েন, সেই চোখ আমায় সবচেয়ে বেশি টানবে, এ আর আশ্চর্য কি!
কয়েকবছর আগে
উটি বেড়াতে গিয়ে ওখানকার রেসিং গ্রাউন্ডের উল্টো দিকের এক হোটেলে ছিলাম। রোজ সকালে
বারান্দা থেকে দেখতাম একটা হতকুচ্ছিত রেসিং গ্রাউন্ডের মাঠে, ততধিক বিশ্রী বুড়ো
ঘোড়াদের ছোটাচ্ছে সেখানকার মিলিটারি-পুলিশ। দূরের সবুজ
পাহাড় দেখতে দেখতে কাছের ঘোড়াদেরও দেখে নিতাম মাঝে মাঝে। ঘোড়া দেখলেই
যেমন আমার ভেতরটা চনমন করে ওঠে, এক্ষেত্রে আমি কেমন ঝিমিয়ে পড়ছিলাম। অপ্সরী কিন্নরীরা
যেমন কোনোদিন বুড়ো হয় না, ঘোড়াদেরও কি বুড়ো হতে নেই? এই জন্যই কি বুড়ো বেতো
ঘোড়াদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়? একে তো উটির ঐ নীচু পাহাড়, তারপর সাজানো গোছানো
টুরিস্ট বাবুদের শহর, সাউথ ইন্ডিয়ান একঘেয়ে খাবার, তার ওপর বুড়ো ঘোড়া – সব মিলিয়ে
মেজাজটা তিতকুটে মেরে ছিল। শপিং করতে
গিয়ে রাস্তা গুলিয়ে যায় একদিন। যাকেই রেসিং
গ্রাউন্ডের পথ জানতে চাইছি, সেইই হাত দেখিয়ে বলছে – স্ট্রেটাআআ দেন রাইট্টাআআ!
এভাবেই সোজা যেতে যেতে অনেক পরে ‘রাইট্টা’র রাস্তা পেয়ে গেলাম, দেখা গেল রেসিং
গ্রাউন্ডের টিন ঘেরা পাঁচিল। তখন সন্ধ্যে
হয়ে গেছে, ঘোড়াগুলোকে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে বোধহয় আস্তাবলে ঢোকানো হচ্ছিল। খুব কাছ
থেকে দেখলাম রোগা রোগা ঘোড়াদের। কেমন যেন মনটা মোচড় দিয়ে উঠল। মনে পড়ে গেল
আমার ইয়া চেহারার দাদুর কথা। যাকে দেখলে
নাকি বাঘে গোরুতে একঘাটে জল খেত। যদিও আমার কাছে ছিল শিশুর মতই। সেই দাদু
মৃত্যুশয্যায় কুঁকড়ে একটা জড়পুঁটুলীর মত হয়ে গেছিল। পিঠে বেডসোর,
সেরিব্রাল অ্যাটাকে কথা বন্ধ হয়ে গেছিল প্রায়, জড়ানো কিছু গোঙানি বের হত মুখ দিয়ে। আমি যখন যাই
দাদুর সাথে দেখা করতে, মুখে সেই শিশুর মত হাসি, একটা হাত তুলে আপ্রাণ চেষ্টায় কিছু
বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে আর না পেরে চোখের দু’পাশ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। এক ছুটে
বেড়িয়ে এসেছিলাম ঘর থেকে। সেই আমার সাথে দাদুর শেষ দেখা। আজ এই বুড়ো
ঘোড়াদের দেখে সেদিনের মতই মন কেমন করে উঠল। মনে মনে
বিদায় জানালাম, আর তত বিশ্রী লাগল না ওদের।
Somir roychiwdhurir chorjapodiyo ghora porte paren
উত্তরমুছুনSomir roychiwdhurir chorjapodiyo ghora porte paren
উত্তরমুছুনSomir roychiwdhurir chorjapodiyo ghora porte paren
উত্তরমুছুন