কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

পায়েল চট্টোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


অনন্যা

 

অনন্যা আজকাল আর আসে না। গত পরশু এসেছিল শেষবার। আমায় বলল

-''দাদা, আপনি এটা করতে পারলেন?''

আমি তখন খাতায় মুখ গুঁজে এঁকে চলেছি আমার গল্পের চরিত্রদের। ওদের সাজাচ্ছি নরম রোদের মতো। অনন্যার কথায় তাতে বাধা পড়ে।

আমি ওকে বলি, ''তোমায় তো জিতিয়ে দিলাম, তাও তুমি খুশি নও?''

-''ধুর! জেতার ইচ্ছে আমার নেই আর। আপনি আমার নামটা পাল্টে দিলেন কেন? নিজেকে বাঁচাতে?'' অনন্যা মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে।

বৃন্তিকা চা দিয়ে যায়। ওর চোখে রোদ। ''আপনার লেখা পড়েছি। অনন্যার প্রতি আপনার পক্ষপাতিত্ব বড় বেশি।'' কথাগুলো বলে খিলখিলিয়ে হাসে বৃন্তিকা। আমি উত্তর দিইনি। সব কথার উত্তর দেওয়া যায় নাকি! আমি শুধু ওকে বললাম, ''তুমি এখন যাও।"

আমি জানি অনন্যা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করবে এবার। ''আপনি ওকে বলেননি? আপনার কি মনে হয় বৃন্তিকা ঠিক বলল! আপনার আমার ওপর পক্ষপাতিত্ব বেশি? ও কি জানে না আপনি আমার সঙ্গে কী করেছেন?''

-"সব কথা কি সবাইকে বলা যায় অনন্যা?'' আমি অনন্যাকে শান্ত করার চেষ্টা করি। তখনো জানতাম না ওটাই অনন্যার আসার শেষ দিন। হয়তো শেষ দিন বলেই অনন্যা আর বেশি কথা বাড়ালো না। নিঃশব্দে চলে গেল। আমি চিৎকার করতে লাগলাম।

-''অনন্যা আবার এসো কিন্তু! আমি তোমায় ছাড়া আজকাল আর লিখতে পারি না।''

অনন্যা একবার মুখ ঘুরিয়ে দেখল। উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে গেল। হঠাৎ দেখলাম আমার লেখার খাতায় জল পড়েছে। অনন্যা কি তবে কাঁদছিল?

প্রকাশক এসে বইটা দিয়ে গেল। ‘অন্তরার আত্মকথা’'। এটা লেখক কপি। প্রথম সংস্করণ, নাকি শেষ? আমি বই নিয়ে ঠায় বসে আছি।

খবরের কাগজের অফিসে যখন অনন্যা আসতো, একেবারে সাধারণ। প্রসাধনের বালাই নেই। নিতান্ত ছাপোষা। আমার আবার চকমকি জিনিসের বড় শখ। কাজের ব্যাপারে ও তেমন পারদর্শী ছিল না। তবে বোঝালে চেষ্টা করত।  নামকরা সংবাদপত্রের ব্যস্ত লেখকের এত সময় কোথায়! প্রায় রোজই কথা শোনাতাম। উত্তর করত না। হঠাৎ একদিন বলল, ''মেধা কম থাকলে সবাই এত হেয় করে কেন? আমার রেজাল্ট দেখেই তো আমায় এখানে নেওয়া হয়েছে!'' সেদিনও উত্তর দিইনি। হঠাৎ করেই দেখলাম আমার জুনিয়র সেক্রেটারি পাল্টে গেছে।

একদিন অফিসে শুনলাম অনন্যা নাকি আত্মহত্যা করেছে। ওর বোন বৃন্তিকা এসে জানিয়েছে। পাওনা গণ্ডা বুঝে নিচ্ছিল মেয়েটা। হঠাৎ কী মনে হল গিন্নির অনেকদিন আগের আবদার মেটাই। মেয়েটাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম গিন্নির সর্বক্ষণের সঙ্গী করে। এরপর থেকেই অনন্যার আসা শুরু হলো রোজ। অনন্যা আমার এই ‘মহান কাজ’কে করুণা আখ্যা দেয়। আমি নিরুত্তর। ‌ অনন্যাকে  নিয়ে লেখা শুরু করলাম তখন। নাম বদলে অনন্যা থেকে অন্তরা। অন্তরার আত্মকথা। আমি অনন্যায় আসক্ত।

অনন্যা কি তাহলে আর কোনদিন আসবে না? অনন্যা না এলে এক অক্ষরও লিখতে পারি না আমি আর। নতুন গল্পের সব চরিত্র যেন অনন্যা হয়ে ওঠে। মাথা ছিঁড়ে যায় আমার। সকলে ধিক্কার দেয় আমায়।

গতকাল প্রকাশক জানাল 'অন্তরার আত্মকথা'র প্রথম সংস্করণ শেষ। তবে দ্বিতীয় সংস্করণ আর বেরোবে না। ওরা মূল পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেছে। তবে সব কটা বই একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে গেছে। হুগলির নিশ্চিন্দিপুর। অনন্যার বাড়ি ওখানে।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন