কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৩ মার্চ, ২০১৩

ঊর্মি খান

গন্তব্য


ঠিক এইরকম ভোরেই সে আত্মহত্যা করেছিল। আমার বাস তখন হাইওয়ে ধরে ছুটছে...আমিও ছুটছি...

চোখে তখন ঘুম কুমারের আসা-যাওয়া। সেলফোন বেজে বেজে কখন বন্ধ হয়েছিল জানি না। ঘুম কুমার আমাকে যখন ছেড়ে গেল, তখন সূর্যটা অনেকটাই মাথার ওপর। বাসস্ট্যান্ডে কোলাহল, লোকে লোকারণ্য। আমি তখনো জানি না তার আত্মমৃত্যুর খবর। বাসটা কোন্ এক অজানা স্ট্যান্ডে থেমে আছে, বুঝতে পারছি না। বাইরে তাকালে যে কোনো সাইনবোর্ড দেখে কিংবা কাউকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে। কিন্তু ইচ্ছে করছে না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে খুব। সেলফোনে চার্জ নেই। সময় কত হলো কে জানে! চোখটা একটু খুলে দেখলাম, পাশে বসা লোকটি আয়েশ করে পান খাচ্ছে। জর্দার তীব্র গন্ধটা নাকের সামনে ধাক্কা দিচ্ছে অনবরত। নাহ... আর চুপচাপ থাকা যাচ্ছে না। একটু নড়ে চড়ে বসতেই লোকটি বলল, ''পান খাবেন আফা?'' ''না। থ্যাঙ্ক ইউ।'' এই প্রথম এক বিরক্তিকর যাত্রী আমার পাশে বসে যাচ্ছে। যতই সরে যাচ্ছি, সে রীতিমতো আমার দিকে চেপে বসার চেষ্টা করছে। বার দুই বলা স্বত্ত্বেও আবার একই কাজ করছে। এভাবে হবে না... কথা বলা শুরু করলাম। ''ভাই সাহেব কী কাজ করেন?'' ''আমি এঞ্জিনিয়ার''। বেশ অবাক হলাম।'' কী ইঞ্জিনিয়ার?'' বিস্তৃত হাসি দিয়ে সে বলল ''এই ধরেন গিয়া তালা-চাবি ঠিকঠাক করি আর কী!'' '' বাহ, বেশ ভালো কাজ।'' কথা আর বাড়ালাম না। একটু বমি বমি ভাব হচ্ছে। জানালায় মুখ বাড়িয়ে দু'বার গল গল করে বমি করলাম। শেষবার যেই না বমিটুকু ফেলতে যাব, দেখি কয়েকটা হকার এটা-ওটা সেধেই চলেছে। কোনো রকমে হাত দিয়ে মুখটা চেপে ধরে রাখলাম। ওরা সরে যেতেই ফেলে দিয়ে স্বস্তি মিলল। ছোটবেলায় বাসে বমি হতো। আজ হঠাৎ কেন যে হলো...!

''আফা পান খান। ভালা লাগব।'' আমি জর্দা ফেলে দিয়ে পান চিবুতে লাগলাম। ঝালে জিভ পুরে যাওয়ার অবস্থা। তারপরও ভালো লাগল খেতে। বাস আবারও চলছে। ঘুম পাচ্ছে খুব। আমি জানতেই পারলাম না, সে নেই!

শরীরের তীব্র আকর্ষণ আমাদের দুজনার আদিম খেলাকে পূর্ণতা দিয়েছে বহুবার। তাকে হারিয়ে ফেললাম একদিন নিজের ভুলেই। হঠাৎ একদিন অনুভব করলাম, শরীরের ভেতর নতুন এক মানব স্বত্ত্বার আগমন তীব্রভাবে জানান দিচ্ছে। এখন যে তাকে খুঁজে পেতেই হবে! অনাগত ভ্রুণ আমাকে যখন আনন্দময় আঘাত করে চলেছে, যখন তাকে খুঁজতে খুঁজতে সেদিন যখন অচেনা বাসস্ট্যান্ডে নেমে তার গন্তব্যের ঠিকানায় নিজের গন্তব্য রচনা করতে গেলাম...; অচেনা উঠোন পেরিয়ে অচেনা দরজায় কড়া নাড়ার আগের মুহূর্তেও আমি জানতে পারি নি, সে নেই! কেন, কি কারণে মৃত্যুর স্বাদ নিল সে, জানা হলো না আমার! মাঝে মাঝে উদাস হয়ে শুধু বলত --''ঈশ্বর বলেছেন, পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে কঠিন, মৃত্যু খুব সহজ।''

আজ আবার সেইরকম একটি ভোর। দ্রুত বেড়ে উঠছে ভ্রুণ। আমি আবারও ছুটছি... হাইওয়ে ধরে বাস ছুটছে তীব্র গতিতে। পাশের সিট ফাঁকা। ঘুমকুমার পালিয়েছে সেদিনই।

আজ কারো মৃত্যু আমাকে তাড়িত করছে না। আজ আমার মৃত্যু স্বয়ং আমাকে গন্তব্যে নিয়ে চলেছে...

পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে কঠিন, মৃত্যু খুব সহজ!

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন