কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ১৭ 




সেটা ১৯৯৭ সাল। কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভাল তখন নিতান্তই শিশু। আমিও তখন যাদবপুরে সদ্য মাস্টার্স করতে গেছি। সেই সময় ফিল্ম ফেস্টিভালে গোর্কি সদনে তিনটে রাশিয়ান ছবি দেখেছিলামঃ ব্যাটলশিপ পোটেমকিন, ইভান দ্য টেরিবল্‌ পার্ট ১ এবং ইভান দ্য টেরিবল্‌ পার্ট ২। যেহেতু তখন প্রধান ভিড় হত  নন্দনে এবং গোর্কি সদনে খুব কম লোকেই উপস্থিত হত (একমাত্র সিনেমা প্রেমীরাই যেত), তাই সেই পঁচিশ বছর আগের বাতানুকূল ফাঁকা নিশ্চুপ গোর্কি সদনে এই তিনটে রাশিয়ান ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখার পর আমি রাশিয়ান ছবির ভক্ত হয়ে যাই। এটা ঠিক যে এই তিনটে সিনেমাতেই মুগ্ধ করে দেবার মত কিছুই নেই, বরং ইভান দ্য টেরিবল্‌ ছবিতে বীভৎসতা দেখান হয়েছে, কিন্তু রাশিয়ান ছবির ইতিহাস প্রাধান্যতা দর্শককে সিটে বসিয়ে রাখতে বাধ্য করে। পরবর্তীকালে যখন তারকোভস্কির সিনেমা দেখেছি, তখন রাশিয়ান ছবির অন্য মাত্রা চোখে পড়েছে।   

এই পর্বে সেজন্য জার্মানির পর আমাদের গন্তব্য রাশিয়ান সিনেমা। তবে হ্যাঁ, প্রথমেই একটা ছোট ব্যাপার খোলসা করে নিই। আমি কিন্তু ১৯২২ থেকে ১৯৯১ অব্দি সোভিয়েত ইউনিয়ন আর তারপর ভেঙে গিয়ে রাশিয়া, ইতিহাসের এইসব  কচকচানিতে যাব না। রাশিয়া হিসেবেই পুরোটা উপস্থাপন করব। তবে সিনেমার পাশে ব্র্যাকেটের ভেতর তার সাল দেখে উৎসাহী পাঠক যদি সেই ভাঙা হিসেব করে নিতে চান, আমার কোন আপত্তি নেই।

তাহলে প্রথমেই রাশিয়ান সিনেমার একগুচ্ছ ডালি সাজিয়ে বসি। সেই দেশের সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক পরিচায়ক হিসেবে।   

ভার্তভের ‘ম্যান উইথ এ মুভি ক্যামেরা’ (১৯২৯), আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ (১৯২৫), ‘ইভান দ্য টেরিবল্‌ পার্ট ১’ (১৯৪৪) এবং ‘ইভান দ্য টেরিবল্‌ পার্ট ২’ (১৯৫৮), কালাটোজোভের ‘দ্য ক্রেনস আর ফ্লাইং’ (১৯৫৭), গ্রেগোরি চাকরে-র ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’ (১৯৫৯), তারকোভস্কির ‘আন্দ্রেই রুবলভ’ (১৯৬৬), ‘সোলারিস’ (১৯৭২), ‘দ্য মিরর’ (১৯৭৪) ও ‘স্টকার’  (১৯৭৯), পারাজানভের ‘শ্যাডোজ অব ফরগটেন অ্যানসেস্টার্স’ (১৯৬৫) ও ‘দ্য কালার অব পমেগ্রেনেট্‌স’ (১৯৬৮), বন্দারচাকের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ (১৯৬৬-৬৭), গেইদাই-এর ‘দ্য ডায়মন্ড আর্ম’ (১৯৬৯), আবুলাদজের ‘দ্য উইশিং ট্রি’  (১৯৭৭), ভ্লাদিমির মেনশোভের ‘মস্কো ডাজন্ড বিলিভ ইন টিয়ার্স’ (১৯৮০), এলেম ক্লিমভের ‘কাম অ্যান্ড সি’ (১৯৮৫), মিখাকভের ‘দ্য বারবার অব সাইবেরিয়া’ (১৯৯৮), সোকুরোভের ‘রাশিয়ান আর্ক’ (২০০৩) এবং আন্দ্রে জিয়াগিনশেভের ‘লেভায়াথন’ (২০১৪)।   

এই লেখার ১১ নম্বর পর্বে আইজেনস্টাইন ও ১২ নম্বর পর্বে পারাজানভকে নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। ফলে আর তাদের সিনেমা আলোচনায় আনব না। আজ জোর দেব তারকোভস্কির ওপর। মোট পাঁচটা সিনেমা নিয়ে আজ বিশদে আলোচনা হবেঃ ব্যালাড অব এ সোলজার, দ্য মিরর, স্টকার, কাম অ্যান্ড সি এবং লেভিয়াথন। এবং যদিও আলোচনা করব না, তবুও বলি যে এই লিস্টে সোকুরোভের ‘রাশিয়ান আর্ক’ (২০০৩) রেখেছি শুধুমাত্র একটা কারণে। ৯৬ মিনিটের একটাই লং শটে এক সিনেমা বানানো, মাত্র একটা টেকে – অদ্ভুত ও অবিস্মরণীয়। সিনেমার ইতিহাস শুধুমাত্র এই কারণেই এই সিনেমা কোনদিন ভুলতে পারবে না।

গ্রেগোরি চাকরে-র ‘ব্যালাড অব এ সোলজার নিয়ে লিখতে গিয়ে একটা কবিতা মনে পড়ে গেল। রবার্ট বার্নসের ‘এ রেড, রেড রোজ – ‘Till all the seas gang dry, my dear/ And the rocks melt with the sun, / I will love thee still, my dear/ While the sands of life shall run.’। এই সিনেমা যেন ভালবাসার কবিতা। সেলুলয়েড বন্দী দেড় ঘন্টার এক কবিতা। এক যুবক-যুবতীর রোমান্টিক আখ্যান, এক বিবাহিত দম্পতির নিঃশব্দ ভালবাসার গল্প, সন্তানের প্রতি মায়ের ভালবাসার টান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ১৯ বছরের এক রাশিয়ান সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের জন্য এক মেডেল পায়। কিন্তু সেই মেডেলের বদলে সে কয়েকদিনের জন্য তার বাড়ি ফিরতে চায়, যাতে সে তার মা-কে দেখতে পায় ও বাড়ির ছাদ মেরামত করতে পারে। ফেরার সময় সে তার সাথে আরেক সৈনিককে নিয়ে ফেরে যার একটা পা যুদ্ধক্ষেত্রে কাটা গেছে। যদিও সে আর বাড়ি ফিরতে উৎসাহিত নয় কারণ তার মনে হয় তার স্ত্রী হয়ত আর তাকে মেনে নেবে না, কিন্তু বাড়ি ফেরার  পর দেখা যায় তার স্ত্রী তাকে আগের মতই ভালবাসে। ১৯ বছরের সেই সৈনিক এরপর এক অফিসারকে ঘুষ দিয়ে তার বাড়ির দিকে রওনা দেওয়া এক মালবাহী ট্রেনে উঠে পড়ে। সেই ট্রেনে সে এক রিফিউজি যুবতীর সান্নিধ্য লাভ করে এবং তাদের মধ্যে রোমান্টিক সম্পর্ক তৈরি হয়। সেই যুবতী তার গন্তব্য স্টেশনে নেমে যাবার পর ট্রেনে এক বিস্ফোরণ হয়। সেই সৈনিক কোনমতে  অবশেষে তার বাড়ি অব্দি পৌঁছয়, তার মাকে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য দেখতে পায়, আবার বেরিয়ে পড়ে, কারণ ছুটি শেষ। তার মা তাকে বিদায় দিয়ে আবার অপেক্ষা শুরু করে ছেলে এরপর কবে ফিরবে সেই আশায়।

যুদ্ধের আবহে বেদনাদায়ক ভালবাসার ছবি। যা কবিতার মত বয়ে চলে। প্রতি ফ্রেম অনবদ্য। বেশ ভাল লাগে ট্রেনের সেই অল্পবয়স্ক যুবতীর ভূমিকায় যানা প্রোখোরেঙ্কোর সহজ সরল আপনভোলা অভিনয়। এবং এক ১৯ বছরের সৈনিকের চোয়ালচাপা দেশভক্তি কিন্তু যুবতীর স্পর্শ পাবার জন্য তার স্বাভাবিক আকর্ষণ ও যৌন আকাঙ্ক্ষা। এই সিনেমাকে সেই সময়ের ‘socialist realism  with a human face’ বলা হত। ক্যামেরার কাজও বেশ ভাল। ডিপ ফোকাস সিনগুলো দেখার মত।

বার্গম্যান ও কিউব্রিকের পর এক্সপেরিমেন্টাল থিম নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজের তালিকায় যার নাম আসবে, সেই পরিচালক হলেন তারকোভস্কি। তাঁর  পরিচালনা করা ছবির লিস্টে ধর্মীয়, কল্পবিজ্ঞান, আধাভৌতিক, সব রকম থিম রয়েছে। তাঁর বৈশিষ্ট্য হল ক্যামেরার স্লো মোশন, লং টেক এবং বিভিন্ন ফ্রেমে  স্বপ্নের মত চিত্রকল্প ফুটিয়ে তোলা। মোট ২৪ বছরের ফিল্ম কেরিয়ারে তিনি মাত্র সাতটা ছবি তৈরি করেছিলেন এবং তার শেষ দুটো রাশিয়া থেকে স্বেচ্ছা  নির্বাসিত অবস্থায়। বোঝাই যায় কী রকম মানসিক চাপ নিয়ে তিনি ৫৪ বছরের ছোট জীবন কাটিয়েছেন। এখানে তাঁর দুটো সিনেমা নিয়ে আলোচনা করব যাতে  পাঠকের কাছে তারকোভস্কির কাজ ঠিক করে ফুটিয়ে তোলা যায়।

মনে করে দেখুন, আমি কিন্তু এই লেখার ১১ নম্বর পর্বে পৃথিবীর সেরা ১২ ক্লাসিক মাস্টারপিস সিনেমার লিস্টে তারকোভস্কির ‘মিরর’ রেখেছিলাম। আজ  সেই সিনেমা নিয়েই আমাদের পরবর্তী আলোচনা। এর আগেও বলেছিলাম যে কীভাবে একটা সিনেমা গ্রেট হয়ে ওঠে। নিজস্বতা, অনন্যতা ও স্বতন্ত্রতা, এগুলোই গ্রেটনেসের পরিচয়। দর্শক যদি সিনেমা থেকে নতুন কিছু না পায়, সে সেই মুভি গ্রেট হিসেবে মেনে নেবে না। সেদিক দিয়েই বরং মিরর-কে কাটাছেঁড়া করা যাক।

১০৬ মিনিটের ছায়াছবি। মৃত্যুশয্যায় থাকা এক কবির মানসচেতনে একে একে ফুটে উঠছে তার ছেলেবেলা, তার মা, তার গ্রাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি এবং সেইসব সময়ের কথা যা তার সুখ দুঃখের সাথী। তার স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে রোজকার সংলাপ ফুটে উঠছে, কখনো মাথায় আসছে তার বাবা-মায়ের ডিভোর্সের বেদনা। অবশ্য এই পুরো ন্যারেশন নন-লিনিয়ার, এরসঙ্গে মিশে আছে স্বপ্ন, ফ্ল্যাশব্যাক, কবিতা। সিনেমা বারবার ঘোরাফেরা করেছে যুদ্ধের আগে, যুদ্ধের সময় ও যুদ্ধের পরের ঘটনায়। প্রধান চরিত্রের স্মৃতির পাশাপাশি ফুটিয়ে তুলেছেন আরেক চরিত্রের স্মৃতি। অবজেক্টিভ। সব মিলিয়ে আধুনিক স্ট্রিম অব কনসাসনেস ভরা ফ্রেম। এক কথায় অদ্ভুত ও অনবদ্য।

এই সিনেমার প্রধান কাজ হচ্ছে ক্যামেরার কাজ। কালার, সাদা-কালো ও সেপিয়া, এই তিন ধরনের রং নিয়ে পরিচালক ফ্রেম থেকে ফ্রেমে খেলা করেছেন। আবার একই ব্যক্তিকে দিয়ে বিভিন্ন চরিত্র ফুটিয়েছেন। ফলে তাঁর কাজ যারা আগে দেখেন নি, তাঁরা বিভ্রান্তিতে পড়বেন। দর্শক বুঝতেই পারবেন না,   এই সিনেমার চরিত্র আসলে পরিচালকেরই আরেক ছায়া। সময়কে নিয়ে ফ্রেম থেকে ফ্রেমে খেলা করেছেন যা অন্য কোন শিল্পকর্মে এভাবে সম্ভব নয়। তারকোভস্কির নিজের কথায় – ‘no other art can compare with cinema in the force, precision and starkness with which it conveys awareness of facts and aesthetic structures existing and changing with time’। এবং এই টাইমফ্রেমের বদলে যাওয়াই মিরর-কে স্বতন্ত্র করে তোলে। পরিশেষে, এই ছবির প্রেক্ষিতে আবার বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, অস্কার কমিটি বাঁধা রাস্তা ছেড়ে অচেনা রাস্তায় নামতে শেখেনি।

এরপর ‘স্টকার’। ১৯৭২ সালের বিখ্যাত উপন্যাস ‘রোডসাইড পিকনিক’  অবলম্বনে তৈরি ২ ঘন্টা ৪০ মিনিটের ছবি। কী নেই এই সিনেমায়? কল্পবিজ্ঞান,  দর্শন, মনস্তত্ব, রূপক ও জটিলতাকে কী করে একসঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যায়, তার পরীক্ষাগত উদাহরণ স্টকার। আমি এই সিনেমাকে আমার লেখার ১২ নম্বর  পর্বে ৭০ দশকের সেরা দুটো এক্সপেরিমেন্টাল বা আর্ট-হাউজ সিনেমার মধ্যে রেখেছিলাম। যদিও আলোচনার পরিসর হয়নি।

কোন এক অজানা দেশে ও সময়ে এক সংরক্ষিত এলাকা আছে যা সবার কাছে ‘জোন’ হিসেব পরিচিত। সেখানে নাকি অনেক রহস্যময় ঘটনা ঘটে। এক চোরাগাইড সেখানে দুজনকে নিয়ে যায় – এক বেদনামুখর সাহিত্যিক ও এক প্রফেসর যিনি আবিষ্কার করতে ভালবাসেন। সেই ‘জোন’এ নাকি দীর্ঘ টানেল পেরিয়ে এমন একটা ঘর আছে যা মানুষের ভেতরে চাপা কামনা-বাসনাকে সাকার করে। এরপর অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে চলে। শেষ দৃশ্যে সেই গাইডের বাড়ির সামনে দিয়ে ট্রেন চলে যায়, গোটা বাড়ি কাঁপতে থাকে।

এই সিনেমার ‘জোন’ পরবর্তীকালে চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর ‘চেরনোবিল এক্সক্লুশন জোন’ হিসেবে কুখ্যাতি পেয়েছিল যেহেতু এই সিনেমায় পাওয়ার প্লান্ট  গোছের কিছু একটা পেছনে দেখান হয়েছিল। যাইহোক, এই সিনেমায় প্রথমেই বলি মিউজিকের কথা। তারকোভস্কি মনে করতেন সঙ্গীত হচ্ছে প্রতি সিনের চিত্রকল্পের সমান্তরাল এক বিকল্প যা পালটে দিয়ে একটা গোটা চিত্রকল্পের মানে বদলে দেওয়া যায়। তিনি এটাও বলতেন যে যেখানে প্রতি সিনে পারস্পরিক  লেনদেন আছে, সেখানে আবার মিউজিকের বদলে বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করা যায়। এই দর্শনের সদব্যবহার হয়েছে স্টকার সিনেমায়। যেমন, জোনের দিকে তিনজন যত এগোচ্ছে, তত জলের শব্দ বাড়ছে। ফলে বোঝা যাচ্ছে জোন আসলে এক ভেজা জায়গা। এরপর ফটোগ্রাফি। মানুষের মাথা যে ফটোগ্রাফির সাবজেক্ট হতে পারে, সেটা এই ছবি দেখে পাঠক নিশ্চয় বুঝেছেন। এমনকি ডায়লগ ও নৈঃশব্দ, দুটোই লক্ষ্য করার। আসলে এই ছবি ছিল এক রূপক,  তৎকালীন শিল্পের ওপর রাজনৈতিক চাপ ও সেই চাপমুক্তির সুপ্ত ইচ্ছে। এই ছবি খুব ভালভাবে দেখলে বোঝা যায়, তারকোভস্কি সামাজিক বুর্জোয়াদের বাঁধন আর সহ্য করতে পারছিলেন না, তাঁর মনের সুপ্ত বাসনা ছিল রাশিয়া ছেড়ে চলে যাবার।   

এলেম ক্লিমভের ‘কাম অ্যান্ড সি’ ১৪২ মিনিটের এক যুদ্ধবিরোধী সিনেমা।  ১৯৭৮ সালের উপন্যাস ‘আয়াম ফ্রম এ ফিয়ারি ভিলেজ’ অবলম্বনে। গোটা ছবি  জুড়ে শুধু নাৎসি বাহিনীর তান্ডব ও অত্যাচার। জার্মান নাৎসি বাহিনী যখন বেলারুশ দখল করে রেখেছিল, তখন এক কিশোর ফ্লোরিয়া একদিন তাদের গ্রামের পরিত্যক্ত ট্রেঞ্চে এক রাইফেল পায়। তারপর তার মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বেলারুশ স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেয়। সেখানে একটি মেয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। এবং তারা গ্রামে ফিরে আসে। এসে দ্যাখে সেই গ্রামের ৬২৮ জন গ্রামবাসীকে একসঙ্গে পুড়িয়ে মারার বীভৎসতা, একইসঙ্গে হিটলারের ফটো ভেসে ওঠার বৈপরিত্য। ফ্লোরিয়ার কাছে যুদ্ধ দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠে। হতাশ হয়ে সে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যায়।

যেটা বলে শুরু করতে চাই, তা হল, এই সিনেমার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বেশ শক্তিশালী আর উপস্থাপনা মনে রাখার মত। এটা এমন এক সিনেমা যেখানে বেঁচে থাকাই কষ্টের। সিনেমায় বাস্তব, পরাবাস্তব আর জাদুবাস্তব একসঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সাথে মনস্তাত্তিক আর রাজনৈতিক মোড়। এই সিনেমার আরেক বৈশিষ্ট্য এর বৈপরিত্য। ক্লিমভ বেশ নিপুণ হাতে একদিকে যুদ্ধের দৈত্যাকার চেহারা আর মাঝে মাঝেই অন্যদিকে রূপকথার মত কিছু ছবি স্ক্রিনে তুলে ধরেছেন। এর পাশাপাশি যদি যুদ্ধবিরোধী ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ আর ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ রাখা হয় (দুটো সিনেমাই এর অনেক পরে তৈরি হয়েছে), তাহলে দেখব  যুদ্ধের বর্বরতা দেখানোর জন্য এই ছবি কিন্তু বেশি মারাত্মক। তেমনি সুন্দর এর ক্যামেরার কাজ। অন্ধকার মাঠে হঠাৎ কমলা দাউদাউ আগুন জ্বলে ওঠা বা সকালের ঘন কুয়াশা ভেদ করে আচমকা জার্মান বাহিনীর একদম সামনে চলে আসা, এগুলো মনে রাখার মত।

রাশিয়ান সেন্সরশিপের কাঁচি বাঁচানোর জন্য এবং এই সাহসী সিনেমা যাতে পাঠকের কাছে পুরোটা তুলে দেওয়া যায়, তার জন্য ক্লিমভকে পাক্কা আট বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এরপর উনি আর কোন সিনেমা করেননি। জিজ্ঞেস করা হলে বলেছিলেন – ‘I lost interest in making films… everything that was possible I felt I had already done’। বোঝা যায়, রাজনীতির চোরাগোপ্তা মারপ্যাঁচে স্পষ্টতই হতাশ হয়েছিলেন। তাহলে পারাজানভ থেকে শুরু করে তারকোভস্কি হয়ে ক্লিমভ অব্দি, বুঝতে পারছেন, রাশিয়ান রাজনীতি সে দেশের শিল্প ও সাহিত্যেকে কতটা চেপে রাখার চেষ্টা করেছে?   

আজকের শেষ আলোচনা ‘লেভায়াথন’। ইহুদি রূপকথায় ‘লেভায়াথন’ মানে এক  প্রকান্ড ও শক্তিশালী সামুদ্রিক দৈত্য। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে এর মানে শক্তিশালী রাজনৈতিক বুর্জোয়াতন্ত্র। আন্দ্রে জিয়াগিনশেভের ‘লেভায়াথন’ সেই রকম এক বুর্জোয়া রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে এক সাধারণ মানুষের যুদ্ধ দেখাতে  চেয়েছে। রাশিয়ার এক ছোট্ট বন্দরশহরের এক জেলে-কাম-মেকানিক সেখানকার দুর্নীতিবাজ মেয়রের বিরুদ্ধে কোর্টে গিয়ে লড়াই করতে বাধ্য হয়। কারণ সেই মেয়র সেই জেলের বাড়ি, জমি আর গ্যারাজ আত্মসাৎ করে নিয়ে  সেখানে একটা মোবাইলের টাওয়ার বসাতে চায়। সাহায্যের জন্য জেলেটি মস্কো থেকে তার পুরনো দিনের এক বন্ধুকে ডেকে পাঠায়, যে মস্কোর বড় একজন উকিল। দুজন মিলে মেয়রের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে এবং ঠিক করে মেয়রের দুর্নীতি ফাঁস করবে। কিন্তু কোর্টে কেস শুরু হবার পর সেই মেকানিককে এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের জন্য অ্যারেস্ট করা হয়। কোর্টে মেয়রের জিত হয়। এরপর সেই জেলের পরিবারে একে একে অশান্তি শুরু হয়। তার স্ত্রী সুইসাইড করে। ছবির শেষে দেখা যায় সেই জেলের বাড়ি ভেঙে সেখানে এক চার্চ তৈরি হচ্ছে।

যদিও এই ছবির স্ক্রিন-প্লে দারুন, কিন্তু আমি এই ছবিকে আগের সিনেমাগুলোর মত প্রচুর নম্বর দেব না। এর বেশ কিছু ভুলভ্রান্তি আছে। কিন্তু যে জায়গায় লেভায়াথনকে সাবাস বলতেই হবে, তা হল, বেশিরভাগ রাশিয়ান ছবির যুদ্ধ ঘেঁষা প্লট ছেড়ে বেরিয়ে এই সিনেমা সাধারণ রাশিয়ান মানুষের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে  এক সাদামাটা গল্প বলেছে, যা মাটির কাছাকাছি। রাজনীতির ধূর্ত মারপ্যাঁচগুলো দেখিয়েছে। এবং রাশিয়ান সরকারের সাংস্কৃতিক বিভাগ এই ছবি প্রকাশের পর বিরুদ্ধতা করেছিল। (ভাগ্যিস নিষিদ্ধ করেনি!)

১৪১ মিনিটের এই সিনেমার স্ক্রিন-প্লে কাটাছেঁড়া করলে আমরা আরেকটা ডাইমেনশন খুঁজে পাব। এর সিনগুলো খুব ভালভাবে উলের মত ঘন বুননে বাঁধা। এর প্রতি সিনের গড়ে ওঠা ড্রামা কিন্তু কখনোই ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছয় না, অন্তত জিয়াগিনশেভ সেভাবে দেখান না। যেটা উনি প্রতিবার করতে থাকেন, তা হল, ড্রামা শুরু হয়, পাক খেতে থাকে এবং হারিয়ে যায়। ঘড়ির কাঁটা যেমন ঘুরেই চলে। আস্তে, নিয়ম মেনে। পরিচালক পর্দা না ফেলা অব্ধি দর্শক সেই মেথডিকাল ড্রামা দেখতে থাকে। এবং এই সিনেমার স্ক্রিন-প্লে’কে আমি সমালোচক হিসেবেও বাহবা দেব কারণ এখানেই প্রথম জিয়াগিনশেভ তার  সিনেমাগুরু তারকোভস্কির প্রভাব ছেড়ে সচেতনভাবে বেরিয়ে এসেছিলেন।  

ব্যাস, আজ এই অব্ধিই। একটা সিনেমা ইচ্ছে থাকলেও এই লিস্টে রাখলাম নাঃ আকিরা কুরোসাওয়ার ‘দারসু উজালা’ (১৯৭৫)। এই বিখ্যাত জাপানি  পরিচালকের একমাত্র রাশিয়ান ছবি। প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক নিয়ে অনবদ্য সিনেমা। সময় পেলে দেখে নিতে অনুরোধ করব।

রাশিয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আপাতত ইউরোপ ভ্রমণ শেষ করলাম। এরপর  আমরা এশিয়ার কয়েকটা দেশের ছবি আর লাতিন আমেরিকার ছবি নিয়ে আলোচনা করব। তারপরের কয়েকটা পর্বে আমরা নতুন করে জেনে নেব আমাদের প্রিয় কিছু নায়ক নায়িকাদের অনবদ্য সব ছবির কথা। সেটা শেষ করে আবার বিশ্বভ্রমণে বেরোব। তখন সময় হলে আবার ইউরোপের সিনেমায় ফিরব।

(ক্রমশ)

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন