কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

ঝর্ণা-কলম


ঘাসের ফাঁকে গপ্প ছিলভরা পাতা। পাতায় ভর করা। সহজ দাঁতের ফাঁকে ফ্যানা। বর্ষাতির ফাঁক দিয়ে সদ্য ভোরের মাজন চোখে মুখে। আলপথ, গড়গড়ি আর মাছ বাগানের ঝিল- যেন গহীন গহীন বেত্তান্ত। ফ্যাকাশে যেখানে গল্প বলে। তারপর হঠাৎ একদিন রাত হয়ে গেল, ফ্যাকাশেকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না।  

পাহাড়ের খাঁজ। তরঙ্গ ও প্রপাত। ও ঝর্ণা দেখতে যাচ্ছিল।  ও কথা বলত না। পারত না। আজন্ম এমন? আমৃত্যু? বলত না। জানা নেই। কথা বলে না বা বলে উঠতে পারে না বলেই একদিন ঝরণা দেখতে যাবে ঠিক করল 

কলাবাগানের রিজুয়ানুর হাসান একবার ওকে বলেছিল, 'জুবান তো মিল যাতা  হ্যায়, মগর হমজুবান নহি মিলতা।' সে সব ছিল ওর কথা বলার দিন, কান পাতার অক্ষাংশ। তারপর সেদিন ওর বন্ধুকে ঘাটশিলার ধাবার ওই লোকটা বললো, 'তু তো মুন্না, ঝাড়খন্ড কা হি হ্যায়, ঔর ফির শিয়ালদা ভি তো হামারা হি হ্যায়!' লোকটার ওর বন্ধুকে খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। ওর আর ওর বন্ধুর নামটাও আবার এক। তাহলে কি বলা যায় লোকটার ওকেও পছন্দ হয়েছিল? না, এমনটা বলা যাবে না কারণ লোকটা ওর সমনামী বন্ধুর নাম জানত না। জানত না এককালে ও ওর সমনামী বন্ধুটিকে মালের ধুনকিতে বলেছিল, 'নেমসেকস শুড হ্যাভ সেক্স।' সে সব ছিল ওর কথা বলার রাত, বন্ধুদের আমোদের দ্রাঘিমা। নাম ছাড়া পছন্দ হয় বুঝি? না হলে তো ওকে আর কারুর পছন্দ হবে না। ওর যে এখন আর কোনো নাম নেই। নাম নেই বলেই তো ঝরণা দেখতে যাচ্ছিল। সেদিন রাতে লোকটার জমাটি ফ্লায়িং কিসের পর ও আর ওর তৎকালীন সমনামী বন্ধু ঘাটশিলা থেকে গালুডি ফেরে। তারপর ঝাড়খন্ড থেকে কলকাতা। তারপর শোনা থেকে বলায়। হয়তো ইতি গজ।  

তখন ও বুঝত না, কান দিয়ে যা কিছু নরমে মরমে পশে, তারই ভেতর থাকে  উন্মাদনার বীজ। অনাসৃষ্টি থেকে অনা-দৃষ্টি, ইস্কুল-কলেজের ভাঙা টেবিল চেয়ার রক্তের স্রোতের ভেতর থেকে কথা বলে উঠেছিল ওর কানে: কৃষ্ণবর্ণ থেকে ধূসর  চামড়ার পান্ডুলিপি। শুনতে শুনতে একদিন রাতে শুশ্রূষা এলো আর বীজ ছুঁয়ে গেল অন্ধকারে। যেদিন দেখতে পেয়ে গেল সেই বীজ, বা শুনতে, সবার আগে হারিয়ে গেল নামটা। তারপর একে একে কথাগুলো। ঠিক যেন কলকাতায় বরফ পড়ার ফ্যান্টাসি দৃশ্যে হঠাৎ কেউ ব্যাক বাটন টিপে দিয়েছে আর একেক করে শব্দের ফ্লেকগুলো খোলাম কুচির মতো আকাশে ফেরৎ চলে যাচ্ছে। সেদিন থেকেই  ও কথাহারা। শ্রোতাহারা এবং শ্রবণহীন। কিন্তু আজকাল আবার পুরনো দিনের  কাঁহাসুনাগুলো, হাসনুহানাগুলো পেয়ে বসছে ওকে। কে জানে হয়তো নামটাও পেয়ে বসতে চাইছে। পাতায় ভর করে। দেওঘরে ত্রিকুট পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ঘেমে নেয়ে একটু ব্রেক নিচ্ছে ও আর ওর তৎকালীন সমনামী ওই বন্ধু, ভাং খেয়ে সাদা ধুতি আর গেঞ্জি পরা একটা লোক গাছের পাতা ছিঁড়ে এনে বাঁশির মতো বাজিয়ে  বাংলা-হিন্দী গানের সাথে উদম নাচ নেচেছিল। আজ সাতসমুদ্র পেরিয়ে সেই পাতা বাজার শব্দ কানে আসছে। সেদিন ওর বন্ধু ওই পাতাবাহারের পারফরমেন্স দেখতে দেখতে বলেছিল, 'এইজন্যেই আমি এদেশে ফিরে আসি, এমন পাগলাচোদা কেস আর  কোথায় হয় বল তো?'

ছুটে চলে রাতের রেলগাড়ি। উল্টোদিকের সীটে তিনটি মেয়ে বসে। দিগন্তে তখনো অল্প অল্প আলো, মিয়োনো হাসির রেশ। ও চুপচাপ দেখে যায়। তিনটি মেয়ে চোখ বুজে কোলে হাত রেখে বিড়বিড় করে বলে চলে, 'Holy Mary, mother of God, show us the way...Holy Mary, mother of God, show us the way'ছড়া কাটার ছন্দে ওর পাঁচালিপাঠ মনে আসে। কথা শোনা... বলা কথা... আর তার  মাঝখানে ওই নিভানো আলো পথ রোখে, ছাড়ে, আবার রুখে দাঁড়ায়। দিগন্তের ঠোঁট দিয়ে শেষ আলোটুকু ঝুপ করে ভেতরে সেঁধিয়ে যেতেই তাদের একজন টিফিন বক্স খুলে তিনটে আপেল বার করে অন্যদের দ্যায়। আপেল কামড়ানোর স্মৃতি নিয়ে রাত ঘনিয়ে আসে। 

উল্টোনো নৌকো ভাবনার মতো জট পাকায় সমুদ্রতীরে। ছায়ায় শুয়ে একটা লোক।  অন্য লোকটা কী যেন কুড়িয়ে খায়। খাবি খায় জল। সব তীরেই কুড়নোর লোক জুটে যায়। আরেকটা লোক প্যারাম্বুলেটরের ভেতর থেকে বাদাম বেচে। বালির  ভেতর এমন কত আকারই না তৈরি হয়, মুছে যায়! জ্যামিতির মাস্টারক্লাস চলে সমুদ্রতীরে। গল্পের জীবাশ্ম গল্প বলে সন্ধেবেলা। এইসব দেখা-শোনা ওকে আবার দেখাশোনা করতে শুরু করে।  

জলের শব্দ, ঝর্ণার দিক থেকে। ফোঁটা ফোঁটা প্রিজম কাহিনীময়। হাতির নরম দুলুনি, ঘাস আর বিচালি খেতে খেতে হঠাৎ ঠাস হয়ে যায় তার নুঙ্কু। জল বইছে নেটওয়ার্ক এরিয়ার বাইরে। চেন্নাইয়ের BSNL কর্মচারী চাম্বা যাবার পথে ওকে বলেছিল, 'পানি কে লিয়ে ইয়ে জিলা জিলা মে কিতনা বাওয়াল, ঔর ইয়ে দেখো কিতনা সারা পানি ইউহি বহে যা রহা হ্যায়।' সেইসব শ্রুতিতে কি গল্প ছিল? এখন মাঝে মাঝে এই প্রশ্নটা ওকে বিব্রত করে।  রেখে আসা কথাগুলো মাঝরাতের নিমপেঁচার মতো ডাক দ্যায়। তাই ভাবলো ঝর্ণা দেখতে আসবে।   

আরেকটা গল্প কি লেখা যাবে? ঝর্ণার জলে মুখ গুঁজে কান পাতলে কি হুড়মুড়িয়ে ফিরে আসবে শব্দগুলো? বাসটা এগিয়ে যেতে থাকে আর ও এইসব সাতপাঁচ আটছয় ভেবে যায়। ঠিক কীভাবে বসত গড়ে মানুষ, গামছা বেঁধে দ্যায়  আড়াআড়ি, হাতের আঙুলগুলো জমে চাল হয়ে যায়, তারপর গলে ভাত, তারপর অন্ধকারে অনেকটা হেঁটে বাড়ি ফেরে, বাবা মায়ের দেওয়ালের দিকে পিঠ আগলে, পিছমোড়া পুঁটুলি গল্প বলতে থাকে অন্ধকারে, ও উৎকর্ণ, যদি দু-একটা কথা শোনা যায়, পুঁটুলির ভেতর থেকে স্রোতের শব্দ আসে, আসে শ্রোতার শব্দ। 

পরিবেশনে কলাপাতা আর উষ্ণ পানীয় জল। ফাঁকা গোলপোস্টের চারপাশে বালি বিলি কাটে শব্দ নিয়ে। এখানে মন্দিরে ঢুকতে গেলে জামা খুলে ঢুকতে হয়। ওর ভয় হয় আর তাই ঝর্ণা দেখতে যাবে ঠিক করে নেয়। ক্যামেরার ভেজা ছায়া গায়ে গজাতে থাকে। 

ঝর্ণার সামনে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সাবধানবাণী।  জলের এক্কেবারে কাছে কশনবোর্ড পেরিয়ে একটা পাথরের ওপর গিয়ে দাঁড়ায় ও। মোতায়েন পুলিশ হুইসল বাজায়। ক্রমে ওর শরীর শান্ত হয়ে আসে। মগ্নচোখের আগল বিঁধে আসে শব্দে।  তারপর ছবি। কথার ছবি। আবার শব্দ। বুরুডি ড্যাম থেকে ধারাগিরি ফলস। চারপাশে দলমা আর লাল পথ, ছেলেটা যাকে শুকনা পাহাড় বলছিল।  লাল মাটি আর কাদায় পা দেবে দেবে পৌঁছেছিল ছিল বসডরা গ্রামে। ঐ গ্রামের লোকেরা ধারাগিরির উপাসক। আলপথ, রোদবিকেল, পিছল ডালপালা আর হাতির সম্ভাবনাময় ওই অতীত। হাওয়ায় ভেসে আসছে বিশ্বাস, ভূষিত এক বিভূতি! ঝর্ণার পথ চেনাতে চেনাতে মঙ্গল ওদের বলেছিল, 'দেবতারে না মানলে হেথায় থাকতে পারবেক না বাবু। ঘরে বাঘ ঢুকবেক।'

মঙ্গলের ছেলে আর তার বন্ধুরা সেদিন সন্ধেবেলা ফেরার সময় ওর আর ওর তৎকালীন সমনামী বন্ধুটির থেকে টাকা চেয়েছিল। তখন প্রায় রাততাড়াহুড়ো করে ফেরার সময় মনের মতোন টাকা না পেয়ে বাচ্চাগুলো ওদের বলেছিল, 'তোদের ভূতে খাবেক।' নাহ, ভূতে খায়নি, মহুয়ার টানে সে যাত্রা ফিরেছিল।  কিন্তু সাতটার প্রায়ান্ধকারে বুরুডির জলে শুকনা পাহাড়ের নিকষ ছায়া দেখে ও তৎক্ষণাৎ বলে উঠেছিল, 'মৃত্যুর মতো দশ টাকার কয়েন, মৃত্যুর যত দশ টাকার কয়েন।' বসডরার মানুষজন এখনো হয়্তো দশ টাকার কয়েন দেখেনি। এখনো অনতিবিলম্বে আর্মি ক্যাম্প আর রাতটহল। অন্ধকারের আইডি প্রুফ।  

এমন সময় হুইসলের শব্দ শোনা গেল... 

এভাবেই শব্দ ভেঙ্গে ছবি। আর টিলার মতো ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে আবার শব্দ।  এতদিনের এত কথা, এত শোনা আর এত বলা একসাথে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে জল। ওর শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে জল বেরোতে লাগলো। ও দুদিকে দুটো হাত মেলে ধরলো আরামে। ওর শরীর তখন ক্লান্ত। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের গার্ড ওর একেবারে কাছের আরেকটা পাথরে এসে থমকে গ্যাছে। বড়সাহেবকে জানাবে বলে পকেটে মোবাইলের দিকে হাত বাড়াচ্ছে বটে, কিন্তু মুখ জোড়া তার হাঁমুখ: এক নিথর শূন্য। সেই শূন্যের ভেতর দিয়ে ওর শরীরভাঙা শব্দভাঙা দৃশ্যভাঙা জলের দুয়েক ফোঁটা হয়তো তার শরীরেও গিয়ে বসত গড়ছে। 

ওর মুখ, নাক, কান, চোখ দিয়ে, এমনকি নাভি, লিঙ্গ দিয়েও জল বেরিয়ে আসছে। অপ্রতিরোধ্য এবং দূর্দমনীয় এই জলযোগের অদূরে গার্ড তৎক্ষণে মোবাইলে কান লাগিয়ে বলছে, 'এক আদমি... উসকে বাদ পানি... বস পানি... পা-আ-নি-ই... ওর কানে সেসব শব্দ ঢুকছে না। সেখানে কেবল ঢেউয়ের শব্দ। স্রোতের শব্দ, শ্রোতার শব্দ। জলের বাঘ এখন শরীর জুড়ে। তারপর সেই বাঘ ঝাঁপ দেয় ঝর্ণার গভীরে। পাথরটা একা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। গার্ড এসে দাঁড়ায় তার ওপর। জলের ভেতর টহল দ্যায় তার চোখ। জল পাত্তা না দিয়ে বয়ে চলে যায়। ওয়াটার ক্যাননের পাশে বাকরুদ্ধ প্রহরীকে প’জ করে রেখে এখানেই এই দৃশ্যকলমের নিবটা ভেঙে ফেলা যাক। 

এরপর আর কোনো শব্দ নেই। পৃথিবীর চার ভাগ জুড়ে শুধুই জল। 

    



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন