কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৫ |
হস্তশিল্প
বাবা প্রায়ই বলতেন কথাটা, ছেলেটাকে আর মানুষ করতে পারলাম না! ছেলে মানে ছোটছেলে অমর্ত্যর কথা বলতেন। বড়ছেলে অদ্বৈত মোটামুটি পড়াশোনা করেছে, অন্তত স্কুল ফাইন্যাল পাশ করেছে, তারপর তিনি অফিসের বড় বড় অফিসারদের হাতেপায়ে ধরে নিজের অফিসেই ফোর্থগ্রেড মানে অফিস পিওনের চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ভবিষ্যতে প্রমোশন পেয়ে থার্ডগ্রেডে উন্নীত হলেও হতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে অমর্ত্যকে নিয়ে। সেও টানাটানি করে স্কুল ফাইন্যাল পাশ করে গেছে, তবে অফিসের পিওন হতে তার একান্ত আপত্তি। বাবা জিজ্ঞেস করতেন, তাহলে তুই করবি কী? অমর্ত্য উত্তর দিত, আমি শিল্পী হব। হ্যাঁ, কথাটা ভুল নয়, ছোটবেলা থেকেই তার আঁকার খুব শখ। বই ও খাতায় সে পেন দিয়ে যা মন চায় তাই আঁকত। আর তার এই শিল্পপ্রেম দেখে শিল্পচর্চার জন্য বাবা তাকে একটা আঁকার স্কুলে ভর্তিও করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এটাও বুঝেছিলেন, অমর্ত্য এতটা প্রতিভাবান নয় যে, ছবি এঁকে নিজের পেট চালাতে পারবে! আর তাই অমর্ত্য যখন অফিস পিওন হবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে শিল্পী হবার বাসনা প্রকাশ করল, তখন থেকেই বাবা বলতে শুরু করলেন, ছেলেটাকে আর মানুষ করতে পারলাম না!
অমর্ত্য হয়তো বাবার আক্ষেপের তাৎপর্য কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পেরেছিল, আর তাই দেরি না করে খোঁজখবর নিয়ে নিত্যদার স্কুলে ভর্তি হয়ে গেল। নিত্যদাও শিল্পী। তবে শিল্পটা পকেটমারির। এখন বয়স হয়েছে, নিজে আর কাজ করেন না, বরং শেখান। যারা শিক্ষার্থী তারা বোঝে, এই শিল্প আয়ত্ব করতে গেলে কতটা ধৈর্য, অধ্যাবসায়, একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। সবটাই হাতের কাজ মানে হস্তশিল্প। এবং সেই কাজ নিপুণ ও নিখুঁতভাবে করতে হয়। একটু এদিক ওদিক হলেই শিল্প মার খেয়ে যায়, শিল্পী ধরা পড়ে যায়, আর পরিণতিতে যা হয়, আড়ং ধোলাই, তার জন্য শরীর ও মনকে প্রস্তুত রাখতে হয়। শুধু মুশকিল হচ্ছে একটাই, এই শিল্প সাধনায় যে যত বড়ই শিল্পী হোক না কেন, তা কাউকে বলা যায় না, স্বীকৃতিও পাওয়া যায় না। আর এজন্যই অমর্ত্যও তার মা-বাবা-দাদাকে মুখ ফুটে বলতে পারেনি এই শিল্পচর্চার কথা। এদিকে বাবা যে আক্ষেপ করেন, সেটাও মেনে নেওয়া যায় না!
সেদিন বাবা অফিসের পর অফিসের বাইরের এটিএম থেকে সংসারের মাসিক খরচের জন্য টাকা তুলে পার্সে রেখে বাড়ি ফেরার জন্য একটা ভিড় বাসে উঠে পড়লেন। অমর্ত্য কাকতালীয়ভাবে সেখানে ছিল। ব্যাপারটা সে লক্ষ্য করেছিল। দেরি না করে দৌড়াতে দৌড়াতে সেও বাসে উঠে পড়ল। ঠাসাঠাসি ভিড়। বাবার বসার কোনো সুযোগই নেই। অমর্ত্য নিজস্ব কায়দায় ঠেলেঠুলে সঠিক পজিশনে পৌঁছে গেল।
বাস থেকে নেমে বাবা যখন পকেট হাতড়ালেন, পার্সটা খুঁজে পেলেন না। এদিকে বাসও ছেড়ে দিয়েছে। তাহলে কি পকেটমারি হলো? মাথায় হাত রেখে রাস্তার ওপরেই বসে পড়লেন বাবা।
কিছুটা রাত করে বাড়ি ফিরল অমর্ত্য। বাড়ির আবহাওয়া থমথমে। অমর্ত্য নিঃশব্দে পার্সটা বাবার প্যান্টের পকেটে রাখল।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন