রেলা-৬
--এই দেশটা যে গরীব কীভাবে বুঝবে?
আমি দেশ নিয়ে সবে ভাবতে আরম্ভ করেছি। গরীবি নিয়েও। যিনি একথা বলছেন, তিনি এত গম্ভীর যে আমার অযথাই মনে হলো, “মসজিদ অব ভি দূর হ্যায় মেরে দোস্ত / চলো কিসি রোতে হুয়ে বচ্চে কো হসায়া যায়েঁ”। বলিনি যদিও, দাদা বলে ডাকছি, অন্ততঃ বছর দশেকের বড়, এবং যারপরনাই বিপ্লবী! কারণ রেডবুক আছে, আমি দেখেছি গতকাল, আর ঝোলা, যা বিব্লবী ছাড়া মানায় না! এখন দুপুর প্রায় দেড়টা, বিপ্লবী বরুণদা আমার দিকে তাকিয়ে, গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, আবার বললেন, কী হলো, বলো?
কী বলবো? আমার যা কথা ছিল সে সব তো কু, কূট নয়, নৈতিক নয়, স্রেফ কু! ওই বয়সে যে সব কথা ভাবি, ভেবে “আপনা হাত জগন্নাথ / করলে ভাই বাজিমাৎ...” করতেই থাকি, সেই অকথ্য বিমোচনময়তায় বিপ্লবের জন্য নিবেদন কোথায়? কোথায় সেই অগ্নিস্রাবী উৎসারণ? আমি ইস্পাত এক্সপ্রেসে বসে আছি, ট্রেন ছাড়তে আরো আধাঘন্টা, তো আমার সামনে কাকতালীয় ভাবেই বিপ্লবী বরুণদা এসে বসলেন। আমি একটু হাসতেই বললেন, ‘কে ভাই তুমি?’ যাদু আছে গলায়, নইলে নেতা কিসের?
গতকাল আমাদের ক্রিকেট ক্লাবের ছেলেদের নিয়ে উনি বসেছিলেন। কী গভীর পান্ডিত্য! হেগেল, মার্ক্স, লেনিন, ট্রটস্কি, মাও, লিন পিয়াও, লি-শাউ-চি, কাস্ত্রো, চে, হো-চি-মিন জাতীয় বুর্জোয়া, দ্বৈত চরিত্র বিশিষ্ট বুর্জোয়া, কম্প্রাডর বুর্জোয়া, জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব, জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ ইত্যাদির গাঁট পেরিয়ে উনি যখন বললেন, “এই বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যবস্থায় যে যত বেশি পড়ে সে তত বেশি মূর্খ হয়” সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে লেগে গেল। শালা এই না হলে বাণী! কে বলছে কে জানে, কিন্তু একদম ঠিক বলেছে...। ইতিমধ্যে বিদ্যাসাগর বরুণদার ভাষণে চলে আসায় আমি ঘাবড়ে গেলাম, সেরেছে বিদ্যাসাগর!... না না ও রকম পন্ডিত! তারপর ল্যাম্পপোস্ট! বিদ্যাসাগর এমন শিক্ষাবিরোধী কথা বলতেই পারেন না! পরে শুনলাম, বরুণদা বিদ্যাসাগরকে ‘নব্য-বুর্জোয়া’ হিসেবে চিহ্ণিত করছেন। বিদ্যাসাগর বুর্জোয়া? হতে পারে, বরুণদার মত যখন! বরুণদা আবার প্রেসিডেন্সির... দারুণ ছাত্র... উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিয়ে বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন...
তো বরুণদা আমায় অচিরেই চিনতে পেরে হেসে বললেন, কালকের মিটিং-এ ছিলে না?
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
বরুণদা তারপর প্রায় উদাসীন হয়েই ওই প্রশ্নে চলে গেলেন, “এই দেশটা যে গরীব কীভাবে বুঝবে?”
আমি ভাবছিলাম, কে গরীব? আর খেতে পাওয়া না পাওয়া নিয়ে আমার চিন্তায় চলে আসছিল সেইসব হাহাকারি মানুষের মুখ... বন্যা... খরা...
বরুণদা হাসলেন। বিপ্লবীর হাসি, পুরো ম্যাদাগাস্কার! ১৯৭০, আমি চোদ্দ থেকে পনেরোর দিকে, ফ্রম সুসু টু ধাসু(ধাসু মানে ম্যাচো টাইপ), বরুণদার হাসিতে প্রবল ম্যাদা থাকায় ম্যাদাগাস্কারই মনে এলো আমার।
তো বিরল হাসি দিয়ে বললেন বরুণদা, দারিদ্র্য থাকে মনে, আমাদের দেশের শোষিত কৃষকরা মনের দিক দিয়ে সবচেয়ে ধনী, অনেক বড় মন ওদের।
--কত বড়?
বরুণদা বিরক্ত হয়ে তাকালেন, আমিও বুঝেছি প্রশ্নটা বোকা বোকা হয়ে গেছে!
--এই বড়ত্বটা মাপা যায় না। এই যে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার পরিকল্পনা আমাদের, এর পেছনে এই মনোবৈজ্ঞানিক কারণটাও রয়েছে। শহরের লোক যতই পয়সার গরম দেখাক তাদের মন নেই, তারা স্বার্থপর, তাই তাদের ঘেরাও করে বৈপ্লবিক ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে... যারা আসবে না, তারা শ্রেণীশত্রু, তাদের আমরা পাইপগান বা রাইফেলের ডগায় সভ্য করে তুলবো!
বরুণদা এতটা বলে একটু হাঁপিয়ে ওঠার ফাঁক খুঁজলেন ঘড়ি দেখে, তারপর আমায় বললেন, এই কিটস-ব্যাগটা এখানে রইলো আর আমার ঝোলাটাও, ঘাবড়াবার কিছু নেই, এখানকার পুলিশ জানে না আমার কথা, আসলে চারু, চারুলতা বীরমিত্রপুরে মিটিং করতে গিয়েছিল, ও আমার সঙ্গেই ফিরবে... আমি একটু নেমে দেখি ও আসছে কিনা!
--ওয়ে কাকে, এতো নেতাজি লগিয়াসি, কৌন পার্টি কা? আমার পাশে বছর ছাব্বিশের দীর্ঘদেহী এক সর্দার। হাসছে। সর্দার যে ভাবে হাসে, বল্লে বল্লে টাইপ!
আমি চেপে গেলাম, বললাম, টিচার হ্যায় জি...
--আচ্ছা টিচার জি... বড়ি অচ্ছি বাত হ্যায় জি...
টিচার হওয়ার মধ্যে অচ্ছি বাত নিশ্চয়ই কিছু আছে, নইলে সর্দার হাসবে কেন?
আমি ততক্ষণে বরুণদার ঝোলা থেকে উঁকি মারা মলাট দেওয়া বইগুলো হাতে নিয়ে নিয়েছি, এ আমার অভ্যেস, বই দেখলেই হাত চুলকোয়। প্রথম বইটিই রেডবুক। চোখ বোলালাম, পরের বইটা কি লেনিনের ‘হোয়াট ইস টু বি ডান?’ কিন্তু পাতা ওল্টাতেই এ সব কী? আমি এদিক ওদিক তাকাই। সর্দার অন্যদিকে তাকিয়ে আছে, এ ছাড়া আমি কী দেখছি কে আর দেখবে? পাতায় পাতায় নর নারীর ওইসব ছ্যাঁকা দেওয়া ছবি, বিবরণেও কী সব অগ্নিপ্রবণতা... আমি আটকে যাই... কানের পাতা তন্দুর হয়ে ওঠে।
--আরে এটা কি হচ্ছে?
বরুণদা!
আমি তাড়াতাড়ি বইগুলো ঝোলায় পাচার করি। বরুণদার ভয়ে কমব্যাট ফোরসের রোঁয়া সার সার দাঁড়িয়ে গেছে। পাশে হাল্কা নীল তাঁতের শাড়িতে ভরানো যিনি, তিনি নিশ্চয়ই চারুলতা! বিরক্ত বরুণদা চারুলতার মোহবর্ণ কানে কিছু বললেন, চারুলতার অসম্বৃত কনুই ধাক্কা মারলো বরুণদার পাঁজরে, আর মুখে শরারতি হাসির ছোঁয়ায় চারুলতা হয়ে উঠলো সেই মুহূর্তের ‘মিস ইস্পাতএক্সপ্রেস’, আমি প্রায় পনেরো হয়েও কাৎ, ‘কিছু করার নেই বস’-এ ছাড়া আমার কিছু বলার নেই এখন। পাশের তরুণ সর্দার আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, মাস্টারজীকা বিবি?
--নহি, উনকা দোস্ত।
--দোস্ত? অচ্ছি বাত হ্যায় জী!
কথায় কথায় ‘অচ্ছি বাত হ্যায় জী!’ বলাটা বোধহয় মুদ্রাদোষ এই সুদর্শন তরুণ সর্দারের!
বরুণদা গম্ভীর আবার, আমায় কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, অপসংস্কৃতি বোঝ?
ওই গরম বইটার কথা বলছে নাকি?
বরুণদা যেন আমায় নয় পুরো বিপথগামী তরুণ সমাজকে জানাচ্ছেন তাঁর অপসংস্কৃতি বিরোধী অবস্থান। এ রকম দৃঢ়তার সঙ্গে বলে যেতে লাগলেন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চায় না এ দেশের যুবসমাজ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখুক, তারা তাই নানারকম ভাবে যুবসমাজকে প্রলোভিত করে চলেছে, হলিউডের সিনেমা, ড্রাগসের নেশা, ক্যাবারে ডান্স আর পর্ণগ্রাফি! তুমি যে বইটা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলে সেটা ওই ইয়ে... মানে পর্ণগ্রাফি! আমরা কাল কলেজ স্ট্রিটে এই বইগুলো পোড়াবো... তার আগে নানা জায়গা থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে... এবার বুঝেছো, ওটা কেন আমার ঝোলায়? একজন বিপ্লবী হলো সমাজের সবচেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষ, সবদিক দিয়ে সে এগিয়ে থাকে, আমরা বাঙালিরা জন্মসূত্রেই এক বিপুল বৈপ্লবিক ঐতিহ্যের অধিকারী, ওই যে তোমার পাশে যে সর্দারটি বসে আছে, তার মতো নয়! এখনো ওরা কতটা ধর্মান্ধ ওদের ওই পাগড়ি দেখলে বোঝা যায়! তো ইয়াং কমরেড, এইসব পিছিয়ে পড়া মানবসমাজকে টেনে তুলতে হবে, তাদের কানে কানে বলতে হবে, জাগো জাগো জাগো সর্বহারা / অনশন বন্দী ক্রীতদাস!
আবেগ, বরুণদার? মাইরি কেঁদে ফেলবে না তো? না কাঁদলেন না, তবে রুমাল বের করে ঠোঁটের কোণে জমে থাকা থুতু পরিষ্কার করে নিলেন আলগোছে! ট্রেন এইসব সুভাষণের ঝলক নিতে নিতে এসে গেল চক্রধরপুরে। ট্রেনে হঠাৎ ভিড়। কোনো মিটিং ছিল নাকি? চাপ তৈরি হয়ে গেল কামরার ভেতরে। আমরা টেনেটুনে বসে জায়গা দিলাম অন্যদের। উল্টোদিকেও একই অবস্থা। বরুণদার মুখে একরাশ বিরক্তি। সবাই বসতে চায়, ঠেলাঠেলি ভেতরেই একজন পড়ে যায় চারুলতার গায়ে, চারুলতা চেঁচিয়ে ওঠে। বরুণদা প্রতিবাদ করেন, এই কেয়া করতা, লেডিজ হ্যায় দেখতা নেহি! ব্যাস ওই ছেলেটির দলবল প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বরুণদার ওপরে। --আব্বে বাঙালিদাদা মারকে তে থোবড়া এয়সা কর দুঙ্গা কে তেরা ইয়ে হেমা মালিনী ভিপহচান নহি পায়েগা! বরুণদা কুঁকড়ে যায়। আমি ভাবছিলাম তীব্র প্রতিবাদ ক’রে বরুণদা ওর সেই পাইপগানটা দিয়ে সবাইকে ঠান্ডা করে দেবেন... কোথায় কী? আরেকজন চারুলতার দিকে তাকিয়ে বললো, কিঁউ মেরি জান উঠাকে লে জাঁউ কেয়া? সামান তো সব অচ্ছা হি রক্ষা হ্যায়, মেরা সামান ভি দেখ লে...! এরপর ইঙ্গিতময় হাসিতে ভরে যায় আশপাশ। এরই মধ্যে একজন হাত বাড়ায় চারুলতার দিকে। চারুলতা সিঁটিয়ে যায়। বরুণদা হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে থাকেন...। আমিও উঠে দাঁড়াই চিৎকার করে, কিন্তু আমার আগেই সেই দীর্ঘদেহী সরদার উঠে দাঁড়িয়ে যে ছেলেটা হাত বাড়াচ্ছিল তাকে প্রায় তুলে নিয়ে ভিড়ের মধ্যে ছুঁড়ে দেয়। বলতে থাকে, প্যাঁয়চো... ঘর মে মা বহেন নহি হ্যায় বে তুমলোগোকা? আমার চোখের সামনে পঞ্চনদের শিখ পুরো ভাংড়া হিল্লোল তুলে পেটাতে থাকে ওই লম্বাচুলো হিপিদের নকল করা ছেলেগুলোকে। আমি সেই প্রথম বুঝতে পারলাম, পাঞ্জাবীরা কেন হীরো হয়, আর বাঙালি বিপ্লবী! দেবানন্দ, ধর্মেন্দ্র, জীতেন্দ্র আর ‘উপ্পর আকা/নিচে কাকা’ যাকে বলা হচ্ছে, সেই রাজেশ খান্না -- সব পাঞ্জাবের। আর বরুণদা, বিপ্লবী বরুণদা বাঙালি...
ইতিমধ্যে সর্দারের ওই ভয়ঙ্কর রূপ দেখে রণে ভঙ্গ দিয়েছে বীরপুঙ্গবেরা। সর্দার যথেচ্ছ পেটানো শেষ করে চারুলতাকে বললো, তুম ফিকর না করো ম্যাডামজী, আরাম সে বয়ঠো, ভাগ গয়া শালে...! আমি দেখলাম ম্যাডামজীর চোখে তখন হীরো ওয়ারশিপের বন্যা নেমে গেছে। বরুণদা তার বৈপ্লবিক আস্থা ফিরে পেয়েই চারুলতাকে বললেন, দেখলে তো কীভাবে দু’জন লুম্পেনকে লড়িয়ে দিতে হয়! চারু, বিপ্লবে ট্যাকটিক্সটাই আসল...। চারু তখন চিত্রাঙ্গদা; মন্ত্রমুগ্ধ তাকিয়ে আছে অর্জুনের দিকে... সেই অবস্থাতেই বরুণদাকে বললো, চুপ করো, কাপুরুষ কোথাকার! তারপর সর্দারকে ধন্যবাদ ইত্যাদি জানিয়ে জড়িয়ে গেল এক অনন্ত কথাবার্তায়...। আমি টাটানগরে নামবো, তো টাটা অব্দি চারুলতা আর সর্দারের ইন্টারএক্টিভ সেশন চলতেই থাকলো...। চারুলতার হাসিতে স্বপ্নভঙ্গ হতেই থাকলো নির্ঝর আর বরুণদাদের...
আর আমি সেই পনেরো বছর বয়সেই দেখলাম কীভাবে আহত বিপ্লবী ফিরে যাচ্ছে প্যাভিলিয়নের দিকে! যদিও খেলা বা প্রেম, এমনকি বিপ্লবও তাতে থেমে থাকবে কেন?
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন