কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৪

০৪) সুবীর সরকার



মাহুত বন্ধু রে



(১)

উঁচু টিলার ওপর রাজবাড়ি। লাল টিয়া। টিয়া উড়ে যায় তামারহাটের দিকে। আসারীকান্দির দিকে। রাজবাড়ির পিছনে বিস্তৃত জলরাশি। বাওবাতাস। কাঁপে তিরতির জলরাশি। লাওখোয়ার বিল। কোষা নৌকো। নদীয়া হোলা। সারা রাতের গানবাজনা সেরে ফিরে যাচ্ছে বসন্ত মালী সুধীর রায় সীতানন্দ বুড়া। ঢোল দোতরা সারিন্দা সহ। গানের পর গান। মদিরাঘন পরিস্থিতি পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়েও কেন যেন আর বেরিয়ে আসা হয় না। টিলা থেকে নেমে বসন্ত ঈষৎ দিগভ্রান্ত হলো। সে কোথাও যাবে। বড় রাজকুমারীর বাড়ি! না কি গোলোকগঞ্জের হাট! সংসার তো সেভাবে আর আটকে রাখতে পারলো না। জন্ম জন্ম ধরে গানের পৃথিবীতে সে যেন গরুর রাখোয়াল। কত কত বছর পূর্বেকার তামারহাটের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা বুনো দাঁতালের গৌরীপুর শহরে ছুটে আসবার দৃশ্যখন্ডটি তাকে হাতছানি দেয়। সেই বুনোকে শেষতক বাগে এনেছিল লালজি রাজা। রঘুনাথ মাহুত। তারপর মাহুত ফান্দিদের সঙ্গে তাকে যেতে হয়েছিল বগরীবাড়ির টিলাপাহাড় ঘেরা বনাঞ্চলে লালজি রাজার হাতিক্যাম্পে। সেখানে ধুনি জ্বালিয়ে রাতভর চলতো কত কিসিমের গান। আগুন জ্বলত। লালজি রাজার হাসির শব্দ বনভূমিতে চঞ্চলতা জাগাতো। ফান্দি দফাদার মাহুতেরা গানের পর গানে মাতোয়ারা হতো। বসন্ত মালী তখন দোতরা বাজাতো। ঢোল বাজাতো। কাঠি ঢোল। গোয়ালপাড়ার কাঠি ঢোল। গানের তাড়সে সুরের নেশায় ফান্দিমাহুতদের শরীরে একেক সময় নাচ এসে যেত। নৃত্যছন্দ এসে যেত। দু’এক পাক নেচেও উঠতো তারা। ঢোল দোতরা বাঁশির আওয়াজে তীব্রতা আসতো আরো--

নাল শাড়ি পিন্ধিবে ময়না
নাল শাড়ি নে
ভূটান মহালের মাহুত রে তুই
গৌরীপুরিয়া ফান্দি
মোটরগাড়ি চড়বে ময়না
নাল শাড়ি নে...
এত কিছুর ধারাবাহিকতায় কেবল স্থির হয়ে থাকতেন লালজি রাজা। হাস্যময় বলিরেখা শোভিত প্রসন্ন মুখমণ্ডল। মাথায় শোলার টুপি। রাজবাড়ি থেকে নেমে এসে এমত দৃশ্যমায়ার স্মৃতিলহর কেন যেন বারবার গ্রাস করেই ফেলে বসন্ত মালীকে। আর তামারহাটের দিকেই উড়ে যেতে থাকে কেবলি লাল টিয়া।




(২)

ভ্রম ও বিভ্রমের বাইরে এসে দাঁড়ালেই বসন্ত মালীর সঙ্গে সুধীর রায়ের সামান্য দৃষ্টি বিনিময় হয়। এই পর্বে আমরা দেখি গানের নিবিড়ত্বে গান। পৃথিবীর স্থিরতর হয়ে থাকাটাকে গতিজাড্যতা এনে দেবার তীব্র প্রয়াসে গদাধর নদীর কোনো এক মানুষডোবা চরে দলবদ্ধ হয়ে মেয়েদের নাচ গান। তরঙ্গায়িত হয়ে বিমূর্ত থেকে মূর্ত হতে থাকে। নদীর হাওয়ায় ধুলোর ঘূর্ণী হয়। চরময় ছড়িয়ে পড়ে ধুলোর কুয়াশা। খিলখিল হাসির শব্দে গান ও নাচ সহ এক নতুন রকম নাচগানের পৃথিবীই বুঝি কেবল চিরায়ত দৃশ্যের মতো জেগে থাকে--
যৌবন রঙ্গের খেলা রে
নয়া নদীর জল যেমন হে
ঔ না যৌবন বান্ধিয়া রাখিনুং
রঙ্গিলা আঞ্চল দিয়া রে

এত এত গানের এত এত নাচের খুব গভীরে প্রবেশ করবার পর সুধীর রায় ও সীতানন্দ বুড়া এক ধরনের নৈকট্য টের পায়। তাদের হাতের দোতরা সারিন্দা দিয়ে তারা দৃশ্যটুকরোগুলিকে আত্মস্থ ও আত্মগত করে তুলতে থাকে। তাদের মনে পড়ে রাজাবাহাদুরের বড় বেটির, মানে নীহার রাজকুমারীর সেই বাঘ শিকারের গাথাগল্পটির কথা। রাজাবাহাদুরের প্রিয় হাতি জংবাহাদুরের হাওদায় বসে রাজকুমারীর বিশাল বাঘটিকে উদ্যত থাবাদাঁতনখের বিপজ্জনকতা নিয়ে ছুটে আসা, ডোরাকাটা হলুদের অপার্থিব সৌন্দর্য নিয়ে ছুটে আসা বাঘটির দিকে ছুটে যাওয়া গুলির শব্দ আজো যেন রূপসীর জঙ্গলবাড়ি থেকে ভেসে আসা বিরহী গানের সুরের মতো ক্রন্দন করতে থাকে। আর সেই ক্রন্দনআর্তি হাহাকার আজও ঘুর ঘুর ঘুর উড়ানী কইতরের গানের মতো দশ কুড়ি গ্রাম-বিল-ঝিল ঝাড়টুকরো অতিক্রম করে গুমরে মরতে থাকে গৌরীপুরের আকাশ বাতাসের শূণ্যতায়। সুধীর সীতানন্দ তাদের বাদ্যবাজনায় একে একে এনে ফেলতে থাকে হাতির মাহুত, নবনী গাড়িয়াল ও মইষাল বন্ধুর জন্য গাইতে থাকা অনবদ্য সব গানগুলিকেই। এত এত ঘটনাক্রমের সাথে তাল মেলাতে না পারলেও শীতকুয়াশার পৃথিবীতে কার্তিক পেরোনো প্রান্তরে প্রান্তরে গত জন্মের দিনকালগুলির কথা মনে পড়ে। স্মৃতিকাতরতা দিয়ে তো আর পুরনো স্মৃতি থেকে বেরিয়ে নতুনে ঢুকে পড়া যায় না! রাজবাড়ি থাকে। রাজার বেটির গান থাকে। ঢোল দোতরার আশ্চর্য সঙ্গতটুকুনও থাকে। কেবল স্মৃতি থেকে গজাতে থাকে আরো আরো স্মৃতি ধারাক্রম ধারা বজায় রেখেই।



(৩)
কালা ছাড়িয়া না যাইস রে
বুকে স্যালো দিয়া
হাঁটিয়া যাইতে ক’মর ঢোলে
আহারে কাঙ্ক্ষিনী গছের গুয়া...

গদাধরের পারে পারে রোজকারের জীবনযাপনের ভিতর বাধ্যতই অভ্যেস এসে পড়লে বেঁচে থাকবার ভিতর এসে পড়া কৌতুকটিকে পুনঃস্থাপন করতে করতে, রাজার বেটি একসময় রাজবাড়ি ও উঁচু টিলাকে নিজের অতীতের কালখণ্ডের খুব কাছাকাছি পৌঁছে দিতে চাইলেও, রাজকুমারী কিছুতেই নিজেকে স্মৃতিকাতর করে তুলতে চান না। তার শুধু গান চাই। অতীতের সব আলোঝলমলতায় কেমন ভেসে ওঠে ব্রহ্মপুত্রের সব চরগুলিতে রাতের পর রাত শীতকুয়াশার চাদরে ঢাকা প্রান্তিক সব মানুষের ভিতর আস্ত এক গানবাড়ি নিয়েই কেমন ঢুকে পড়া। কোনো খেই থাকে না জীবনে। নিয়ন্ত্রণহীন জীবনে কেবল গানের পর গান ঢেউ-এর ভাসমান মোচার খোলের মতো। সেই সব সিজিলমিছিলের পাশে রাজাবাহাদুরের শিকারজুলুস। বাদ্যবাজনার স্ফুরণ। প্রতাপ সিং-এর জোড়া দাঁতের হাওদায় বিশ্রামরত চিতিসাপ। ঝমঝম বৃষ্টির ভিতর কেমন বাল্যকাল! বৃষ্টির শব্দের ঘোরাচ্ছন্নতার ভিতর, নিশীথপোকার গুঞ্জনের ভিতর কেমন দোতরা বাজিয়ে যেতেন করিতুল্লা বয়াতি! বয়ান শেখ। শরীরময় নাচ নিয়ে জীবনের জীবন হয়ে ওঠার সমগ্রতা নিয়ে তাকে নাচ শেখাতো শরৎসুন্দরী বড়ুয়ানী। এ কোনো প্রথাগত শিক্ষা নয়। পরিপার্শ্ব বাজনার মতো ছন্দের বহতা নিয়েই কেমন ঢুকে যেত রক্তের ভিতর যাপনচিত্র হয়ে।




(৪)

নিন্দের আলিসে তাকে কিঞ্চিৎ স্মৃতিময় হতেই হয়। সে তার আভিজাত্য দিয়ে সারল্য নিয়ে একগুঁয়েমি দিয়ে হাহাকার নিয়ে প্রেমময় আর্তি নিয়ে নতুন ধানের গন্ধ নিয়ে গৌরীপুরের মাহুতবন্ধুদের নিয়ে গদাধরের পারে পারে হেঁটে বেড়াতে থাকা জ্যেঠবাবাকেই যেন আবডাল থেকে দেখে ফেলে। আবার তার ভ্রম ভাঙতেও সময় লাগে না। জ্যেঠবাবা নেই। লালজি রাজা নেই। রাজপাট কামলাকিষাণ হাতি ফান্দি কিছুই নেই আজ। তবুও অভ্যেসের চিরকালীন মত্ততায় সে নিজের জীবনকে জীবনের হাতেই ছেড়ে দিয়ে কেমন উদাসীন হয়ে পড়ে। রাজবাড়ির আভিজাত্য ভেঙে গোটা রাজপরিবারই তো বরাবর নেমে এসেছিল মিশে থেকেছিল সাদাসাপটা ধুলোমাখা হাটমাঠের জনমানুষের ঘামঘ্রাণের ভিতর। মিশে থাকতে থাকতে কখন কীভাবে যেন কিংবদন্তীর গাথাগল্পের জন্ম হয়েছিল। গানগুলি নাচগুলি সে ছড়িয়ে দিয়েছিল সঞ্চরণশীল মেঘের মতো চারপাশের মানুষদের সমগ্রতায়। তার দুই মেয়েও তো লোকগান নিয়ে নাচ নিয়ে তারই উত্তরাধীকার বহন করতে করতে একসময় শিয়ালডাকা গ্রামদেশের অন্দরে কন্দরে রাজবাড়ির গান-নাচকেই চূড়ান্তের দিকে নিয়ে যাবার প্রয়াসটুকুই অনুমোদনের অপেক্ষায় না থেকে চিরদূরত্বের এক রঙিলা দালানকোঠার দৃশ্যচিত্র হয়ে জলঘুঙ্গুরার বাজনের মতো মুখরিত হয়ে উঠেছিল। এত কিছু নিয়ে সাজানো জীবন মানুষের। অথচ কেউ কি কখনো ভাবে--
দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে
রঙিলা দালানের মাটি
ও গোঁসাই জি, কোন রঙ্গে




(৫)
বইল মাছে
খেইল খেলায়...

রাজবাড়ির সামনে হাওয়াখানার সামনে উঁচু টিলার ওপর অ্যানথ্রাক্স রোগে মরে যাওয়া লালজি রাজার সেই হাতিটি; প্রতাপ সিং যার নাম, তার সমাধির ওপর ফুল ছড়াতে ছড়াতে রাজকুমারীর মনে পড়ে যায় বাল্যের সব দৃশ্যগুলি। প্রতাপ সিং-এর সামনে নেচে নেচে সে গান ধরতো--
হাতি রে তুই দমিয়া দমিয়া নাচেক রে
মধুমালার হাতি রে
লালজি রাজার হাতি রে...

শুঁড় দুলিয়ে আহ্লাদিত হতো প্রতাপ সিং। খুদে খুদে চোখে অপার খুশির ঝিলিক। রঘুনাথ মাহুতের কাছে, রঘুনাথের বাবার কাছে প্রতাপ-এর নানান আশ্চর্য গল্পগাছা শুনতে শুনতে সে তার নাচ তার গান তার ঘুরে বেড়ানোর জীবনেই কেবল ভেসে বেড়াতো। তখন জ্যেঠোবাবার হাতি বড়বাবার হাতি লালজি রাজার হাতি পার্বতী বাই’দর হাতি সব যেন সার সার হেঁটে যেত গদাধরের পারে পারে, চরে চরে। লাউখাওয়ার বিলের পাশে নৃত্যবাদ্যগীতের শোভাযাত্রায় নাচতে নাচতে জীবনের পর জীবন চলে যাওয়া আগমনী চাপড় অভয়াপুরী তামারহাট বা ধুবড়ির দিকে। গোলকগঞ্জ রতিয়াদহ অতিক্রম করতে করতে আলাউদ্দিন ভাইজানের গানের সুরকে প্রলম্বিত করবার জন্য চারপাশে ভরা রোদের ভরভরন্তের ভিতর কেমন বাঁশি বেজে উঠতো। তরলাবাঁশের বাঁশি। প্রেমানন্দ ঠোঁট ছোঁয়ালেই সংক্রামিত হয়ে ওঠা সেই বাঁশি আবেগথরথর এক বাঁশিয়ালের বৃত্তান্ত রচনা করতে করতে অনেক অনেক রূপকথায় যেন সাঁতার কাটতে থাকা মাছেদের গোপন ঘাই হয়ে ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি নিয়েই বৃত্তাকারে হতে থাকতো। রাজকুমারী বলো, রাজার বেটি বলো, সবাই তখন পরি্পূর্ণতা নিয়ে যেন বিনির্মিত ভরা যুবতীর পায়রাজোড়া। পাটগাভরু। প্রতাপ সিং-এর কথা বারবার ঘুরে ঘুরে আসে তার স্মৃতিতে, আর সে অনন্ত অতীত থেকে বর্তমানে ফিরতে চাইলেও সদাঅতীতময় এক তাড়না বোধ করতে থাকে। সমগ্রতার সঙ্গ অনুসঙ্গে বহন করতেই থাকে গৌরীপুর আর গৌরীপুর। অন্যমনস্কতায় তার কন্ঠে গুনগুন সুর চলে এলে সে সুরের ধরতাই-এ অবধারিত সমর্পণ করেই ফেলে নিজেকে। কবেকার ভরসন্ধের শীতে, শীতার্ত হতে হতে গড়িয়ে নামে গান। ঢোলবাঁশিসারিন্দার মিশ্রণে বেগবতী সেই গান যেন গড়িয়ে গড়িয়ে টিলা থেকে নামতে থাকে গদাধরের দিকেই--
ঝিকো ঝিকো কড়ি রে
আঞ্চলে বান্ধিয়া রে
যায় নীলীমণ গৌরীপুরের
হাট রে
নীলীমণ নীলায় ও না...




(৬)
আমতলি নদীতে
ঝাম্পলি খেলাইতে
খসিয়া বা পড়িল
বালির শিষের সেন্দুর রে...

গল্পের একটা সূত্র থাকে। গল্প থেকে গল্পে যাবার একটা ঘটনা পরম্পরাক্রম থাকে। সাঁকো বা ব্রিজের মতো। গল্পকে সাজিয়ে বসলেই তো আর হয় না! গল্পকে পটভূমি দিতে হয়। পরিসরের অবকাশটুকু দিতে হয়। গল্পকথকের চোখেমুখে শীতদুপুরের রোদ মাখা থাকলেও গল্প স্রোতময় নদীতে ভাসতে থাকা সাম্পান হয়ে যেন অনেক অনেক দূরে চলে যাবার ঘনঘটায় একধরনের রণমত্ততায় বর্ণিল হয়ে ওঠে, আর গল্প থেকে গল্পে যেতে যেতে জ্বলে ওঠে ক্যাম্পফায়ারের আগুন। রতিকান্ত দেওয়ানীর অব্যবহৃত বন্দুকনামার মরপৃথিবীতে নেমে আসা। রতিয়াদহ বাজারে একা একা গান জমিয়ে দেওয়া আব্দুল জব্বারের গানের হিজিবিজির ভিতর স্বপ্নের নানারকম দিকবিদিকের রসায়নে যেন হাড়িতে ভাত ফোটবার টগবগ শব্দের মায়া লেগে যাওয়া। রতিয়াদহ থেকে বেরিয়ে আসা গল্প তখন গঙ্গাধরের দিকে ছোটে। বাইচ খেলার গানতরজায় নানা কিসিমের আরো গল্প অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই তখন মিশ্রিত হয়ে যায়। পটভূমির ভিতর উপুড় হয়ে বসে থাকা গল্প তখন ক্লান্তি বিষণ্ণতা নিয়ে বাওবাতাসের আশ্রয় চায়। বাওবাতাসে মিশে গিয়ে বাওবাতাসেরই গল্প বয়ন করতে করতে সকল গল্প বুঝি রাজবাড়ির দেশেই ফিরতে থাকে। সেতু পেরিয়ে তো কোথাও যাওয়া হয় না। কত কত শীতরাতের স্মৃতিপুরাণে গানের পর গান দিয়ে নাচের পর নাচ দিয়ে রাজপুরুষদের দাম্ভিক হাসি দিয়ে দোতরার কান মোচড়ানোর শব্দ দিয়ে বুকের ভিতরের অদ্ভুত এক কষ্টের মতোন কিছু যেন জাপটে ধরে। পুরাতন থেকে বর্তমানে আসা যাওয়ায় দেহতত্ব মনোশিক্ষা কুষাণযাত্রার মরমীয়া বুনটে বারবার চোরা ঢেকুর তুলতে থাকে সেই সব ছোটবড় হাতির দল। মাহুতফান্দির দল। বসন্ত মালীর বেটা বিমল মালী বলো কিংবা সুধীর রায়ের বেটা অনিলই বলো, সবাই যেন তখন প্রাণপণে দৃশ্যখন্ডকে আটকে রাখতে চায়। তামারহাটের শিকারবাড়িতে ঢাকঢোল বাজতে থাকে। তামারহাটের দিকে উড়ে যাওয়া রাজবাড়ির টিয়ার ঝাঁক অতিক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করে সব ও সমস্ত ঝাড়টাড়ভূট্টাবন। রাজার বেটির ছোট কইন্যা তখন গান ধরে--
নাল টিয়া কি টিয়া রে তোর
ভাসা নলের আগালে
বিনা বাতাসে ভাসা ঢোলে রে
জন্ম জন্মান্তরের এইসব গল্পগুলি জন্ম জন্মান্তরের এক আবহমানতাই এনে দিতে থাকে।



(৭)

যেমন হাতিধরার ভিতর জীবন কাটিয়ে যাওয়া লালজি রাজা, যেমন উত্তাপ উষ্ণতা মাখতে মাখতে সন্নাসী ও সৈনিকের জীবন কাটিয়ে গেলেন জ্যেঠোবাবা; ঠিক জীবনসম্পৃক্ত জীবনেই বেঁচে থাকবার এক মানুষঘেরা গানঘেরা নদীঘেরা মদ্য ও মাদকঘেরা জীবন নিয়ে জীবনকেই জীবন্ত করে তুলতে তুলতে চুরমার করে দিয়ে নিজেকে নতুনতর জীবনের সংজ্ঞায়নে উন্নীত করেই গেলেন রাজকুমারী। তার গান, লোকমানুষের এক পৃথিবী, ভালোবাসার এক ঘোর, অজস্র হাতিমাহুতের উত্তাপ তাকে তখন কীভাবে যেন হস্তীকন্যায় রূপান্তরিত করে দিল। হস্তীকন্যার উদাসীনতায় আভিজাত্যে সে কিন্তু হাতিমাহুতের গানের ভুবনে বারবার দেশজতা টেনে এনেছিল। মরুচমতী কন্যার মরিচগাছে হেলানি দিয়ে নেচে ওঠবার পাশাপাশি বিরহবেদনার বারমাসীয়া গানগুলি দিয়ে সে কী এক ধরনের মুক্তিই প্রত্যাশা করেছিল! সে কি গদাধরের পারে পারে শূন্যতা নিয়ে মাহুতবন্ধুকে হেঁটে যেতে দেখেছিল! এত এত সংশয়ের পাঁকে তার যাপনপর্ব অসমাপ্ত পালাগানের খোসার মতো ক্রমে তার দিকে বিদ্রুপময় এগিয়ে এসে তাকে অনেকানেক গানবাড়ির মুক্তাঞ্চলে, লোককথার হারানো কিসসাগুলির সঙ্গে মিশে যেতে সামান্য প্ররোচনাও দিয়েছিল বুঝি! চটুল গানের দিকে যেতে যেতে সে ডেকে নেয় গৌরীপুরের চ্যাংড়া বন্ধুকে। চ্যাংড়া বন্ধুর নাচের তাল-লয়ে তার শরীরময় অনন্য বাজনার আবাহনে সে কিন্তু চটুলতাকে গানের স্রোতে তালডিঙার ভেসে যাওয়াকে লিপ্ত করে দেয়। গান থাকে। নাচ থাকে। শিকারক্যাম্প থেকে জংলি হাতির বৃংহণ ভেসে আসে। সবই সাবলীল দৃশ্যের সহজিয়া অবতারণা যেন। আদতে কি বোধগম্য কোনো ব্যাখ্যা মেলে জীবনের? যেমন চ্যাংড়া বন্ধুর চ্যাংড়া বন্ধু হয়ে ওঠা! যেমন রসিয়া বন্ধুর রসিয়া বন্ধুই হতে চাওয়া কেবল! হস্তীকন্যার হস্তীকন্যা হয়ে ওঠার কথাকাহিনীর সামান্য মোচড়ের জন্যই হয়তো ডুবজলে ডুবে থাকা গানকলি ভুস করে ভেসে ওঠে--
রসিয়া বসাইছে ফান
বানিয়া বসাইছে ফান
নিধুয়া পাথারে ও কালা
যাইও না...
ভেসে ওঠা গানখন্ড পলকহীন যাপনসর্বস্বতা নিয়েই হাজার মানুষের ছুটন্ত পদশব্দে চমকে উঠতে গিয়ে সন্ত্রস্ত হয় আর যাবতীয় নাচগান কোমড়ের ভাঁজে দুরন্ত দুলুনি নিয়ে চ্যাংড়া বন্ধুর দ্বিধাহীনভাবে চ্যাংড়া বন্ধুই হয়ে উঠতে চাওয়া যেন বা!


(৮)

অনেক রোদের বিস্তারিতের ভিতর আদ্যন্ত ডুবে থাকতে থাকতে নদীপ্রান্তরের পাথারবাড়ির নকশিবিষাদটুকু সারাজীবন ধরতে গিয়েও শেষাবধি অধরাই থেকে যায়। ইশারাসংকেত দিয়ে তার রাজার বেটি হয়ে ওঠার ঘটনাক্রম একসময় থিতু হয়ে যায়। তার যাপনটাই বুঝি মিথ হয়ে ওঠে। আগুনের গোলকের মধ্যে সর্বশরীর ডুবিয়ে গানে গানে মেতে ওঠা জীবন নিয়ে তাকে ঘুরে বেড়াতে হয় জনপদ আর জনপদে। সে দেখে নিতে থাকে কীভাবে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘ। জলহীন শুকানদিঘীতে হরিণেরা জল খেতে আসে। জন্ম জন্ম ধরে দিনকাল জুড়ে এ এক অচরিতার্থ যাপনবৃত্তান্ত। কবেকার মানকাচরের গানবাড়িতে গিয়াসুদ্দিন, ভুলুলালদের নেচে ওঠবার যৌথতার স্মৃতি তার গানের ভুবনে বেগ এনে দিলে সে গানের কিসসার, ছিলকার গাঁওবুড়োর হুঁকোর তালে তালে নতুন এক জীবনই যেন খুঁজে পায়। ধরাবাঁধার বাইরেই আজীবন তাকে থেকে যেতে হলো। বিষণ্ণ হয়ে ওঠবার অবকাশই সে পায় না। সে অধিকন্তু কেবল বিষণ্ণতা নিয়েই গানের ভুবনে বিস্তারিত হতে থাকে। পুরনো গানগুলি থেকে মহিষের গাড়ি ও মৈষাল গাড়িয়ালের গানগুলি দিয়ে সে অতীত- বর্তমান বাহিত হয়ে মহামহিম জীবনেই প্রাণান্তকর ফিরতে থাকে। তখন বসন্ত মালী বলো সুধীর রায় বলো সীতানন্দ বুড়া বলো সবাই যেন ঢোলবাঁশিগান নিয়ে রাজবাড়ির দিকে ভাঙা প্রাসাদের দিকে প্রতাপ সিং-এর সমাধির দিকে গৌরীপুরের হাটের দিকে ধুবড়ি শহরের দিকে গদাধরের নামহীন চরের দিকে আগমনী বিষখোওয়া গঙ্গাধরের দোলং-এর দিকে প্রজাবিদ্রোহের দিকে লালজি রাজার হাতিধুরার দিকে হা হা হাসির দিকে চিরবিরহের সব গান নিয়ে কেবলই ফিরতে থাকে। তাদের কন্ঠের সমবেতে গান বাজে--
গান কইরচে হায় প্রাণ ঢালেয়া
গোয়ালপাড়িয়া গীতি...
রাজবাড়ির স্তব্ধতা ভেঙে ফিরে আসতে থাকে গমগম গমনাগমন। বটবৃক্ষের ছায়ার মতোন একটা আশ্রয়ের ভরসা জাগে যেন। লন্ঠন জ্বালিয়ে পদুমোহন আসে। ফরাস বিছিয়ে দেয় ফুলমতী মাই। হাতির দাঁতের চিরুণী দিয়ে রাজার বেটি সেরে নেয় কেশবিন্যাস-প্রসাধন। গানে গানে জেগে উঠবে আজ বাইচ খেলা। মেলাবাড়ির দিকে গড়িয়ে নামবে বাইচের গান। আসরবন্দনার টানা স্রোতে নিবিষ্ট হতে হতে দোয়ারিরা গলা মেলাবে। নাচনিরা খোসা নাচ দিয়ে ভরিয়ে দেবে পাথারবাড়ি--
শ্যাম কালা ও রে শ্যাম কালা
ছাড়িয়া দে মোর শাড়ির আঞ্চল
যায় বেলা...
আর হামলে পড়বে শীতের পাল।



(৯)
ও মোর দান্তাল হাতির মাহুত রে
যেদিন মাহুত জঙ্গল যায়
নারীর মন মোর ঝুরিয়া রয় রে...
হাতিমাহুতের জন্য দান্তাল হাতির জন্য তার প্রাণ কান্দে। তার মাহুত ঘুরে বেড়ায় জঙ্গলে জঙ্গলে। হাতির পিঠিত চড়িয়া তার মাহুত যেন কিসের বাঁটুল মারে। আবার গোয়ালপাড়ায় গিয়ে খেয়ে আসে গামছাবান্ধা দই। চিলমারীয়া চিকন চিড়া। তামাকবাড়িতে সন্ধ্যে নামলে মাহুত আর কেবল মাহুত থাকে না। হাতির পিঠ থেকে নেমে এসে অতিমানুষ হয়ে ওঠে। মাহুতের জন্য কি প্রেম জমে মনে! যেমন গৌরীপুরীয়া গাভরুর জন্য ভূপেনদার মনে জন্মেছিল! তার মরম লাগে। সমস্ত যৌবনকাল জুড়ে সে তো মাহুতের জন্য, দান্তাল হাতির মাহুতের জন্য বারবার গেয়েই ওঠে গান--
ও মোর হায় হস্তির কন্যা রে
খানিক দয়া নাই
খানিক মায়া নাই
মাহুতক লাগিয়া রে...
মাহুতের গামছাজড়ানো মাথার ওপর শীতের আকাশ। মাহুত যখন জঙ্গলবাড়ির দিকে তখন তো বাদ্যনৃত্যের সমবেতে সে তার মাহুতকেই খুঁজতে থাকে; খুঁজেই গেছে অন্তহীন। মাহুতের প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে সে তো জীবনভর হাতিমাহুতের পৃথিবীর
চালচিত্রে, খুঁড়ে খুঁড়ে এনেছে পুরাকল্পবাহিত যতসব গান--
ও মোর মাকনা হাতির মাহুত রে
হাতির পিঠিত চড়িয়া রে মাহুত
তোমরা কিসের বাঁটুল মারো...

তার গান জুড়ে তো কেবল হাহাকারই থাকে না! হাতিমাহুতবন্দনাই থাকে না! তার গান বহন করে আনে লোকজনতার ইতিহাস। কথাকিংবদন্তী থেকে হস্তিতত্ব নিয়ে এসে ইতিহাসকে নিম্নবর্গীয়তার ভুবনেই প্রবিষ্ট করা হয়। পরম্পরা পারম্পর্য ভেঙে এভাবেই তার মাহুত, তার হাতি, তার হাতিশিকার, হাতিপ্রশিক্ষণ সবকিছু দিয়ে সে অত্যাশ্চর্য এক হাতিসংস্কৃতিই তুলে ধরতে চেয়েছে। এখানেই তো স্বতন্ত্রতা। এভাবেই তো তার মিথ হয়ে ওঠা। মিথ হয়ে যেতে যেতে মিথের ওঠানামায় শীতের খুব জাড়ের ভিতর সে আদুল শরীরের মাহুতকে গানে গানে কথায় কথায় বাদ্যে বাদ্যে উষ্ণ থেকে উষ্ণতরতার দিকেই ঠেলে দেয়। জীবনের ভিতর আর কিছু না থাক, আর কিছু না পাওয়া যাক; সে ভীষণরকম মাহুতবন্ধুর গানের টানে টানেই পরিপুর্ণ হতে থাকবে।



(১০)
কলসির পানি মাঝিয়ায় ঢালিয়া
কলসি হইল মোর খালি
হায়রে কলসিতে নাই মোর পানি রে...
গদাধর নদীর পারে দলবদ্ধ মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে নাচে। গান গায়। গান নাচেরই পৃথিবী তাদের। তারা সব চিরকালের নাচুনি। বিহুতলিতে নাচে। পাথারবাড়িত নাচে। বিয়াওবাড়িত নাচে। কীর্তনবাড়িত নাচে। নাচে, কেবল নাচে। নাচতে নাচতে তারা গানপালার আঁখরগুলিই তুলে আনে। তাদের গানের, নাচের ভিতর আশ্চর্য ধারাবর্ণনা। দৈনন্দিন মানবজীবন উঠে আসে। শরৎসুন্দরী, মৌরীবালা, নান্দুনি বুড়ি, খইমালার চিরপুরাতনকে চিরনতুন করে দিয়ে মরিচখেত বাইগনবাড়ির ভিতর, ভুস করে জেগে ওঠা নদীচরের কাশিয়ার ঝোপে ঝোপে নাচগান নিয়েই চলাচল করে। তাদের এই উচ্ছ্বাসময়তা দিয়ে বেন্ধে রাখা জীবনযাপন কখন কীভাবে ভূগোল ইতিহাস দেশাচারলগ্ন হয়ে পড়ে, তার কোনো ঠায়ঠিকানা থাকে না আর; কেবল আকাশময় মেঘের আলোয় তাদেরকে হুদুমপুজার মাঠে গিয়ে দাঁড়াতেই হয়, কখন আন্ধাররাতি আসবে সেই উদগ্র আশাআকাংক্ষা নিয়েই। কোথাও কেউ থাকে না। কেবল হুমহুম এক হাহাকার। নদীর কাছাড় ভাঙার হিড়িক হিড়িক শব্দ বুকের গহীনে। বলরামের ঢোল বাজে। কাঁঠল খুঁটার দোতরা কথা বলে। গদাধর নদীর শিয়রে লোকঠাকুরের থানে মাটির পিদিম জ্বালিয়ে নদীতেই নেমে যায় কেউ। দূরে কাছের ঘরবাড়ির ভিতর রাত্রিকাল নেমে আসে। আন্ধাররাতি। কৃষ্ণকালো কেশ খুলে দিয়ে ধেয়ে আসে খ্যাপা, হাড়িয়া মেঘদল। নাচুনিরা থামে না; তাদের তো থামতে নেই। দূরাগত বাতাসে ভেসে আসে তাদের গান--
আয়রে হাড়িয়া ম্যাঘ
আয় পর্বত ধায়া
তোক ম্যাঘক বান্ধি থুইম
ক্যাশের আগাল দিয়া
নাচগানের দিনদুনিয়ায় নাচগানকে প্রাধান্য তো দিতেই হয়। বসন্ত মালী না থাক, সুধীর বা সীতানন্দ না থাক; নাচগান থাকেই। বৃহত্তরতার ঐকতানে, বোধে জারিত হতে হতে হাস্যচপল নাচুনিরা নাচে। নদীজলে নেমে পড়ে। জল ছড়াতে থাকে। গান ছড়াতে থাকে--
ছিড়িয়া বাইগনের বোঁটা
মাইরো না...



(১১)

রাজবাড়ির গল্পে রাজকুমারীর গল্পে রাজার বেটির গল্পে লালজি রাজার গল্পে কোনো আদিঅন্ত থাকে না। রাজার বেটির গানভুবনের মেয়াদ কি চিরদিনের হতে পারে! থেমে যাওয়াটা আবশ্যিক। থেমে যাবার বিন্দু থেকে নতুনভাবে উঠে আসবেই সব আবার। এ এক ধারাবাহিকতাই যেন। পদ্মশ্রী পাবার পর তেমন পুলক তো জাগেনি তার! সে তো নিস্পৃহই ছিল। পান্ডের সঙ্গে কেমন এক দূরত্বই থেকে গেল সারাজীবন! জীবন তো তেমন কোনো গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারলো না! অবশ্য গন্তব্য বলে কিছু হয়? নিশ্চিতই কিছু থাকে! মানুষ তো গন্তব্যহীন গন্তব্য নিয়েই দূরাগত হাওয়ায় কেবল কেঁপে কেঁপে ওঠে। সারাজীবন কেবল ‘নিন্দের আলিসে হাত পড়ে বালিশে’। গৌরীপুর সেজে উঠেছিল তাকে বিদায় জানাবার জন্য। সারারাতের অপেক্ষা শেষে তাকে তো আসতেই হয়েছিল। ডিসেম্বরের শীতে। কুয়াশাময় শ্লোকের ভিতরে। শোকসংগীতের বদলে একযোগে বেজে উঠেছিল একশো দোতরা। জীবনযাপনের ভিতর সমস্ত না পাওয়াগুলি নিয়ে সে বেঁচে ছিল দীর্ঘ কিছু দিন, নিজের মতোন। তার চোখের তারায় কৌতুক। যা দিয়ে চিরদিনই সে প্রান্তিকতার দিকে, প্রান্তবাসীর কাছে, ভূমিলগ্ন জীবনই সাজাতে চেয়েছিল। তার জীবন ছিল গ্রন্থের খোলা পাতার মতো। হেঁটো কবির পাঁচালীর মতো। ফকিরকবিরাজের ঝোলার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা জীবন নিয়ে সে কি আদ্যন্ত এক হস্তিকন্যা হয়ে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করবার প্রাণান্তকর এক ব্যস্ততার কুয়াশায় উড়ে গিয়েছিল! যেভাবে, যত গানই সে গেয়ে থাক; সমস্ত জীবন জুড়ে একটিমাত্র গানই কুহকে ডুবে গিয়ে তাকে গেয়েই যেতে হয়েছিল--
তোমরা গেইলে কি আসিবেন
ও মোর মাহুত বন্ধু রে...


(১২)
বাইজ আইনছেন ঢ্যারেৎ ঢ্যারেৎ
ও শ্যাম কালিয়া রে...
উঁচু টিলার ওপর রাজবাড়ি। লাল টিয়া। টিয়া উড়ে যায় ঝাঁকে ঝাঁকে। তামারহাটের দিকে। আগমনীর দিকে। গদাধরের পারে পারে। রাজার বেটির স্বপ্নময়তার ফাঁকে রাজবাড়ির ভয়াবহ শূন্যতার ফোকরে আবারো বাদ্য বাজে। নৃত্যময় ভঙ্গি সাজিয়ে বর্তমানের নাচুনিরা জড়ো হয়। বিমল মালী আসে। অনিল আসে। পরমেশ্বর ও গিরেনও এসে যায়। আসে প্রিয়ম। ঢোল-দোতরা-বাঁশি-সারিন্দা ও নতুন সব গীতভান্ডার নিয়েই। রাজবাড়িতে গান বাজে। শীতশিশিরের ফোঁটায় ফোঁটায় মিশে যেতে থাকে টুকরো টাকরা সব গানগুলি। যেন ঢেউ জাগে। লাউখোওয়ার বিল থেকে ফিসফিস কথাবার্তায় বাতাসেরা ঘিরে ধরে সময়। মহাকাল। আমরা দেখতে পাই, নয়াবাড়ির নয়া সাগাইসোদরের মতোন গান গাইছেন পুনম বরুয়া। নতুনকালের সময়াতীত অতিক্রম করে আসা এক নতুন হস্তীকন্যার মতো। যাকে গাইতে হয়, গাইতেই হবে হাতিমাহুতের সব অনন্তকালের গানগুলি। গৌরীপুরীয়া মাহুতবন্ধুকে আবহমানতায় ফিরিয়ে আনবার জন্যই হয়তো বা!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন