মৃত্যু-ইকোলজি
শীর্ষক এই শব্দস্থাপন আমার খুব প্রিয়। অনায়াসে হাজির হয় আমার কবিতায়। ‘লু’ – আমার এই বইয়ে এই শব্দের বহুল উপস্থিতি। একবার ভেবেওছিলাম, আমারই লেখা ‘কবিতার ফ্যালাসি’ গদ্যে বলা – “কবি একটা বিশেষ শব্দ-উদ্ভাবন বারে বারে ব্যবহার ক’রে প্রমাণ রাখতে চায় যে, সেটির পেটেন্ট হয়ে গেল, আর কেউ মেরে দেবে না”– আমি সেরকমই কোনো চক্করে পড়ে যাইনি তো?
মৃত্যু-ইকোলজি
--- কয়েকটা ব্যবহার ছিল এরকম ---
১)
ফোলা মোমের শিল্যুট আর ডেটলের রেমিংটন গন্ধে
মৃত্যু-ইকোলজি আমি ভুলব না
রাকস্যাকে আমরা যৌনজড়িত খাসপক্ষ... ... ... (ফোলা মোমের গন্ধ)
২)
গলতে গলতে একজোট হচ্ছে সুলতা
ইকোলজির সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসছে ... ... ... (ফোলা মোমের গন্ধ)
৩)
কয়লা থেকে ফিরে আসা
পেট্রল থেকে ফিরে আসা ফসিলের টুটা ফাটা শব্দ
শোনা ইকোলজিতে ঘোরানো হিসির অক্ষর ... ... ... (দলমার ব্লু প্রিন্ট)
৪)
মৃত্যুকালীন আচরণের মধ্যে তাকে আমরা ফুটে উঠতে দেখি
দেখি প্রজাপতিও
আল্পনার ব্লোআপে তিনসারেগা বটানিকা রঙ
চলল জানলা
আমরাও চলি সমান্তরাল কবরচাষীর সাদা বিছানাগুলো... ... ... (হাসপাতাল সিরিজ -- ৭)
৫)
বর্ষাকালে যখন বৃষ্টি পড়ছে না তখন এক শীতমেশিনের শব্দ ওঠে
এক মৃত্যু-ইকোলজি
এক সবুজশান্তি নামে স্নাবিক স্নাবিক ক্যাম্প খুলিয়ের চলনে ... ... ... (শব্দের প্ল্যান – ১১)
৬)
শারীরিক চিঠিগুলোর ডাক কিন্তু ডাকে না কাউকে
মৃত্যু-ইকোলজির মধ্যে অথচ একটাই ফিটিং প্রিয়
নিশ্ গন্ধ... ... ... (শব্দের প্ল্যান – ১৪)
কবির কল্পনা আর কল্পনাশক্তি। এই দুনিয়াটাই এক কল্পনা। কল্পনাচ্যুত হয়ে, বা কল্পনার অভাবে পতন আঘাত সম্ভাবিত হয়ে ওঠে বিরূপে। সারফেস টেনশন বা তলটান দুনিয়ার ছয়টি বলের অন্যতম একটি। তলটান বলে – সমবস্তুর অংশরা, বিশেষ – তরলে দ্রষ্টব্য, কাছাকাছি হলে দ্রুত একত্র হয়ে যায়। মেঝেয় পড়া জলটুকরো গড়ানোয়, পারদের, দুধের সমগোত্রিয় আচরণ তুমি দেখেছো। আবার আরো দেখেছো উত্তর-দক্ষিণ চুম্বক কেন্দ্রের ব্যবহার, নারী-পুরুষের ব্যবহার, ইলেকট্রন-প্রোটন সমৃদ্ধ বস্তু-অবস্থার ব্যবহার, জীবন-মৃত্যু দাঁড়িপারের আচরণ। এরা অংক জানতো না, কিন্তু তাদের ভেতরে অংক আছে। আছে কোলের হাহামমতা। কল্পনার জন্যও খানিক শিক্ষা প্রয়োজন।
নীরদ মজুমদারের ছবি দেখে আমি ভারতীয় তন্ত্রকলায় আগ্রহী। তাঁর আগেকার কপালকুন্ডলা বা কামাখ্যার তান্ত্রিকতা ভালো লাগেনি আগে। পরে জেনেছি, আসাম থেকে সিংহল পর্যন্ত ভারতীয় পূর্বপার ধরে তান্ত্রিক ভারতবর্ষের কথা। রঙে লাল, ফুলে জবা -- তার অলঙ্কার। পরে সারা উত্তর পাহাড় ধরে সেই চর্চা দেখি মনাস্ট্রিগুলিতে। এমনকি মুম্বাইয়ের কেপ ক্যানারি গুহাতেও। এ সবই দীর্ঘকালব্যাপী ভারতীয় আচরণ। বৈদিক শৃঙ্খলার বিরোধী ঔপনিষদিক বাচন, তৎবিরোধী বৌদ্ধ প্রয়াস, তৎবিরোধী তান্ত্রিক বুদ্ধাচার – বিরোধীতাকে ভালোবেসে আবিষ্কার একটি সুপ্রাচীন ঘটনা। আদিকালে আমারই একজন গ্রামবাসী নালন্দা থেকে শ্রীজ্ঞান দীপঙ্কর নাম-এ বৌদ্ধিক প্রচার নিমিত্ত তিব্বতে প্রেরিত হয়ে সেকালীন স্থানিক ধর্মাচার সম্পৃক্ত ক’রে প্রয়োজনভিত্তিক নতুনতর বজ্রযানী বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তন ক’রে ভারতে ফিরে এলে নালন্দা মহাবিদ্যালয় তাঁকে বহিষ্কার করে। তিনি গ্রামে ফিরে বজ্রযান সাধনার বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে আমার গ্রামের নাম হয় বজ্রযোগিনী। দীপঙ্করই ভারতের পূর্বঘাট পর্বতমালা ও দাক্ষিণাত্যে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন আমৃত্যু। আমি মনে মনে হাততালি দিই। তন্ত্রে আমার আগ্রহ হয়। সেই জবা সেই জবা ধরে একদিন আবিষ্কার করলাম হিবিস্কাসি আর শিবিস্কাসি শব্দদুটো। তাদের কারণ আর অকারণগুলো ব্যবহার করলাম কবিতায়। একটু বিশদে বলা যাক।
‘ইংকুবাস’ আর ‘সুক্উবাস’ – এই শব্দদুটি অলৌকিক বিদ্যার। ইংকুবাস হলো প্রেমিকার কাঙ্খিত দেহে রমণ সম্ভোগের জন্য পুরুষের অলৌকিক উপস্থিতির ঘটনা। আর এরই বিপরীত ঘটনাটি হলো সুক্উবাস। এটা ঠিক অপর-সত্ত্বার মতো। হয় কিনা জানি না। আমার জীবনে হয়নি বলাটা মিথ্যা হবে। স্বপ্নদোষকালে এবং পরেও জাগরণে (মৈথুনের সময়) ও নিদ্রায় প্রেমিকার শরীর ভেসে উঠতো এবং সম্ভোগতৃপ্তি হতো। এসব ব্যাপারে ফ্রয়েড সাহেবের থিওরিগুলো ভুল প্রমাণিত হয়েছে। Intuition, ESP ইত্যাদি সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে এবং ছোটবেলায় অভেদানন্দের বইয়ে যৌনতা ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে অলৌকিকভাবে শরীরের ট্রান্সপোর্টেশন প্রমাণের চেষ্টা – এই সব মিলে আমার মাথার ভূতমুক্ত হবার বড় বাধা ছিল। তান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় – মিথ, শোনা কথা – বাণ মারা বা আত্মার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে কোনো কাজ করে ফিরে আসা, সমাধি হওয়া – এইসব ব্যাপার আমি দেখিনি – সবই শুনেছি, পড়েছি, অনুভব করেছি। রবার্ট মনরো’র Journeys Out of the Body এই ব্যাপারে একটা উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ভিক্টর বক্রিসকে দেওয়া উইলিয়াম বারোজের সাক্ষাৎকারে (A Report From The Bunker) পরিষ্কারভাবে এসব ব্যাখ্যা করা আছে। কানাডার অকাল্ট ইউনিভার্সিটির কথা বাদ দিলাম, কিন্তু ‘মহাজাগতিক কথা’র লেখক জহর মজুমদারের মুখে যখন সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতার কথা শুনি, যেভাবে তিনি তাঁর বাবাকে শূন্যে ভাসমান দেখেছিলেন – আমি এসব ব্যাপার অমূলক বলে উড়িয়ে দিতে পারি না, যদিও আমার তেমন ভিশন নেই। মনে হয় ভিশন না থাকায় আমার উপকার হয়েছে। তবে এইসব তন্ত্রমতের অভ্যাস এখনো মানুষের আছে। এই সেদিন আর এক মজুমদার কামাক্ষায় নিজের ছেলেকে বলি দিচ্ছিল আরো শক্তিশালী হবার আকাঙ্ক্ষায়। তুমি বলবে এর সাথে কবিতার সম্পর্ক কি? সোজা সম্পর্ক নেই। তবে এইসব তোমার কল্পনাকে অনেকখানি পাখনা দেয় না? ঈশ্বর নেই অর্থে – জনসাধারণের মধ্যে মিথ এবং বিশ্বাসের মতো নেই। শয়তানও তাই। অলৌকিক শরীরও তাই। তাই বলে, কবিতা লেখাটা যখন মানুষের জন্য মানুষের প্রতি, তখন শুধু প্রেম নয়, মানুষের মলমূত্রও চলে আসে বৈকি পরীক্ষাগারে।
তন্ত্র অভ্যাসে লাল জবা (হিবিস্কাস) আমার ঐ পশ্চিমী অলৌকিক ইংকুবাসের জবাব, এবং সুক্উবাস হয়ে যায় শিবিস্কাস – হি আর শি – এই দুই আচরণের মধ্যে। আমি ভাবি হিবিস্কাস হলো পুরুষ শরীর ছেড়ে তার অপর সত্ত্বার বেরিয়ে আসা। এই বেরিয়ে আসা আর পুনর্প্রবেশ চলতে থাকে। তুমি নিজে কি কখনো বুশের কান মুলে দাওনি? চাঁদে হাঁটোনি? স্ত্রীর সাথে স্বপ্নে ঝগড়া করোনি? সিকিমের বাবামন্দিরে কাঁপুনির ফিল্ম চালাওনি? করলে কি করে? এসবই তোমার হিবিস্কাসি আচরণ। সেই মুহূর্তগুলোতে তুমি তোমার মধ্যে নেই।
যখন তুমি টেবিলে বসে শব্দের প্ল্যানগুলি হারিয়ে ফেলো, মৃতশব্দ-সজ্জা সম্ভব হচ্ছে না বুঝতে পারো, অন্য কবিদের কবিতা থেকে শব্দরান্নার তেল ফুরিয়েছে মনে করো, তখন তোমাকে বাইরে চেয়ে দেখতে হবে। তোমার অভিজ্ঞতার ফিল্মগুলো চালাতে হবে। তোমার অপর-সত্ত্বাকে বাইরে গিয়ে বেড়াতে দিতে হবে নিখিলে চরাচরে মানুষের ভিড়ে স্পার্কের খোঁজে। মানো কিনা, তোমার প্রাণবন্ত শরীরকে সঙ্গত নিয়ন্ত্রণে রাখে শারীরিক চিঠির মতো শরীরের অভ্যন্তরে চলমান একটি ইলেকট্রন প্রকল্পনা, যার বৈদ্যুতিক এবং চৌম্বক ফিল্ড আছে তোমাকে ঘিরে, যা কখনও উত্তেজিত হলে ইনফ্রা-ইলেকট্রনিক ক্যামেরায় তার ছবি ধরা পড়তে পারে। এও জানো কিনা যে, যদি আমার ফিল্ডে দশটি, say, ইলেকট্রন বল থাকে আর তোমার থাকে এগারোটি – তাহলে আপেক্ষিকভাবে আমি পজিটিভ আর তুমি নেগেটিভ – আমাদের ফিল্ডগুলি এবং আমরাও পরস্পর আকর্ষণ অনুভব করব। পৃথিবীতে সেভাবেই বিভিন্ন দৃশ্য, শ্রবণ, ঘটনা, মানুষ, কথা কবিতা হয়ে ধরা দেবে তোমার কাছে, এবং ঘটবে স্পার্ক। তোমার কাল্পনিক অভিজ্ঞতা থেকে গলগল ক’রে বেরিয়ে আসতে চাইবে শব্দরা।
‘অতিচেতনার কথা’ বইটাতে দেখো দ্বিতীয় জীবনের কথা বলা আছে। কবির দ্বিতীয় জীবনে এই অপর সত্ত্বার বাস, যা কেউ জানে না। এ কী কাউকে বলার মতো? হয়তো অনেকেরই সেই বোধ আছে এবং ব্যবহার করে থাকে, কিন্তু পরিষ্কারভাবে টের পায় না, বা বলে সন্দেহভাজন হতে চায় না। কবি কয়েক রকমেরই হয়। অবোধ কবি, ভিখারী কবি, সেয়ানা কবি, পাগল কবি – এই শেষের জন ছাড়া বাকি সবাই চেষ্টা করে জার্সি লুকিয়ে অস্বচ্ছ হবার। কেবল পাগলের হুঁশ নেই। সে তার হিবিস্কাসি অস্তিত্বের কথা বলে ফেলতে দ্বিধা করে না। মৃত্যুকালীন আচরণের মধ্যে তাকে আমরা ফুটে উঠতে দেখি। ফসিল ভাবলে মিথ ভেঙে ফেলি। শারীরিক চিঠির ডাক এজন্যই ডাকে না সবাইকে। তারা কবিতা লিখবে কী ক’রে, যারা টেরই পেল না উৎস কবিতা? তা হলে যা সব হচ্ছে বা বলা হচ্ছে চারপাশে, সে সব কী? সে অন্য গল্প, অন্য কোনো সময়ে।
ধরো আমার অপর সত্ত্বা বেরিয়েছে কবিতার সন্ধানে। আরো অনেক কবিদের মধ্যে তুমিও বেরিয়েছো, মানে অনেক কবির অপর সত্ত্বারা। তুমি আমাকে চিনতে পারবে? উৎস কবিতাকে তুমি বা তোমরা কি একই রকম দেখছো? না। তা হতে পারে না। এই সত্ত্বা অলৌকিক কিছু নয়, রাতেই বেরোয়, তা-ও না – আমি কোনো ভূতুড়ে ব্যাপারে যাচ্ছি না। পরিবেশেই খুঁজি পরিবেশ নষ্ট না ক’রে। এটাই মৃত্যু-ইকোলজি। তোমার কল্পনাশক্তিকে বাড়াও না। সেটাও অভ্যাসের ব্যাপার। এভাবেই কাল্পনিক অভিজ্ঞতা বাড়ে, অর্থাৎ বাস্তবিক অভিজ্ঞতার অনেকটাই কাল্পনিক অভিজ্ঞতায় পর্যযবসিত হয়। একইভাবে তা শিবিস্কাসি আচরণেও খাটে।
যদি সবাই বলে – আরে, এতো আমাদের সবারই হয়, সবাই জানি – এ আর নতুন কথা কী হলো? তাহলে বলি, নিউটনই কি প্রথম আপেল পড়তে দেখেছিলেন? ওপরের উদাহরণগুলো আমার এই সব উদ্ভট কল্পনার ফসল, যা এই নিবন্ধে র্যাশনালাইজ করার চেষ্টা করেছি। এসব শুধু কবির, পাঠকের নয়। পাঠক কবিতালিপিটি হাতে পেয়ে কোনো হিবিস্কাসের কথা না ভাবলেই ভালো। কবিরাই ভাবে না – পাঠক কোন্ দুঃখে ভাবতে যাব,? তাদের কল্পনাশক্তিও তো সীমিত। তাতে দুটো টুং টাং বেজে ওঠাই যথেষ্ট।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন