সিনেমার পৃথিবী – ১৮
আগের পর্বে বলেছিলাম এবার আমরা এশিয়ার সিনেমায় ফিরব। আজ এশিয়া ভ্রমণের প্রথমেই ইরান। তবে এবার আমরা একটু অন্য পদ্ধতিতে এগোব। প্রতিবারের মত ছবি ধরে ধরে নয় – আজ পরিচালক ক্রমানুযায়ী ইরানের সিনেমা নিয়ে আলোচনা করব। আসলে ইরানে বিভিন্ন সময়ে বড়জোর কয়েকজন করে পরিচালক ছাপ রেখেছেন, তাই সেইসব পরিচালকদের ধরতে পারলেই আমরা মোটামুটি ইরানের সিনেমার একটা সময়পঞ্জী পেয়ে যাব।
আজ যাদের নিয়ে আলোচনা করব, তাঁরা হলেন
– কিয়ারোস্তামি, মখমলবাফ্, মজিদি, ফারহাদি। তবে এঁদের নিয়ে আলোচনা শুরুর আগে একটা
পুরনো ছবি নিয়ে কিছু লিখব কারণ আমার মতে সত্তরের দশকের সেই সিনেমাকে ছবির পর্দায় কবিতা
বলা উচিৎ এবং সে্টাই ছিল ইরানি সিনেমার আর্ট ফিল্ম হয়ে ওঠার প্রথম পদক্ষেপ। ধৈর্য ধরে
দেখলে মনে হবে ইয়াসুজিরো ওজু-র সিনেমা দেখছেন। শোহরাব শাহিদ-সালেসের ‘স্টিল লাইফ’
(১৯৭৪)।
এক অচিন গ্রামের নির্জন রেল স্টেশন।
আশেপাশে কেউ নেই। সেখানে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন এক ক্রশিং গার্ড। এখন বৃদ্ধ।
একই কাজ, একই রোজনামচা। একঘেয়ে জীবন। বাড়িতে তাঁর বয়স্কা স্ত্রী সময় কাটানোর জন্য দিনরাত সেলাই করেন। তাঁদের একমাত্র সন্তান তাঁদের
ছেড়ে গিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এটাকে হয়ত থিম বলা যায় আবার হয়ত এটা নতুন কোন থিম
নয় কারণ বেশিরভাগ বয়স্ক মানুষের একাকীত্ব এরকমই। কিন্তু ৯৩ মিনিটের সিনেমায় যেটা ভাল লাগবে, সেটা হল ধীরে
ধীরে বয়ে চলা নিখুঁত লং শট এবং ক্যামেরার ওয়াইড অ্যাঙ্গল, যা পুরো ফ্রেমকে ধরে নিয়ে
চোখের সামনে এক বাস্তব জীবন তুলে ধরে। রুটিন কাজ। গার্ড আস্তে আস্তে স্টেশনে গেলেন,
সিগনাল দিলেন এবং ফিরে এলেন। কোথাও ক্যামেরার সিন-কাট নেই। অথবা তাঁর স্ত্রী ডিনার
খাচ্ছেন। দীর্ঘ শট। কাট নেই। প্রতি সিন নতুনভাবে তোলা হয়েছে, কিন্তু ঘুরেফিরে সেই একই দৃশ্যের পুনরায়ন।
বুঝতে পারবেন না আপনি কোন্ টাইম-ফ্রেমে বসে আছেন। ফলে গতানুগতিক পথ পেরিয়ে এই সিনেমা
আর্ট-ফিল্ম হয়ে উঠেছে। ঠিক এই কারণে ‘দ্য হাউজ ইজ ব্ল্যাক’ বা ‘ব্রিক অ্যান্ড মিরর’
বা ‘দ্য কাউ’ না বেছে এই সিনেমাকেই বাছলাম ইরানের শুরুর দিকের প্রতিভূ হিসেবে।
এবার পরিচালকদের আলোচনায় ফিরি। প্রথমেই
আব্বাস কিয়ারোস্তামি। একটুও ভুল বলা হবে না যদি বলি আব্বাস কিয়ারোস্তামি ছিলেন প্রথম
পার্সি পরিচালক যিনি ইরানি ছায়াছবিকে ধারাবাহিকভাবে বিশ্বমানের করে তুলেছিলেন। সেই
সত্তরের দশক থেকে এত অসাধারণ সব সিনেমা উনি উপহার দিয়েছেন –
রিপোর্ট
(১৯৭৭), হয়্যার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম? (১৯৮৭), ক্লোজ-আপ (১৯৯০), টেস্ট অব চেরি (১৯৯৭),
দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস (১৯৯৯) ইত্যাদি, যে ওনাকে ইরানের ছবির সত্যজিৎ রায় বলা যায়।
এখানে ওনার ঠিক দুটো ছবি নিয়ে বলব - ক্লোজ-আপ (১৯৯০) এবং টেস্ট অব চেরি (১৯৯৭)। এই
দুটোর গল্প এবং স্টাইল, পাঠক, ভাল করে লক্ষ্য করবেন।
এবার দেখুন, এই দুই ছবিই কিন্তু তির্যক,
সোশাল স্যাটায়ার। কেউ নিজের আইডলকে এত পছন্দ করে যে নিজেকে সেই আইডল হিসেবে পরিচয় দেয়
বা আরেকজন নিজের কবর দেওয়ার লোক খুঁজতে থাকে, এগুলো সমাজের বিভিন্ন অংশের সাধারণ মানুষের
মনস্তত্ত্ব ফুটিয়ে তোলে। এবং ছবিগুলো একটাও অ্যাবস্ট্রাক্ট নয়, বরং মিনিমালিস্ট। সমাজের কোন
এক সত্যি অংশকে ফুটিয়ে তোলা। কল্প কিন্তু অনেকটা ডকুমেন্টরি গোছের। এটাই কিয়ারোস্তামির
বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও ওনার সিনেমার প্রতি আমার ভাললাগার আরো কয়েকটা কারণ হল, উনি ক্যামেরা
প্রধানত এক জায়গায় বসিয়ে (স্ট্যাটিক) সেখান থেকে পুরো সিন ফুটিয়ে তোলেন, যা বেশ কষ্টকর।
এবং ওনার সিনেমার আবহে মাঝে মাঝেই পার্সি কবিতা ফুটে ওঠে।
রাজনৈতিক সিনেমা বানাতে বানাতে আশির
দশকের একদম শেষদিকে মোহসেন মখমলবাফ্ বানিয়েছিলেন ‘দ্য সাইক্লিস্ট’ (১৯৮৯)। সেই শুরুতেই
এক শক্ত বার্তা (ক্লোজ-আপ ছবিতে এই সিনেমার
রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে)। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ৯০ এর দশকে মখমলবাফ্ হয়ে
ওঠেন ইরানের সিনেমার প্রধান মুখ। ক্রিটিকাল কিছু সিনেমা উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। ওয়ান্স
আপন এ টাইম, সিনেমা (১৯৯২), হ্যালো সিনেমা (১৯৯৫), এ মোমেন্ট অব ইনোসেন্স (১৯৯৬), দ্য
সাইলেন্স (১৯৯৮), কান্দাহার (২০০১), সেক্স অ্যান্ড ফিলসফি (২০০৫) ইত্যাদি অদ্ভুত এবং
সাহসী সব সিনেমা। আমরা এখানে ওনার একটাই সিনেমা পর্যালোচনা করব - সেক্স অ্যান্ড ফিলসফি
(২০০৫)।
এই সিনেমাও স্যাটায়ার, কিন্তু এর ভেতরের
প্যাঁচ লক্ষ্য করুন। তাহলে বুঝবেন কেন এটা বাছলাম। মধ্যবয়স্ক নাচের শিক্ষক, জাঁ, ডিপ্রেশনে
ভুগছেন। উনি ঠিক করলেন ওনার চারজন প্রেমিকাকে একসঙ্গে ডেকে বলে দেবেন যে উনি তাদের
চারজনের সঙ্গেই প্রেম করেন এবং কেন, ঠিক কি কি পরিস্থিতিতে ওনার তাদের একে একে ভালো
লেগেছিল বা কেন উনি এখনো তাদের চারজনকেই ভালবাসেন – কারো প্রতি ভালবাসা কমেনি। উনি
সেই মিটিং করেন এবং তার প্রতি প্রেমিকাকে একটা করে হাতঘড়ি উপহার দেন। উনি ভেবেছিলেন
হয়ত তার প্রেমিকারা তাকে বকাঝকা বা মারধর করবে কিন্তু তারা কিছুই করে না, ঘড়ি নিয়ে
চলে যায়। এর কিছুদিন পর জাঁ-কে তার এক প্রেমিকা তার নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠায়। সেখানে
গিয়ে জাঁ বুঝতে পারে যে তার সেই প্রেমিকারও একাধিক প্রেমিক আছে এবং সেই প্রেমিকা তার
সমস্ত প্রেমিকদের তার বাড়িতে একত্রে ডেকেছে – ঠিক জাঁ এর মত।
অদ্ভুত, অসাধারণ, দুরন্ত। কি নেই এখানে?
মানুষের আদিম প্রবৃত্তি থেকে মনোস্তত্ত্ব, সততা বা অসততা, সাহস, ঈর্ষা, ভয়, আকুলতা
– সবকিছু। এজন্যই মখমলবাফ্ অন্যরকম এবং এত
সাহসী। কিন্তু এর ওপরেও এই সিনেমার আরেক ডাইমেনশন আছে। খুব ভালভাবে দেখলে বোঝা যাবে,
এইসব সুন্দরী প্রেমিকারা অহরহ জাঁ-এর মনের মধ্যে রয়েছে, হয়ত বাস্তবে তারা নেই। এবং
জাঁ এক স্টপ-ওয়াচ ব্যবহার করছে, যেখানে সে নিজের মত সময় সেট করছে। তাহলে কি এই পুরোটাই
আমাদের দৃষ্টিভ্রম? আমাদের সমাজের দৃষ্টিভ্রম? ভাবতে পারেন, এই ব্যতিক্রমী সিনেমাকে
অস্কার কমিটি সেরা বিদেশী সিনেমার দৌড় থেকে বাদ দিয়েছিল! কারণটাও শুনে রাখুন – এই সিনেমার
ইংলিশ সাবটাইটেল ছিল না। আর এই কারণেই অস্কার কমিটির প্রতি মাঝে মাঝে আমি ক্ষোভ উগড়ে
দিই। যাইহোক, এই সিনেমায় সুররিয়েলিজম এবং অ্যাবস্ট্রাক্ট সিন বেশ কিছু। যেমন গাড়ি চলছে, আর তার মাঝে সামনের-পেছনের
যাত্রী ফোনে কথা বলে চলেছে। অথবা এক বিশাল বড় এরোপ্লেনে মাত্র একজন যাত্রী। ক্যামেরার
ওয়াইড অ্যাঙ্গলের কাজ বেশ ভাল। এবং পরিচালককে যেখানে ফুল মার্ক্স দিতেই হবে, তা হল
ঠিকঠাক লোকজনকে দিয়ে নিখুঁত অভিনয় করানো। আদ্যন্ত ভয়ডরহীন তাঁর সিনেমার স্টাইল। যে
কারণে বনিবনা হয়নি বলে মখমলবাফ্ ইরান ছেড়ে চলে যেতেও দ্বিধা করেননি।
৯০এর দশক ও শূন্য দশকে যে পরিচালক বিভিন্ন
রকমের থিম নিয়ে কাজ করে সকলের মন জয় করেছেন, যাকে নিয়ে কিয়ারোস্তামি বা মখমলবাফের মত
কোন বিতর্ক নেই, তিনি হলেন মজিদ মজিদি। তাঁর যে যে সিনেমা মনে রাখার মত, সেগুলোর নাম – বাদুক (১৯৯২), চিল্ড্রেন অব হেভেন
(১৯৯৭), কালার অব প্যারাডাইস (১৯৯৯), বারান (২০০১), দ্য উইলো ট্রি (২০০৫) এবং দ্য সং
অব স্প্যারোজ (২০০৮)। এগুলোর ভেতর আজ আমরা মজিদির চিল্ড্রেন অব হেভেন (১৯৯৭) এবং বারান
(২০০১) নিয়ে আলোচনা করব।
‘চিল্ড্রেন অব হেভেন’ শুরু হচ্ছে ইরানের
এক গ্রাম্য পটভূমিতে এক গরীব ভাড়াটে পরিবারে।
দু’ভাইবোন – আলি আর জারা। স্কুল-পড়ুয়া। আলি এক মুচির কাছে জারার স্কুলের জুতো ঠিক করিয়ে নিয়ে আসার পথে
সেটা খোয়া যায়। তাদের বাবা এত গরীব যে নতুন জুতো হয়ত বাবা কিনে দিতে পারবে না, সেই
ভয়ে আলি বাড়িতে এই জুতো হারানোর কথা বলতে পারে না। সে নিজের বোনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি
করায় যে তার জুতোজোড়া এবার থেকে জারা সকালে স্কুলে পরে যাবে, আর জারা ফিরে আসার পর
আলি সেই জুতো পরে স্কুলে যাবে। কিন্তু বাড়িতে কিছুই জানানো চলবে না। বোনের মন রাখার
জন্য আলি স্কুলে থেকে প্রাইজ হিসেবে পাওয়া সোনালি পেন জারাকে দিয়ে দেয়। এদিকে রোজ স্কুলফেরৎ
জারার জন্য আর জুতোর জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে আলি স্কুলে লেট হয়ে যায়। এই নিয়ে হেডমাস্টার
তাকে বকাঝকা করে, কিন্তু আলি কিছুই বলতে পারে না। সে চুপচাপ কাঁদে। একদিন আলিকে সঙ্গে
নিয়ে তার বাবা শহরে যায়, বাগানের কাজ করে বেশ কিছু টাকা রোজগার করে এবং ঠিক করে এবার
জারাকে নতুন জুতো কিনে দেবে। কিন্তু রাস্তাতেই তার বাবার দুর্ঘটনা ঘটে যায়। নতুন জুতো
আর কেনা হয় না। তখন আলি ঠিক করে সে এক দৌড় প্রতিযোগিতায় নাম লেখাবে এবং সেখান থেকে
প্রাইজ হিসেবে নতুন জুতোজোড়া এনে তার বোনকে দেবে। কিন্তু সেখানে সে ফার্স্ট হয় এবং
জুতোর বদলে এক বিশাল কাপ পায়। আলি মনের দুঃখে কাপ নিয়ে বাড়ি ফেরে। তখন আরেক কাট-সিনে
দেখায় যে তাদের বাবা সাইকেলে বাড়ি ফিরছে, সামনে ছেলেমেয়ের জন্য নতুন দু’জোড়া জুতো।
এই সিনেমার এক হিন্দি রিমেক হয়েছিল – বাম বাম
বোলে (২০১০)। দেখেছেন কি?
‘বারান’ এমন এক সিনেমা যা মজিদিকে আন্তর্জাতিক
খ্যাতি এনে দিয়েছিল। এই সিনেমায় ইরানের সেই
সময়ের এক জ্বলন্ত সমস্যা দেখান হয়েছিল অনেকটা রূপকথার মত। আফগান উদ্বাস্তুরা মাঝে মাঝেই
তেহরানে এসে জড়ো হয় একটু উন্নত জীবন আর রুজিরুটির সন্ধানে। সেই নিয়ে ‘বারান’। এক আফগান
শরণার্থী পরিবারের মেয়ে ছেলে সেজে এক কনস্ট্রাকশন
সাইটে কাজ করতে আসে। বারান হয়ে যায় রহমত। কিন্তু এই গোপন তথ্য শুধুমাত্র সেই পরিবার
আর সেই দালাল, যে মেয়েটিকে কাজ করাতে এনেছে, জানে। অন্য কেউ জানে না। কিন্তু একদিন
অন্য এক শ্রমিক লতিফ দূর থেকে বারানকে স্নান করতে দেখে ফেলে এবং বুঝে যায় সে মেয়ে।
সে মনে মনে বারানকে ভালবেসে ফেলে, তাকে অন্যদের থেকে বাঁচিয়ে রাখে, তার কাজ হাতেহাতে
করে তার ভার হাল্কা করে দিতে চায়। কিন্তু একদিন কিছু সরকারী ইন্সপেক্টর এসে সাইট পরিদর্শনের
সময় বারানকে ধরে ফেলে। বুঝে যায় যে সে হচ্ছে বেআইনি আফগান শরণার্থী। বারান ছুটে পালিয়ে যায়। এরপর লতিফ খুঁজে খুঁজে বারানের
বাড়িতে যায় এবং দেখতে পায় সে মেয়ের পোষাকে অন্য এক জায়গায় পাথর ভাঙার কাজ করছে।
এই দুই সিনেমাই গ্রাম্য পটভূমিতে তৈরি।
এবং মজিদি এই ব্যাপারটাই তাঁর বিভিন্ন ছবিতে খুব ভালভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। তাঁর
প্যানোরামিক ক্যামেরা, ওয়াইড অ্যাঙ্গল, প্রকৃতির
দৃশ্যায়ন – মজিদির হাতে সহজেই ফুটে ওঠে। একেক গল্প হয়ে ওঠে রূপকথা। সিনেমা দেখতে বসে
দর্শকের ভাল লাগে, কোন বিতর্ক বা কঠিন চিন্তাভাবনা মজিদির সিনেমায় আসে না। ফলে উনি
হয়ে ওঠেন সব বয়সের দর্শকের পরিচালক।
এবার মজিদির উল্টোদিকের এক পরিচালকের
কথায় আসি। শূন্য দশকের যে ইরানি পরিচালককে প্রতি সিনেমায় তার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে
উঠে আসা মনস্তাত্ত্বিক গল্পকথার জন্য সবথেকে শক্তিশালী ধরা হয়, তার নাম আসগর ফারহাদি।
যে কটি সিনেমা উনি পরিচালনা করেছেন - অ্যাবাউট এলি (২০০৮), এ সেপারেশন (২০১১), দ্য
পাস্ট (২০১৩), দ্য সেলস্ম্যান (২০১৬), এভরিবডি নোজ (২০১৮) এবং এ হিরো (২০২১), এর প্রত্যেকটাই
অনবদ্য গল্পে সাজানো যা দেখে দর্শক ভাবতে বাধ্য হবেন। আমরা এখানে এই সিনেমাগুলো থেকে
এ সেপারেশন (২০১১) এবং দ্য সেলস্ম্যান (২০১৬) নিয়ে আলোচনা করব। এই দুটোই বিদেশি ভাষায়
অস্কার পুরস্কার পাওয়া সিনেমা।
‘এ সেপারেশন’এর আমি মাত্র একটা অংশ বলব।
বাকিটা আপনাদের দেখে নিতে হবে। এক দম্পতি কোর্টে
ডিভোর্স কেস ফাইল করেছে কারণ স্ত্রী বাইরে চলে যেতে চায়, কিন্তু স্বামী নিজের বাড়িতে
থেকে তার আলঝেইমার আক্রান্ত বাবাকে দেখতে চায়।
এদের ১১ বছরের একমাত্র মেয়ে চুপচাপ। কোর্টের জাজ এই কেসে কোনো মেরিট খুঁজে না পেয়ে
ডিভোর্স বাতিল করে দেন। স্ত্রী চলে যায় বাপের বাড়ি আর মেয়ে বাবার হাত ধরে বাবার বাড়ি
চলে আসে। অবশেষে অনেকদিন পর তাদের ডিভোর্স মঞ্জুর হয় এবং মেয়েকে জাজ জিজ্ঞেস করতে শুরু
করেন যে সে কার কাছে থাকতে চায়। কিন্তু এর মাঝের এক বড় অংশ জুড়ে আরেক মনস্তাত্তিক গল্প
আছে - আলঝেইমার আক্রান্ত বাবা ও তার জন্য রাখা আয়াকে ঘিরে। সেই গল্প জানতে হলে এই ছবি
নিজে দেখতে হবে।
দ্য সেলস্ম্যান’ ছবিতেও গল্পের মধ্যে
গল্প। সাহাব আর তারানা এক অভিনেতা দম্পতি যারা
স্টেজে রোজ আর্থার মিলারের The Death of a Salesman নাটকের অভিনয় করে। তাদের ফ্ল্যাটের
হাল খারাপ হয়ে যাওয়ায় তারা এক নতুন জায়গায় থাকতে শুরু করে। এক রাত্রে তারানা যখন নতুন
ফ্ল্যাটে একা, সে বাথরুমে চান করতে ঢোকে এবং কেউ বা কারা তার ওপর অত্যাচার করে। সাহাব
বাড়িতে ফিরে দেখে তার ফ্ল্যাটের দরজা খোলা, ভেতরে তারানা নেই, বাথরুম জুড়ে চাপচাপ রক্ত।
এক প্রতিবেশী তাকে জানায় তারানা-কে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে এবং তার ফ্ল্যাটের দরজার
তালা পালটানো দরকার। সাহাব হাসপাতালে যায় এবং তারানার সংগে কথা বলে বুঝতে পারে এটা
দুর্ঘটনা নয়, তার স্ত্রীকে অপরিচিত কেউ মেরেছে। তারা ফিরে আসে। সাহাব খোঁজখবর শুরু
করে জানতে পারে যে তাদের আগে ঐ ফ্ল্যাটে যে মহিলা থাকতেন, তিনি পেশায় ছিলেন এক যৌনকর্মী
এবং তার ক্লায়েন্টদের সঙ্গে বিভিন্ন রকম ঝামেলা লেগে থাকত। সাহাব সেই অজ্ঞাত পরিচয়
আক্রমণকারীদের খুঁজতে শুরু করে। এদিকে তারানা
এই ফ্ল্যাটে ফিরে আসার পর থেকে আতঙ্কে ভুগতে শুরু করে। সে একা থাকতে ভয় পায়, বাথরুমে
স্নান করতে যেতে ভয় পায়, স্টেজে অভিনয় করতে
করতে হঠাৎ থেমে কান্নায় ভেঙে পড়ে স্টেজ ছেড়ে পালিয়ে যায়। এমনকি সে পুলিশের কাছে রিপোর্ট
লেখাতে যেতেও ভয় পায়। এদিকে আক্রমণকারী তার গাড়ির চাবি আর কিছু টাকা ভুল করে ফেলে গেছিল,
যে সূত্র ধরে সাহাব তাকে খুঁজতে থাকে। নিজের
এক ছাত্রের পুলিশ অফিসার বাবার সাহায্য নেয়। এবং এক বয়স্ক ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে
যার সঙ্গে কথা বলে সাহাব বুঝতে পারে যে সেই তার স্ত্রীকে সেরাত্রে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু
সেই বয়স্ক ব্যক্তি মুখে সেটা অস্বীকার করে। এরপর আবার একপ্রস্থ নাটক এবং সেই বয়স্ক
ব্যক্তিকে পুলিশে তুলে দেবার বদলে সাহাব হাসপাতালে পাঠায় চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সেই
একপ্রস্থ নাটক ঠিক কী, সেটা বলব না – সেটা জানতে হলে আপনাকে নিজে এই ছবি দেখতে হবে।
ফারহাদি, যেটা একটু আগেই বললাম, মজিদির
উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে শহুরে ইরানের জটিল জীবন তুলে ধরতে পছন্দ করেন। এই দুটো সিনেমাই সেরকম
দুই থিম নিয়ে। তাঁর সিনেমায় মনস্তত্ত্ব আসে সামাজিক ক্লাস, নারী-পুরুষ বা ধর্মীয় টানাপোড়েন থেকে। এছাড়াও তাঁর প্রতি সিনেমাতে
থাকে গল্পের মধ্যে গল্প। পুরোটাই আধুনিক ইরানকে
ঘিরে। এবং এই সিনেমার বিষয়ে ইতি টানার আগে আরেকজনের কথা বলে নিই। সিনেমার নায়িকা তারানা
আলিদুস্তি। আমার চোখে ইন্টেলেকচুয়াল সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তারানা
সেরা অভিনেত্রীর সন্মান পেয়েছিলেন। এই ছবিতেও যথেষ্ট ভাল অভিনয় করেছেন।
আর একজন পরিচালকের কথা সংক্ষেপে বলে
আজকের আলোচনা শেষ করব। কারণ তাঁর কথা না লিখলে সমালোচক হিসেবে আমার অধর্ম হবে। কেরিয়ার
শুরু করেছিলেন আব্বাস কিয়ারোস্তামির সহকারি
হিসেবে। তারপর ১৯৯৫ সালে এক অনবদ্য সিনেমা বানান – দ্য হোয়াইট বেলুন। এরপর একে একে
দ্য মিরর (১৯৯৭), দ্য সার্কল (২০০০), অফসাইড (২০০৬) ইত্যাদি ছবি যেগুলো কান বা বার্লিন
বা ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভাল থেকে বিভিন্ন পুরস্কার এনেছে। কিন্তু প্রতি সিনেমায় এত স্ট্রং
মেসেজ থাকত যে ইরান সরকার ওনাকে ‘সরকার-বিরোধী’
তকমা
দিয়ে ২০১০-এ জেলে ঢুকিয়ে দেয়। শুধু ওনাকেই নয়, ওনার স্ত্রী, মেয়ে, ১৫ জন বন্ধু – সবাইকে।
ছ’বছর জেল হয়। মজার ব্যাপার, জেলে বসেও উনি একে একে পুরস্কার পেয়েছিলেন, যদিও নিতে যেতে পারেননি।
এরকম একজন পরিচালকের কথা না বলে কী করে শেষ করি বলুন তো? জাফর পানাহি। এখানে জাফর পানাহির
‘দ্য হোয়াইট বেলুন’ (১৯৯৫) নিয়ে কয়েকটি কথা বলব।
পরের দিন ইরানে নতুন বছর। তাই আগেরদিন
সন্ধেবেলা ছোট্ট মেয়ে রাজিয়া তার মায়ের সঙ্গে শপিং করছে। একটা নতুন গোল্ডফিশ কিনে দেবার
জন্য তার মাকে আব্দার করছে। কিন্তু তার মা সেটা কিনে না দিয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে চলে আসে
কারণ তাদের বাড়িতে ইতিমধ্যেই কয়েকটা গোল্ডফিশ আছে। রাজিয়া বাড়ি ফিরে তার দাদা আলিকে বলে মা-কে বলার জন্য। দাদাকে
রাজি করানোর জন্য নিজের একটা বেলুন সে দাদাকে দিয়ে দেয়। রাজিয়ার মা অবশেষে তার হাতে
৫০০ টোমান তুলে দিয়ে বলে গোল্ডফিশ কেনার পর খুচরো টাকা তার ফেরৎ চাই। রাজিয়া আর তার
দাদা দৌড় লাগায় মাছের দোকানে, কিন্তু রাস্তায় এক ড্রেনের নিচে রাজিয়া নোটটা হারিয়ে
ফেলে। গভীর ড্রেন, তাই নোটটা তুলতেও পারে না। এক বেলুন বিক্রেতার সাহায্যে শেষে সেই
নোট উদ্ধার হয়। শেষ সিনে দেখা যায় রাজিয়া আর তার দাদা গোল্ডফিশ কিনে ফিরছে, আর সেই
বেলুন বিক্রেতা একটাই সাদা বেলুন নিয়ে এক জায়গায় বসে আছে। আবহে ভেসে ওঠে ইরানের নতুন
বছর।
এই সিনেমার বিশেষত্ব হল এটা একদম সাদামাটা
বাচ্চাদের ছবি, অনেকটা রূপকথার ঢংয়ে বলা। এখানে কোন বিদ্বেষ নেই, বিরোধীতা নেই, ঘৃণা
নেই – শুধু ভাললাগা আছে। এটাই তো সত্যিকারের পরিচালকের লক্ষণ। নিজের মনের কথাগুলো সেলুলয়েডে ফুটিয়ে তোলা। সেটা ভাল-খারাপ দুইই
হতে পারে। তবুও পারাজানভ বা পানাহিদের ‘বিরোধী’ তকমা দিয়ে নিজেদের দেশে জেলে পুরে দেওয়া হয়। সমালোচক হিসেবে এর প্রতিবাদ তো জানাতেই
হয়।
সবশেষে একটা অ্যানিমেশন ছবি দেখতে বলব
– পার্সেপোলিস (২০০৭) দেখুন। দেখে মন্তব্য করবেন।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন