কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৩ মার্চ, ২০১৩

রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়

কর্ণার্জুন



প্রিয় কর্ণ,

আমি ব্রাহ্মণকে বরণ করলাম। আমার বাবা নেই। তাই সমাগত পাণিপ্রার্থীরা তাকে আক্রমণ থেকে বিরত থাকলো। আমার মা আছেন, তবে একাধিকে যে আমাকে মিলিত ভাবে ভোগ করবে, তা কখনো তিনি বোধহয় ভেবে উঠতে পারেন নি।

আমি ভেবেছিলাম। আমার বুকের মধ্যে উলের গোলা। আমার হাতে পায়ে ঘৃণ্য রোম। ফলতঃ দীর্ঘ পাজামা, রঙিন ও উজ্জ্বল, আমার ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসা নিকৃষ্ট শিশ্ন আর আমার শীৎকার নিয়ে ভেবেছিলাম। আমি তো তোমার পুরুষকারের কাছে বালিকা উত্তীর্ণ কিশোরী মাত্র। তোমার ওই রূপলাবণ্যের রূপক স্বর্ণকবচ ও কুন্ডল দ্বারা আমাকে আশ্রিত রাখো। রাখো তোমার অর্জুনবিদ্বেষ। অঙ্গরাজ্য থেকে মালিনী নগর পর্যন্ত তোমার শৌর্য অক্ষুণ্ণ রাখো।

এটাই তো রাজন্যনীতি! গুরুর গোত্র অনুসারে নিজেকে ভার্গব পরিচিতি দেবে তুমি, বহ্মাস্ত্রের জ্ঞান লাভ হবে তোমার, পরশুরামের ক্ষমা পাবে না, সেই জ্ঞান তিরোহণ হবে। তাই তো তুমি প্রিয় কর্ণ। আমাকে বহুভোগ্যা আখ্যা দানের পরেও। দাসীর কর্তব্য অবহিত করেছিলে আমাকে। প্রকাশ্য সভায়। আমি আহত নয়, আহৃত হয়েছিলাম। দাসীত্বে বরণ করেছিলাম নিজেকে। আর অর্জন করেছিলাম তোমায়, কর্ণ। অর্জিত হয়েছিলাম তোমাতে।

বৃহন্নলার সঙ্গে যুদ্ধে যখন তুমি পরাজিত হলে তখন আশ্চর্য হয়েছিলাম কি? পূর্বেই তোমার কর্ণচ্ছেদ হয়েছিল। ছদ্মবেশী দেবরাজকে কুন্ডল দানের সাথে সাথেই তুমি অমোঘ বৈজয়ন্তী শক্তি লাভ করেছিলে। বেদাদি শাস্ত্রেও তোমার ব্যুৎপত্তি ছিল। দান উপাসনা ছিল। আর আমার শরীর থেকে পুরুষ ঝরে পড়ছিল। কানীন সুতপুত্র তুমি, আমি কখনো তোমার মাকে ক্ষমা করতে পারি নি, যেমন আমার মাকেও, যিনি শুধু কন্যাসন্তান চেয়ে পুত্রের শরীরে কন্যা স্তুতি ও শংসাকে আরোপ করেছিলেন। কিন্তু আমি তো কন্যা, দেখো, আমার আয়ত নেত্র যুগল, মনোহর শ্রোণিদেশ, কৃষ্ণ ও কুঞ্চিত কেশরাশি।

তোমার মৃত্যু সংবাদ আমি পাবো নিশ্চিত। অগ্নিহোত্রী ব্রাহ্মণের হোমধেনু বধ করেছিলে তুমি। রথচক্রগ্রাস নিয়তি তোমার।

তখনও থাকবো, তোমারই।

আমি কৃষ্ণা।



প্রিয় অর্জুন,

আমার এই জীবন কোনো অধুনা ব্যাসদেব দ্বারা লিখিত নয়। আমার কোনো বিধিলিপি নেই। আমিই আমার বিধিলিপি। আমি কল্যাণী নই। সর্বনাশিনী। একদিন নিজের অস্তিত্বকেও বিনাশ করবো বলে আমি কর্ণকে ত্যাগ করিনি। তোমাকেও।

তুমি কীর্তিমান। যুদ্ধ জনিত যশ সকলি তোমার। নৃত্য, গীতাদি, গান্ধর্ব বিদ্যায় প্রভূত জ্ঞান তোমার। কিন্তু তুমি ততদূর কীর্তিমান নও যতদূর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি আমার শরীরে প্রবেশ করাও। বহু নারীতে তুমি প্রবৃত্ত হয়েছো। তাই আমি তোমার নিবৃত্তি স্বরূপ।

তাই বৃহন্নলা নাম ধারণ করে তুমি যখন অজ্ঞাতবাস করেছিলে, তোমার সেই পুরুষ অভ্যন্তরস্থ নারীটিকে আমি আমার পুরুষ অভ্যন্তরস্থ নারীটিকে দিয়ে সর্বসুখ আস্বাদন করেছিলাম। তুমি যখন পুরস্ত্রীগণকে নৃত্য গীতাদি শিক্ষাদানের মধ্যে প্রীত করতে, আমি তখন স্বয়ং প্রীত হতাম। পার্থসারথ্য তোমাকে মহিমান্বিত করেছিল কি না আমি জানি না। কিন্তু তোমার প্রতি পার্থের বহু অন্যায় পক্ষপাতিত্ব একদিন অন্য কোনো মহাভারতে লেখা হবে।

যেমনটা উলঙ্গ আমি রূপ দ্বারা শাসিত, আমার পদ্মপলাশাক্ষি, তোমার পার্থ তখনই লজ্জাবাস টেনে দিল আমার শরীরে! কী লজ্জার! কিন্তু দ্রৌপদী যে ভারতবর্ষ, লিঙ্গ বিভক্ত ভারতবর্ষ, নারী অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিরূদ্ধ ভারতবর্ষ -- সেই মহাভারতবর্ষর কথা কেউ লিখবে না। এই জেনেও আমি লৌহিত্যসাগর পর্যন্ত তোমার সঙ্গে যাব। অহংকার তোমার পতনের কারণ হওয়ার ঢের আগেই তোমার প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণে আমার পতন নিশ্চিত হবে।

হে সঞ্জয়, আমি তো প্রত্যঙ্গ স্থাপনের পরেও পুত্র উৎপাদনে অক্ষম হবো, কী ভাবে প্রশ্ন করবো আপনাকে আমার সেই কল্পিত সন্তানদের পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে আপনার কৃতকর্ম কী হতে পারে!

তখনও তুমি থেকো অর্জুন, আমার এই গোপনকে সঙ্গোপনে লালন করার জন্য।

আমি দ্রৌপদী।




0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন