ধারাবাহিক উপন্যাস
একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী
(১৫)
পিকনিকের কয়েকদিন আগে সাঁঝের এক নতুন পরিচয় পায় সবাই। কয়েকটি খুব দুর্লভ ও খুব দামী ফুলগাছ বিদেশ থেকে আনতে হবে। কিন্তু অর্থ জোগাড় হচ্ছিল না। তখনই সাঁঝ একটা অদ্ভুত প্রস্তাব দেয়। এই প্রস্তাব সবাইকে একদম চমকে দেয়। সাঁঝ নিজের একটা সোনার হার দিয়ে সেটা বিক্রি করে দিতে বলে। বিশ্রুতকেই সে প্রথম এই প্রস্তাবটা দেয়। বিশ্রুত এসে জানায় হৃদয়কে। হৃদয় হতবাক হয়ে যায়। বলে, সত্যি বলছিস?
সত্যি।
এরকম মেয়ে আছে নাকি? এসব তো বইয়ে পড়া যায়!
তুই কি রাজি?
নিশ্চয়ই। এরকম একটা মহত্ব, স্বীকৃতি না জানিয়ে উপায় আছে?
তাছাড়া আমাদের প্রয়োজনটাও ভাবতে হবে।
ঠিকই। কিন্তু আমি ভাবছি ওর অন্তরটা নিয়ে। এরকম একটা সময়ে সবাই
নিজেদের ছোটো ছোটো লাভ-লোকসান নিয়ে ব্যস্ত, অলৌকিক মনে হচ্ছে আমার...
হৃদয় আর বিশ্রুত সাঁঝকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে হারটি বিক্রি করে আসে। সঙ্গে থাকে অনির্বেদ আর দিশারী। সেই টাকাতেই ঐ দামী আর দুর্লভ ফুলগাছগুলো কেনা হয়। এই ঘটনা সাঁঝকে সবার চোখে খুব উঁচুতে তুলে দেয়। বিশেষ করে হৃদয়ের সঙ্গে সাঁঝের একটা উষ্ণ, অন্তরঙ্গ, নির্মল বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নানা বিষয় নিয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করত এবং অকপটে মত বিনিময় করত। পরে কিছুদিনের জন্য সাঁঝ যখন অতলান্তের খুব ঘনিষ্ঠ হয়, অতলান্ত সাঁঝকে নিজের প্রেমিকা হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে, তখনও সাঁঝ হৃদয়ের প্রতি এই শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখেছিল। অতলান্ত এটা জানত এবং কখনই এই নিয়ে ওকে ঘাটাত না। সাঁঝের মর্যাদাবোধকে ও সমীহ করত।
অনির্বেদ একদম অভিভূত হয়ে যায় এই ঘটনায়। পিকনিকে গিয়ে সাঁঝের দিক থেকে সে যেন চোখ ফেরাতে পারে না। শুধু সাঁঝের কথা ভেবেই জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে নানা বন্য ফুল সংগ্রহ করে আনে। সেসব ফুল দেখে সাঁঝও চমকে চমকে ওথে। অনির্বেদকে নিয়ে তার মধ্যেও কেমন একটা ভালো লাগা তৈরি হতে থাকে। সকাল থেকেই এরকম চলছিল। হঠাৎ সেই ঘটনাটা ঘটে।
অনির্বেদ সেদিন খুব উত্তেজিত ছিল। সাঁঝের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে সে সমুদ্রের ধারে চলে গিয়েছিল। সবাই চেয়েছিল ওদের সম্পর্কটা দানা বাঁধুক। গত কয়েকমাস ধরেই অনির্বেদ একটার পর একটা চিঠি লিখে গেছে। এতদিনে সে চিঠি লেখার মানুষ খুঁজে পেয়েছে। বিশ্রুত সেসব চিঠি পৌঁছে দিয়েছে সাঁঝের কাছে। সাঁঝ কখনও কখনও উত্তর দিয়েছে। তাও ছোটো ছোটো চিরকুটে। কিন্তু কবে থেকে যেন ওর মধ্যেও একটা অপেক্ষা তৈরি হয়ে গেছে। অনির্বেদের চিঠির জন্য একটা ব্যাকুলতাও জন্মেছে মনে। অনির্বেদ কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু জানায়নি। শুধু কিছু অস্পষ্ট ভাবের কথা, বড়ো বড়ো লোকের উদ্ধৃতি, কিন্তু আসল কথাটা জানাতে গিয়েই কোথাও একটা আটকে গেছে। দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছে। সাহসে ঠিক কুলায়নি।
সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দু-জনের কেউই কোনো কথা বলছিল না। অনির্বেদ সাঁঝের পাশে হাঁটতে হাঁটতে খুব আড়ষ্ট বোধ করছিল। ক্রমেই আরও বেশি করে জড়োসড়ো হয়ে উঠছিল সে। অথচ বুকের ভেতরটা কথার স্রোতে যেন তার তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল। কত কথাই সাঁঝকে বলতে চায় সে! বিশেষ করে ঐ সোনার হারটার কথা! নিজের মুগ্ধতার কথা! কেন অমন করল সাঁঝ? কোত্থেকে পেল ওই বিরল আত্মত্যাগের প্রেরণা? ছোটোবেলা থেকেই অনির্বেদ খুব আদর্শবাদী। সাঁঝের ওই আত্মত্যাগ তাকে যেন ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে। অন্যদিকে সাঁঝও ঠিক বুঝতে পারছিল না, কোথা থেকে শুরু করবে। অনির্বেদকে সে কতটুকুই বা চেনে! কিন্তু শুরু তো করতেই হবে। এভাবে সবার থেকে আলাদা হয়ে সরে আসা, সে তো পরস্পরকে আরো ভালোভাবে জানার জন্যই!
সাঁঝ বুঝতে পেরেছিল, তাকেই কথা শুরু করতে হবে। হঠাৎ সে জানতে চেয়েছিল, তুই আমার কাছে কী চাস?
খুবই অকপট এই প্রশ্ন। অন্যভাবেও হয়তো করা যেত। কিন্তু সাঁঝ অনির্বেদের
ভেতরের কথাটাই জানতে চাইল। অনির্বেদ বলতে পারত ভালোবাসা। কারণ সত্যিই তো ওটাই সে চায়।
সাঁঝের সান্নিধ্য, বন্ধুত্ব, প্রেরণা, ঘনিষ্ঠতা, কত রকম শব্দেই নিজের হৃদয়কে মেলে ধরা
যায়! কিন্তু ওসব ভাবের কথায় কী হবে? যেটা তার সত্যিই দরকার, সেটাই সাঁঝকে বলা উচিৎ।
যাকে সে নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষ করে তুলতে চায়, নিজের প্রেরণা ভাবে, তার কাছে সত্য
গোপন করে লাভ কী!
অনির্বেদ তাই সোজা সাপটা বলে ওঠে, ডিকশনারি।
সাঁঝ প্রথমটায় থতমত খেয়ে যায়। চলতে চলতে সামান্য একটু হোঁচটও
খায় সে। তারপর গভীর বিস্ময়ে বলে ওঠে, ডিকশনারি?
অনির্বেদ কিছুই বুঝতে পারে না। আগের মতোই সরলভাবে এবং অকপটে
সে জানায়, হ্যাঁ, এখন আমার ওটাই দরকার।
সাঁঝ যেন হঠাৎ কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তারপর নির্লিপ্তভাবে
বলে ওঠে, ঠিক আছে, বিশ্রুতর হাত দিয়ে আমি পাঠিয়ে দেব। চল, ফেরা যাক...।
এবার অনির্বেদ খুব অবাক হয়। কোনও কথাই তো হল না। এর মধ্যেই সাঁঝের
উৎসাহ ফুরিয়ে গেল? ওদের সম্পর্কটা ওখানেই শেষ হয়ে যায়। সাঁঝ সত্যিই একটা ডিকশনারি পাঠিয়ে
দিয়েছিল। যদিও সেটা ছিল বাড়ির পুরনো ছেঁড়া একটা ডিকশনারি। একটা নতুন ডিকশনারি কিনে
পাঠানোর মতো উৎসাহও তখন আর তার অবশিষ্ট ছিল না।
হৃদয় পরে বিশ্রুতকে বলেছিল, ও কি অন্য কিছু চাইতে পারত না?
হয়ত পারত, বিশ্রুত বলেছিল, কিন্তু সেটা মিথ্যাচার হত।
কেন?
কারণ একটা ডিকশনারির জন্য ও তখন মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ওটার অভাবে
ওর পড়াশুনোর খুব অসুবিধা হচ্ছিল। সাঁঝ ওর কাছে ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। ও তাই
সাঁঝের কাছে ওর যেটা সবচেয়ে প্রয়োজন সেটাই চেয়েছিল।
কিন্তু বিশ্রুত, প্রয়োজনের কথা কি সব জায়গায় বলা যায়? এসব মুহূর্তে
মানুষ কি প্রয়োজনের কথা শুনতে চায় না ভাবের কথা?
বিশ্রুত মৃদু হেসেছিল। তারপর বলেছিল, অনির্বেদের জায়গায় তুই
থাকলে একথা বলতে পারতিস না। প্রয়োজনটাই হয়ে উঠেছিল ওর জীবন। আর সাঁঝ সেটা বুঝতে পেরেছিল।
অনির্বেদের মতো মানুষ সবচেয়ে অন্তরঙ্গ মুহূর্তেও
নিজের প্রয়োজনকে ভুলতে পারে না। সাঁঝ যতই উদার হোক, এরকম একজন মানুষের সঙ্গে নিজের
জীবনকে জড়াতে চায়নি। তাছাড়া সেটা ভালোও হত
না। ওই ঘটনার পর অনির্বেদের জন্য ওর মনে করুণা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অনির্বেদ সেটা
নিতে পারত না।
এই ঘটনার পর অনির্বেদ নিজেকে যেন আরও গুটিয়ে নিয়েছিল। যত দিন যাচ্ছিল ওর ঘনিষ্ঠতা শুধু বাড়ছিল অতলান্তের সঙ্গে। অতলান্ত অন্তরমুখী স্বভাবের মানুষ। যদিও কথাবার্তায় দারুণ তুখোড়। এমনভাবে কথা বলে যা সবসময়েই হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। শব্দ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে খুব কৌশলী। বাক্য প্রয়োগ করতে পারে হিসেব করে। সবারই মনে জয় করে নিয়েছিল অতলান্ত। আর অনির্বেদ যেন ভেসে গেছিল। হৃদয়ের মেধাবী জগৎ অনির্বেদের ভেতর থেকে পছন্দ ছিল না। অতলান্তের মেধাহীন, কল্পনাপ্রবণ হৃদয়সর্বস্বতাই ওকে আকৃষ্ট করত।
বিশ্রুত বলেছিল, আসলে ও নিজে উঠে এসেছে একটা মেধাহীন জগৎ থেকে। তাই মেধাহীনতার মধ্যেই ও স্বস্তি বোধ করত। ওর মধ্যে একটা জন্মগত কল্পনাপ্রবণ মন ছিল। সেই কল্পনার জগৎটাকেই উসকে দিত অতলান্ত। ও যেন অতলান্তের মোহে পড়ে গেছিল।
হৃদয় বলেছিল, অনির্বেদ বোধ হয় জানত না, পিকনিকের দিনই অতলান্ত
প্রথম...
হেসে উঠেছিল বিশ্রুত। হ্যাঁ সাঁঝকে নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু
করে। কয়েকটা জোকসও লিখে ফেলে সাঁঝকে নিয়ে।
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন