কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

মৌ চক্রবর্তী

 

মিথ অভিনেত্রী শাঁওলী মিত্র




সে বা তিনি শিশুশিল্পী। সে ডাকঘর-এর অমল। অমল চরিত্রটি বালক হলেও, শিশুদের ক্ষেত্রে অভিনয়ে এরকম হয়েই থাকে মঞ্চ ও সিনেমার অভিনয়ের জন্যে। শিশুশিল্পী হিসেবে তাঁর অভিনয় বহুরূপী দলের নাট্য প্রযোজনায়। এটি বিশেষ এক সূচনা হিসেবে ধরা গেল। তারপর মেয়েটি বেড়ে উঠল নাটকের পরিবেশে। কারণ, বাবা শম্ভু মিত্র এবং মা তৃপ্তি মিত্র। নাটকের সংসারে নাটকের পরিবেশে বেড়ে উঠতে থাকল সে বা শিশুকন্যেটি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর নামকরণ হয় শাঁওলী। এর অর্থ বাঙালি মাত্রেই জানেন, শ্যামলা মেয়ে। কখন খাওয়ার টেবিলে ঘুমিয়ে যাওয়া খেতে খেতে। কখনও সাজঘরে বসে স্কুলের পড়া করে নেওয়া। এত মনোযোগী ছাত্রী শাঁওলীকে দেখে বাবা শম্ভু মিত্র অবাক। কেন, এত পড়া, পরীক্ষার কম্পিটিশনে যাওয়া! আরে  বাবা, যে মেয়ে নাটুকে পরিবারে জন্মেছে, সে তো নাটকই করবে! আর মেয়ের তখন  নাটকে হাতেখড়ি হলেও, মনের ভেতরে দানা বাঁধেনি নাটকের প্রতি ভালবাসা। তবে, রাতদিন বাড়িতেই রিহার্সাল দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠার প্রভাব থেকেই যায়। প্রতিদিন সংলাপ শুনতে শুনতে কিন্তু গেঁথে যায় শিশু মস্তিষ্কে। আওড়ে ফেলে যেখানে সেখানে। কিছু মজা রয়ে যায় শিশুর অভ্যন্তরে। এও তাই, কলকাতা দূরদর্শনের সাক্ষাৎকার দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, কী প্রাণবন্ত! টাটকা কথা, তাজা অভিনেত্রী বা শিল্পী বা  মানুষটা এখন আর নেই। সেই সুধাকণ্ঠী বাচিক শিল্পী আর নেই। এ যা লিখলাম তা সৌজন্য আন্তর্জালিক মাধ্যমে পাওয়া, শোনা ও দেখা যাবে। এহেন সংরক্ষিত ও বহমান থাকবে তাঁর গুণমানসম্পন্ন অভিনেয় কর্ম। এখানেই লেখা শেষ হলে, আরেকটি শিল্পীর কথা না-জানা থেকে যায়। সদ্য প্রয়াত হওয়ার সূত্রে তাঁকে ঘিরে কিছু প্রবন্ধ এবং লেখা ভাসছে গণ-মাধ্যমে। সেই লেখা পড়তে গিয়ে মনে হল আরেকটি চেনা শিল্পীর অজানার লেখা হতে পারে। জানা মধ্যেই তো এক অজানা শিল্পী মানুষটির দেখা মেলে। সেই দেখাই ২০২২-এ লিখতে থাকলাম।

শাঁওলী মিত্র-কে নিয়ে পড়েছি পরে। জেনেছি আর দেখেছিলাম আগেই। তখন কলকাতার গিরিশ মঞ্চে নাট্য অ্যাকাডেমি আয়োজিত অভিনয় নাট্য কর্মশালা চলছিল।

সাল ২০০৬, ২৬ জুন থেকে ২ জুলাই ছিল এর সময়। এরই একটি দিনে তিনি এসেছিলেন সেই প্রশিক্ষণ শিবিরে শেখাতে। কালো শাড়ি। গোল টিপ। 'নাথবতী অনাথবৎ' –এর আংশিক পাঠ ও অভিনেয় পরিবেশনা করে দেখাবেন তিনি। আলো নিভতেই মুহূর্তে হলেন দ্রৌপদী। আশ্চর্যের যে, এততুকু না বুঝেও যেন দাগ কেটে গেল স্বর, কথা, ধ্বনি। সুর শুধু গানে থাকে না। থাকে কণ্ঠেও। তাই যেন আবৃত করে দিল। কর্মশালা জুড়ে নাট্যকর্মীদের মরমে পশিল যেন। অভিনয় করার ব্যাকরণ বুঝিনি তখনও। তাঁর কণ্ঠের ওঠানামা অনুভূতি, আবেগ এসবও যেন বুজিয়ে দিল গলা। সাধারণত, শিল্পীদের নিরপেক্ষ হতে হয়। কিন্তু শ্রোতা হলে? সেই দায় থাকে না। অমনি তাঁকে বলেছিলাম, বা বলতে পেরেছিলাম, পারি না দিদি, আমি কিচ্ছুটি পারি না।

তিনি যেন জানতেন আমি কী বলব, টেকনিক্যাল নাটকের সংলাপের রিহার্সাল ছাড়াই  চার সেকেন্ড পজ। তারপর উত্তর দিলেন, আমিও জানি কতটুকু শিখছি এখনও। এই যেভাবে তুমি বললে, জানি না দিদি। জানি না। আমার কথা ওঁর গলায় সুরে খেলে গেল। বললাম, দিদি, আমি পারব না। বললেন, সেই না, পারাটাই তো জানা নিজেকে। এই যা তুমি জান, তুমি পারো আর পারো না কতটা। এইটাই তো তোমার অভিনয়  করতে জানার প্রথম শর্ত। সেখানে জুড়ে দিলেন নিজের ছোটবেলার কিছু কথা। কথা মানে, গল্প। জানা গল্প। অজানা সময়ের। একটি নক্ষত্রের অবয়ব যেন মিশে গেছে উইংস থেকে আড়াল করাটা জানতাম। শিখেছি এটুকুই যে, উইংয়ের কোথায় দাঁড়ালে আর দেখা যায় না অভিনেতাকে। আর শাঁওলীদি, ঘিরে বসে সব্বাই। মনে হচ্ছে উনি পদ্মাবতী। মনে হচ্ছে উনি সরস্বতী। আর আমরা ওঁর পাশে ছড়িয়ে থাকা শালুক বা পদ্মপাতা। সেই পাতার এক বিন্দু জলকণা যেন না পড়ে হারিয়ে যায়। সেই চেষ্টায় রইলাম। অভিনয় বুঝি না ভেবে এদ্দিনে শান্তি পেলাম। এভাবেই ওঁর সামনে ছোট  থাকা গেল, থেকে যাওয়া গেল। কিন্তু অভিনয় করতেই হল। কী যে বিস্ময়ে জেগেছিল  সেই তাঁর দুচোখ। অনুজ অচেনা অপারদর্শী আমার ভেতর তিনি খুঁজতে চেষ্টা করছিলেন – সন্ধান, যা গবেষণার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। একমাত্র নিরুপায় আমিটাকে অভিনয় নামক কঠিন কাজের মধ্যে ফেলে পালিয়ে আসতে পারিনি। হয়নি সেটা। পালা করে সবাইকেই টুকরো কিছু অভিনয় করতে হচ্ছিল। তবে এটুক বোঝা গেল, ওঁর কাছে সবটাই শিল্প, নাটক বা গুরুত্বের। আমরা অভিনয় করছি বলে উনি কিন্তু মনোসংযোগ হারাননি। এই শ্রদ্ধায় অবনত হই আজও। কারণ, প্রকৃত শিল্পী তিনিই যিনি শিল্পের সাধনায় রত নবিশদেরও সম্মান করেন। তিনি কাজ শেষে চলে গেলেও আমরা প্রশিক্ষণ শিবিরে ছিলাম। 'সেখানে ছিলাম আমি...' জীবনানন্দ কবির এটুকু নাড়া দিচ্ছিল। রাতের মঞ্চে বসে ছিলাম। আলো নেভা এক দৃশ্যে তিনি ফের এসেছিলেন যেন। না শেষ হওয়া কথাগুলো বলতে, 'বাবুমশাইরা...'। নরম আবহে রয়ে গেল দিদি। অভিনেত্রী শাঁওলী মিত্র। এভাবেই লক্ষ কোটি অনুজদের মধ্যে বেশ হারিয়ে থাকলাম।

আড়ালে আবডালে দেখতাম তাঁকে। সবার দিদি। কিন্তু আমার কাছে ওই এক চরিত্র।  তারপর অনেক অনেকবার তাঁর অভিনয়ের ব্যাকরণ বুঝে তারিফ করেছি আয়নার  সামনে। আর ভয় পেয়েছি অভিনয় কত সহজে করেছেন ভেবে, কত কঠিন যা। কাচ সাধারণত সব দেখায়। দেখতে দেয় ওপাশে এপাশে। আমিও তাই ছিলাম। নক্ষত্র সমাবেশে দেখা হলে, তাঁরা হতেন আলোচক। আমি মুগ্ধ এক ক্ষুদে অপটু ভক্ত  তাঁর। সবসময় বাছতাম আড়াল। ওই আড়াল শিশির মঞ্চের পেছনের বাড়িটার সৌন্দর্যরক্ষা করে ছায়া নেমে এলে। সেখানের দোতলা ঘরে কখনও একতলায় নাট্যপাঠের আসর বসত। পাঠ করতে আসতেন নাট্যকারঅভিনেতা মনোজ মিত্র। নাট্যকার-নির্দেশক  চন্দন সেন। এবং একদিন এই ক্রমে তিনি ফের এলেন। আগেই জানতাম। নাট্য একাডেমী থেকে অজন্তাদি (অজন্তা ঘোষ) খবর দিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন গণনাট্য  সংঘের অনেক বরিষ্ঠ সদস্য এবং গ্রুপ থিয়েটারের অভিনেতা, নাট্যকর্মী প্রমুখ। আর ছিলাম নগণ্য আমি। সঙ্গে আমার লজ্জা, না পারার লজ্জা। না জানার লজ্জাবোধ। দূরেই ছিলাম তাই। রক্ষা তবুও হল না। বাঙালি নারী, কৃষ্ণবর্ণা কৃষ্ণা আমার কাছে এসে, বেঁকে চলে গেলেন পাঠ শুরুর আগে মঞ্চে বসলেন। সবাই মুগ্ধ। অপূর্ব এক সন্ধ্যা। তিনি যেতেন ওই দূরের দিকে। কাচ। দেওয়াল। তারপর আমি। দাঁড়িয়ে বুঝতাম কতটা  দূরে তিনি। মনে পড়ত সংলাপ, ওই নারী, যিনি কথক থেকে চলে যাচ্ছেন চরিত্রে।  আর স্পর্শ  করেছেন আগামীকে, আলোচকদের। আমাদের বুঝিয়ে তুলেছেন  নারীজাতির সংজ্ঞা। মাতৃসত্তা থেকে নয়। যে কথক কথার চেয়েও বেশি স্পর্শ করছেন ব্যথা দিয়ে। সেই আরেকবার দেখা তাঁর পারফরমেন্স। শিল্পী হিসেবে দেখা। চেয়ার  টেবিলে বসে তিনি। শুধু কথা দিয়ে অভিনয়। সেও নাটকের সংলাপ। নড়বড় করে উঠল আমার চেয়ারের হাতলটা। পড়ে না যাই, তাই ধরে থাকলাম। অন্ধকারে  পিনপতন শব্দে মোচড় দিল আলো। কক্ষের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয় শুধু মঞ্চের আলো জ্বলে নাটক পাঠের সময়। আরও অনেকেই ছিলেন। আমিও ছিলাম। অদৃশ্য সেদিন আমি বসে পড়েছিলাম মঞ্চের একপাশে। সম্বিৎ ফিরতেই সবাই কথা বলছেন শুনলাম।  নাটক-জগতের  মহীরুহদের সমাবেশ থেকে একজন শাড়ি, বেণী, চুলের ফুলে এসে দাঁড়ালেন। গাছের ডালে কলকাতার রাত-আকাশের চাঁদ। সেদিন পূর্ণিমা হবে বা। সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ভুলে যেতে হয়।

সেদিন চাঁদ ছিল গোলপানা পূর্ণিমা হবে। জোছনার রঙ। ওঁর চুলে ধরেছে সেই রঙ। অকৃত্রিম রঙ, স্নিগ্ধ। কেশবিন্যাসে ওঁর প্রাকৃতিক রঙ, কৃত্রিম ছোঁয়াচ নেই। মুগ্ধ দিদি, অসাধারণ, আপনি তো পাঞ্চালীকে দেখালেন কীভাবে ধারণ করতে হয় সত্তা। পাঠ  শেষেও রয়ে গেছে। বললেন, তাও কিছু খামতি রয়ে গেছে। যেমন... ঐ যে ওখানটায়, একটু যেন বৃন্তছিন্ন হয়ে যাওয়া ফুলের মতন সুর কাটল। সকলেই বললেন যে, না তো বুঝতে পারিনি আমরা। উনি হাসলেন, বললেন, আমি বুঝেছি কেটেছি। এরপর গ্রুপ থিয়েটার পত্রিকার দেবাশিসদা বললেন, শুনলে, এই হল শিল্পী। পারফেক্ট শিল্পী। ততক্ষণে ভেসে গেছি আমি। চাঁদের আলো পড়ে মরা সায়রের জলে। যেন স্নেহ। আমাকে ডাক দিতেই ফিরে এলাম দলে। আলোচনা শেষে তিনি যাবেন ফিরে বাসগৃহে। বলতে চাইলাম, দিদি আপনি তো মিথ অভিনেত্রী। দিদি আপনি তো শম্ভু মিত্রের কন্যে। তৃপ্তি মিত্রের যোগ্য দুহিতা। উত্তরসূরি। বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের এক সংজ্ঞা ও নির্ণয় সূত্র। তাঁকে এরচেয়ে আর কী বলি, বলতে গিয়ে সেই একই কথাগুলো বললাম,  অসাধারণ পাঠ করেছেন দিদি। শেখাবেন? হ্যাঁ, নিশ্চয়। গ্রীষ্মের রাত। যেন আঁচলে করে তুলে ছুঁইয়ে দিলেন নরম স্নেহ থুতনিতে। এস!

মনে পড়ছে। তন্ময় আমাকে কতবার যেতে হয়েছে ওঁর কাছে গুনতে পারিনি। সশরীরে না গেলেও বারবার গিয়েছি ওঁর ঘর বারান্দা আর সাজকক্ষে। আর অশরীরী তিনিও  দেখা দিয়েছেন বারবার। সাজঘরে, একাডেমীর বারান্দায়, অলিন্দে, সভাকক্ষে এবং লেখার এই সঞ্চারিত মুহূর্তে। কাঁপতে থাকা হাতটা ধরে আরও কেউ কতকিছু বলেছেন। তবে, রিহার্সাল না-থাকা সংলাপ এখনও ঐ চাতালে দাঁড়ালে শুনি, এস...! যা এখনও শাঁওলি মিথ, ঘিরে থাকে আমার ভুবন। 


2 কমেন্টস্: