:P
বিমল হাত তুলে জানালার বাইরে কিছু একটা দেখানোর চেষ্টা করছিলো। এই হাসপাতালের কেবিনগুলো বেশ বড়ো আর জানালাগুলোও সমানুপাতে। এমনকি কেবিনের ভেতর থেকেই দ্বিতীয় হুগলী ব্রীজ দেখা যায়।
--তোর কখনো মনে হয় না, পৃথিবীটা ঠিকঠাক ক’রে বানানোই হয়নি? মানে বলতে চাইছি, গড, ইফ হি একজিস্টস্, হি ইজ এসেনশিয়ালি আ পুওর আর্কিটেক্ট। তাই না কি?
-- বিমল। ফিলোজফি মাড়াস না। নন্দিনী বলছিলো, তুই নাকি ইদানীং টোটাল ভেজ হয়ে গেছিস। ফলের রস ছাড়া কিছুই মুখে তুলছিস না!
-- হুঁহ্। ভেজ।
বিমল আবার চুপ করে গেল। সাদা বিছানায় আধশোয়া। পাশাপাশি আরও তিনখানা বেড। ফাঁকা। তিনজনই নাকি আজ সকালে ছাড়া পেয়েছে। বিমল ছুটি পায়নি। আসলে বাবার জন্য ডাঃ পাকড়াশীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট করাতে এসেছিলাম এই হাসপাতালে।
রিসেপশনে নন্দিনীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। অনেক দিন পর। জানতে পারলাম, বিমলের একটা ফুসফুসে ম্যালিগন্যান্ট গ্রোথ। কেমো চলছে। এটা তিন নম্বর। গতকালই জেনারেল বেডে দিয়েছে। নন্দিনী আমার হাত ধরে বলেছিলো, “ভিসিটিং আওয়ার চলছে। একবার দেখা ক’রে যাস, প্লীজ। ওর ভালো লাগবে... ঘনঘন ঘড়ির দিকে দেখছি লক্ষ্য ক’রে বিমল হাসলো।
--কী? চলে যাবি তো? জানি। তাও আর একটু বোস। আর পাঁচ মিনিট।
-- কীভাবে টের পেলি? কাশি হতো? জ্বর?
-- না। কাশিটা নিয়ে মোটেও চাপ ছিলো না। স্মোকার্স কফ বলেই ভাবতাম। সেরকম কষ্টও হয়নি। শুধু কাঁধে যন্ত্রণা হতো। টাটিয়ে থাকতো সারারাত। ডাক্তার এক্সরে করাতে বললো, তারপর বায়োপ্সি এটসেট্রা এটসেট্রা...
বিমলের সঙ্গে যদি এই শেষ দেখা হয়, তাহলে শেষের আগেরবার দেখা হয়েছিলো প্রায় বছর সাতেক আগে। হাওড়া বাসস্ট্যান্ডের পাবলিক ইউরিন্যালে। দু’জনেই হিসি করতে করতে, আমি বাঁ দিকে আর বিমল ডান দিকে, ঘাড় না ঘোরালে হয়তো দেখতেই পেতাম না!
-- তাহলেই দ্যাখ্, ইস্ট মিটস ওয়েস্ট ইন আ পাবলিক মুতখানা। ভাবা যায়! কঠিন... হাহাহা।
-- বিমল, কলেজের কারোর সঙ্গে আর দেখা হয় তোর? আই মীন, কেউ জানে?
-- ওঃ! না। আর কীই বা জানানোর আছে? আমি মাথা নাড়ি। এইবার আমাকে উঠতেই হবে। আজ বিকেলটা একপ্রকার নষ্টই হলো। আমি ইন্সেন্সিটিভ হচ্ছি না, কিন্তু আমাকে বলতেই হবে, বিমলের সঙ্গে আমার আর কোনো স্মৃতি অবশিষ্ট নেই। সে যে একসময় আমার বন্ধু ছিলো, এখন আর মনে হচ্ছে না। বিকেলে আমি একটা টিউশন মিস ক’রেছি। ছাত্রদের ফোন ধরিনি। আজকালকার বাজারে মাস্টারদের এইরকম খামখেয়ালিপনা কেউই সহ্য করে না। পরদিন থেকে একজন ছাত্রও যদি কমে যায়, তাহলে সেটা আমারই ক্ষতি।
--ভালো থাকিস... আমি নন্দিনীকে ফোন নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি... বাড়ি ফিরলে একদিন যাবো... মাসিমা কেমন আছে... ইত্যাদি ব’লে বেরোতে যাচ্ছি, বিমল আবার বললো কথাটা। এইবার একটু জোর গলায়।
-- অমিয়, তুই যাই বল না কেন, আমি শিওর যে আমি ঈশ্বর হলে পৃথিবীটা আরও বেটার বানাতে পারতাম। বাল্। মুখ দিয়ে খিস্তিটা বেরিয়ে যাচ্ছিলো। কোনোরকমে আটকালাম। মুচকি হাসলাম। এই কথাটা নেপোলিয়ান ভেবেছিলো, বাহাদুর শাহ্ জাফর ভেবেছিলো, আমার ধারণা লেনিনও এই ধরনের কিছু নিশ্চয়ই কোনো না কোনো সময় ভেবেছিলেন। সব্বাই ভাবে। এটাকে ফিলজফিক্যাল স্টেটাস দেয়ার কোনো মানেই হয় না। মৃত্যু এড়ানো যাবে না জেনেও মানুষ যে কেন ফালতু ফালতু নাটক করে!
বাড়ি ফিরে বিমলের ওপর খানিকটা রাগই হলো। না, টাইম খাওয়ার জন্য ততটা নয় যতটা ভাবনাটা মাথায় ঢোকানোর জন্য। বিমলের ঘরবাড়ির কথা আমি যতদূর মনে করতে পারছি, ওরা ছিলো যাকে বলে ওয়েল অফফ। ক্যান্সার হওয়াটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ব্যাপার, কিন্তু ওরা অন্তত তার খরচ বহন করতে পারবে। বিনা চিকিৎসায় মরে যেতে হবে না। নন্দিনী বলছিলো, কয়েকমাস বাদেই সে নাকি সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাবে বিমলকে। সুতরাং সহানুভূতির কোনো জায়গা নেই। বিমল বা নন্দিনী যে আমার খুব কাছের বন্ধু ছিলো, তাও নয়। শুধু এক ক্লাস। এক স্টাডি সার্কেল। এক হাফ-হার্টেড রাজনীতি। তারপর সময়। না। আমার বিমলের জন্য শোক করার প্রয়োজন নেই। শুধু ওল্টানো গুবরে পোকার মতো গোঁ গোঁ করছে বুলশিট ভাবনাটা।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে নিজের দু’কাঁধ টিপেটুপে দেখলাম। নাহ্! কোথাও ব্যথা বেদনা নেই। দিব্যি ঝরঝরে লাগছে। আমার বোকামিতে আমি নিজেই হেসে ফেললাম।
বিমল হাত তুলে জানালার বাইরে কিছু একটা দেখানোর চেষ্টা করছিলো। এই হাসপাতালের কেবিনগুলো বেশ বড়ো আর জানালাগুলোও সমানুপাতে। এমনকি কেবিনের ভেতর থেকেই দ্বিতীয় হুগলী ব্রীজ দেখা যায়।
--তোর কখনো মনে হয় না, পৃথিবীটা ঠিকঠাক ক’রে বানানোই হয়নি? মানে বলতে চাইছি, গড, ইফ হি একজিস্টস্, হি ইজ এসেনশিয়ালি আ পুওর আর্কিটেক্ট। তাই না কি?
-- বিমল। ফিলোজফি মাড়াস না। নন্দিনী বলছিলো, তুই নাকি ইদানীং টোটাল ভেজ হয়ে গেছিস। ফলের রস ছাড়া কিছুই মুখে তুলছিস না!
-- হুঁহ্। ভেজ।
বিমল আবার চুপ করে গেল। সাদা বিছানায় আধশোয়া। পাশাপাশি আরও তিনখানা বেড। ফাঁকা। তিনজনই নাকি আজ সকালে ছাড়া পেয়েছে। বিমল ছুটি পায়নি। আসলে বাবার জন্য ডাঃ পাকড়াশীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট করাতে এসেছিলাম এই হাসপাতালে।
রিসেপশনে নন্দিনীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। অনেক দিন পর। জানতে পারলাম, বিমলের একটা ফুসফুসে ম্যালিগন্যান্ট গ্রোথ। কেমো চলছে। এটা তিন নম্বর। গতকালই জেনারেল বেডে দিয়েছে। নন্দিনী আমার হাত ধরে বলেছিলো, “ভিসিটিং আওয়ার চলছে। একবার দেখা ক’রে যাস, প্লীজ। ওর ভালো লাগবে... ঘনঘন ঘড়ির দিকে দেখছি লক্ষ্য ক’রে বিমল হাসলো।
--কী? চলে যাবি তো? জানি। তাও আর একটু বোস। আর পাঁচ মিনিট।
-- কীভাবে টের পেলি? কাশি হতো? জ্বর?
-- না। কাশিটা নিয়ে মোটেও চাপ ছিলো না। স্মোকার্স কফ বলেই ভাবতাম। সেরকম কষ্টও হয়নি। শুধু কাঁধে যন্ত্রণা হতো। টাটিয়ে থাকতো সারারাত। ডাক্তার এক্সরে করাতে বললো, তারপর বায়োপ্সি এটসেট্রা এটসেট্রা...
বিমলের সঙ্গে যদি এই শেষ দেখা হয়, তাহলে শেষের আগেরবার দেখা হয়েছিলো প্রায় বছর সাতেক আগে। হাওড়া বাসস্ট্যান্ডের পাবলিক ইউরিন্যালে। দু’জনেই হিসি করতে করতে, আমি বাঁ দিকে আর বিমল ডান দিকে, ঘাড় না ঘোরালে হয়তো দেখতেই পেতাম না!
-- তাহলেই দ্যাখ্, ইস্ট মিটস ওয়েস্ট ইন আ পাবলিক মুতখানা। ভাবা যায়! কঠিন... হাহাহা।
-- বিমল, কলেজের কারোর সঙ্গে আর দেখা হয় তোর? আই মীন, কেউ জানে?
-- ওঃ! না। আর কীই বা জানানোর আছে? আমি মাথা নাড়ি। এইবার আমাকে উঠতেই হবে। আজ বিকেলটা একপ্রকার নষ্টই হলো। আমি ইন্সেন্সিটিভ হচ্ছি না, কিন্তু আমাকে বলতেই হবে, বিমলের সঙ্গে আমার আর কোনো স্মৃতি অবশিষ্ট নেই। সে যে একসময় আমার বন্ধু ছিলো, এখন আর মনে হচ্ছে না। বিকেলে আমি একটা টিউশন মিস ক’রেছি। ছাত্রদের ফোন ধরিনি। আজকালকার বাজারে মাস্টারদের এইরকম খামখেয়ালিপনা কেউই সহ্য করে না। পরদিন থেকে একজন ছাত্রও যদি কমে যায়, তাহলে সেটা আমারই ক্ষতি।
--ভালো থাকিস... আমি নন্দিনীকে ফোন নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি... বাড়ি ফিরলে একদিন যাবো... মাসিমা কেমন আছে... ইত্যাদি ব’লে বেরোতে যাচ্ছি, বিমল আবার বললো কথাটা। এইবার একটু জোর গলায়।
-- অমিয়, তুই যাই বল না কেন, আমি শিওর যে আমি ঈশ্বর হলে পৃথিবীটা আরও বেটার বানাতে পারতাম। বাল্। মুখ দিয়ে খিস্তিটা বেরিয়ে যাচ্ছিলো। কোনোরকমে আটকালাম। মুচকি হাসলাম। এই কথাটা নেপোলিয়ান ভেবেছিলো, বাহাদুর শাহ্ জাফর ভেবেছিলো, আমার ধারণা লেনিনও এই ধরনের কিছু নিশ্চয়ই কোনো না কোনো সময় ভেবেছিলেন। সব্বাই ভাবে। এটাকে ফিলজফিক্যাল স্টেটাস দেয়ার কোনো মানেই হয় না। মৃত্যু এড়ানো যাবে না জেনেও মানুষ যে কেন ফালতু ফালতু নাটক করে!
বাড়ি ফিরে বিমলের ওপর খানিকটা রাগই হলো। না, টাইম খাওয়ার জন্য ততটা নয় যতটা ভাবনাটা মাথায় ঢোকানোর জন্য। বিমলের ঘরবাড়ির কথা আমি যতদূর মনে করতে পারছি, ওরা ছিলো যাকে বলে ওয়েল অফফ। ক্যান্সার হওয়াটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ব্যাপার, কিন্তু ওরা অন্তত তার খরচ বহন করতে পারবে। বিনা চিকিৎসায় মরে যেতে হবে না। নন্দিনী বলছিলো, কয়েকমাস বাদেই সে নাকি সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাবে বিমলকে। সুতরাং সহানুভূতির কোনো জায়গা নেই। বিমল বা নন্দিনী যে আমার খুব কাছের বন্ধু ছিলো, তাও নয়। শুধু এক ক্লাস। এক স্টাডি সার্কেল। এক হাফ-হার্টেড রাজনীতি। তারপর সময়। না। আমার বিমলের জন্য শোক করার প্রয়োজন নেই। শুধু ওল্টানো গুবরে পোকার মতো গোঁ গোঁ করছে বুলশিট ভাবনাটা।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে নিজের দু’কাঁধ টিপেটুপে দেখলাম। নাহ্! কোথাও ব্যথা বেদনা নেই। দিব্যি ঝরঝরে লাগছে। আমার বোকামিতে আমি নিজেই হেসে ফেললাম।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন