কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২

মৌ চক্রবর্তী

 

ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি



প্রতি,

এ চিঠি বা প্রতিবেদন। এ লিখন। এ স্মৃতিকথা। না, কবি জীবনানন্দের 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' নয়। তারচেয়েও কিছু দুস্তর ফ্ল্যাশব্যাকের কথা। সিনেমায় ফ্ল্যাশব্যাক হয়। কিন্তু থিয়েটারে? হয় কি? হয় হয়। স্মৃতির ভুবনে হাত পাতলেই হয়। হ্যাঁ, একটা হলদে আলোই হবে বা সাদাও হতে পারে। কে একজন কাব্যি করে বলেছিলেন, 'সুনীল আকাশে উড়িল বিহঙ্গ পতঙ্গ রে'। কোন বড় কবির লেখা কিনা, তাও জানেন না যিনি এই সংলাপ আওড়ে আমার স্মৃতি ফিকে হতে দেননি। ঘরের পরে বলেই হয়ত, বাচ্চা কাঁদলে মন ভোলাতে এই সংলাপ হেসে উঠত। থরথর নাকি ঘরঘর কীরকম শব্দ হয়েছিল? শিশু-কান আজ আর তা   শুনতে পায় না। কিন্তু পেলে ভাল হত। মজার লাগত সেসময় সব। একটা কিছু হবে যেটা মঞ্চ নামিয়ে নিয়ে যেত। ফিকে আলোয় মন দিয়ে তাকিয়ে থাকা। মাঝখানে বিশাল গোল গর্ত। আবার সেটায় করে লোকে-ওঠে নামে। থিয়েটার শুরুর আগে পর্যন্ত ওটা ফাঁকাই থাকে। আর শুরু হলে ওটা নেমে যায়, অভিনয়-করিয়েদের নিয়ে উঠে আসে। এক-আধবার বোধহয় আশপাশ দিয়েও অভিনেতা প্রবেশ করতেন। দর্শকরা যে যার সিট ছেড়ে লাফিয়ে উঠতেন দেখার জন্যে। পরে  বুঝেছি, ওঁরা বক্স আর্টিস্ট। আর একুশ শতকের সাংস্কৃতিক-অর্থনীতির ভাষায় ওঁদের টিআরপি বেশ বেশির দিকে। আরও মজার ছিল মঞ্চ তো ঘুরে যেত এদিকে ওদিকে, আলাদা সব ঘরবাড়ি আবছা আলোয় দেখা যেত। তারপরই আলো জোরে এসে পড়ত, যেমনটি পড়ার কথা। কিন্তু, এই মঞ্চের নাম মনে নেই। থিয়েটারের নাম ছিল 'কাকের বাসা'। আর একটা দেখে মজা লাগত, সেটা হল একটা প্লেন সুতোয় বাঁধা লাইন দিয়ে চলে আসত। সামনে। মাথার উপর হবে বা। কারোর সঙ্গে সঙ্গে সংলাপ ছিল, বম্বে যাওয়ার। মঞ্চের কোণায় একজন শিল্পী দাঁড়াতেন এসে। খুব কিছু বলবেনও বা। না, মনে পড়ে না। শুধু শেষের সংলাপ মনে পড়ে, মানিয়ে নাও, একটু মানিয়ে নাও, একটু অ্যাডজাস্টমেন্ট।  অনেক পরে জেনেছিলাম, ঐ মানিয়ে নেওয়া হল মানিয়ে চলা, মিলেমিশে চলা। মোটাসোটা একজন লোক সেটা বলতেন খুব জোরের সঙ্গে। তিনি ছিলেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবা ভক্ত না হলেও কলেজ স্ট্রিট পাড়া থেকে হাতিবাগানে যেতেন। সপরিবারে। বন্ধু- আত্মীয় জুটিয়ে, তাঁদের টিকিট কেটে নিয়ে। রবিবার। সন্ধ্যা সাড়ে ছটা। এই সময় কবে থেকে চালু হয় কে জানে! কিন্তু রবিবারের কথা  খুব মনে পড়ে। সন্ধ্যা ছটায় বাবার প্রেসের সামনে এসে জুটতাম। জুতো মোজা পরা আমাদের সাজুগুজু ভাব। আর বাবা হাতের কণুই পর্যন্ত কালি মেখে। বাবার  জামাতেও কালি। মা ব্যাগে করে একটা জামা আনতে ভুলত না। সেটাই বাবা হাতে-মুখে-চোখে জল দিয়ে পরে নিত। ভাগ্য ভাল থাকলে একটা ট্রাম মিলত।  সৌভাগ্য চরমে থাকলে ট্যাক্সি। দেরি হয়ে গেছে। কোনমতে হাত ধরে ছুটে চলা। কোনদিন এমনও হয়েছে থিয়েটারের টিকিট পুরনো জামায় রয়ে গেছে। জামা তো প্রেসে ঝুলছে। আবার ছুটত বাবা। আমাদের জন্যে সেদিন থিয়েটার বোধহয় অপেক্ষা করত। এমন একটা কিছু করে পিছিয়ে যেত, যেখানে আমরা বুঝতে পারি। বোঝাতে কেউই চাইত না। ফিসফিস করে বলত, ঐ যে অপর্ণা সেন। স্বরলিপি, বিশ্বরূপা মঞ্চে তাঁর জন্যেই হিট হিট হিট। কে বলত, ঐ যে দীপঙ্কর। কখনও এভাবেই শুনেছি কিছু নাম। কানে ভাসে কিছু আর কিছু নয়। তবে, উত্তর কলকাতার ভাগে দেশভাগের পর সিনেমা থিয়েটার যাত্রাপালা আর সার্কাসে মুগ্ধ ছিল। টিকিট পাওয়া যেত না মাঝে মধ্যেই। হাউসফুল লেখা একটা বোর্ড টাঙানো থাকত। কলকাতাবাসী বাঙালির জীবনে এই থিয়েটার পাড়া এসে পড়েছিল। ভাগের বাংলার অভিনেত্রীদের মধ্যে নাম করা লিলি চক্রবর্তী-র ‘বিলকিস বেগম’ কত রজনী পূর্ণ করেছিল, তা কোথাও লেখা হয়ত রয়েছে,  কিন্তু সর্বজনীনভাবে কেউই জানেন না। বাঙালি মাত্রই জানেন মনোজ মিত্রের নাটক 'দম্পতি'র কথা। আর গীতা দে-র সঙ্গে নাট্যকার ও অভিনেতা মনোজ মিত্রের কেমিস্ট্রি মানে রসায়ন। সঙ্গে ছিলেন আরও এক নামজাদা অভিনেতা শুভেন্দু চ্যাটারজি। দেশভাগের পর এই প্রফেশনাল বোর্ডের থিয়েটার, যা সাধারণ রঙ্গালয়ের পরে বাণিজ্যিক সাফল্যের চূড়ান্তে গিয়ে পৌঁছেছিল। একদিকে, কাজ  করেছেন নামজাদা অভিনেত্রীরা। যাঁদের এই মঞ্চ থেকে সিনেমা এবং সিনেমার সঙ্গে সঙ্গে থিয়েটারে কাজ। চলেছে সমান্তরালভাবেই। আর্থিক স্বচ্ছলতা পেয়েছেন। সাফল্য পেয়েছেন। যেখানে কেতকী দত্তের অভিনীত 'বারবধূ' খুব সাফল্য পায়। ইতিহাস তৈরিও হয়। কিন্তু তার সন্ধান করে লিপিবদ্ধ হয় না। প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চায় একসময়ে পাঠক্রমে থিয়েটার এল। পাশ করে ডিগ্রি নিয়ে তার দ্বারা কাজ করার প্রবণতা তৈরি হল। সেই প্রবণতা বা ঝোঁক নিয়ে তথ্য বিশ্লেষণ করলে খুব উঁচু দরের শিল্প-প্রেমীদের সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে যা মেলে, তা হল একটা দিক, যেখানে কেতকী দত্ত প্রমুখের নামের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় সন্ধান। কেমন ছিল ঐ থিয়েটারের জগত? সেখানে কি কেবলই অর্থের জন্যেই অভিনয় করা হত? মানে, অর্থের মাহাত্ম্যে অভিনয়, নাকি অভিনয়ের মাহাত্ম্যে অর্থলাভত? নাকি অভিনয় এবং অর্থলাভ সমার্থক হয়ে ওঠে? তাত্ত্বিক  বিশ্লেষণে না গিয়েও অনায়াসেই এই তথ্য প্রকাশিত হয় যে, অর্থ নিয়ে অভিনয় করলেও, সেটা ছিল অধ্যয়নের 'সাধনার মতন'। 'সাধনার মতন' শব্দবন্ধের ব্যবহার করেছেন আলোচক সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী। তিনি নাট্য-গবেষক। তিনি ২০২২ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতায় নাটকে বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত  বিভাগীয় প্রধান। এবং নিয়মিত অভিনেতা গ্রুপ থিয়েটার পর্বের। তিনি এক ‘রঙরূপ’ দল প্রযোজিত ও সীমা মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত নাটকে অভিনয় করে  থাকেন। চর্চা করতে গিয়ে সংলগ্ন গ্রুপ থিয়েটার পর্বের অভিনেত্রীদের সঙ্গে জুড়ে যায় মঞ্চ, কাল ও আর্থিক এক বিশ্লেষণ। সমাজ এরই সমন্বয়ে চলমান।



মনে পড়ে সারকারিনায় এসেছিলাম। অনেক বছর পর শ্রদ্ধেয় অমর ঘোষ মাস্টারমশায়ের হাত ধরে। তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়-আয়োজিত একটি কর্মশালা করিয়েছিলেন। সেখানেই আলাপ। তারপর জানালেন, সারকারিনায় অভিনয় করবে? লিড ক্যারেক্টার। গিয়ে দেখলাম সেই সারকারিনা, যেখানে একদিন জুলুষে ঠিকরে পড়ত চোখ। এখন হলদে আলোয় বসে থাকা মলিন চেয়ার হাতলে জঙ। আর স্যারের কপালে ভাঁজ। শুনে অবাক হয়েছিলাম, ঐ মঞ্চে বসে দেখছিলাম নাটক 'মরজিনা'। সেই চরিত্রটিই আমাকে করতে হবে আগামীতে। কিন্তু এই কী হাল! ততদিনে যেতে যেতে বুঝেছিলাম, ওটা চালাতে  গিয়ে স্যারের সব গেছে। বাড়ি বলতে মঞ্চই তাঁর আপন ঘর। এভাবেও ভাবতে  পারেন? স্যার আমায় দেখে শোয়ের শেষে বলেছিলেন যে, বুঝেছি, এই ক্যারেক্টারটা করবে না, তাই তো? আসলে পোশাক। পোশাক বিতর্কে সারকারিনা  বরাবরই সমালোচনায়। দর্শক টানতে যদি ওইরকম পোশাক পরতেও হয়, কী  এসে যায়? তদ্দিনে তো হেলেন-সিনেমায় ওরকম পোশাক পরেছেন। এবং, হিট ছবির হিট গানে আজও সেসব প্রাণবন্ত। কিন্তু কলকাতা নেয়নি। মানে, দর্শক। তাহলে সিনেমায় যা চলে তা কিন্তু চলে না থিয়েটারে। কিন্তু আবার সেই একই কলাকুশলীদের জন্যে থিয়েটারের হাউসফুল শো- হয়। কিন্তু গপ্প, কাহিনি, পোশাক যেন মঞ্চের বাতাবরণে এসে ঠেকে যায় একটা সভ্যতার চরে। নাকি সংস্কৃতির পিঠস্থান বলে একদা খ্যাত মঞ্চনাটকের পাড়া তখনও নাকউঁচু হয়েই ছিল! তাই, অনেক করেও চলেনি ঐ মর্জিনা। চলে গেছে সময়। অনেক বছর পর  আবার থিয়েটার পাড়ায় যাতায়াত। এদিকে ওদিকে সব পাল্টে গেছে। রয়েছে লাল কটি বাড়ি বা উঁচুতল। যারা হেরিটেজ বলেই পাল্টে যায়নি। তাহলে, দর্শকের  কাছে প্রশ্ন এই যে, হেরিটেজ কি থিয়েটার নয়? যেখানে এত রমরমা সেসব হল বা প্রেক্ষাগৃহ নয়? 

গত সময়ের অনতিদূরে নাকউঁচু বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি ছিল আছে থাকবে। কিন্তু কোথায় গেল এতগুলো মঞ্চ বা হল? হাতিবাগান অঞ্চলের থিয়েটার পাড়া  নিয়ে লেখা হচ্ছে। এবং তা স্মৃতি উসকে দিচ্ছে। কিন্তু সীমাবদ্ধ সেই পরিসর। আন্তর্জাতিক থিয়েটারের সঙ্গে বাঙালির জুড়ে যাওয়া। জুড়ে যাওয়া বাঙালির সিনেমা ও থিয়েটার নিয়ে মাতামাতি। দর্শক হয়ে ওঠা। অভিনেতা অভিনেত্রী হয়ে  ওঠা। নির্দেশক, ম্যানেজার হয়ে ওঠা। কলাকুশলী হয়ে ওঠা এবং টিকে থাকার লড়াই। যা ক্ষণস্থায়ী পর্যবেক্ষণের নয়। যা বিচ্ছিন্ন করে একটা ইতিহাসের পাণ্ডুলিপিও তৈরি করে না। এ হল অধুনাকৃত গবেষণা-পদ্ধতির ভাষা। যার চর্চা আগেও ছিল, পরেও থাকবে। আর থিয়েটার প্রেমী ডটকমে উঠে আসবে, না জানা তত্ত্ব, তথ্য। যার রসায়ন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সলতে পাকাচ্ছে।

_ ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী 

 


6 কমেন্টস্:

  1. The knowledge of the author regarding the subject is evident. Her deep feelings for theatre and theatre related activities has been expressed.The style of writing is crisp and clear.The author will carve a niche for herself as a writer and theatre activist in the near future.

    উত্তরমুছুন
  2. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  3. অসামান্য লেখা... স্মৃতি কাতরতায় আমিও আচ্ছন্ন হলাম।

    উত্তরমুছুন
  4. সুন্দর উপস্থাপনা। তার সাথে অত্যন্ত নস্টালজিকও।গত শতাব্দীর ষষ্ঠ এবং সপ্তম দশকে কলকাতায় থাকা কালীন আমি নিয়মিত ওই সব স্টেজে থিয়েটার দেখেছি। আমার সাবিত্রী চ্যাটার্জী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদির অভিনয় অত্যন্ত ভালো লাগতো।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. বুঝতেই পারি ... একদিন কথা হোক তবে যোগাযোগ 9836226846

      মুছুন