কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৪

০৭) শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়

ডোরাকাটা



বেদানার চারপাশে মৌমাছির মৃদু গুনগুন শুনে ঘুম ভাঙার ঠিক আগের মুহূর্তে স্বপ্নটি দেখেছিলাম; সেখানে কোনো পিঁপড়ে ছিল না, জেগে থাকা দ্বীপের খন্ডপাথর ছিল, দু’ফোঁটা জলের বিন্দু ছিল, কিন্তু না; কোনো পিঁপড়ে ছিল না। আমার স্বপ্নে পিঁপড়ে বিশেষ আসে না। ওয়াড্রবপূর্ণ পা আসে, জ্বলন্ত জিরাফ আসে, বিষণ্ন ঘোড়া ও কঙ্কাল বা লম্বা জিভও আসে, কিন্তু না; পিঁপড়ে কোনো কালেই আসে না। পিঁপড়ে নিয়ে আমি কোনো কালেই ভাবিত নই; দেখলেই হয় টপাটপ আঙুল দিয়ে টিপে মেরে ফেলি, নয়তো নিজেকে উৎকৃষ্ট ভাবার প্রবণতায় পাশ কাটিয়ে মগ্ন থাকি নিজের নিত্যকার কাজে। পিঁপড়ে নিয়ে ভাবিত হওয়ার ফুরসৎ আমার নেই, ছিল না কোনো কালেই।

পিঁপড়ের কথা এলেই আমার হৃদয়বানের কথা মনে পড়ে। হৃদয়বান বিষণ্ন একলা মুখচোরা এক পুরুষ। সিঁড়ির ঘরের নিচে থাকতো সে। আমাদের পাশের স্যাঁতস্যাঁতে দোতলা বাড়ির আড়ালে যে ঝরে পড়া চুনকামওয়ালা কাঠের দোতলা বাড়ি, তার নিচের তলার পাকা ঘরগুলোর পাশ দিয়ে উঠে যাওয়ার মুখে লড়ঝরে সিঁড়ি, আর তার লাগোয়া যে ঘর, সেই ঘরে হৃদয়বান থাকতো। পাড়ার সকলেই জানতো হৃদয়বানের প্রেমিকা আছে। কিন্তু কে সেই প্রেমিকা, তা আমার জানা ছিল না, যদিও বাকি আর সব কথাই আমার জানা বলে দাবী করে থাকি। হৃদয়বান রোজ সকালে বাজার যেত, বাজার করে হেঁটে ফিরতো, তার পর রান্না করে বাসন মাজতো। বাড়িতে বিভিন্ন বয়সের অনেক ছেলেমেয়ে পড়তে আসতো, তাদের পড়ানো শেষ হলে হৃদয়বান সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কারও তোয়াক্কা না করে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা গায়ে ঘষে ঘষে তেল মাখতো, আর কুয়ো থেকে জল তুলে স্নান করতো। দুপুরে রান্নার বাকি অংশটুকু খেয়ে বাসন মেজে হৃদয়বান দরজা জানালা খোলা রেখেই ঘুমোতো। বিকেল হলে ছেলেমেয়েরা বেল বাজিয়ে উঠোনে ভিড় করলে, আবার পড়ানো শুরু করতো। একেবারে রাত ন’টা অব্দি পড়িয়ে ঘরে তালা দিয়ে সে বেড়িয়ে পড়তো। কোথায় যেত হৃদয়বান এতো রাত করে, আর কত রাতেই বা ফিরে আসতো, তা আমার জানা নেই। যদিও ওর সম্পর্কে বাকি আর সব কথাই আমার জানা ছিল বলে আমি দাবী করতেই পারি...। পরদিন সকালে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দেখতাম হৃদয়বান বাজার যাচ্ছে ঝুঁকে, হাত দুলিয়ে, গভীরভাবে কিছু চিন্তা করতে করতে।

হৃদয়বানের প্রেমিকা আছে, সবাই জানে। আর জানে, সে পিঁপড়েদের খুব ভালোবাসে এবং পিঁপড়ে পোষে। এসব কিছুতেই আমার কোনো কৌতূহল ছিল না কখনোই, কিন্তু হৃদয়বানের সব গল্পই আমার জানা। গ্রীষ্মের দুপুরেও আজকাল জানালা বন্ধ করে সিঁড়ির ঘরের ভ্যাপসা গরমে সে কেন থাকছে, এই কৌতূহল কেবলমাত্র একটি দিনের জন্যই আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল নিজের অজান্তেই, জানালায় উঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে। আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো লড়ঝরে সিঁড়ির চতুর্থ ধাপ পর্যন্ত তুলে নিয়ে গিয়েছিল। আসলে আজকাল প্রায় দুপুরে দরজা জানালা বন্ধ করে হৃদয়বান খেলা করত নিজের সঙ্গে আর মনে প্রাণে ভাবতো তার প্রেমিকার মুখ ও তার কথাগুলোকে। সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে অমোঘ আকর্ষণে দেখেছি আর নিজে যেন এক ল্লিগাট বন্দরের উপকূলে ভেসে বেড়ানো হলুদ ও নীল পরীর মতো পালটে নিচ্ছি নিজের মনের ভেতরকার দুই অবস্থান। পিরামিডের মতো দুই পাহাড়ের ধাপ চাষের আদলে রোপন করে রাখছি নিজের সমস্ত মায়াগুলোকে, বুনোট পারম্পর্যে সেগুলোতে আগামী কোনো ঋতুতে মাটি ফুঁড়ে চারা বের হবেই, এই দৃঢ় বিশ্বাস মেঘ ফুঁড়ে দ্যুতির মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে বন্দরের পালতোলা আগমনী নৌকাতে। এখন দিব্যি বুঝতে পারছি, হৃদয়বান টের পেয়েছে, জানালার বাইরে আমি নিঃস্পলক তাকে দেখছি নিজের সঙ্গে খেলা করতে; আর সব ভুলে হৃদয়বান পিঁপড়ে জমানো কাচের বোতলগুলোর দিকে তাকিয়ে তীব্র হয়ে উঠছে, তীব্র থেকে তীব্র স্ট্রোকে সে যেন আঁকছে তার প্রেমিকার মুখাবয়ব। কোনো কার্ভ লাইন নেই সেখানে, টানটান সমান্তরাল, উপরে নিচে টানছে রেখা আর সরলরেখার মতো ডোরাকাটা মুখের প্রেমিকা ছড়িয়ে যাচ্ছে হৃদয়বানের সমস্ত স্নায়ুতে, ক্লান্ত করে দিয়ে তাকে শুইয়ে দিয়েছে সাদাকালো, গুমোট দমবন্ধ করা ঘরের ডোরাকাটা বিন্যাসে।

বাইরে দাঁড়িয়ে দম আটকে মুখ বুজে স্থানুবৎ দেখে যাচ্ছি কেবল এক নির্মাণকার্য। নিজের মুখের কাছে হাত চাপা দিয়ে শ্বাস বা কথা আটকাতে যাব এইরকম একটা কিছু ভাবছিলাম যখন, দেখি দু’ঠোঁট শক্ত করে বুজে রাখার ফলে মুখটা ঘষে গিয়েছে, আর অসংখ্য পিঁপড়ে সেখানে জমা হয়েছে। মুখের ত্বক পেশী খুঁড়ে পিঁপড়েরা ঢুকতে চাইছে মুখগহ্বরে। মেটালিক ফিনিশ্‌ড বডির এক একটি ডাঁই সর্বশক্তি দিয়ে ফুটো করে দিচ্ছে আমার মুখ। ব্যথা যন্ত্রণায় নীল হয়ে আসছে চামড়া আর দম আটকে আসছে। তীব্র ভাবে কথা বলার ইচ্ছায় বা চিৎকারই না হয় করে বসলাম! কিন্তু না, মুখের এই পার থেকে ওপার করার জন্য কেবলমাত্র নির্ভর করতেই হচ্ছে পিঁপড়েগুলোর ওপর। এদিকে ব্যথায় নীল হয়ে যাওয়া কামড়গুলোকে সহ্যের এক পরাক্রমশীল ক্ষমতা এখন খুঁজে পাচ্ছি হৃদয়বানের চোখে চোখ রেখে। জানালার আধবোজা ফাঁকের আলো দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হৃদয়বানের টিসতানের মতো ফুলে ফেঁপে ওঠা পেশীর ঢেউগুলোকে। এদিকে মুখে ফাটল ধরিয়ে পিঁপড়েগুলো এতক্ষণ আমার মুখকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে কয়েক জায়গায়। আর এই প্রত্যাশিত জয়লাভে আরও উচ্ছ্বসিত হয়ে অঝোরে সিঁড়ির সিলিং হতে পিঁপড়েরা সব নেমে এসে কাটতে শুরু করেছে আমার মাংসল মুখের ত্বক হতে পেশী সবকিছুকে। কত দীর্ঘ সময় পিঁপড়েদের লাগতো আমার সম্পূর্ণ মুখটিকে কামড়ে খেতে, জানা গেল না! কারণ, তার আগেই বুক ঠেলে কান্না উঠে এলো। কারো এক পরিচিত কন্ঠস্বরের ডাকে উত্তর দিতে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম, শব্দের বদলে উঠে এলো কান্না আর সব শক্তি দিয়ে মুখের মাস্‌লগুলোকে সচল করার দুর্নিবার প্রচেষ্টার ফলে কান্নার বদলে বমি হয়ে গেল পিঁপড়ে। দলা দলা পিঁপড়ের পিন্ড বেড়িয়ে আসতে শুরু করলো মুখ হতে। যত পরিমান পিঁপড়ে বাইরে থেকে ভেতরে ঢোকার জন্য কামড়ে যাচ্ছিল অনবরত, তার সহস্রাধিক পিঁপড়ের পিন্ড অবিরাম বেড়িয়ে আসতে শুরু করলো মুখ দিয়ে। ছড়িয়ে পড়তে থাকলো সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে, উঠোনে, জানালায়...। ভরে যেতে থাকলো হৃদয়বানের পিঁপড়ে জমানোর বোতলগুলোও...। মুচকি হেসে ঘামে স্নান করা শরীর নিয়ে পিঁপড়ে ভর্তি বোতলগুলোকে একবার ঝাঁকিয়ে রেখে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল হৃদয়বান। ওদিকে আধবোজা জানালার আলোতে তার ডান কাঁধের নিঃসঙ্গতায় জমতে শুরু করলো খোলস ও জীবাশ্ম সকল...

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন