কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২২

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী




(১৬)  

কয়েকদিন পর এক রাতে বিশ্রুত আর অনির্বেদ হৃদয়ের বাড়িতেই থেকে গিয়েছিল। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প গুজব হয়েছিল ওদের। অনির্বেদ শুয়েছিল মাঝখানে আর তার দুপাশে হৃদয় আর বিশ্রুত। হঠাৎ মাঝরাতে বিশ্রুতর চীৎকারে ঘুম ভেঙে গেল হৃদয়ের। চোখ খুলতেই দেখতে পেল অনির্বেদ খুব জোরে জড়িয়ে ধরেছে বিশ্রুতকে আর বিশ্রুত বুকের সঙ্গে লেপ্টে থাকা অনির্বেদের হাতটা সরাতে গিয়ে বলছে,

আঃ কী করছিস, সরা, হাতটা সরা। শেষ পর্যন্ত বিশ্রুত সফল হচ্ছে, অনির্বেদের হাতটা আলগা করে ছুড়ে দিচ্ছে, আর অনির্বেদ বিশ্রুতরপিঠের দিকে ফিরেই হাত গুটিয়ে আবার এলিয়ে পড়েছে, কোনও হুঁশই নেই ওর। বিশ্রুত অবশ্য আগের মতোই দেওয়ালের দিকে ঘুরে গেছে, সেদিকে পাশ ফিরেই ঘুমোচ্ছে।

ওরা দুজনেই আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু হৃদয় কিছুতেই ঘুমোতে পারছে না। কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হয়েছে ওর। বিশ্রুতর ঘুমের মধ্যে রেগে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু অনির্বেদ? ও অমন করছে কেন?  

হঠাৎ হৃদয় লক্ষ করল অনির্বেদ আবার জড়িয়ে ধরেছে বিশ্রুতকে। এবারও বেশ জোরে। একদম আঁকড়ে ধরার মতো করে। বিশ্রুত দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে। কিছু টের পাচ্ছে না। কিন্তু একটু উসখুস করতে শুরু করেছে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল এভাবে। অনির্বেদ মুখ লুকিয়েছে বিশ্রুতর পিঠের ভাঁজে। তার হাত বিশ্রুতকে আলিঙ্গন করে তার বুক ছুঁয়েছে।

আচমকা অনির্বেদ যেন ছিটকে গেল। তারপর পুরো ঘুরে গেল হৃদয়ের দিকে। বিশ্রুত উঠে বসেছে। অনির্বেদের হাতটা সজোরে ছুড়ে দিয়েছে আর চেঁচিয়ে উঠেছে হঠাৎ আরে, এটা হচ্ছেটা কী! ব্যাপারটা কী, অ্যাঁ, ওঃ একটু ঘুমোবার জো নেই দেখছি।

অনির্বেদেরও ঘুম ভেঙে গেছে। সেও উঠে বসেছে। তারপর বিহ্বলের মতো তাকিয়ে জানতে চেয়েছে, কী হয়েছে? কী করেছি আমি?

বিশ্রুত খুব রেগে গেছে। ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, কেন এরকম করছিস তুই? তোর পাশে যদি আর কোনোদিন...

কী করেছি আমি? অনির্বেদ সরল ভাবেই জানতে চাইল, আমি তো ঘুমোচ্ছিলাম...

আর আমার ঘুম বরবাদ করছিলি...

বিশ্রুত আর কথা বাড়াল না, দেওয়ালের দিকে মুখ করে আবার শুয়ে পড়ল, ঘুমে ওর চোখ জড়িয়ে আসছিল। অনির্বেদ কিছুক্ষণ বসেই রইল। তারপর আবার শুয়ে এবার হৃদয়ের দিকে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল। এবার আর কোনও বিপত্তি হল না। হৃদয় জেগেই ছিল। কিন্তু অনির্বেদ এখন যেন সতর্ক হয়েই ঘুমোচ্ছে। তার হাতটা নিয়ন্ত্রণেই রইল। হৃদয়ের কাছে পৌঁছাবার কোনও চেষ্টাই করল না।

পরদিন সকালে অনির্বেদ চলে যাওয়ার পর হৃদয় বলল, গতকাল রাতে যা ঘটেছে, তার সবই আমি দেখেছি...

বিশ্রুত একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, কী প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতা ওর মধ্যে! ঘুমের মধ্যেও কেমন করে অবলম্বন খোঁজে, তাই না?

আমিও তাই দেখলাম। আর কিছু বলল না হৃদয়। গতকাল রাতে অনির্বেদ ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে এমনকি ঘুমের মধ্যেও ও কোনোদিন অনির্ব্রদের অবলম্বন হতে পারবে না। হৃদয়ের দিকে পাশ ফেরার পর ঘুমের মধ্যেও ওর মধ্যে তাই সতর্কতা কাজকরেছে। বিশ্রুতর ক্ষেত্রে কিন্তু তা হয়নি। ওর মধ্যে অনির্বেদ ভরসা খুঁজেছে। যদিও পুরো ব্যাপারটাই ঘটেছে ওর অবচেতন স্তরে।

অনির্বেদ চেশটা করত বাইরে একটা গাম্ভীর্য বজায় রাখতে। আসলে সবাই ওকে মনে মনে করুণা করত। কখনও বা হাসির খোরাক বানিয়ে তুলত। সমিধার বাড়িতে একদিন ওরা সবাই গেছে। হঠাৎ আগ্নেয় চোখ টিপে সমিধাকে কী যেন ইশারা করল। তারপর অনির্বেদকে বলল, প্লিজ একটু বারান্দায় আয়, রেলিং ধরে দাঁড়া।

অনির্বেদ অতলান্তর সঙ্গে ফিসফিস করে গল্প করছিল। অদ্ভুত অদ্ভুত সব ফুলের নাম মনে থাকে তার। সেগুলোই বলছিল। হঠাৎ এই প্রস্তাবে সরলভাবেই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আর তখনই আগ্নেয় ওর সামনে প্রণয় নিবেদনের ভঙ্গিতে একটা প্লাস্টিকের গোলাপ বাড়িয়ে দিল। আর নিমেষে নিজের মোবাইলে এই ছবিটা ইয়ুলে নিল সমিধা। চারপাশে সবাই হেসে উঠল। অনির্বেদও হেসে উঠল। যদিও কয়েক সেকেণ্ড পর অসম্ভব গম্ভীর হয়ে উঠল ওর মুখ।

একদিন তো ওকে জোর করে ক্রিকেট খেলায় নামিয়ে দিল আগ্নেয়। সবাই জানত, অনির্বেদ কোনওদিন খেলাধুলো করে নি। কোনও খেলাই সে পারে না। ওসব নিয়ে তার মনে কোনও উৎসাহই নেই। সে এক নরম সুন্দর জগতের বাসিন্দা। ব্যাট হাতে অনির্বেদকে নামতে দেখে সবাই বনেশ মজা পেল। অনির্বেদ ক্রিজে গিয়ে ঠিকমতো দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বোল্ড হয়ে গেল। বলটাকে ভালো করে দেখতেই পেল না। ব্যাটটাকেও ঠিকমতো ধরতে পারল না। ব্যাট হাতে ওকে বোলারের মুখোমুখি দাঁড়াতে দেখেই আগ্নেয় মুচকি মুচকি হাসতে শুরু করেছিল। নিতান্ত অনিচ্ছায় ও মাঠে নেমেছিল। আউট হয়ে যাওয়ার পর খুব বিমর্ষ হয়ে গেল। অনির্বেদের মনে হল সবার চোখে ও যেন একটা অপদার্থ হয়ে উঠেছে। সবাই ওকে করুণা করছে।

আর একটা দর্শনীয় বিষয় ছিল, অনির্বেদের সাইকেল। নতুন সাইকেল কেনার মতো অর্থ ওর ছিল না। একটা লঝঝরে সাইকেলে চেপে ও সব জায়গায় ঘুরে বেড়াত। সেকেণ্ড কিনেছিল সাইকেলটা। ট্রেনে, বাসে, বা অটোয় ওঠার পয়সা সবসময় ওর কাছে থাকত না। তাই সাইকেলটার ওপরে ওর নির্ভরতা ছিল খুব বেশী। এই সাইকেলটা ছাড়া অনির্বেদকে ভাবাই যেত না। ও প্রচুর টিউশ্যুনি করত। আর সব জায়গায় সাইকেল চেপেই যেত। বন্ধুরা অবাক হয়ে জানতে চাইত, ওইখানে? সাইকেল চেপে গেলি? সে তো অনেক দূর! কিন্তু সাইকেল সঙ্গে থাকলে কোনও দূরই অনির্বেদের কাছে দূর বলে মনে হতো না। সাইকেল ও অনির্বেদ যেন হয়ে উঠেছিল যেন অভিন্ন সত্তা। অনির্বেদের কথা ভাবতে বসলেও আগে মনে আসত সাইকেলটার কথা। লঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে সাইকেল আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে অনির্বেদ। পেরিয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা দ্বীপ। সাইকেলটার ফিকে হয়ে আসা রঙ, পুরোনো, মরচে-পড়া, লঝঝরে অবস্থা দেখে সবারই করুণা হত। অনির্বেদও টের পেত সাইকেলটার জন্য সবাই ওকে করুণা করছে।

এই ব্যাপারগুলো চলতোই। এমনিকী প্রেমে পড়লেও কেউ সেভাবে গুরুত্ব দিত না। সবাই ব্যাপারটা হাসিঠাট্টার স্তরেই রাখত। এরকমই একটা ব্যাপার ঘটল কয়েকদিন পর। সাঁঝের সঙ্গে ব্যাপারটা যখন দাঁড়াল না, অনির্বেদ তখন আকৃষ্ট হল মেহুলীর প্রতি। মেহুলী অনির্বেদের স্পর্ধা দেখে যেমন অবাক হল, তেমনই ভেতরে ভেতরে কৌতুকও বোধ করল। অনির্বেদের আর্থিক অবস্থার কথা ও জানত। তাই মনে মনে করুণাই করত অনির্বেদকে। পেছনে সব সময়েই হাসিঠাট্টা করত অনির্বেদকে নিয়ে। অন্য বন্ধুরাও তাতে সায় দিত। আগ্নেয়কে ও বলেছিল, ব্যাটার বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার শখ হয়েছে। এবারই হবে আসল মজা।

আসলে অনির্বেদকে কেউ গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্যই মনে করত না। আর অনির্বেদ সবার কাছে গুরুত্ব পাওয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে মরিয়া ছিল। একদিন একটা ঘটনা ঘটল। রোববারের আড্ডায় অনির্বেদ মেহুলীকে বলল, কাল তোদের দ্বীপে যেতে হবে। দুপুরের দিকে তোদের ফ্ল্যাটে যাব...

ঐ সময়? খাবি কোথায়?

অনির্বেদ চুপ করে থাকে। মেহুলী বলে, ঠিক আছে আসিস।

কী খাওয়াবি ওকে? হঠাৎ জানতে চায় আগ্নেয়। নির্মাল্যকে নিয়ে সেই সময়ে মেহুলী উদাসীন হয়ে পড়েছে। প্রথমে খুব আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল নির্মাল্যকে। কিন্তু ভালোবাসা নিয়ে ওর বাড়াবাড়ি, অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা আর অধিকারবোধই মেহুলীকে হতাশ করেছে। বরং আগ্নেয়র সঙ্গে খেলাটা একটু একটু করে জমে উঠেছে। আর আগ্নেয় নিজেও জানত, অনির্বেদের সঙ্গে যে ব্যবহার করা চলে, ওর সঙ্গে সেটা করা এক্সযায় না। নিজেকে সে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে জানত।

কিস্যু না। তাচ্ছিল্য করেই জবাব দিল মেহুলী।

ব্যাপারটা ওখানেই থেমে গেল। যদিও অনির্বেদ জানত, মেহুলী একটা কিছু ব্যবস্থা রাখবেই। সেটাই তো স্বাভাবিক।

পরদিন যখন ও মেহুলীর ফ্ল্যাটে পৌঁছল, তখন প্রায় বেলা দুটো। অনির্বেদ অসম্ভব ক্ষুধার্ত। মেহুলী কিন্তু ওকে খেতে দেওয়ার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নিল না। যদিও খাতির-যত্ন করেই বসতে দিল। হাসিঠাট্টাও করল। অনির্বেদ বসেছিল সোফায়। মেহুলী নিজের বিছানায়। ঘরটা ছায়ায় ঢাকা। অনির্বেদ তীব্র আকর্ষণ বোধ করছিল মেহুলীর প্রতি। বুকের খাঁজ দেখা যাচ্ছিল তার। যদিও সেই আকর্ষণকে ছাপিয়ে গিয়েছিল প্রচণ্ড ক্ষুধা। কিন্তু অনির্বেদ মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারল না। মেহুলী সেটা জানত।

গতকাল আগ্নেয় আর মেহুলী ঠিক এই সময় এই বিছানায় শুয়ে ছিল। ফ্ল্যাটে আর কেউ ছিল না। বাবা-মা দুজনেই চাকরিতে গেছেন। আগ্নেয় অনেকভাবে ওর বুক ছোঁইয়ার চেষ্টা করে। পারে নি। নানা কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছিল মেহুলী। কিন্তু এই ছেলেটার সঙ্গে সেই মজা করা যায় না। অনির্বেদ সবসময়েই কেমন সিরিয়াস আর গম্ভী। মজারও যোগ্য নয় যেন। একে শুধু করুণা করা যায়।

কথায় কথায় বহুক্ষণ কেটে গেল। অনির্বেদের পেটে খিদে তখন থিতিয়ে এসেছে। কেমন যেন অবসন্ন লাগছে শরীর। কিন্তু খিদে সহ্য করতে ও শৈশব থেকেই অভ্যস্ত। তাই সামলে নিয়েছে ব্যাপারটা। বিকেল পাঁচটা নাগাদ ও উঠে দাঁড়াল। মেহুলীকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না। তবু বলল, চলি তাহলে।

এখনই যাবি? একটু চা করে দিই? মেহুলী বলল।

নাঃ, এখন থাক। গভীর সঙ্কোচে অনির্বেদ বলল।

তাহলে কিছু খেয়ে যা অন্তত। একটু মুড়ি মেখে দিই?

না না কিছু দরকার নেই। বাড়িতে মা অপেক্ষা করছে।

হ্যাঁ, তাই তো, মনেই ছিল না একদম। হঠাৎ মনে পড়েছে, এমন ভঙ্গীতে মেহুলী বলল। হাঁপ ছেড়েও বাঁচল যেন। তারপর অনির্বেদ চলে যাওয়ার পর একা একা ঘরে হাসতে ফেটে পড়ল। ব্যাপারটা নিয়ে খুব

হাসাহাসি চলল কয়েকদিন আগ্নেয় আর সমিধার মধ্যে।

 

(ক্রমশঃ)     

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন