গবেষণাগার, প্রযুক্তি-বিদ্যালয় ও শিল্প-উপনিবেশ : বিবেকানন্দের বিজ্ঞান-স্বপ্ন
ভ্যাঙ্কুভারের ‘দি ডেইলি নিউজ অ্যাডভারটাইসার’ কাগজটিতে ১৮৯৩ সালের ২৬শে জুলাই একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়, যার সারমর্ম – ‘দি এম্প্রেস অব ইন্ডিয়া’ জাহাজটি আগের দিন সন্ধ্যায় ভ্যাঙ্কুভারে উপস্থিত হয়েছে, এবং এর যাত্রীদের মধ্যে রয়েছেন জনৈক ‘মিঃ ভিভোস্কানন্দ্র’ ও আরেকজন মিঃ টাটা, সঙ্গে তাঁর পরিচারক। আজ আমরা অনেকেই জানি যে, উল্লিখিত এই দুই ভারতীয় যাত্রী যথাক্রমে স্বামী বিবেকানন্দ ও জামশেদজি টাটা, জাপানের ইয়োকোহামা থেকে এই জাহাজ-সফরে তাঁরা দু’জন সহযাত্রী ছিলেন। বিবেকানন্দ তখন অধিকাংশ ভারত ও বহির্বিশ্বের কাছে অপরিচিত, যদিও জামশেদজি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তরুণ সন্ন্যাসী সে-সময় চীন ও জাপান হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসছিলেন শিকাগোয় বিশ্বধর্মস্মমেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে। সে-বছরই জুন মাস নাগাদ জাপানে পৌঁছে স্বামীজী যেসব স্থান দেখতে যান, তার মধ্যে ছিল, জাপানী এঞ্জিনীয়রদের তৈরি এক মাইল লম্বা এক টানেল আর একটি দেশলাইয়ের কারখানা, যেগুলিকে তিনি বন্ধুদের কাছে লেখা চিঠিতে ‘একেবারে দেখার মতো জায়গা’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। কেউ কেউ এমন অনুমানও করেছেন যে, দেশলাই-কারখানা দেখতে গিয়েই বিবেকানন্দের সঙ্গে টাটার আলাপ হয়। অপরপক্ষে জামশেদজি টাটা তখন জাপানে কী করছিলেন? যতদূর জানা যায়, তিনি কিছু বাণিজ্যিক পরিকল্পনা নিয়েই ও-দেশে গিয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিল জাপানী সহযোগিতায় এক ভারতীয় জাহাজ পরিবহন কোম্পানি চালু করা, জাপান থেকে তুলোর বীজ এনে স্বদেশী কাপড়ের মিল খোলা ও জাপান থেকে দেশলাই আমদানি করে ভারতের বাজারে বিক্রি করা। আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লেখা বিবেকানন্দের এক সমকালীন চিঠি [১০ই জুলাই, ১৮৯৩] থেকে জানা যায় যে, জাপানের দেশলাই শিল্প ও জাহাজ-পরিবহন ব্যবসা – এই দু’টি ব্যাপার ছাড়াও জাপ সেনার জন্য নিজস্ব কামান উদ্ভাবন ও তার নৌবাহিনীর সম্প্রসারণ সম্পর্কে স্বামীজি শুধু ওয়াকিবহালই ছিলেন না, জাপানের প্রয়োজনীয় সব কিছু নিজের উদ্যোগে তৈরি করার উদ্যমের সপ্রশংস উল্লেখও করেছিলেন। এই পূর্ব ইতিহাসটুকু থেকে এ-কথা অনুমান করতে সুবিধা হতে পারে যে, আপাতদৃষ্টিতে ভিন্নধর্মী প্রযত্নে নিযুক্ত এই দু’জন ভারতসন্তানের মনেই ছিল মানুষের উপযোগিতায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে এক সাধারণ আগ্রহ ও উদ্যোগ। এই অনুমান আরও জোর পায়, যদি জাপান থেকে আমেরিকার ঐ জাহাজ-সফরে দু’জনের আলোচনার বিষয়গুলো ভেবে দেখা যায়।
ঠিক কী কী বিষয়ে এই দু’জনের আলোচনা হয়েছিল, সে-সম্পর্কে বিস্তারিত কোনও বিবরণ পাওয়া না গেলেও যে-সব সূত্র থেকে সংক্ষিপ্ত ও টুকরো টুকরো খবর পাওয়া যায়, তার মধ্যে সর্বপ্রথমে উল্লেখনীয় ১৮৯৮ সালে স্বামীজিকে লেখা টাটার একটি চিঠি, যা থেকে জানা যায় যে, স্বামীজি টাটাকে প্রাচীন ভারতের আধ্যাত্মিকতার আদর্শের বিকাশ ও তাকে নষ্ট হতে না দিয়ে উপযোগী খাতে প্রবাহিত করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। এরপর উল্লেখযোগ্য বিবেকানন্দের ছোটভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের একটি বইয়ের [‘স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের ঘটনাবলী’, তৃতীয় খন্ড] এমন এক দাবি যে, স্বামীজি নাকি তাঁর কোনো চিঠিতে দু’জনের এই আলোচনা সম্পর্কে লিখেছিলেন। যদিও এখনও স্বামীজির তেমন কোনও চিঠির খোঁজ পাওয়া যায়নি, মহেন্দ্রনাথের বিবরণটি এখানে দেখা যেতে পারে। এই বিবরণ অনুযায়ী তিরিশ বছরের সন্ন্যাসী চুয়ান্ন বছর বয়স্ক শিল্পপতিকে সোজাসুজি প্রশ্ন করেছিলেন, “জাপান থেকে দেশলাই নিয়ে গিয়ে দেশে বিক্রয় করে জাপানকে টাকা দিচ্ছ কেন? তুমি তো সামান্য কিছু দস্তুরী পাও মাত্র। এর চেয়ে দেশলাইয়ের কারখানা করলে তোমারও লাভ হবে, দশটা লোকেরও প্রতিপালন হবে ও দেশের টাকা দেশে থাকবে।” [ভাষা মহেন্দ্রনাথের] বিবেকানন্দের এই পরামর্শ অবশ্য টাটা স্বীকার করেননি, কারণ তিনি বাণিজ্যটা ভালোই বুঝতেন। তিনি জানতেন, ভারতে তাঁর দেশলাই ব্যবসা একচেটিয়া। অপর দিকে স্বামীজির কাছে কী ব্যবসা হোক, বা বিজ্ঞান, প্রথম ও শেষ বিবেচ্য বিষয় ছিল জনমানুষের কল্যাণ। মুনাফার কথা না ভেবে জনহিতে ব্যবসার লাভকে ব্যয় করার অভিনব পরামর্শ তিনি পরবর্তীকালে বিশ্বখ্যাত ব্যবসায়ী রকফেলারকেও দিয়েছেন ও কিছু পরিমাণে উদ্বুদ্ধ করতেও সমর্থ হয়েছেন।
যা-ই হোক, আপাতত এ-টুকু বোঝা যাচ্ছে যে, ঐ চিঠিটিতে বিবেকানন্দ-টাটা আলোচ্য বিষয়ের যে-বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে প্রত্যক্ষভাবে বিজ্ঞানসংক্রান্ত কিছু না থাকলেও জনকল্যাণ ও স্বদেশী বাণিজ্যের প্রসঙ্গগুলি অবশ্যই জড়িত ছিল। পরবর্তী ইতিহাস অবশ্য এ-কথার সাক্ষ্য দেয় যে, ভারতের মানুষের উৎকর্ষসাধনে বিজ্ঞানের ব্যবহারের ভাবনা এই দুই মনীষীর মনকেই যথেষ্ট পরিমাণে অধিকার করে রেখেছিল। বিবেকানন্দের দিক থেকে এর যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় আমেরিকায় পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নানা বক্তৃতায় তাঁর ভারতের জন্য শিল্প ও বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কিত উক্তিগুলি থেকে। এখানে বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে তার কিছু সংক্ষিপ্ত নমুনা দেখা যেতে পারে।
‘সালেম ইভনিং নিউজ’- “ভারতের লোকদের ধর্মশিক্ষা দিতে মিশনারি না পাঠিয়ে তাদের শিল্পশিক্ষা দিতে পারবে, এমন লোক পাঠালেই আমেরিকানরা ভালো করবে।” [২৯.৮.১৮৯৩.] ‘ডেইলি গেজেট’- “দেশের উন্নয়নের জন্য সন্ন্যাসীদের সংগঠন তৈরি করতে চাই, যাতে এঁরা জনগণকে তাঁদের শিল্পজ্ঞানের ফল দিতে পারেন, এতে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটবে।” [২৯.৮.১৮৯৩.] ঐ- “মিশনারিরা আধুনিক ভারতবর্ষে ধর্মশিক্ষা না দিয়ে সামাজিক ও শিল্পবিষয়ক শিক্ষা দিলেই ভালো করবেন।” [৫.৯.১৮৯৩.] আমরা দেখবো, ভবিষ্যতেও বিবেকানন্দ তাঁর শিষ্য-সতীর্থদের এ-জাতীয় কথা চিঠিপত্রে লিখবেন।
এরপর আমরা জামশেদজি টাটার দিক দিয়ে ভারতের বিজ্ঞান-প্রগতির বিষয়টি লক্ষ্য করার চেষ্টা করবো। উনিশ শতকের শেষ ভাগে বিবেকানন্দ যখন শিকাগোতে ধর্মপ্রচারে তাঁর সাফল্যের সূত্রে ভারতে ও পশ্চিমী দুনিয়ায় সুপরিচিত, তখন টাটাও পশিম ভারতে স্থাপন করেছেন স্বদেশী কাপড়ের মিল, হোটেল-ব্যবসা, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও ইস্পাতশিল্পের মতো উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছেন। এই সময়েই তিনি ভারতীয় ছাত্রদের জন্য এক বিজ্ঞান গবেষণা-প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ভাবনাচিন্তাও শুরু করেন। এই উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর প্রতিনিধি বরজোরজি পাদশা ইংলন্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি পাঁচটি দেশের শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এর ফলস্বরূপ তিনি ভারতীয় ছাত্রদের জন্য শিল্পবণিজ্য-সংক্রান্ত বিজ্ঞান গবেষণা ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার এক প্রতিষ্ঠানের স্থাপনার জন্য আনুমানিক ত্রিশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি প্রদানের কথা ঘোষণা করেন, যা ভারতীয় খবরের কাগজগুলিতে প্রকাশিত হয় ১৮৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ‘টাটা পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত এই প্রস্তাব দেশীয় মহলে বিপুলভাবে অভিনন্দিত হয়। এই পরিকল্পনা রচনার সময় টাটা যে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগর পার হবার সময় তাঁর পাঁচ বছর আগের আলোচনার কথা মাথায় রেখেছিলেন, তাঁর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে আরো কয়েক মাস পরে বিবেকানন্দকে লেখা তাঁর এক ঐতিহাসিক চিঠিতে। ২৩শে নভেম্বরের এই চিঠিটির প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ এ-রকমঃ- “প্রিয় স্বামী বিবেকানন্দ, আমার বিশ্বাস, জাপান থেকে শিকাগো সফরে আপনার সহযাত্রীরূপে আপনি আমাকে মনে রেখেছেন। এই মুহূর্তে ভারতে সন্ন্যাসের ভাবধারার বিকাশ ও তাকে ধ্বংস না করে উপযোগী পথে চালিত করার ব্যাপারে আপনার মতামতের কথা আমার খুবই মনে পড়ছে।
“আমার এই সব ভাবধারার কথা মনে পড়ছে ভারতে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আমার পরিকল্পনার সূত্রে, যে-বিষয়ে আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন বা পড়েছেন। আমার মনে হয়, যদি এমন মঠ বা আবাসিক ভবনের স্থাপনা করা যায়, যেখানে সন্ন্যাসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ মানুষেরা সাধারণভাবে বসবাস করে প্রাকৃতিক ও মানবিক বিজ্ঞানের চর্চায় তাদের জীবনকে নিয়োগ করবে, তা হলে ঐ আদর্শের উৎকৃষ্টতর প্রয়োগ আর কিছু হতে পারে না। আমার মতে কোনো সুযোগ্য নেতা যদি এ-রকম সন্ন্যাসীসুলভ ত্যাগের আদর্শে চালিত ধর্মযুদ্ধের দায়িত্ব নেন, তাহলে তা সাধারণভাবে সন্ন্যাসের আদর্শ, বিজ্ঞান ও আমাদের স্বদেশের সুনামের সহায়ক হবে এবং আমি জানি না, এই অভিযানে বিবেকানন্দের চেয়ে যোগ্যতর নায়ক আর কে হবেন! আপনি কি মনে করেন, আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে জীবনে প্রোথিত করার এই মহদুদ্দেশ্যে আপনি আত্মনিয়োগ করবেন?....” এই চিঠিটিতেই টাটা বিবেকানন্দকে প্রস্তাব দেন যে, ঐ উদ্দেশ্যে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য স্বামীজি একটি পুস্তিকা রচনা করতে চাইলে তিনি সানন্দে তার ব্যয়ভার বহন করবেন।
>
এই ঐতিহাসিক পত্রটির সূত্রে টাটা-বিবেকানন্দ যোগাযোগের পরবর্তী কাহিনীতে যাবার আগে আমরা পত্রটির বক্তব্য আরও একটু বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি। নিজের গবেষণায়তন প্রকল্প প্রসঙ্গে টাটার যে প্রথমেই স্বামীজির প্রেরণার কথা মনে পড়েছিল, সেটা এই চিঠি থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না। এখানে টাটা বিবেকানন্দ সম্পর্কে শুধু এ-টুকুই বলেছেন যে, তিনি জাহাজ-যাত্রাকালে তাঁকে ভারতে সন্ন্যাসের আদর্শের উজ্জীবনের কথা বলেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, টাটা শুধু সন্ন্যাসব্রতধারীদের মঠস্থাপনার ধারণাটিই বিবেকানন্দের থেকে নিয়েছিলেন, ঐ প্রবুদ্ধ মানুষগুলিকে দিয়ে বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয় চর্চার পরিকল্পনাটি তাঁর নিজস্ব। কিন্তু আমরা ‘ডেইলি গেজেটে’র সংবাদে দেখেছি, টাটার সঙ্গে আলোচনার সমকালেই বিবেকানন্দ মার্কিন দেশে সন্ন্যাসী-সঙ্ঘ তৈরি করে শিল্পশিক্ষা দেবার কথা বলেছেন। এমন কী, আমেরিকায় আসারও আগে, যখন তিনি এক অপরিচিত পরিব্রাজক, তখনও তিনি ভারতের দারিদ্র্যের প্রতিষেধক হিসেবে ইয়োরোপ থেকে শিল্পশিক্ষা নেবার কথা ভেবেছেন। এ-সময় খেতরির মহারাজাকে তিনি বিজ্ঞালের প্রাথমিক পাঠও দিয়েছেন। আমেরিকায় থাকাকালীন এক ভারতীয় মেকানিককে লোহার কারখানা দেখার জন্য নিজের শিষ্যা মিসেস বুলের কাছে পাঠিয়ে স্বামীজি তাঁকে লেখেন, “...এর বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। কিন্তু লোকটি যদি পাক্কা বদমাশও হয়, তবু আমাদের দেশের লোকদের মধ্যে এ-রকম বেপরোয়া মনোভাব দেখলে তাকে উৎসাহ দিতে চাই।”[১৪ই এপ্রিল, ১৮৯৬]। কয়েক মাস পরেই [৫ই জুন] তিনি আবার লিখছেন যে, যদিও তাঁর বাবা উকিল ছিলেন, তবু তিনি ভারতের জন্য আর উকিল চান না, তাঁর ইচ্ছে, তাঁর ভাই মহেন্দ্রনাথ একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান হন- “নিজের ও স্বজাতির জন্য সে একটা নতুন পথ উদ্ভাবনের চেষ্টা করুক। যদি সে ব্যর্থও হয়, তবু জানবো সে বড়ো হবার, দেশের যথার্থ কাজে লাগার চেষ্টা করেছিল। একজন ইলেক্ট্রিকাল এঞ্জিনীয়ার ভারতে অনায়াসে জীবিকা অর্জন করে বাঁচতে পারে।”
পশ্চিমী দুনিয়ার কাছ থেকে ভারতীয়দের বিজ্ঞান ও শিল্পশিক্ষা নেবার বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দ নানাভাবে বারবার বলেছেন, ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকার নভেম্বর, ১৯৩০ সংখ্যায় একটি প্রবন্ধে সে-সব উক্তি সংকলিত হয়েছিল, সেখান থেকে তার কয়েকটি এখানে উদ্ধৃত করা যায়।
“তোরা একটা ছুঁচ পর্যন্ত তৈরি করতে পারিস না, তবু ইংরেজদের সমালোচনা করিস! ওরে নির্বোধ, আগে তাদের পায়ের কাছে বসে ব্যবসা-বাণিজ্য, কার্যকরী বুদ্ধি শিখে নে, যাতে জীবনযুদ্ধে জিততে পারিস।” কিংবা – “পাশ্চাত্ত্যের কাছ থেকে বস্তুবিজ্ঞান শিখতে হবে, যাতে আমরা জীবনসংগ্রামের বেশি উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারি।” জামশেদজি টাটাকে যেমন পরামর্শ দিয়েছিলেন তেমনটা তিনি অন্যত্রও বলেছেনঃ-“মাড়োয়ারিরা ব্যবসায় টাকা খাটিয়ে সামান্য মুনাফা করে। তারা যদি ইয়োরোপীয়দের পকেট ভরাবার চেষ্টা না করে কিছু কলকারখানা, কর্মশালা তৈরি করত, তা হলে তাদেরও লাভ হতো, আর দেশেরও স্থায়ী কল্যাণ হতো।” আর সেই বিজ্ঞানব্রতী সন্ন্যাসীদের সঙ্ঘবদ্ধ করার স্বপ্ন - “প্রতি শহরে ও গ্রামে একটি করে মঠ করতে হবে। একজন সুশিক্ষিত সন্ন্যাসী মঠাধ্যক্ষ হয়ে থাকবেন। তাঁর অধীনে কার্যকরী বিজ্ঞান ও শিল্পশিক্ষার নানা বিভাগ থাকবে। সে বিভাগগুলি পরিচালনা করবেন এক একজন বিশেষজ্ঞ সন্ন্যাসী।” আরও স্পষ্টভাষায় তাঁর দাবিঃ- “যদি বাঁচতে হয়, আমাদের বৈজ্ঞানিক জাতি হতে হবে।” কিংবা সুনির্দিষ্টভাবে প্রযুক্তিবিদ্যার কথাঃ- “আমাদের প্রয়োজন কারিগরি শিক্ষা বা ওইরকম জিনিস, যা শিল্পোন্নয়নে সহায়তা করবে।”
মার্কিন দেশ থেকে ভারতে ফিরে আসার পরেও এই শিল্পবিজ্ঞান-ঋদ্ধ ভারতবর্ষের স্বপ্ন বিবেকানন্দকে অধিকার করে রেখেছিল। ১৮৯৭ সালে কলকাতায় যখন এক ঘরোয়া সভায় রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রস্তাব নেওয়া হয়, তখন মানুষের সাংসারিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য জনসমাজে বেদান্ত ও অন্যান্য ধর্মভাব প্রবর্তন ছাড়াও ‘বিদ্যাদানের উপযুক্ত লোক শিক্ষিতকরণ’ ও ‘শিল্প ও শ্রমোপজীবিকার উৎসাহবর্ধন’ – এ-গুলিও প্রস্তাবিত সঙ্ঘের উদ্দেশ্য হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। এ-বছর শেষ পর্যন্ত যখন রামকৃষ্ণ মিশন গঠিত হ্য়, তখনও তার কর্মধারার খসড়ায় অনিবার্যভাবেই স্থান পায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগণ্য ভূমিকাঃ- “এই মঠটিকে ধীরে ধীরে একটি সর্বাঙ্গসুন্দর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করিতে হইবে। তাহার মধ্যে দার্শনিক চর্চা ও ধর্মচর্চার সঙ্গে সঙ্গে একটি পূর্ণ টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট করিতে হইবে। এইটি প্রথম কর্তব্য, অন্য সব অবয়ব ক্রমে-ক্রমে যুক্ত হইবে।” শুধু শিল্প-বিজ্ঞানের চর্চাই নয়, বিস্ময়ের কথা, তাঁর স্বপ্নের শিল্পবিজ্ঞান-প্রকল্পের বাস্তবায়নের জন্য স্থান নির্দেশও করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ ঐ খসড়াতেইঃ- “....মধ্যভারতে হাজারিবাগ প্রভৃতি জেলার নিকট উর্বর, সজল, স্বাস্থ্যকর অনেক ভূমি এখনও অনায়াসে পাওয়া যাইতে পারে। ঐ প্রদেশে এক বৃহৎ ভূমিখন্ড লইয়া তাহার উপর একটি বৃহৎ শিল্প-বিদ্যালয়, ধীরে-ধীরে কারখানা ইত্যাদি খুলিতে হইবে। অন্নাগমের নূতন পথ যেমনই আবিষ্কৃত হইতে থাকিবে, লোক তেমনই উক্ত উপনিবেশে আসিতে থাকিবে।” ভারতে আধুনিক বিজ্ঞাননির্ভর শিল্পপত্তনের ইতিহাস যাঁরা সামান্য অবগত আছেন, তাঁদের কাছে উপরোক্ত উল্লেখগুলিকে শুধু কর্মসূচি নয়, ভবিষ্যদ্বাণী বা নির্ভুল পূর্বাভাস বলেই মনে হতে পারে। এই ভবিষ্যদ্দর্শনের বিষয়টিতে আমরা পরে আবার আসব, তার আগে স্বামীজির বিজ্ঞানভাবনার আরো কিছু সংবাদ আমাদের নিতে হবে।
স্বামীজি যে এ-সময় শুধু তাঁর স্বপ্নের সন্ন্যাসী-সঙ্ঘে শিল্পশিক্ষা বা উৎপাদনকেন্দ্রের কথাই ভেবে ক্ষান্ত হননি, তার বিপণন বা বাণিজ্যের দিকটিও ভেবে রেখেছিলেন, তা বোঝা যায় রামকৃষ্ণ মিশনের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার কয়েকদিন আগে সরলা দেবীকে [ঘোষাল] তাঁর এই পত্রাংশটি থেকেঃ- “ক্রমশঃ ঐ সকল প্রধান কেন্দ্রে কৃষি বাণিজ্য প্রভৃতি শিখানো যাবে এবং শিল্পাদিরও যাহাতে এদেশে উন্নতি হয় তদুপায়ে কর্মশালা খোলা যাবে। ঐ কর্মশালার মালবিক্রয় যাহাতে ইউরোপ ও আমেরিকায় হয় তজ্জন্য উক্ত দেশসমুহেও সভাস্থাপনা হইয়াছে ও হইবে।।...”[২৪শে এপ্রিল] অতঃপর বেলুড় মঠের সন্ন্যাসীদের মধ্যে রীতিমতো বিজ্ঞানের পঠনপাঠন চালু করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন তিনি, গুরুভাইদের বারবার তাড়া দিয়ে চিঠি লিখতে থাকলেন। ১১ই জুলাইয়ের এমনই একটি চিঠির অংশঃ- “আগে একবার লিখেছিলাম যে, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যার যন্ত্রপাতি কিনে ওইসব বিষয়ে, বিশেষত শারীরবিজ্ঞান সম্বন্ধে প্রাথমিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা দিলে ভালো হয়, কই সেসব ব্যাপারে তো কোনো উচ্চবাচ্য নেই? আরো একটি কথা লিখেছিলাম – যেসব বিজ্ঞানের বইয়ের বাংলায় অনুবাদ হয়েছে, সেগুলি কিনে ফেলা উচিত, সে সম্পর্কেই বা কী হলো? [স্বামী শুদ্ধানন্দকে লেখা] স্বামীজির পরিকল্পনা অনুসরণ করে ভগিনী নিবেদিতা কিছুদিন মঠে বিজ্ঞানের ক্লাশও নিয়েছিলেন। মিসেস বুলকে লেখা নিবেদিতার এক চিঠি [৬.৩.১৮৯৯] থেকে জানা যাচ্ছে যে, তাঁর গুরু ভারতের জনসাধারণের জীবিকা অর্জনের উপায় নিয়ে তাঁর সঙ্গে যে-আলোচনা করেন, তার মধ্যে ছিল শিল্প-উপনিবেশ স্থাপন, খাদ্যশস্য উৎপাদন, পুরনো পদ্ধতিতে তৈরি শিল্পসামগ্রীর জন্য ইয়োরোপে বাজার সৃষ্টি, সেখানকার পেটেন্ট কেনার জন্য কীভাবে অর্থসংস্থান করা যায় ইত্যাদি বিষয়। নিবেদিতার নানা চিঠিপত্র থেকে বিবাকানন্দের অন্যান্য যেসব শিল্পস্বপ্নের কথা জানা যায়, তা হলো – মঠের খরচ চালাবার জন্য শিল্পসামগ্রী তৈরি, কৃষিখামার স্থাপন ইত্যাদি।
দ্বিতীয়বার মার্কিন মুলুক সফরের সময়েও বিবেকানন্দ তাঁর ঐ শিল্প-বিজ্ঞানস্বপ্নকে লালন ও অনুসরণ করে চলেছিলেন। সেখানকার একটি কাগজ জানাচ্ছে, শুধু দর্শনশিক্ষা দেওয়াই স্বামী বিবেকানন্দের উদ্দেশ্য নয়, ভারতবর্ষের মানুষের উন্নয়নে শিল্পবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এদেশে আগ্রহসৃষ্টিও তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য।[‘লস এঞ্জেলস টাইমস’, ১৪.১.১৯০০] ‘প্যাসাডোনা ডেইলি স্টার’ কাগজটি লিখেছিল, স্বামীজি আরও বক্তৃতা দিতে রাজি আছেন, যদি স্থানীয় মানুষ ভারতে শিল্পবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁকে সাহায্য করেন।[১৬-১-১৯০০] এই কাগজটি থেকেই জানা যাচ্ছে, স্বামীজির থ্রপ পলিটেকনিক ইন্সটিট্যুট [পরবর্তীকালে কালিফোর্নিয়া ইনস্টিট্যুট অব টেকনোলজি নামে বিখ্যাত] পরিদর্শনের ও এর ম্যানুয়াল ট্রেনিং বিভাগটি দেখে তাঁর খুশি হবার খবর। এমন কথাও কাগজটি লিখেছিল যে, স্বামীজি এখানকার কাঠখোদাই পদ্ধতিটি স্বামীজি নাকি তাঁর পরিকল্পিত ভারতীয় বিদ্যালয়গুলিতে চালু করতে চেয়েছিলেন।[৮ই ফেব্রুয়ারি]
স্বামী বিবেকানন্দের শিল্পবিজ্ঞান চিন্তার প্রসঙ্গটি এখানে স্থগিত রেখে আমরা আপাতত ফিরে যাবো জামশেদজি টাটার কাহিনীতে। এতক্ষণ আমরা যেসব সংবাদ পরিবেশন করেছি, তার ভিত্তিতে এটুকু অনুমান মোটেও অসঙ্গত হবে না যে, টাটার বিজ্ঞান ও শিল্পসংক্রান্ত নিজস্ব বাণিজ্যিক পরিকল্পনা থেকে থাকলেও তার সঙ্গে জনহিত ও ত্যাগব্রতের আদর্শকে [ টাটার নিজের ভাষায় ‘ascetism’] যুক্ত করার ব্যাপারে তাঁকে খুব সম্ভব স্বামী বিবেকানন্দই অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এই প্রেরণার স্বীকৃতিস্বরূপ টাটা তাঁকে যে-চিঠিটি লেখেন, তাতে এ-বিষয়ে প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে স্বামীজিকে যে একটি পুস্তিকা রচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তা’ও আমরা দেখেছি। বিবেকানন্দ ঐ চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন কিনা বা ওইরকম কোনও পুস্তিকা রচনা করেছিলেন কিনা, তা জানা না গেলেও এটুকু জানানো যায় যে, জামশেদজি কিন্তু শুধু ঐ চিঠি লিখেই নিরস্ত হননি। তিনি ভালোই জানতেন যে, নিবেদিতপ্রাণ ত্যাগব্রতীদের সঙ্ঘবদ্ধ করে শিল্প বিজ্ঞানের প্রচার তাঁর সাধ্যায়ত্ত্ব নয়। তাই যা তিনি করতে পারেন অভ্রান্ত পদক্ষেপে সেটাই করলেন। প্রাথমিক অর্থসংস্থানের ঘোষণা করেই প্রথমে চিঠি লিখলেন বিবেকানন্দকে ও তাঁর কাছে এক ব্যক্তিগত দূতও পাঠালেন। পরের বছরই [১৮৯৯] তাঁর শিক্ষাবিষয়ক প্রকল্পের সংগঠক পাদশা এসে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এই সাক্ষাৎকারের কাছাকাছি সময়ে [আগে না পরে সঠিক ভাবে জানা যাচ্ছে না] স্বামীজির প্রতিষ্ঠিত ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকায় টাটা-পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রথম মন্তব্য করা হয়। ঐ পত্রিকার এপ্রিল, ১৮৯৯ সংখ্যার সহৃদয় ও উৎসাহপূর্ণ সম্পাদকীয় মন্তব্যের অংশবিশেষ ছিল এ-রকমঃ- “ভারতবর্ষের মঙ্গলের জন্য আজ অবধি যত পরিকল্পনা হয়েছে, তার মধ্যে শ্রীযুক্ত টাটার স্নাতকোত্তর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পটির চেয়ে বেশি সময়োচিত, আর সদূরপ্রসারী ফলদায়ী অন্য কিছু হয়েছে কিনা সন্দেহ।... কারো কারো কাছে এই প্রকল্পটি কল্পনাবিলাসে পূর্ণ, কেননা এর জন্য প্রয়োজন বিপুল অর্থ, অন্তত চুয়াত্তর লক্ষ টাকা। এই আশঙ্কার যথোচিত জবাব হচ্ছে – দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি না হয়েও একজন মানুষ একাই যদি তিরিশ লক্ষ টাকা দান করতে পারেন, তবে দেশের অন্যান্যরা কি বাকি অর্থের সংস্থান করতে পারেন না!... তাই সমগ্র জাতি ক্ষুদ্র সম্প্রদায়-স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে যেন প্রকল্পটিকে সার্থক করার ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করে।....”
স্বদেশী মহলে টাটার পরিকল্পনাটিকে স্বাগত জানানো হলেও সরকারী মহলে কিন্তু প্রথম থেকেই এ-নিয়ে ছিল শীতল ঔদাসীন্য! ভারতে বাধাগ্রস্ত হয়ে জামশেদজি শিক্ষাবিভাগের কর্তাদের বোঝাতে ইংলন্ডেও যান ও সেখানে স্বামীজির শিষ্যা মিসেস বুল ও নিবেদিতার উদ্যোগে ঐ বিভাগের স্যার বার্ডউডের সঙ্গে আলোচনাও করেন, সরকারের বিরূপতার কারণে যা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। অবশ্য নিবেদিতা এতে ক্ষান্ত না হয়ে গুরুর স্বপ্নকে নিজের ‘মিশন’ হিসেবে নিয়ে নানা দেশের বিদগ্ধ মানুষদের সঙ্গে টাটার প্রকল্পটির ব্যাপারে যোগাযোগ ও আলোচনা আর পত্রপত্রিকায় লেখালেখি চালিয়ে যান। তাঁর এই প্রযত্ন স্বামীজি ও টাটার দেহাবসানের পরেও ক্রিয়াশীল ছিল। স্বামীজির মৃত্যুর [১৯০২] আগে আরও দু’বার টাটা প্রকল্প বিষয়ে ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’ মন্তব্য করা হয়েছিল। ১৯০১ সালের মার্চ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল যে, সরকার ‘দেশপ্রেমিক পার্সি শ্রী টাটা’-র প্রকল্পকে সমর্থন ও সহায়তা করলে ভারতবর্ষের জন্য নবীন জীবন, নবযুগ ও নতুন সমৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত হবে। বিবেকানন্দের জীবনকালে পত্রিকাটির সর্বশেষ মন্তব্যে [মার্চ, ১৯০২] বাঙ্গালোরে প্রতিষ্ঠিতব্য ঐ গবেষণাসংস্থার নাম হবে ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিট্যুট অব সায়েন্স’ ইত্যাদি সংবাদ প্রকাশিত হলেও শেষ পর্যন্ত বিবেকানন্দ বা টাটা কারও জীবনকালেই ঐ বিজ্ঞান শিক্ষায়তন বাস্তবে রূপ পরিগ্রহ করেনি। ১৯০৪ সালে টাটার প্রয়াণের পরে তাঁর উত্তরসূরিদের নিবেদিতা, মিসেস বুল, মিস ম্যাকলয়েড প্রমুখ বিবেকানন্দের শিষ্যেরা ঐ শিক্ষায়তন প্রকল্পের রূপায়নে কীভাবে সহায়তা করেছিলেন, সে নিয়ে বিস্তারিত কাহিনীতে আমরা আপাতত যাবো না। এখানে এটুকু জানানোই যথেষ্ট হবে যে, অবশেষে ভারত সরকার ও মহীশূর সরকারের আর্থিক বরাদ্দের ওপর নির্ভর করে ১৯১১ সালে ইন্ডিয়ান ইন্সটিট্যুট অব সায়েন্স-এর ভিত্তিস্থাপন হয়েছিল।
শুধু বিজ্ঞান-গবেষণাগারের কথাতে শেষ করলে কিন্তু বিবেকানন্দের স্বপ্নপূরণের কাহিনী সম্পূর্ণ হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বদেশের শিল্পনির্ভরতা নিয়েও স্বামীজির ছিল সমান্তরাল এক স্বপ্ন, যার সঙ্গে তাঁর বিজ্ঞানস্বপ্নও ছিল অঙ্গাঙ্গী জড়িত আর জামশেদজিও ছিলেন সেই স্বপ্নের অংশীদার। আমরা জানি যে, ভারতে ইস্পাত-কারখানা স্থাপনা ছিল জামশেদজির অন্যতম উচ্চাভিলাষী প্রকল্প। এই উদ্দেশ্যে সরেজমিনে লৌহ আকরিক ও কারখানার উপযুক্ত জমি অনুসন্ধানের কাজটিও শুরু হয়েছিল স্বামীজি ও টাটা দু’জনেরই প্রয়াণের পরে। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, প্রথমে চম্বা, দুর্গ প্রভৃতি যে-সব অঞ্চলে লৌহ-আকরের জন্য টাটা কোম্পানির তরফে ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালানো হচ্ছিল, সে-গুলো কিন্ত সেই মধ্যভারতেই, যে অঞ্চলে কারখানা ও প্রযুক্তি-বিদ্যালয় স্থাপনের কথা বিবেকানন্দ তাঁর রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের খসড়া-পরিকল্পনায় ঐ সব প্রচেষ্টা শুরুর অনেক আগেই উল্লেখ করেছিলেন। এই আশ্চর্য সমাপতনের সূত্রে কারও কারও মনে এমন প্রশ্নও জেগেছে, যে স্বামীজি যেহেতু একদা মধ্যভারতের নানা স্থানে পর্যটন করেছেন, তিনি কি লৌহ-আকরিকের অস্তিত্ব সম্পর্কে ব্যক্তিগত ধারণার ভিত্তিতেই ওই-রকম স্থানে কারখানার স্বপ্ন দেখেছিলেন? এই সমাপতনের শেষ কিন্তু এখানেই নয়। শেষ পর্যন্ত ভূতাত্ত্বিক প্রমথনাথ বসুর সুপারিশে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জে আকরিকের সন্ধান পেয়ে টাটারা সুবর্ণরেখা ও খরকাইয়ের নদীসঙ্গমে যেখানে কারখানার স্থান নির্বাচন করেন, সেই সাকচি গ্রাম, বা পরবর্তীকালের জামশেদপুরও কিন্তু স্বামীজি-নির্দেশিত হাজারিবাগ অঞ্চলের থেকে খুব দূরে নয়। ইতিহাসবিধাতার অদ্ভুত ঘটনাসন্নিবেশে এই দুই স্বপ্নদর্শীর ঐহিক জীবনাবসানের কয়েক দশকের মধ্যেই জামশেদপুরে টাটা স্টীল কোম্পানির পত্তন [১৯০৭] ও ইস্পাত উৎপাদনের সূচনা [১৯১২] ও টেকনিকাল ইন্সটিট্যুটের প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছিল। আরও স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে, বিবেকানন্দের শিল্পস্বপ্ন ও বিজ্ঞানস্বপ্ন দু’টিকেই সাকার করার ক্ষেত্রে সংঘটকের অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছিলেন জামশেদজি টাটা ও তাঁর উত্তরসূরিরা।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন