কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

প্রিক্যারিয়াট চার্টার  



ওদের আপনি বিভিন্ন সময়ে দেখেছেন। দরজায় ধাক্কা দিয়ে বা ডোরবেল বাজিয়ে, নিজেদের ‘ম্যানেজমেণ্ট ট্রেনি’ পরিচয় দিয়ে ওরা আপনার কাছে বিভিন্ন কাজের বা অকাজের জিনিস বিক্রি করতে আসে — অক্সব্রিজ সহ বিদেশী প্রকাশকের অজস্র ডিকশনারি, সাইক্লোপিডিয়া/এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে রান্নার বই, বাগান করার বই, পাখির বই, বাচ্চাদের বই থেকে আরো নানান কিসিমের নন-বুক, রান্নাঘরের দরকারি/অদরকারি সাধিত্র, বিভিন্ন দৈনন্দিন ব্যবহারের অ্যাপ্লায়ায়ান্সেস, যেমন ডিশি, আকোয়াগার্ড, ভ্যাকুম ক্লিনার। যখন আপনি দেশিবিদেশি প্রাইভেট ব্যাঙ্কে, জীবন-গাড়ি-বাড়ি ইত্যাদির  ইন্সিওরেন্স কোম্পানিতে যান, ওরা টেবিল  সাজিয়ে বসে  থাকে। পোশাকটা মোটামুটি এক, বাঁধা গতেরছেলে হলে ট্রাউজারের মধ্যে গোঁজা, গলা অবধি বোতাম লাগানো ফুলশ্লিভ শার্ট, নেকটাই, গলায় ঝোলানো আইডেন্টিটি কার্ড, মোবাইল-তথা-মুঠোফোন। মেয়ে হলে সালোয়ারকামিজ, শার্টপ্যাণ্ট, এমনকি ক্লিপ লাগানো শাড়িএছাড়া ‘আশাক’ মোটামুটি এক। যখন গ্যাসবুক করা থেকে ক্রেডিট কার্ডে, ব্রডব্র্যাণ্ডে, যাত্রাডটকমে, মেকমাইট্রিপে, হোটেলবুকিংএ কোনো কাস্টমার কেয়ার ‘এক্সিকিউটিভের’ সঙ্গে কথা বলেন, তখন ওরাই বিভিন্ন কলসেণ্টারে আপনার ফোন  ধরে, ইংরিজিতে-হিন্দিতে-বাংলায়। এরকম ভৌত দূরত্ব না বজায় থাকলে আপনি ওদের গা থেকে শস্তা ‘ডিও’ ছাপিয়ে অনেকদিন না-কাচা পোশাকের হাল্কা দুর্গন্ধ পান। গ্রীষ্মকালে হয়তো জিজ্ঞেস করে —  সার! একটু জল হবে? কী করবে? চোদ্দ ঘণ্টার পরিশ্রমে তিন থেকে ছয় হাজার টাকায় জামা-কাপড়-টাই-ওড়না-মোবাইল সামলে ওরা সুরভিত থাকে কী করে? ওরা অনিশ্চিত বা প্রিক্যারিয়াস কর্মজীবনের শিকার, পুঁজিবাদের প্রথম পর্যায়ের প্রলিতারিয়েতের চেয়ে অবস্থা ভালো নয় ওদের! সমাজবিজ্ঞানে এবং অর্থনীতিতে প্রিক্যারিয়াট একটা সামাজিক শ্রেণী, যেটা গঠিত হয় সেই সব লোককে নিয়ে যারা ‘প্রিক্যারিটি’ বা (অর্থনৈতিক) অনিশ্চয়তা থেকে   ভুগছে। এরা প্রলিতারিয়েত, কেননা মানসিক এবং বস্তুগত স্বাচ্ছন্দ্য তছনছ করে দেওয়া ‘প্রিক্যারিটি’ বা (অর্থনৈতিক) নিশ্চয়তা, পূর্বাভাসদানযোগ্যতা ইত্যাদি বিরহিত এক অস্তিত্বের পারিপার্শ্বিকতার শিকার হওয়া ছাড়াও এরা এক সর্বহারা শৈল্পিক শ্রেণীর সদস্য, যাদের উৎপাদনের উপকরণগুলির মালিকানা নেই আর তাই গত্যন্তরবিহীন হয়ে প্রাণধারণের জন্য নিজেদের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হয়।

আরো সুনির্দিষ্টভাবে এটি কর্মের অনিরাপত্তা, অর্থাৎ ক্ষণিক তথা সবিরাম নিয়োগ, তথা যখন তখন চাকরি যোগ্যতার চেয়ে খারাপ চাকরি আর এখান থেকে আসা টেনশন ও দুশ্চিন্তাকে নির্দেশ করে। এই শ্রেণির আত্মপ্রকাশ নয়া পুঁজিবাদের কায়েমি বসার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শব্দটি পোর্টম্যান্টো। একদিকে প্রিক্যারিয়াস আরেকদিকে প্রলেতারিয়েতের সমন্বয়ে গঠিত। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ গাই স্ট্যান্ডিং প্রথমে Think Tank Policy Network- এর জন্য করা কাজে এই জায়মাণ নতুন সামাজিক শ্রেণির তত্ত্বায়ন করলেও The Precariat: The New Dangerous Class (২০১১) বইতে এদের আলোচনাই আমাদের কাছে বিখ্যাত!

যে সমস্ত শিল্পোন্নত দেশে ইতিমধ্যে প্রিক্যারিয়াটরা তাৎপর্যজনকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে আর একুশ শতকের প্রথমাংশে নয়া-পুঁজিবাদী, উত্তর-ফোর্ডিস্ট অর্থনীতির আর নয়া-উদারনীতিবাদী গণতন্ত্রের বিপদ-ঘণ্টা বাজিয়ে দিচ্ছে, তাদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,  ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, উন্নত জাপান ছাড়াও অনেক তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশও পড়বে! উন্নয়নশীল দেশগুলিতে গাই স্ট্যান্ডিং-এর মতে এই প্রিক্যারিয়াটদের সঙ্গেই জড়িত বা বরং তাদের মধ্যে পড়ে প্রচুর সংখ্যক সাইবারট্যারিয়াট (cybertariat) তথা সাইবার-কুলিপ্রিক্যারিয়াটদের সংখ্যা বেশি হতেই হবে নয়া পুঁজিবাদের আর নয়া-উদারনীতিবাদী গণতন্ত্রের সমন্বয়ে বেড়ে ওঠা বেকারত্ব ও অযথেষ্ট-নিয়োগের কারণে। গাই স্ট্যান্ডিং তাঁর Work after Globalization: Building Occupational Citizenship (২০১০) বইতে দেখিয়েছেন একুশ শতকের প্রথমাংশে আমেরিকায় বেকার-আধাবেকারদের শতাংশ পাঁচ আর ১৯৬০-এর পর সব চেয়ে কম হলেও ২৫-৩০ বয়ঃগোষ্ঠীর পুরুষদের শতাংশ কুড়ি, যা ১৯৬৮-র শেষে ছিল ১৩ শতাংশমহিলাদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা আরো খারাপ, সাতাশ ২০০৮-এ, ২০০০-এর থেকে দুই শতাংশ বেশি!  ইংলণ্ডে ২০০৮-এর মাঝামাঝি স্থায়ী বেকারের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ। এদের মধ্যে প্রিক্যারিয়াটরা  জন্ম নেবে না তো কোথায় নেবে?

একটা ধারণা আছে, প্রিক্যারিয়াট সমস্যা উন্নত দেশগুলির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তৃতীয়  বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে নয়! কিন্তু গাই স্ট্যান্ডিং দেখাচ্ছেন একুশ শতকের প্রথমাংশে সমস্ত শ্রমিকদের দক্ষিণ কোরিয়ার ষাট শতাংশ (মহিলাদের ক্ষেত্রে সত্তর) অনিশ্চিত উচ্চ-প্রাযুক্তিক কাজে নিয়োজিত ছিল। দঃ আফ্রিকায় এদের শতাংশ ছিল পঁচিশের বেশি। ভারতে যেখানে সমগ্র কর্মীবাহিনীর আশি শতাংশেরও বেশি অনানুষ্ঠনিক ক্ষেত্রে নিয়োজিত তাদের সংখ্যা জাপানে ‘freeters’ নামে খ্যাত এই কুড়ি মিলিয়ন অনিশ্চিত-শ্রমিকের কতগুণ হবে, ভগাও জানে বলে মনে হয় না! আমাদের জনসমষ্টি আড়ে-বহরে অনেক বড় নয়!

কার্ল পল্যানির Great Transformation (১৯৪৪) বইতে একটা ছবি ফুটে উঠেছিল রাজপথ ভর্তি অনিয়োজিত, কম-নিয়োজিত অসংখ্য মানুষদের। আমরা প্রায়শঃই বাস্তবে, দুঃস্বপ্নে দেখি রাস্তার ভিড়ে আমাদের সন্তানদের ছবি। কিন্তু কোথাও কোনো দেশে মূল প্রবাহের কোনো রাজনৈতিক দলই ওদের নিয়ে মাথা ঘামায় না! তবুও  প্রিক্যারিয়াটদের সংগঠিত শ্রেণি-আন্দোলনের ঊষালগ্ন ফুটে উঠেছে প্যারিসে আর সুইডেনের শহরগুলিতে ‘banlieues’–দের রায়টগুলিতে, বহু EuroMayDay প্যারেডে, তারপরে আরব বসন্তে, ২০১১-র ওয়াল স্ট্রিট অকিপাই আন্দোলনে, ২০১১-র অগাস্টে ইংলণ্ডের শহরগুলির দাঙ্গায়, আর পর্তুগালে M12M প্রতিবাদে, যেখানে তিন লাখ মানুষ(ঈ) প্রিক্যারিটির বিরুদ্ধে মিছিল করেছিল। গ্রিসে ঘটেছে ‘den pirilinono’  অর্থাৎ বিল-ট্যাক্স-ফি দেওয়ার প্রতিবাদে আন্দোলন! স্পেনে M15, ইতালিতে ২০১৩-র সাধারণ নির্বাচনের আগে Five Star Movement (M55) 

  
এই সব আন্দোলনের অসুবিধে একটা নয়, অনেক। প্রথমতঃ এদের সাংগঠনিক দিকটা তরলনয়া-লাড্ডাইট দাঙ্গাহাঙ্গামায় কিছুই দানা বাঁধে না! দ্বিতীয়তঃ এদের কোনো সুসংহত দাবিসনদ নেই! গাই স্ট্যান্ডিং তাঁর A Precariat Charter: From Denizens to Citizens (২০১৪) বইতে বলেছেন, এই পিপল্‌স চার্টারের আদলে এক প্রিক্যারিয়াট  চার্টার বা দাবিসনদে ন্যূনতমপক্ষে থাকতে হবে ন্যুনতম বেতন স্বীকৃত বেতন, চাকুরির নিরাপত্তা, সময়ের উপরে নিয়ন্ত্রণ, উচ্চমানের কাজের জায়গার প্রতি অধিগম্যতা ও নিয়ন্ত্রণ, বৈশ্বিক বাজার অর্থব্যবস্থার পুনর্বিতরণ, আর সর্বোপরি প্রতিনিধিত্ব।


৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে Cyrus Cylinder থেকে, ১২১৫-র Magna Carta, ১২১৭-র  Charter of the Forests, ১৭৮৯-র মানুষ ও নাগরিকদের অধিকারের ফরাসি ঘোষণা ইত্যাদি ঘুরে পিপল্‌স চার্টারের ধারণা দানা বেঁধেছিলো। এদের তুঙ্গবিন্দু ১৮৩০-এর দশকের চার্টিস্ট আন্দোলনের পরিণতিতে ১৮৩৮-এর People’s Charter এর যে ছটি রাজনৈতিক দফা শ্রমিক শ্রেণির র‍্যাডিকালরা সমন্বিত করেন, তার উদ্দিষ্ট ছিলেন পুঁজিবাদের প্রথম দিনগুলোতে অবহেলিত, ভোটাধিকারবর্জিত, শ্রমিকরা! মার্ক্স এদের এই দাবিসনদকে বহু শ্রমিকবিপ্লবের সমান মর্যাদাবাহী বলেছিলেন। আজকের মার্ক্সবাদী, সামাজিক গণতন্ত্রীরা এই প্রিক্যারিয়াট চার্টারের সম্পর্কে কী বলবেন, করবেন তা জানতে খুব ইচ্ছে করে! সব নতুন সামাজিক আন্দোলনের রাশ নিতে হবে সত্যিকারের গণতন্ত্রীদের!  
.

    

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন