কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২

প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

আমার ইংরেজী বই পড়া




 

()

স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে ইংরেজী পাঠ্যবইটির নাম এখনো মনে আছেঃ With Peter and Susanতৃতীয় শ্রেণী থেকেই মনে হয় চালু হয়ে গিয়েছিল তৎকালীন ওরিয়েন্ট লংম্যান সংস্থার The New Method Readersতার সঙ্গে থাকতো দ্রুতপঠনের জন্য কিছু গল্পের বই। চতুর্থ শ্রেণীর এমন একটি বই খুব ভালো লেগেছিলোঃ The Hair Tree নামে একটি মিলনান্তক রূপকথা, যার সঙ্গে ছিল The Story of the Opal নামের আরেকটি বিয়োগান্তক গল্প – সব ভুলে গেছি, শুধু মনে রয়ে গেছে দ্বিতীয় গল্পে nightingale পাখীর উপস্থিতি, আর প্রথম গল্পের এই ছড়াটিঃ

I know, I know:

Inside the wind does blow,

Inside the waters go:

This makes the Hair Tree grow–

I know, I know.

আপনারা যাঁরা আমার বাংলা বই পড়া নিয়ে স্মৃতিচারণ পড়েছেন, তাঁদের মনে থাকতে পারে যে এই সময় পাঠ্যপুস্তকের বাইরে আমি পড়েছি শুধুই বাংলা গল্প। এ  নিয়ে আমার বাবা-মা খানিকটা চিন্তিতই ছিলেন। স্কুলের ইংরেজী বইগুলি মোটামুটি পড়তাম, পরীক্ষায় নম্বর উঠতো ভালো-খারাপ মিশিয়ে। অবশ্য পঞ্চম শ্রেণী থেকে যে বাংলাতেও খুব একটা ভালো করতাম, তা নয়! এই সময় ষষ্ঠ শ্রেণীতে ঘটে গেল আমার পাঠ্যজীবনে একটা বড় পরিবর্তন। শ্রেণীশিক্ষক প্রশান্তকুমার সিংহ মহাশয় পড়াতেন ইংরেজী, ইতিহাস এবং গণিত। ইংরেজীতে নির্দিষ্ট পাঠ্যবই ছাড়াও, অবসর পেলেই তিনি পড়ে শোনাতে শুরু করলেন সেই ওরিয়েন্ট লংম্যান থেকেই প্রকাশিত The Hand of the Law নামের একটি বই। নাম শুনে বিষয়বস্তু কিছুটা আন্দাজ করতে পারছেন কি? ইংল্যান্ডের একটি শহরের পুলিশ এবং সেখানে ঘটে যাওয়া এক-এক অপরাধমূলক রহস্যের সমাধান কাহিনী। মনে করিয়ে দিই যে এই সময় আমি হেমেন্দ্রকুমার রায়ের একনিষ্ঠ পাঠক! হঠাৎ ইংরেজীতে রহস্য গল্প! অবশ্য এর অনেক আগে থেকেই (চতুর্থ শ্রেণী) রাতে ঘুমোতে যাবার আগে বাবা শার্লক হোমসের একটি করে ছোট গল্প বাংলায় অনুবাদ করে শোনাতেন, কিন্তু সেও তো বাংলাতেই! দক্ষিণ কলকাতার শরৎ বোস রোডের ‘গ্রন্থ চয়ন’ থেকে আমাদের স্কুলের যাবতীয় বই-খাতা কেনা হতো। তার প্রায় পাশেই ছিল (এখনও আছে কি?) মৃত্যুঞ্জয় ঘোষের মিষ্টির দোকান। মনে আছে, বাড়ির গাড়ি করে সেখানে যাওয়া  হয়েছে সপরিবারে। বাবা-মা মিষ্টি কিনতে ব্যস্ত, গাড়িতে বসে দীর্ঘ রোগভোগের পর সাম্প্রতিক আরোগ্যপ্রাপ্ত দাদা। আমি হঠাৎ টুক করে নেমে গিয়ে গ্রন্থ চয়নে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম, “Hand of the Law পাওয়া যাবে?” একটু বিরক্তি-সহকারে একজন কর্মচারী বললেন, “ওটা আবার কোন ক্লাসে লাগছে এখন?” তারপর বেশ কিছু বই ঘেঁটে উক্ত পুস্তকটির একখানা কপি বেরোল। আরও মুখ তেতো করে কর্মচারীটি প্রশ্ন করলেন, “তোমার কি এটা খুবই দরকার?” প্রায় হাঁউমাঁউ করে উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুউউব দরকার! মৃত্যুঞ্জয়ের দোকানেই বাবা-মা আছেন, দাম বলুন, এক্ষুণি এনে দিচ্ছি!” উত্তর এলো, “দু’ টাকা বাষট্টি পয়সা।” ছুটে গেলাম মৃত্যুঞ্জয়ে; “ও বাবা, বাবা, ২ টাকা ৬২ পয়সা দেবে, একটা ভালো ইংরেজী বই কিনব!” ইংরেজী বই কেনার কথা শুনে বোধহয় খানিকটা বিস্মিত এবং আশান্বিত হয়েই বাবা একটি ২ টাকার নোট এবং খুচরো ৬৫ পয়সা হাতে দিলেন। আবার ছুটে গিয়ে গ্রন্থ চয়নে দাম দিয়ে পেলাম The Hand of the Law এবং ৩ নয়া পয়সা ফেরৎ (আপনাদের কারোর স্মরণে আছে এইসব ১, ২, ৩, ৫, ১০  পয়সা?)। বাড়ি ফিরে গোগ্রাসে গিললাম ইন্সপেক্টার কাউলি, কনস্টেবল টাফট  প্রমুখের রহস্য ভেদের ছোট-ছোট গল্প।

শ্রেণীশিক্ষক সিংহমশায় আরো একটি ভালো কাজ করার প্রয়াস করেছিলেন। দ্রুতপঠনে পাঠ্য ছিল Monte Cristoবুঝতেই পারছেন, এ হলো দুমার ‘কাউন্ট অব মন্টি ক্রিস্টো’র সংক্ষেপিত রূপ। সেই সময় (সালটা ১৯৬৮), ভবানীপুরের অধুনালুপ্ত ‘পূর্ণ’ প্রেক্ষাগৃহে প্রতি রবিবার সকালে ১০-৩০-এ ইংরেজী ছবি দেখানো  হতো। এক রবিবার, জানা গেলো দেখান হবে ১৯৬১ সালে ফরাসী ভাষায় তৈরী এবং ১৯৬২-তে ইংরেজীতে রূপান্তরিত The Story of the Count of Monte Cristoসিংহমশায় হলের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে আমাদের পুরো ‘ক্লাস’টিকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করলেন। সে এক দারুণ উত্তেজনা। সিনেমা তো কতই দেখি, বিশেষ করে ইংরেজী সিনেমা। কিন্তু সে তো বাবা-মা-দাদার সঙ্গে। স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে ছবি দেখা এক অভিনব ব্যাপার! দুর্ভাগ্যক্রমে ছবিটির print ছিল শতছিন্ন! যাবার উৎসাহ অনেকটাই ধাক্কা খেয়েছিল!

১৯৬৮ আমার ইংরেজী বই পড়ার ইতিহাসে এক অত গুরুত্বপূর্ণ বছর। সে বছরেই ‘মেট্রো’ সিনেমায় মুক্তি পায় ইংরেজী-বাংলা-হিন্দী মিলিয়ে যত ছবি দেখেছি, তার মধ্যে, আমার সবচেয়ে প্রিয় ছবি, ওয়াল্ট ডিজনির Mary Poppinsআমার সিনেমা দেখার স্মৃতিচারণে বলেছি যে মেট্রোতে ৬ হপ্তা চলাকালীন ছবিটি দেখতে যাই তিনবার! এর পরে বেরোই ছবি যে বইগুলি থেকে অনুপ্রাণিত, সেগুলির খোঁজে। সবার আগে পাওয়া গেল অধুনালুপ্ত ‘লাইটহাউস’ সিনেমার উল্টোদিকে ছোট কিন্তু বিখ্যাত বইয়ের দোকান ‘মডার্ন বুক ডিপো’য় Mary Poppins Comes Back, যেটি সিরিজের দ্বিতীয় বই। পড়ে দারুণ লাগল। ছবিটির শেষে মেরি পপিন্সের চলে যাওয়ায় আমার আজও চোখে জল আসে। বইতে দেখলাম সে আবার ফিরে এসেছে সেই Banks পরিবারে। এরপর দাদা জোগাড় করে এনে দিলেন প্রথম বই Mary Poppins, যার মলাটে আর পেছনে ছিল ছবিতে মেরি পপিন্সরূপিনী, এবং ততদিনে সকলের কাছে The Sound of Music-এর Maria-রূপে বিখ্যাত, Julie Andrews-এর ছবি। পড়ে দেখলাম যে প্রিয় ছবিটির কাহিনীর উপাদান মূলত এই প্রথম বইটি থেকেই নেওয়া ফুটপাথে আঁকা ছবির মধ্যে ঢুকে যাওয়া, মেরি পপিন্সের আত্মীয়ের বাড়িতে সিলিঙে বসে চা খাওয়া, ইত্যাদি। কিন্তু সিরিজে তো আরো দু’টি বই আছে!  এখানেই বিধি বাম! প্রথম বই দু’টি ‘পেপারব্যাক’ সংস্করণে কেনা, দাম ২ থেকে চার টাকার মধ্যে। আর পরের বইদু’টি ‘হার্ডব্যাক’, এক-একটির দাম ১২ টাকা ১৫ পয়সা! মনে রাখবেন, সালটা ১৯৬৮, তখন, যতদূর মনে আছে ভারতীয় ৯ টাকায় এক পাউন্ড (এখন বোধহয় ১০০ টাকায় পাউন্ড!)। উদাস নয়নে পার্ক স্ট্রীটের অধুনালুপ্ত ‘কেম্ব্রিজ বুক এ্যান্ড স্টেশনারি’র তাকে বইগুলির দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া গতি নেই!

বছর প্রায় শেষ, তখনকার স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী প্রতি শ্রেণীর প্রান্তিক পরীক্ষা হতো বছরের শেষে নভেম্বর-ডিসেম্বরে। ষষ্ঠ শ্রেণীর বাৎসরিক ফলাফল বেরোল। মোটামুটি  ফল পেয়ে সপ্তম শ্রেণীতে ওঠার ছাড়পত্র পেলাম। পঞ্চম শ্রেণীর প্রান্তিক পরীক্ষার পর, ফল বেরোবার আগেই বাবা কলেজ স্ট্রীট চত্বর থেকে কিনে দিয়েছিলেন  একতাড়া হেমেন্দ্রকুমার (যার মধ্যে ছিল তাঁর ‘ড্রাকুলা’র রূপান্তর ‘বিশালগড়ের দুঃশাসন’), এবং এও বলেছিলেন, “ফেল করলে কিন্তু এই সব ফেরত দেব!” তা, সেবারেও ফেল আর করিনি, আর ষষ্ঠশ্রেণীর ফল হলো তুলনায় একটু ভাল (স্কুলে অষ্টম শ্রেণী অবধি আমার পরীক্ষার ফলাফল মধ্যমেধার দিকেই ইঙ্গিত করত)। তার ওপর ছেলে নিজের আগ্রহে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ইংরেজী গল্পের বই পড়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে! অতএব পুরস্কার হিসেবে পেলাম ‘মেরি পপিন্স’ সিরিজের ৩য় ও ৪র্থ বই দু’টি – মোট ২৪ টাকা ৩০ পয়সা দামে!

এই বইগুলি নিয়ে কিছু কথা আছে। পরে জেনেছি যে অনেক বিদেশী লেখার মধ্যেই জাতি এবং বর্ণবিদ্বেষের প্রকাশ ঘটেছে। যেমন Mary Poppins Opens the Door বইয়ের আরম্ভেই চিমনি পরিস্কার করতে যে Chimney Sweep Banks-পরিবারের চেরি ট্রি লেনের বাড়িতে ঢুকেছে, বাড়ির দুই কাজের মহিলার মধ্যে একজন ক্ষেপে  গিয়ে বলছেন যে ওই ‘হটেনটট’ যদি বসবার ঘরে ঢোকে, তিনি তৎক্ষণাৎ কাজে জবাব দেবেন! কারণ স্পষ্ট, চিমনির ময়লা পরিস্কার করতে-করতে উক্ত স্বেতাঙ্গটির  শ্বেতবর্ণ কালিতে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। এরপর, রসিক sweep যখন জোর করেই ওই মহিলার সঙ্গে করমর্দন করেন, মহিলা চরম বিরূপতা প্রকাশ করে চেঁচিয়ে উঠছেন, “Let me go, you Hindoo!” অর্থাৎ, মহিলার ভূগোল জ্ঞান কালো রঙের সঙ্গে আফ্রিকা-এশিয়াকে এক করে ফেলেছে! আমার ব্যাপারটা খুব মজারই লেগেছিল। এখন শুনছি এই কথাগুলো নাকি বাদ দিয়ে বইগুলি ছাপা হয়। জানি না, এর কোন প্রয়োজন আছে কিনা! মহিলা চরিত্রটির জাতি ও বর্ণবিদ্বেষ যে লেখিকা (তিনি যে লেখিকা, লেখক নন, এটা জানতে অনেক বছর লেগেছে। এমনকি, সেই ৬৮ সালে Collins-এর প্রকাশিত hardback বইতেও কাহিনীকার P. L. Travers সম্বন্ধে ‘he’ সর্বনামটিই ব্যবহার করা হয়েছিল) সমর্থন করছেন না, বরং ব্যঙ্গ করছেন এটা অন্তত আমার কাছে তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

আবার প্রথম বইতে একটি ঘটনা শুরু হচ্ছে চেরি ট্রি লেনে একটি গাভীর ঘুরে বেড়ানো দিয়ে। গল্পের শিশুরা অবাক হয়ে মেরি পপিন্সকে প্রশ্ন করছে যে গরু কীভাবে রাস্তায় ঘোরে! এখন ভাবুন, ১৯৬৮ সালে, কলকাতার রাস্তায় গরু ঘুরে  বেড়ানো খুবই সাধারণ দৃশ্য ছিল, এখনও যে তাদের রাস্তায় দেখা যায় না, তা নয়! আমি অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে রাস্তায় গরু দেখে শিশুরা অবাক হবে কেন!

এবার ১৯৬৯ সালে আমার হাতে এলো Five have a Wonderful Time – আমার দেখা Enid Blyton-এর প্রথম বই! আস্তে-আস্তে নেশা ধরল Famous Five-এর, এবং কিছু পরে আরও ভালো লেগে গেল Five Find-Outers and Dog-দের, তাদের গ্রামে একেকটি করে রহস্যভেদ। এটা অভিনব লেগেছিল, অপরাধের কিনারা  করছে জয়ন্ত বা হেমন্তর মতো প্রাপ্তবয়স্করা নয় – একদল স্কুলে পড়া ছেলেমেয়ে। তার মধ্যে সবচেয়ে তীক্ষ্নবুদ্ধি যে, তার নাম Frederick Algernon Trotteville (F A T), এবং তার নামের আদ্যাক্ষর মিলে যা হয়, সে তাইই – মোটা! পরে স্ত্রীর কাছে শুনেছি যে বাংলায় এই দ্বিতীয় পঞ্চম-ও-সারমেয় দলটির রূপান্তর করেছেন ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’দের মাধ্যমে।

 

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন