কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫

মেঘ অদিতি

কারনেশন


ঘুম ভেঙে দেখি, জানালা ছুঁই ছুঁই মেঘেদের দিন
 
গত দু’দিন জ্বর। মুখ ভীষণ তেতো। মা থাকলে বলত, আমলকি চিবিয়ে জল খাএ বিরান ফ্ল্যাটে জল খেতেও নিজেকে উঠতে হয় এখন অবশ্য অন্যরকম দিন চলছে। ঋতু এলে হাতের কাছে সব গুছিয়ে দিয়ে যায়বাকিটা ওর রেখে যাওয়া লোক সিরাজ, ও করে। মাস দেড়েক আমি তো বিছানায় শুয়ে। ব্যবস্থাটা তাই ওরকম। ঋতু মন চাইলে হানা দেয়। এখানে অন্তত মাস দেড়েক ওর হুটহাট এসে পড়াটা তেমনই। ঘরে ঢুকে চোখ সরু করে এটা গোছানো নেই, উপচে পড়া ছাইদান কেন, যেন এই ফ্ল্যাটের মালকিন সেই প্রশ্নগুলো আবার সিরাজকে নয়, ভ্রূ কুঁচকে আমাকে। উত্তর করি না। উত্তরের অপেক্ষাই বা কে করছে! জায়গামতো জিনিসপত্র গুছিয়ে  গুনগুন করতে করতে মর্জি হলে দু’একটা পদ রান্না করে টেবিলে ঢাকা দিয়ে সিরাজের কাছে আমার আপডেট নেয়। তারপর কাঁধে রাজস্থানী ঝোলা ঝুলিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে যেমন হঠাৎ এসে পড়া তেমনই হঠাৎ বলা, চললাম। ওই মোহন তীব্র ভঙ্গীর দিকে তাকালে ভুলে যাই ব্যথা। ভুলে যাই ওকে বলতে চাওয়া সবচে জরুরী কথাটা যে,  এভাবে হুটহাট ব্যচেলরস ডেনে ঢুকে পড়তে নেই

শোবার ঘরটা থেকে বেরোবার দরজাটা দেখা যায়। কী বুঝে লকটা টেনে দেবার  আগে ও আরেকবার ঘুরে তাকায়। চোখগুলো খুব সুন্দর, চোখে কি কাজল পরে? খুব খেয়াল করিনি। যখন ও আসে তার উপস্থিতি এত প্রাঞ্জল যে আলাদা করে ওর কিছু দেখা হয় না। কেবল ওর ঘুরে দাঁড়ানোর সময়টায় ওই ও চলে যাবার পরও ঘরের আটকে পড়া হাওয়ায় ঘুরে বেড়ানো ওর গায়ের গন্ধ।

কিন্তু কী হয়েছে যেন এবারটা। ঋতু কিন্তু বেশ ক’দিন আসছে না।
গত দেড় মাস ওর আসা যাওয়াটা সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই ছিল। তারপর সাতদিনে চারবার। তারপর কমে তিনবার থেকে একবার হয়েছে। কোথায় থাকে জানি না। জিগ্যেস করিনি। কী হবে! পথে হঠাৎ দেখা হওয়া অপরিচিত মুখগুলো সরে যায়  দূরে... পরিচিত মুখগুলো? ঋতুর সাথে দেখা হবার দিনটার কথা মনে পড়ল।
  
ঠিক দু’মাস আগে এক দুপুরে কলেজ থেকে বেরিয়ে লিঙ্ক রোড ধরে যখন আমি ফিরছিলাম, কী একটা স্টুডেস্ট স্ট্রাইক শুরু হব হব করছে। কলেজগেটের সামনে জটলা দুপুর সবে ঝিম ধরেছে। ফাঁকা রাস্তা। সময়টা মার্চ। কোকিল ডাকার সময় বোধহয়। ডাকছিল কি? কে জানে। বাংলা মোটরে নেমে ইস্কাটনের গলি ধরে এগিয়ে আসার সময় প্রথম যে বাঁকটা পড়ে তার আগে ঋতু নামের এই মেয়েটার সাথে এক অস্বাভাবিকতার ভেতর দিয়ে দেখা। দুপুর রাস্তায় ফাঁকা পেয়ে ওকে ঘিরে ধরেছে চার-পাঁচজন ছেলে। তখনও আমি সামনে এসে পড়িনি, কিন্তু ঘটনাটা যা বোঝার  বুঝে গেছিনিজেকে চট করে আরেকটু আড়াল করে আগে তরুণ, আমার যে বন্ধু এসবির এস আই তাকে এরিয়া জানিয়ে টেক্সট করলাম। উত্তর এলো না। ফোন করার  সময় নেই। মেয়েটাকে লক্ষ্য করছি, ভয় পেয়েছে খুব। একটা ছেলে হঠাৎ ওর ওড়না  ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। আরেকজন এগিয়ে আনছে হাত... এভাবে মোলেস্ট... আর সময় নেই। দ্রুত এগিয়ে গেলাম। তারপর যা হয়, মারকুটে স্বভাবের নই, তার ওপর  জন্মরোগা। মেরেছিল খুব। হাতে পায়ে ফ্রাকচার। আর তরুণের ফোনটা যখন এলো  সেটা ধরে লোকেশন বলার সময়ই ওরা ছুরি চালাল এলোপাথাড়ি। ফোন হাত থেকে ছিটকে গেল। এদিক সেদিক আমাকে ফুটবলের মতো ছোড়াছুড়ি করে বাইকে ওরা চলে গেল।
হাসপাতালে দিন পনের। 
তারপর এই মেয়েটাই বাড়িতে রেখে গেছে। কোথা থেকে মাঝবয়সী এক লোক মানে ওই সিরাজ, তাকে রেখেছে আমার দেখাশোনার জন্যনিজেও আসে। কিন্তু এ সপ্তাহে ও এলো কই! একবার অন্তত যে আসে সে সপ্তাহ পেরিয়ে যাবার পরও এ্লো না। একটা ফোন করব? না থাক।

সিরাজ দু’বার এসে জিগ্যেস করে গেল খাবার দেবে কি না।
কলেজ অথরিটিকে ফোন করে জানালাম দু'সপ্তাহ পর জয়েন করব। মা’কে একবার ফোন করলাম। শীত শীত করছে। ঋতুর কী হলো! আবার কোনো বিপদ হলো না  তো! জিওগ্রাফি চ্যানেলে লাইভ ফ্রি অর ডাই চলছে। কী ফাঁকা যে এই ফ্ল্যাটটা, ধুত্তোর!  

বৃষ্টি এলো। ঋতু কই!
মন সরাতে হাতের কাছে রাখা বইপত্তর টেনে নিলাম। নাহ... ভাল্লাগছে না। এই মেয়েটাকে মিস করছি কেন! সিরাজকে ডেকে চা দিতে বলে দেখলাম ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বিরক্ত লাগছিল, তবু মনে হলো ওকে জিগ্যেস করি ঋতুর কথা। রোজ তো ও ফোনে কথা বলে। জিগ্যেস করতেই ছেলেটা কেমন যেন পিছলে গেল। ব্যাপারটা কী?
সপ্তাহের প্রথম দিন। আজও ঋতু আসবে না?
জ্বর বাড়ছে। ভেতর ভেতর ঋতু আসছে ঋতু যাচ্ছে।
ঋতুচ্ছন্ন হতে হতে সিরাজকে ডেকে বললাম, আমাকে বোধহয় হাসপাতালে নিতে হবে...
বৃষ্টি বাড়ছে। বোধহয় জ্বরও। খুব রাগ হলো, হাতের কাছে যা ছিল ছুঁড়ে ফেলছি। বইপত্তর সব। ছুঁড়ে ফেলা বইয়ের ফাঁক গলে উঁকি মারল নীল খামের মাথা। কী ওটা? হাত বাড়িয়ে নিতে পারছি না। সিরাজকে ডাকতে এগিয়ে এসে বইটা হাতে তুলে দিয়ে বেরিয়ে গেল। খুব দূর থেকে ভেসে আসছে কারো অস্পষ্ট ফোনালাপ।
খামে কিছু লেখা নেই। খুলে দেখলাম দু’ সপ্তাহ আগের একটা চিরকূট। সম্বোধনহীন। শুধু লেখা আছে, যদি হাতটা বাড়াই, ধরবেন?
মাথার রিমঝিম ছাপিয়ে বুক জুড়ে থরে থরে তখন হলুদ কারনেশন!
আচ্ছন্ন হতে হতেও ঋতুকে খুঁজতে হাতড়ে তুলে নিচ্ছি মুঠোফোন।
ফোন বাজছে...
দরজায় বেল বাজল টুং...



1 কমেন্টস্:

  1. অসাধারন। আজ অফিসে এসেই প্রথমে নিজের লেখা তারপরই আপনার লেখাটা পড়লাম। দারুন শুরু হল সকালটার। ধন্যবাদ মেঘ অদিতি। আগে আপনার ছবি দেখেছি তমালদার পোষ্টে। আজ লেখা পড়লাম। সব কিছুই দারুন। শুভেচ্ছা আপনার জন্য।

    উত্তরমুছুন