কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

লাল-নীল-পেন্সিল



 

(২৪)

একঘেয়ে সকালে ওঠো, চা-জলখাবার, রান্না, কাজের লোক, কাপড় ধোওয়া, সপ্তাহে দু-দিন বাজার, দিন গড়িয়ে বিকেল, সন্ধে, রাত। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অবসরে রাস্তা দেখা, আকাশ দেখা। এখানে আসার আগে কর্মস্থলে বেশ ছিল ব্যস্ত দিনগুলো, দ্রুত দিন ফুরিয়ে যেত। লিপিকা চাইলে ছোটোখাট প্রাইভেট কম্পানিতে যোগ দিতেই পারে, চাকরির অনেকটা বাকি পড়ে আছে। আসলে উদ্যমটাই কেমন মরে গেছে, সারাদিনে যেন সংসারের কাজ ফুরোতে চায় না। ক-দিন ধরে সলমনকে তাড়াতাড়ি সরিয়ে আলাদা ছোটো জারে রাখতে হয়েছে। মাছেদের গায়ে তুলো-তুলো একধরনের ফাঙ্গাস হয়, ওতেই গোটাতিনেক মরে  গেল। জল থেকে বা অন্য কোন কারণে হয়েছে, মাথা ঘামায়নি লিপিকা। জল বদলে অ্যাকোয়ারিয়াম পরিষ্কার করে ওষুধ মিশিয়ে বাঁচানো গেছে। এটা মাছেদের সাধারণ অসুখ যদিও, কিন্তু সময়মতো চিকিৎসা না দিলে সব ক-টাই যাবে। সলমনের মুখের দিকে শুরু হয়েছিল, অ্যান্টি-ফাঙ্গাল সল্যুশন দেওয়ায় আর বাড়েনি। লিপিকা ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢোকে, অ্যাকোয়ারিয়ামের সামনে দাঁড়ায়। সলমনের মনে হয় একা থাকতে ভালোই লাগছে। ঘোরাফেরার জায়গা কম, মাঝে মাঝে থেমে স্থিরভাবে কাচের বাইরে তাকিয়ে থাকে। লিপিকা সামনে এলে ঈষৎ নড়াচড়া দেখে মনে হয় তাকে ও চিনতে পারে। মায়া লাগে তখন, ইচ্ছে করে কোলে তুলে আদর করতে।

বাজার করে এনেছে খানিক আগে, কিচেনের মেঝেতে পড়ে আছে, তুলে গুছোতে হবে। সোফায় শোভন, গভীর মনোযোগ আঁকার খাতায়। মোটামুটি ভালো স্কেচ করছে আজকাল। এক-একবার লিপিকা ভাবে মাম্‌পিকে আসতে বলে, নিজেকে অপরাধী মনে হয়। যেতে বলেছিল ওর একজিবিশনে, তারা যায়নি।

কিচেনের দিকে যেতে দেখে শোভন ডাকে,

--লিপি এইদিকে এসো, দেখে যাও।

লিপিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকায়, বিরক্তি চেপে বলে,

--পরে, পরে। কাজ সেরেনি, গাদা কাজ পড়ে আছে।

শোভন মাথা নাড়ে, জানে সে। আজকাল মন বড়ো সঙ্গ চায়, লিপিকা দরকারে বের হলেও সে ছটফট করে। অথচ বোঝে লিপিকা সমস্ত দায়িত্ব সামলে তাকে সময় দেয়। গাড়ি নিয়ে টুকটাক ঘুরিয়ে আনে কাছাকাছি, একদম ফাঁকা রাস্তা থাকলে শোভনকে ড্রাইভ করতে উৎসাহ দেয়। নিজে-নিজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করে শোভন কিন্তু বেশীক্ষণ অন্যমনস্ক হলে চিন্তাগুলোকে ধাওয়া করতে থাকে, গলিপথের ট্র্যাক সঠিক রাখার জন্যে ওইসব আনতাবড়ি আঁকিবুকির চেষ্টা। ছেলেকে নিজে থেকে ফোন করে না। সময় করে বাবুলই করে, শোভন কী বলবে খুঁজে পায় না।

রঙ করে আর ছুলে-ছুলে রঙপেন্সিলগুলো ছোটো হয়ে গিয়েছিল, লিপিকা নতুন বাক্স কিনে এনেছে। ঘষঘষ করে পেন্সিল ঘষে শোভন, হলুদ-বাদামি মেশানো বালির রঙ, রোদ্দুর পড়ে সোনালি রঙ ধরে আছে বালি, দূরে পাড় ধরে গাঢ় সবুজ ঝোপঝাড়। চড়া পড়ে যাওয়া নদী, কোথাও কোথাও অল্প জল, জলের রঙ কী দেওয়া উচিত ভেবে সে পেছনে হাঁটে। কম্পানির টাউনশিপের কাছে বাসস্ট্যাণ্ড, ছোটোমতো প্রাইভেট বাস ধরে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার, নামলে নদীঘাট। চওড়া নদী শুকনো, যে ক-বার গেছে, তেমনই দেখেছে, কোন কাল ছিল ভুলে গেছে। বর্ষাকাল নিশ্চয়ই নয়, বর্ষায় ওই নদীই দানববাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ প্রকল্প করা হয়েছে।

যেসব জায়গায় জল, সেখানে বাবা লম্বা মানুষ হওয়া সত্বেও হাঁটু ছাড়ানো জল, দাদার বুকজল, শোভনের গলা-মাথা জেগে আর রঞ্জু হয়তো বা ডুবেই যাবে। শোভন থমকে দাঁড়ায়। ওখানটাতে সেই উলো-ঝুলো মাথা, কুটকুটে ময়লা, ঝুলঝুলে ছেঁড়া কাপড়-পরা লোকটা ঘাটে বসে থাকে। শোভনদের কাছাকাছি যে হাট, হাটবারে বাবার সঙ্গে গিয়ে ওখানেও অনেকবার লোকটাকে দেখেছে। দিব্যি আছে, চার-পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা আপনমনে যাতায়াত করে। হাটের ব্যাপারীরা কেউ না কেউ খেতে দেয়, কোণে বসে শালপাতার ডোঙা থেকে চেটে ঘুঘনি খায়, নোংরা দাঁতে রুটি বা পাঁউরুটি ছেঁড়ে। কথা-টথা বলে না, নিতান্ত নিরীহ মানুষ, কখনো কাউকে উৎপাত করে না।

নদী পারাপারের দৃশ্য দ্রুত এঁকে ফেলছে শোভন। বাবা প্যান্ট গুটিয়ে তুলেছেন, রঞ্জুকে বসিয়েছেন নিজের কাঁধে, শোভু আর বিজু দুই শক্তপোক্ত মাঝির কাঁধে দু-পা দু-দিকে ঝুলিয়ে। বিজু বড়ো বলে জোর আপত্তি করছিল, এক ধমক লাগিয়েছেন বাবা। বাবা রেগে গেলে বড্ড কড়া। শোভু বিনা বাক্যে মাঝির কাঁধে চড়ে বসেছে। নদী পেরিয়ে ওপারে নেমে বাসে উঠতে হয়।

শোভন আঁকা থামিয়ে পেন্সিল ছড়িয়ে বসে, এসব কবেকার ঘটনা যেন? কত ছোটো সে? বাবা বিজু আর শোভুকে মিশনের স্কুলে বারদুই নিয়ে গিয়েছিলেন, একবার স্কুল দেখাতে পরের বার ভর্তির পরীক্ষা দিতে। মা-কে নিয়ে যাননি, বাড়িতে রঞ্জু, ঠাকুমা আর মা ছিল। দাদার চেয়ে দু-বছরের ছোটো শোভন ভর্তি-পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করল, দাদা পারল না, পরিষ্কার মনে পড়ছে শোভনের। স্কুলের প্রকাণ্ড ক্যাম্পাস, খেলার মাঠ, হস্টেল, ছোট্ট চিড়িয়াখানা সবটা দেখে ওঠা হয়নি, যেহেতু ভর্তি হওয়া হয়নি। মিশন থেকে ভর্তিও পরীক্ষার রেজাল্ট এলো একদিন। দেখে বাবার মুখ গম্ভীর, দুঃখ পেয়েছিলেন। শোভনকে পাশে নিয়ে বসে বিজুকে ডেকেছিলেন,

--তোর হল না বিজু, ভাই পেরেছে, ওকে ভর্তি করে দেবো। কী বলিস? অবশ্য সিক্সে সীট্‌ কমই ছিল, সেজন্যে আরো খাটা উচিত ছিল।

সদ্য সিক্সে-ওঠা বিজু বাবার সামনে কয়েক মিনিট মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে ছুটে পালায়। দাদার সেদিনের মুখটা মনে পড়ে শোভনের, চোখের সামনে ঝাপসা দেখায়। রাত্তিরে রান্নাঘরের দাওয়ায় বাবাকে ভাত বেড়ে দিয়ে মা বলে,

--বড়খোকার যখন হয়নি, শোভুকেও ওখানে দিতে হবে না।

--কীরকম কথা বলছ? ওরকম স্কুলে চান্স পাওয়া কত ভাগ্য, ছেলেটা পেল, ছেড়ে দেবে? আমি নিজে তত পড়তে পারিনি, কত স্বপ্ন এদের নিয়ে!

--তা করলে ছেলেদুটোর একটাও ভালো থাকবে না। পিঠোপিঠি ভাই, আলাদা হয়ে বড়ো হলে ভালো হবে বুঝি?

বাবা ‘হ্যাঁ-না’ কী জবাব দিয়েছিলেন শোভন জানে না। শোভনেরও মিশন-স্কুলে যাওয়া হয়নি, দাদার সঙ্গে ওখানকারই বয়েজ হাই স্কুলে রয়ে গেল। চারবছর পরে রঞ্জু যখন ক্লাস ফোরের পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পেল, তখন আর মা-র কথা শোনেননি বাবা। শোভন ক্লাস এইটের প্রথম পাঁচজনের মধ্যে, দাদার পড়াশোনায় বিশেষ মনোযোগ ছিল না। তাকে ভর্তি না করার আপশোশ বাবার মনের মধ্যে পুষেছিলেন।

নিজের আঁকার দিকে তাকিয়ে থাকে শোভন, বেশ হয়েছে স্কেচটা। লম্বা বাবা, গাঁট্টাগোট্টা চেহারার মাঝিরা। রঞ্জু যখন যেতে আরম্ভ করে ব্রিজটা হয়েছিল? কবে হয়েছিল ব্রিজ? একা সলমনের দিকে তার চোখ আটকে যায়, জারের ভেতরে স্থির হয়ে আছে মাছটা। ঠেলে-আসা চোখ স্থির, লেজের পাখনা সামান্য নড়ছে। সলমনের মুখটা হঠাৎ কেমন বাবার মুখের মতো দেখায়, চোখের ভাষা অবোধ্য। শোভন হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে লিপিকা বলে,

--ওকে আর দু-তিনদিন পরে অ্যাকোয়ারিয়ামে রেখে দেবো। একেবারে লোনলি,  বোধহয় কষ্ট হচ্ছে বেচারার।

শোভন চমকে ওঠে, ঘোর কেটে যায়, পেছন ফিরে কী বলবে ভেবে জিভের মধ্যে জড়িয়ে যায় সব কথা।

 

(ক্রমশঃ)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন