বাবা, মা, আমি এবং সুচিত্রা সেন
(মহানায়িকা আজ সকালে প্রয়াত। শোকার্ত বাঙালি। কয়েক প্রজন্মের সিনেমা অনুরাগী তাঁর মাদকতায় আচ্ছন্ন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঝুলিতে তারই কয়েকটি টুকরো। রসরচনার আঙ্গিকে লেখাটি আশাকরি কারও আবেগকে আহত করবে না।)
(এক)
সুচিত্রা লন্ড্রি। উত্তম ধোলাই। আমাদের পাড়ার প্রথম লন্ড্রি। সুচিত্রা লন্ড্রির নিচে একটু ছোট অক্ষরে ‘উত্তম ধোলাই’। এই উত্তম ধোলাই শব্দ দুটি নিয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে একটু চোখ টেপাটেপি একটু অর্থপূর্ণ হাসি ঐ বয়সেও আমি বুঝতে পারতাম। সত্যি বলতে কী, ঐ নাম দুটির কাছাকাছি অবস্থান আমাকেও একরকম ইয়ে করতো। ঐ বয়সেই। লন্ড্রির সামনে দিয়েই যাতায়াত - স্কুল, খেলার মাঠ, মুদিখানা যেখানেই যাই সামনে দিয়েই। যতবার চোখ পড়ে ততবারই শিহরণ জাগে। ঐ বয়সেই!
(দুই)
আর একটু বড় তখন। ফাইভ, সিক্স বা সেভেনে পড়ি। আমার পরের বোন তিন ক্লাস নিচে। ও একদিন স্কুল থেকে ওর বয়সী একটি মেয়ে ও তার ভাইকে নিয়ে বাড়িতে এলো। চাপা উত্তেজনার সঙ্গে মুখে বিশ্বজয়ের ঝিলিক। মাকে বললো - সুচিত্রা সেনের নিজের দিদির নিজের (অধিকন্তু ন দোষায়) ছেলে আর মেয়ে। ওদের স্কুলে ভর্তি হয়েছে দু’তিন দিন হলো। মা তো আরও উত্তেজিত। আমি স্কুল থেকে ফিরে সব শুনে উত্তেজনা লুকোবার ব্যর্থ চেষ্টা করে একটা কাচের প্লেটই ভেঙে ফেললাম। বাড়িতে তিনটে কাচের প্লেট আস্ত ছিলো (বাবা-মায়ের বিয়েতে পাওয়া ছ'টি প্লেটের তিনটি)। VIP এলে নামানো হতো। যাক, দুটো প্লেট আস্ত, VIPও দুজন!
তখনকার সময়ে তের বছরের বালক দশ বছরের বালিকার কাছে গিয়ে Hi বলে হাত বাড়িয়ে দিতে পারতো না। তাই নানা রকম অজুহাত তৈরি করে ওঘরে যেতে হচ্ছে। একবার বই, তারপর খাতা এবং তারপর পেনটাও তো লাগে! মা খুব ব্যস্ত রান্নাঘরে। তারই মধ্যে, "কিরে আজ খেলতে গেলি না"। না, হোমটাস্ক করতে হবে। পাশের ঘরে সুচিত্রা সেনের নিজের...! “তুমি খেলো না গিয়ে। পরে করবে হোম টাস্ক। বাবাকে দৌড়ে গিয়ে বলো মিষ্টি কিনে দিতে”। একরাশ মেকি বিরক্তি নিয়ে বলি হোমটাস্কটা... জামাটা তো আবার ওঘরে। মা জামা আনতে যাবার উদ্যোগ করতেই একলাফে ওঘরে। বোনের সঙ্গে গল্পে মগ্ন সুচিত্রা সেনের নিজের...
একমিনিট দূরে বাবার অফিস। উত্তেজনা ও হাঁফ ধরে যাওয়ার কারণে আমার সামান্য কথাটা বুঝতে বাবার খানিকটা সময় লেগেছিল। বুঝে যাবার পর এবার বাবা উত্তেজিত। “না না, শুধু মিষ্টি তে হয় নাকি, গরম গরম সিঙাড়াও নিয়ে নিচ্ছি!” “মা বললো আমাকেই নিয়ে যেতে। তোমার যদি দেরী...”। “না না, একশো চার ডাউনটা চলে গেছে, পরের ট্রেন আধঘণ্টা পরে। তুই যা, বাড়িতে সুচি... সাহাকাকু পাছে শুনে ফেলেন, তাই কথাটা শেষ করেন না।
“বোসবাবু আমার কাউন্টারটা একটু খেয়াল রাখবেন তো!” উত্তেজনার মাথায় সাহাকাকুকে বোসবাবু বলে বাবা চলে গেলেন। হতাশ আমি, অবাক হলাম এই ভেবে- বাবা তুমিও!
মন খারাপ করে ফেরার পথে। বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার আর একমাত্র সুযোগ - যদি ওদের বাড়ি পৌঁছে দেবার দায়িত্বটুকু বাবা আমার ওপর ছাড়তে পারে! তবে আর ভরসা করা যাচ্ছে না, বাবার যা অবস্থা... মা'র কথা ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
মা ততক্ষণে অতিথিদের সঙ্গে বসে গেছে। “তোমার মাসিমণি প্রায়ই আসেন নিশ্চয়ই? এলে একবার নিয়ে এসো, কেমন! তোমাদের বাড়িতে উত্তমকুমারও এসেছেন নিশ্চয়ই? সিনেমায় যেমন দেখি, অমনি? খুব সিগারেট খান, না? তোমার মাসি বকেন না? আমি হলে এমন...!” মা, মাগো, তুমিও??
আমার বাবা নেই, মা নেই, অনাথবৎ আমি বসে আছি। পাশের ঘরে সুচিত্রা সেনের নিজের দিদির / বোনের নিজের...
প্রদীপ, পারিসও, এর আগে তোর এমন সরস গদ্য পড়িনি, মাইরি। কী ভাল যে লাগল, কি বলব। পড়ছি আর হাসছি।
উত্তরমুছুন