কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৪

১২) সঞ্জিতা সেন

আলো-ছায়া



শীতের বেলা দশটার রোদ্দুর জলাশয়টিকে একটি বিশাল আয়নার মতো আকাশের দিকে ধরে রেখেছে। ঝিলের ঠিক মাঝখানটায় নোঙর করা কাঠের নৌকার গলুই-এ বসে আছে অনড় একটা পাখি – যেন চাইনিজ ইঙ্ক দিয়ে আঁকা। একটা পানকৌড়ি। তীক্ষ্ণ তীরের মতো নিঃশব্দে জলে ঝাঁপ দিল। তার বেশ কিছুক্ষণ পর উঠে এসে আবার নৌকার কিনারায় বসলো – ঠিক যেখানে বসেছিল আগে। তবে এবার ডানা ছড়িয়ে অনড় মূর্তি। সে তার ডানাদুটি এবার শুকিয়ে নিচ্ছে। তার ডানায় জল দাঁড়ায় না। যেন পদ্মপাতা, জলে থাকে, তবু জল তার মধ্যে বাস করতে পারে না। এই পানকৌড়ির চিত্রকল্প মাথায় বয়ে সপ্তাহখানেক নানা কাজে ঘোরাফেরা করে সে। চায় বা না-চায়, আসলে প্রতিটি মানুষই বস্তুত পানকৌড়ি। নিজের চেনা ঝিলে তার যাপন। জল তার জীবন। নৌকার কোণা তার সারা দিনের ঠেক। তারপর ডানার প্রতিটি জলকণা ঝেড়ে ফেলে সে কোথায় চলে যায়, কেউ কোনোদিন জানে না।

পানকৌড়ি সমেত নৌকাটি খোলামকুচির মতো ঝিলের কেন্দ্রে, আকাশ আর নিম-নিশিন্দা-অশোকগাছের ছায়ায় পাড় বসানো ফ্রেমে।। ঝিলটিকে কেন্দ্রে রেখে যে রাস্তা ঘুরে গেছে, সেখান দিয়ে হেঁটে গিয়ে মাঠ পেরোলে ওপাশে ইনস্টিটিউটের বাড়িটা। ওখানে পৌঁছোতে গেলে যে পথটা, তার দু’ধারে সারা বছর ফুটে থাকে যে সব ফুল, তাদের গাছগুলো সব বিশাল। একেক ঋতুতে তারা একেকজন স্বর্গতরু হয়ে ওঠে। বনতল তখন ফুলের বাগিচা।

সেই পথে গবেষণাগারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে চলে বন-নীলিমা। ডাকনাম নীলি। তার নিজের পছন্দ তার রাবীন্দ্রিক দাদুর দেওয়া ভালো নামটাই। যেতে যেতে সে দেখতে পায় দু’জন সাধারণ ঘরের বৃদ্ধাকে। তাঁরা একে অন্যকে চলতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন মাঝেমধ্যে। কেমন যেন হারিয়ে যাওয়া শিশুর মতোন মুখচোখ তাঁদের। তাঁরা বন-নীলিমার কাছে জানতে চান, বাগানে রাখা যশোদা-কৃষ্ণের ভাস্কর্যটি কী দিয়ে বানানো! সে তাঁদের জানায়, এটা পোড়ামাটির কাজ। এক বৃদ্ধা বললেন, “যা দিয়েই তৈরি হোক্‌, কী অপূর্ব সুন্দর!”

বন-নীলিমা কথায় কথায় জানতে পারে যে, এঁরা দুজন এই প্রথম এই বাগানে এসেছেন। “এলামই যখন এতদূর, ভাবলাম একটু ঘুরে দেখে যাই। কী কী দেখার আছে?” ওঁদের মাথার ওপর ছাতা ধরে আছে বিশাল কাঞ্চনগাছ – শ্যামকাঞ্চন-নীলচে বেগ্‌নি ফুল – অসংখ্য। বন-নীলিমা প্রশ্ন করে, “এটা কী গাছ, বলুন তো?” এক মহিলা বলেন, “না, ঠিক চিনতে পারছি না। দেখেছি বলে মনে পড়ে না”। সে বলে, “কাঞ্চনগাছ”। “হ্যাঁ হ্যাঁ, নামটা শোনা, দেখিনি কোনোদিন। ওহো, এটাই সেই কাঞ্চনফুল! ওই যে রে, বিনুদিদি বলতেন, তাঁদের বাড়িতে এই ফুল ফুটতো!” বন-নীলিমা তাঁদের দেখায়, “এই যে দেখুন, ফুল পড়ে আছে গাছের পায়ের কাছে, ঝোপ-বেড়ার ওপাশে। মাটি থেকে তুললে কেউ আপত্তি করবে না, তুলে দেখুন, কেমন!” দু’জনের মধ্যে কেমন একটা দ্রুততা এসে যায়, তাঁরা ফুল হাতে নিয়ে নিসর্গের সাথে একাত্ম হয়ে যান। বন-নীলিমা ‘আসি’ বলে রওনা দিতেই তাঁরা বললেন, “চিরদিন এমনই থাকবেন!” ঘুরে দাঁড়িয়ে সে হাত জোড় করে নতশিরে প্রণাম করে। ঈশ্বরের নিউ-ইয়ার গিফ্‌ট!

ফুলন্ত কাঞ্চনগাছের নিচে বিবর্ণ শাড়ি পরিহিতা দুই বৃদ্ধা শৈশবের খুশিতে উজ্জ্বল। কাঞ্চনগাছ আজ বন-নীলিমার মনে জীবনের অনুষঙ্গকে আরও একবার মনে করিয়ে দেয়। বছরের শেষ দিনে মায়ের বাড়ির জানালা দিয়ে একবার সে দেখেছিল এরকমই পুষ্পিত এক শ্যামকাঞ্চন – পাতা প্রায় দেখাই যাচ্ছে না, এত ফুল... এত ফুল...! আর জানালার কাছে খাটের ওপর শেষ শয়নে তার ভাইটি, শালপ্রাংশু; তাকে ঘিরে কয়েকজন নারী – যাঁদের মুখ দেখা যায় না – শালের অবগুন্ঠনে ছায়াবৃতা।

ঝিলের জল থেকে নিঃশব্দে উঠে এসে পানকৌড়ি তার ডানা থেকে সব জলকণা ঝেড়ে ফেলে উড়ে যায়। ফুলের প্রাচুর্যে ভরা শ্যামকাঞ্চন গাছ থেকে সুতীব্র স্বরে ডেকে ওঠে এক গান-পাখি।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন