কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫

জিনাত ইসলাম

জীবন যেমন




স্বপ্নের রাশি রাশি স্তুপের পাশে আমার এই পড়ে থাকা জীবন যদি বলি ব্যর্থ, ভুল যদি বলি সফল, তবে জোর করে মিলিয়ে দেওয়া হবে যদি বলি বোরখা নেই তাই  স্বাধীন, যদি বলি হাতে চুড়ি পড়ি না তাই শৃঙখল মুক্ত, তবে তো আমি একদম স্বাধীনচেতা, উদার যদি বলি নামাজ পড়তে জানি না, আরবী শিখিনি, কোরান-এর সব লেখাকে পরম সত্যের তো ধারকরতে পারি না; আমার যুক্তি, আমার নিজের ভাবনা উঁকি দেয়; তবে আমার ধর্মটাও নেই যদি বলি স্বামীকে ভগবান মানি না, তাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের বাড়িতেই কাটালাম আজীবন; তবে সব্বাই বলে উঠবে মেয়েটি খারাপ এরপরেও যদি আমি দাবী করি আমি সমাজের অনেকের চেয়ে সৎ! তবে? আমাদের ভন্ডামী ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে নানান কথা কে জানে, কার তরী কোথায় কিনারা পায়! মা বলতেন আমাদের নাকি হাদিসে বলা ছে, পাপীদের রক্ষা নেই! চুলের তো সরু পথ পেরিয়ে যেতে হবে পরকালের নিশ্চিত, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে! কে জানে, গল্পের উৎস কোথায়! আমি তো পরীক্ষার আগেই ঘোষিত ফেল

প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হতে গিয়ে ছাগলের তিনটি পা বলার পর থেকেই বাড়িতে অ্যাবনরম্যাল বলে খ্যাতি অর্জন করিতারপর কালো রঙ, তাই বিয়ের পাত্র মিলবে না, টা ভেবেই মা সহ আত্মীয়স্বজন বিব্রত হতে থাকে এমন মানসিক শারীরিক প্রতিবন্ধীর যে কখনো নিজের একটা চাকরি সহ ডাক্তার স্বামী জুটতে পারে, তা বুঝি জ্যোতিষি নারও বাইরে ছিল হিসেব উল্টে আমার আমি হয়ে ওঠায় এক নতুন প্রবাদ জন্ম নেয় আমাদের পরিবারের ঘরের চৌকাঠে আরে এই মেয়ে কী কালো ছিল, পড়াশোনায় কী গাধা, সেও কিনা মাষ্টার আর ডাক্তারের স্ত্রী! কী কপাল বাপ-মায়ের! অন্যদিকে আমার মানে পথ্যে ফিসফাস করে বোকা মেয়ে একটু বুঝেসুঝে সংসারে মানিয়ে নিতে পারল না কত টাকা ডাক্তারদের!

এই নিরেট বোকা শিশুটিরও এক শৈশব ছিল সাদা শিউলির মলিনতায় সে খুঁজে পেত নিজেকে মা সব সময় তার রাজপুত্রকে নিয়ে ব্যস্ত মন খারাপে সাথী ছিল তার বাবার অফিসের পুরনো কাগজপত্রের সম্ভার ঝো কান্নার সাথী ছিল রাতের নৈঃশব্দ্য একাকীত্বের যে ভার তা বহন করা খুব কঠিন বাবার বদলি সাথে বদল হতে থাকত মনও ফেলে আসা শহর, মানুষ, পথঘাট সবের জন্যই কেমন যেন মন খারাপ করত এর মধ্যে একটু হাসি উঁকি দিত নন্টে ফন্টের বেশে প্রতি মাসে আনন্দমেলা খুঁজতে যেতাম বিমলা ষ্টোর নামের এক বইয়ের দোকানে ঠিক তার পাশের গলি দিয়ে ছিল খাগড়া শ্মশানঘাট যাওয়ার রাস্তা প্রতিদিন দেখতাম মৃতদেহ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে কতগুলি বেসামাল মানুষের দল শোক কখনো এত উচ্ছ্বসিত করতে পারে অমানবিক হৃদয়কে, তার ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা



বিদ্যালয়ের দুটি বিষয় আমায় গভীরভাবে প্রভাবিত করে, তা আমার দুই শিক্ষিকার ব্যক্তিত্ব, আর প্রতি বছর নিয়ম করে অনুষ্ঠিত সরস্বতী পুজো সেখানে আমি জাত ধর্মের বিভেদ প্রথম জেনেছি জেনেছি মুসলিমদের গোরু খাওয়ার উৎসব হয় জেনেছি তারা স্নান করে না তারা বিছানায় খায় জানা মাত্র নিজেকে মিলিয়েছি, দেখেছি তা একদম আমি নই, তাই আমি তাদেরই লোক মুসলিমরা আমার কেউ না ভারত পাকিস্তা ম্যাচে ভারত জিতেছে দাবী তাই ছাত্রীদের, ছুটি হোক বিব্রত  ম্যাডাম লেন, হাত তোলো কে কে ছুটি চাও? আমি যথারীতি ছুটি না নেবার দলে অনেকে চেঁচিয়ে বলে, তো পাকিস্তানের, কেন ছুটি নেবে! নবম শ্রেণী আমার, তবু নতুন করে ম্যাপে দেশটাকে দেখি সত্যি কি সম্পর্ক এই দেশের সঙ্গে জেনে লজ্জিত হতে থাকি বন্ধুদের অজ্ঞতা আর অসভ্যতায় বিদ্যালয় পেরিয়ে কলেজে এসব বিভাজন কমে আসে অন্যভাবে এখন শুধু নাম জিজ্ঞাসা, তারপর একটি বড় বিস্ময় প্রকাশ, আচ্ছা! এই প্রকাশনায় এক অসীম নির্লিপ্ততা পেতাম যা ভেতর পর্যন্ত কুড়ে খেত মনে তো, কি জানি কী আছে এই নামে!

যখন বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়েই বিবাহের জালে নিজেকে বন্দী করলাম, দেখি সন্তোষপুর এলাকায় কেউ আমাদের দম্পতি মানতেই নারাজ তারপর হিন্দু-মুসলিম ম্যারেজ তারপর আবার ছাত্র একজন এম.বি.বি.এস, আরেকজন এম. তারপর স্কলারশিপের পাঁচ হাজার টাকা সম্বল অবশেষে মিলেছিল এক চিলতে ঘর সেখান থেকেই ছাত্রজীবন সমাপ্তির কাজ সেরেছিলাম ওই চত্বরে ঠিক আমার মাথার উপরেই থাকতেন নাকি স্বনামধন্য পরিচালক ঘটকস্যারের কন্যা জানি না তা সত্য না গুজব, নাকি অন্য ঘটককন্যা, চোখে দেখার অবকাশ মেলেনি তবে একটু রাতে ভেসে আসত সিনেমার গল্প একাধিক পুরুষ সহ মহিলার ভিড়ে ভরে থাকত ঘর গনগনে যৌবনের উত্তাপের সাথে সস্তা মদের গন্ধ, অকারউল্লাসে ভাঙত ঘুম আমাদের জীবনেও তখন রৌদ্রর স্বপ্ন

কলকাতার জীবন সত্যি খুব অন্যরকম হষ্টেল আর ক্যাম্পাস জুড়ে এককমের অজানা উন্মাদনা কে কাকে চায়, কি চায়,  কেন চায়তা কেউ জানে না, কিন্তু এক বোহেমিয়ান জীবন শুনেছিলাম নন্দন চত্বরেই কারো কারো কেটে গেছে যৌবন, বার্ধক্যের অনেকটাই ঘরে ফেরা তেমন করে হয়নি ওই চত্বরের লীলাভূমিতেই জীবন ভরে গেছে সিগারেটের ধোঁয়ায় যে সব মেয়ে চমকে দিত মফস্বলের চেনা মুখদের, তারা আজ ঘরোয়া স্ত্রী একদম পাতি গৃহবধূ চুল ছোট করে রাখাটাও তাদের কাছে ফ্যাশন হষ্টেলের টেবিলে প্রকাশ্যে কন্ট্রাসেপ্টিভ রাখা অত্যাধুনিকরা শুনেছি, তারাও আজ পুরবাসিনী এই তো গেল চেনা মেয়েদের কথা ছেলেদের দেখি কী অসাধারভাবে সাপের তো খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে কলকাতায় গড়া পুরনো সম্পর্ক থেকে চোখে চোখ পড়লেই দৃষ্টি পিছলে পালাতে চায় চোরাচোখতারপর নজরে আসে গোলমাটোল মাথায় লালচাঁদ বসানো এক মহিলা কাঁচুমাচু হয়ে বলে, চিনতেই পারিনি! পেছনে কি তোমার বৌ? একটু থেমে, হ্যাঁ রে! বাড়ি থেকে ছাড়লো না! এই তো আমাদের রীতি প্রেম, প্রতিশ্রুতিতে মায়ের অনুমোদন লাগে না, বিয়ের পিঁড়িতে তার চাপেই বসতে হয় বাধ্যতায় আমাদের জুড়ি নেই!



জীবন জুড়ে পরিক্রমা শুধুই প্রতিরোধ, তবু হিসেব মেলানোর মরিয়া এক চেষ্টা যে ছেলেটিকে বিবাহ করেছিলাম, লড়াই করেছিলাম সমাজ পরিবারের তথাকথিত নিয়ম ভেঙে, আজ সেই লড়াই কি অর্থহীন লাগে! অস্তগামী সূর্যের যেমন টুপ করে ডুবে যাওয়া নিশ্চিত, তেমন এই সম্পর্ক হারিয়ে যাওয়াছিল অনিবার্য তাতে কি! কোনো রকমে জুড়ে থাকার নাম বুঝি বেঁচে থাকা বন্ধন হোক নিষ্ক্রিয় উত্তরণে এক সম্ভাবনায় তো প্রতি সকালে লালসূর্য দেখি





0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন