কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২২

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

দিগন্তসেনা




 

(৩)

দিগন্তসেনায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্যামাঙ্গী যেদিন অবনীমোহন রায়চৌধুরীদের মোচার খোলার মত নৌকা পর্যবেক্ষণ করছিল সহকারী পেদ্রো সাল্ভাদরেসকে সঙ্গে নিয়ে নিজের রাজ্যপাটের চূড়ান্ত পর্যায়ের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য, সেদিনই তার হঠাত মনে পড়ে যায় তার কৈশরের দিনগুলোর কথা, মনে পড়ে উপমা,  লগ্নলতা, অনঙ্গ, মানময়ী ও তার সংসারের হাজার তা নিয়ম আর গতিমুখের কথা। কৈশরের সেই দিনগুলোতে উপমা যত বেড়ে উঠতে থাকে, মানময়ী লক্ষ করে দেখেছিল, ও ব্যাঙের ছাতা খেতে খুব ভালোবাসে। একবার যদি ও ব্যাঙের ছাতা পায়, তাহলে ওর আর কিছু চাই না। পড়াশুনো শেখে শ্যামাঙ্গী আর সুদামের কাছে। লগ্নলতাকে নিয়ে  সুলক্ষী মাঝে মাঝেই চলে আসে। ও লঙ্কা দেখলেই আঁতকে ওঠে। হাতে ধরা তো দূরের কথা। ও ওগুলোর চার হাতের মধ্যেও যেতে রাজী হয় না। আর মিষ্টি আর পিঠে হল ওর সবচেয়ে প্রিয় খাবার।

মানময়ীর দাদারা আসা যাওয়া করে। ওদের সঙ্গে এইবার পাপ্পা, পুপু আর পপি এসে গোটা বাড়ির মুখরতা দশগুণ বাড়িয়ে দেয়। ওদের মধ্যে শামাঙ্গীই সব থেকে  বড়। পুপু আর পপি শামাঙ্গীর ঘরেই ওর খাটে শোয়। সোমবার রাতে হঠাৎ বাথরুমে যাবার জন্য উঠে অনঙ্গ নজর করে দেখে পুপু মুখে বিড়বিড় করে কি সব বলছে আর গোটা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রথমে অনঙ্গ ওকে দোতলার বারান্দায় আবিস্কার করে।  তারপর বাথরুম থেকে বেরিয়ে নজর করে, ও নিচে চলে গেছে। অনঙ্গ একটু ভয় পেয়ে যায়, যদি ও দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায়! অনঙ্গ  কথাটা ভাবা মাত্র পুপু দরজা খুলে বাগানে চলে গিয়ে ঘাস ছিঁড়তে শুরু করে।  অনঙ্গ মানময়ীকে ডাকে, মানময়ী বড়দাকে দাকে। বড়দা এসে দেখে তো অবাক। বড়বৌদি এসে দেখে ভয় পেয়ে বলে ওঠে, ‘ওমা! ঠাকুরজী, আমার মেয়েটাকে নিশ্চয় নিশিতে পেয়েছে! হা ভগবান আমার মেয়েটা গেল’। বলে হাত পা ছেড়ে কাঁদতে বসে পড়ে। হৈ হট্টগোলে বাড়ি শুধ্বু সকলে জেগে ওঠে। গুরুজী এসে তাড়াতাড়ি বলেন, ‘দাঁড়া বেটি। ম্যায় দেখতা হু’। বলে তিনি নিচে নেমে বসার ঘরের সোফায় বসে তানপুরা বাজিয়ে গান ধরেন। গানের সুরে তিনি পুপুকে ডেকে আনেন আর তাঁর সঙ্গে পুপুও গলা খুলে গান গাইতে শুরু করে। ভোর হতে তখনও ঢের বাকি। তবু এক ঐশী আলোয় পাখিদের কাকলিতে চরাচর মুখরিত হয়ে ওঠে। সকলেই ছাদে উঠে যায়। গিয়ে দেখে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। দলবদ্ধ ভাবে পাখিরা মিছিল করে যাচ্ছে নৈঋত থেকে ঈশানে। সকলের প্রথমে রয়েছে মাছরাঙারা, তারপর দুরন্ত চড়াইয়ের দল, তারপর একে একে বাবুই, কাঠঠোকরা, কোকিল, বক, ঘুঘু, কাক, অন্যান্যরা। সকলের শেষে যাদের দেখা গেল তারা হল ময়ুর!

পরদিন সকালে একটা জবরদস্ত উৎসব শুরু হয়ে যায় চাটার্জী ভবনে। আর তারই মাঝখানে গুরুজী, গুরুমা দুজনে খুব করে দাদা বৌদিকে বোঝালেন, পুপু প্রতিভাবান। তাই আর দেরি না করে এখন থেকেই ওর সঙ্গীত সাধনার ব্যাবস্থা করতে হবে। পুপুর সঙ্গীত শিক্ষা নিয়ে ওরা কে কী ভাবল তা বোঝা গেল না। মাঝখান থেকে পপি তাড়াতাড়ি এসে গুরুমাকে হাতে পায়ে ধরে ওর সঙ্গীত শিক্ষার জন্য দরবার করতে শুরু করে দিল। ওর সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও। অথচ ওরা তো শিখছেই! বাড়িতে যেন বড় সড় সঙ্গীত প্রতিযোগিতার মহড়া শুরু হয়ে গেল। পাড়ার লোকজনেরাও ভাবল, তাহলে তো আমাদের ছেলেমেয়েদেরও অল্প সল্প সঙ্গীত শিক্ষার ব্যবস্থা হলে মন্দ হয় না। বিশেষ করে বাচ্চা মেয়েদের। আজ নয়  কাল বিয়ে ত দিতেই হবে। যদি গাইতে পারে তাহলে হয়ত ভাল পাত্রও পাওয়া যাবে। সকলেই কমবেশি একে একে গুরুজীকে অনুরোধ করল তার মেয়েটাকে অন্তত একটু গান শেখাতে। কথাটা এমন ভাবে রটে গেল যে, একে একে নিহিতপাতালপুরী ব্লক ১, তারপর ব্লক ২ থেকেও সব মেয়েদের অভিভাবকরা আসতে লাগল। শেষ পর্যন্ত ব্লক ৩ থেকেও সবাই এসে লাইন দিয়ে দাঁড়াল গুরুজীর সঙ্গে দেখা করার জন্য। মানময়ী তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য বাড়িতে ঢোকার মুখেই অনঙ্গ আর ভজাকে দারোয়ানের মত দাঁড় করিয়ে  দিল। আর বাড়ির গেটের মুখে নিজে একটা চেয়ার টেবিলে খাতা পেন নিয়ে বসে গেল। যদিও এ ব্যাপারটাকে ও তেমন রোজগারের উপায় হিসাবে ভাবছে না , তবু ভীড়টার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য ও একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকা সবাইকে দিতে হবে, জানিয়ে দিল। কেউই তাতে দমল না। এমনকি ওর কাছ অব্দি পৌঁছানোর আগেই অনঙ্গ কিম্বা আর কাউকে দিয়ে টাকার সঙ্গে চিরকুটে নাম ঠিকানা  লিখে হাতেহাতে ওর কাছে পাঠিয়ে দিতে লাগল। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়াল যে ওদের একান্ত ব্যক্তিগত পারিবারিক অনুষ্ঠান একেবারে শিকেয় উঠল। অনেক রাতে যে সব ভাল মন্দ রান্না হয়েছিল সকলে একে একে সেসব কোনরকমে নাকে মুখে গুঁজে যে যার ঘরে ঘুমোতে গেল।

মানময়ী হিসেব করে দেখল, শুধু একদিনে গুরুজীর সঙ্গে দেখা করার জন্য সকলের দেওয়া টাকার পরিমাণ যা দাঁড়িয়েছে তা দিয়ে একটা বড় সড়  বাড়ি কেনার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তারপর যখন গান শেখানো শুরু হল, তার জন্য গুরুদক্ষিণা হিসেবে সকলে যে যা পারে দিতে থাকল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়াল যে কে কাকে টপকে আরও বেশি টাকা দিতে পারে তার একটা ক্ষমতা প্রদর্শনী শুরু হয়ে গেল। এরপর পাড়ায় একটা তিনদিন ব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হল। শিক্ষার্থীরা সকলেই একে একে মঞ্চে উঠে গান গেয়ে নেমে গেল। তাদের মধ্যে থেকে ওরা তিনজনকে প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় হেসেবে বেছে নিয়ে পুরস্কার দেবে ঠিক করল।

উৎসবে পার্বনে কনকাঞ্জলী বারুদ আর ভাতিকে নিয়ে চলে আসে। ওদিকে সুলক্ষী লগ্নলতা তো আছেই। বাপের বাড়ি শ্বশুরবাড়ির লোকজন নিয়ে সারা বাড়ি একেবারে গমগম করে। ভাটি আর শ্যামাঙ্গীর খুব ভাব। ইতিমধ্যে বেশ অনেকটাই বড় হয়েছে সম্রাট। তার বন্ধুসঙ্গ এতটাই খারাপ যে তা নিয়ে মানময়ী অনঙ্গ সবসময়েই মানসিক অশান্তিতে থাকে। সুদাম পড়াশুনো করতে বাইরে চলে যায়।

অনঙ্গ এবার শ্যামাঙ্গীর বিয়ে নিয়ে একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু শ্যামাঙ্গী তা চায় না। বরং সে বড় হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে এই পরিবার ও গোটা জনপদের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিতে চায়। আর তার সেই কথাটা শোনা  মাত্রই অনঙ্গ ওকে বলে, ‘মেয়ে সন্তানের ভালোবাসা হল মুসলমানের মুরগী পোষার মত’। কথাটা শোনা মাত্রই শ্যামাঙ্গী সাঙ্ঘাতিক ভাবে আহত ও অপমানিত হয় ভেতরে ভেতরে। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। সম্রাটের জন্য আর সবার সঙ্গে ওরও পড়াশুনো, গানবাজনা লাটে উঠেছে। অনঙ্গর কাছে নালিশ করলেই অনঙ্গ বলে, করেছে তো বেশ করেছে। আরও করবে। আমার ছেলে তোমার মাথার ওপর পা দিয়ে চলবে। তাতে তোমার পোষালে তুমি এ বাড়িতে থাক। না হলে নিজের পথ নিজে মাপো। বুঝলে? হাজার হোক তুমি মেয়ে আর ও ছেলে’। শ্যামাঙ্গী আস্তে  আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ঘুমের সময় ঘুমোয় না। খাওয়ার সময় খায় না। সারা রাত জেগে পড়াশুনো করে যায় শুধু। কারুর কোনও কথাই কানে তোলে না। এদিকে লগ্নলতা বড় হচ্ছে। উপমাও তর তর করে বাড়ছে। ওদের নিয়ে খুব ভয় হয় সকলের। ক্রমশ শ্যামাঙ্গী রূঢ় হয়ে ওঠে। ওর চিরকালের শান্ত মিষ্টি স্বভাবটা কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। আর শ্যামাঙ্গী  যত রূঢ় হয়ে ওঠে, অনঙ্গ তত ওর ওপর খাপ্পা হয়ে উঠে প্রায়শই ওকে বেধড়ক মারে। অনঙ্গর  একটাই কথা, ‘কথায় বলে, মেয়ে মানুষের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। আর  তুমি? হতচ্ছাড়া মেয়ে! ঘাড় থেকে নামে না!’

তীর্থসরোবর অঞ্চলে মহাসঙ্গীত  সম্মেলনের আয়োজন  করলেন ওস্তাদ রসিদুল্লা খাঁ সাহেব। গুরুজীর হঠাৎ এই আয়োজনের কারণ প্রথমে মানময়ী বুঝতে পারেনি। তখন গুরুমাই সবটা খুলে বুঝিয়ে বললেন। মানময়ীর এই প্রখর  সাংসারিক অশান্তির দিনে, সম্রাটের ঔদ্ধত্ব, অনঙ্গর অসামঞ্জস্যপুর্ণ ব্যবহারে গুরুজী সকলের মন খানিক মেরামত করতে চাইছেন। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি আগামী দুমাস পরে শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে এই আয়োজন করেছেন। মানময়ীর মুখে যেন সহস্র কোটি ওয়াটের  ঝাড়বাতি জ্বলে উঠল। ঠিক হল ওই অনুষ্ঠান চলাকালীনই ওদের গোটা জনপদের সমস্ত ছেলেমেয়েদের জন্য এক গণসয়ম্বর সভার আয়োজনও করা হবে। মহাসঙ্গীত সম্মেলন উপলক্ষে এক বিরাট অঞ্চল জুড়ে যেন সাজ সাজ রব পড়ে গেল। মানময়ীর বাড়ির পরিস্থিতিও অনেকাংশে বদলে গেল। আয়োজক কমিটি গড়া হল একটা আর বলা বাহুল্য অনঙ্গ তার মধ্যে একটা গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকায় অবতীর্ণ হল। সম্রাট এতদিন গুরুজী, গুরুমার  মুখোমুখি হত না। কিন্তু নতুন উৎসব সমাগম তাকেও আমূল নাড়িয়ে দিল। সে  গুরুজীর কাছে কিছু খোঁজ খবরের জন্য মাঝেমধ্যে দেখা করতেই যে গেল তাইই নয়, গুরুজীকে সে বলল যে কোন রকম সহযোগিতার জন্য সে ও তার বন্ধুরা  সবসময়েই প্রস্তুত।

উপমাকে মানময়ী বাড়ির পরিস্থিতি বিচার করে দূরে পার্বত্য প্রদেশে কোন শিক্ষানবিশী আশ্রমে পাঠাবেন বলে সে সব ব্যাপারে খোঁজ খবর করতে শুরু করে দিয়েছিল। এখন সে উপমাকে বলল মন দিয়ে নিয়মিত অনেকক্ষণ ধরে রেওয়াজ  করতে। উপমা সেই মত ভোরবেলা থেকে রেওয়াজ করতে শুরু করে দিল। দিনে চোদ্দ ঘন্টা ধরে রেওয়াজ করা শুরু করল। উচাঙ্গ সঙ্গীতের পাশাপাশি  বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের অভ্যেস সে আগেই করত। এবার সেটা আরও বেশি করে আর ভাল করে শুরু করল। মানময়ী উপযুক্ত খাবার খাওয়ানোর জন্য দিন রাত ওর পেছনে পড়ে রইল। লগ্নলতা এসে একদিন লক্ষ্য করল, উপমা রাতে দুধের মধ্যে আফিম দিয়ে খায়। কারণ জানতে চাইলে সে ওকে বলল এতে যে শুধু গলাটা সত্যি খোলতাই হবে তাইই নয়, রেওয়াজ করার জন্য গলার আর শরীরের প্রচুর শক্তি দরকার হয়, তা অনেক বেশি বেশি পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে সে লগ্নলতাকে একথাও বলল ব্যাপারটা যেন সে আর কাউকে না জানায়। কিন্তু তবু কথাটা লগ্নলতা শ্যামাঙ্গীকে বলার জন্য রীতিমত উসখুস করতে শুরু করল। পরিস্থিতি এমন চরমে উঠল যে এর ফলে রোজ পেট ফেঁপে উঠতে লাগল। তারপরের অবস্থা এমন দাঁড়াল যে সবসময়ই তার পেট ফুলে থাকে এবং কিছু খেতে গেলেই বমি করে ফেলে। তারপর শুরু করে সে লুকিয়ে লুকিয়ে কাগজ খাওয়া। তার কাগজ খাওয়ার জন্য প্রচুর পরিমান কাগজের দরকার হয়ে পড়ল খুব শিগগিরিই। একদিন ও মানময়ীর কাছে ধরাও পড়ে গেল। মানময়ী ডাক্তার ডাকতেই ডাক্তার এসে আসল ঘটনাটা জানতে পারলেন। কিন্তু কাউকে কিছু বললেন না। ডাক্তারের পরামর্শ মত ওসব কথা শ্যামাঙ্গীকে বলল আর তার পরামর্শ মত কাজ করতেই লগ্নলতা দিব্যি সুস্থ হয়ে ঘোরাফেরা করতে লাগল। শ্যামাঙ্গী শুনে সবাইকে বলল, ‘ওটা ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমাদের নাক গলাবার দরকার নেই’।

এরই মধ্যে একদিন গৃহদেবতার আরাধনার ব্যবস্থা  করল মানময়ী বছর দুয়েকের  মধ্যকালীন বিরতির পর বড় করে। গতবার যখন হয়েছিল, বাড়ির সমস্ত ছেলেরা, মেয়েরা, ছোটরা বড়রা – সকলেই তাতে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু এবার যে দিন সেটার জন্য স্থির হল, তার দুদিন আগে থেকেই শ্যামাঙ্গীর মাসিক ঋতুকালীন অশৌচ পর্বটা শুরু হয়ে গেল। মানময়ী শ্যামাঙ্গীকে জানাল, ও যেন সেদিন আরাধনায় অংশগ্রহণ না করে। কথাটা শুনে শ্যামাঙ্গী তার কারণটা  জানতে চাইল। পরম্পরা অর্জিত জ্ঞানের অংশ থেকে মানময়ী বলল যে সে সময় মেয়েরা অশুচি থাকে। তাই সেই সময় মেয়েরা কোন আরাধনায় অংশগ্রহণ  করতে পারে না। শুনে শ্যামাঙ্গী আশ্চর্য হয়ে গেল। ও মানময়ীকে জিজ্ঞেস করল যে ও যদি ওখানে অংশগ্রহণ না করে আর অন্য সবাই ওখানে থাকে আর ওকে জিজ্ঞেস করে যে ও কেন ওখানে গেল না , তাহলে ও কী উত্তর দেবে। মানময়ী ওর কথা শুনে মুচকি হাসল। তারপর বলল যে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করবে না। সবাই জানে। আর কেউ একান্তই জানতে চাইলে শরীর খারাপ আছে বললেই হবে। শ্যামাঙ্গী মাকে খুব ভালবাসে। কিন্তু সেই মুহূর্তে মাকে খুব খারাপ আর নিষ্ঠুর মনে হল ওর। দলা দলা অপমান আর লজ্জা হজম করতে হবে ভেবে ও তখনই মরে যেতে চাইল। কিন্তু আরাধনার দিনটা আসতেই দেখা গেল, শ্যামাঙ্গী যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব করে সবার সঙ্গে হেসে কথা বলতে লাগল।  আরাধনা শুরু হওয়ার আগে অন্যরা কেউ কেউ যখন ওকে ডাকতে এল তারা এসে দেখতে পেল শ্যামাঙ্গী সারা ঘরময় বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গালে পেনটা ঠেকিয়ে এমন মশগুল হয়ে বসে আছে যেন কোন দুর্বিসহ জটিল একটা অঙ্ক মেলাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ওকে ডাকতেই ও ওদের বলল, ‘তোরা যা। আমি যাব না। ওসব ফালতু কাজে সময় নষ্ট করার মত সময় আমার হাতে নেই’। সকলে হাঁ করে ওর দিকে তাকাল। একজন বলল, এরকম বলতে নেই। সর্বশক্তিমান কুপিত হবেন। ও তখন  পাল্টা সবার দিকে উত্তরটা ছুঁড়ে দিল যে ও-ও  দেবতার ওপর কুপিত হয়েই এখন  ওখানে যেতে চাইছে না এবং যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিনের মধ্যে আর কোনদিনই আর ও মুখো হবে না। আরাধনা শেষ করে এসে ভাঁটি তাড়াতাড়ি ওকে বলল, ‘শরীর খারাপ তো? বুঝেছি’। সঙ্গে সঙ্গে ওপাল্টা উত্তর দিল, ‘কিছুই বোঝ নি। আর আমার যে আদৌ কোন শরীর  খারাপ হয়নি সেটা এর পরের বছরগুলো থেকেই বুঝতে পারবে’। ভাঁটি তাড়াতাড়ি লগ্নলতাকে নিয়ে উপমার ঘরে ঢুকল। ওদেরকে সবটা বলল। তারপর  ওরা সবাই মিলে যেন একটা অমঙ্গলের আঁচ পেল। তা নিজেরা বাঁচতে আর অন্যদেরও বাঁচাতে ভাঁটির নেতৃত্বে ওরা সবাই যখন মানময়ীর কাছে গেল, তখন সেখানে মানময়ীর সঙ্গে কনকাঞ্জলি, সুলক্ষী সবাই মিলে বসে গল্প করছে হাত-পা ছড়িয়ে সারাদিনের খাটাখাটুনির শেষে। ভাঁটিই সমস্ত কাথাটা ওদের বলল।  ওরা সকলেই বলল, ‘এখন ওসব নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। সময়কালে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর তাছাড়া এটাই তো নিয়ম। চিরকাল এটাই চলে  আসছে’। ঘরের বাইরে আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে শ্যামাঙ্গী সবটা শুনল। আর তার পরেই ও সোজা ঘরে চলে গেল। ওর মধ্যে থেকে এক ধরনের বিষাক্ত বাষ্প  বেরাতে লাগল যেটা কেউ চোখে দেখতে না পেলেও গন্ধটা সবাই টের পেল। আস্তে আস্তে সেই গন্ধ ওদের বাড়ির ওপর থেকে নিচ হয়ে উঠোন, বাগান, গেট পেরিয়ে রাস্তাটাও পার করে বইতে শুরু করল। এক সময় দেখা গেল গোটা জনপদই সেই বিষাক্ত হাওয়ায় কাপছে। কথাটা কোনভাবে গুরুমার কানে গেলে তিনি অন্য সবাইকে বললেন, ‘তোমরা শুধু একটা হাওয়ার পেছনেই ছুটে মরছ। মেয়েটার কষ্টটা কেউ বুঝছ না!’ তারপর শ্যামাঙ্গীর ঘরে গিয়ে ওকে দুটো গান শোনালেন আর কিছুক্ষণ  গল্প করে সময় কাটিয়ে নিজের ঘরে ফিরে গেলেন।   আস্তে আস্তে শ্যামাঙ্গী ঠাণ্ডা হল। সেই সঙ্গে ওর শরীর থেকে বিষাক্ত গ্যাস বেরানোও বন্ধ হল।  নিহিতপাতালপুরী সংলগ্ন গোটা জনপদ আস্তে আস্তে নিজস্ব ছন্দে ফিরে এল। মানময়ী বলল, ‘বাবা! মেয়ের রাগ দেখেছ!’

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন