কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০

অদিতি ফাল্গুনী



সমকালীন ছোটগল্প


জোসেফ কে-র যে গল্পগুলো কোনোদিন কাফকা লেখেন নি



(৪)


প্রিয় প্রাগ তোমাকেই তবু বলি...


তবু সব মিলিয়ে তার গোটা জীবনটার দিকে পিছে ফিরে তাকালে কে-র নিজেকে সৌভাগ্যবানই মনে হয়। ভার্সিটি থেকে বের হবার পর সে ভাল ভাল কাজ পেয়েছে। তার লেখার খুব হাতে গোণা হলেও কিছু সমঝদার আছে। আর নারী ভাগ্য... নিজেরই নানা সংশয় ও হেঁয়ালিতে সে আজো একা বটে... তবে অসুস্থ এক হ্যাংলা-পাতলা ইহুদি হিসেবে তার ত’ এতখানিও পাবার কথা না। সে নিজে বুদ্ধির অভাবে হোক বা ঘটনার পাকেচক্রে হোক... আজো হয়ত একা... কিন্ত অনেক রূপবান বা সুদর্শন তরুণও যা পায় না... যেমন তার মেজো কাজিন দিমিত্রফই তার থেকে ঢের বেশি সুন্দর হয়ে আর এখন একজন ভাল ব্যবসায়ী হয়েও... কি পেল? নেহাত বদখত এক ক্রিশ্চিয়ান মেয়ের জন্য বাবা-কাকা সবার সাথে বছরের পর বছর তর্ক করে, তারপর নিজেই ক্রিশ্চিয়ান হতে পারবে না এমন ভয়ে দেরি করতে করতে ঐ মেয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করে বসলো। গাধা দিমিত্রভ এখন নি:সঙ্গ। কাজ করে অনেক, মদ খায়। অথচ সুন্দরী মেয়ে জুটতে পারত বলে দিমিত্রভের ভাগ্যে। তা’ না জুটে জুটলো কিনা জোসেফ কে-র? বলতে নেই প্রাগের সুন্দরীতমারা, পরী বা অপ্সরার মত মেয়েরা তার কাছে এসেছে ঝঁকে ঝাঁকে। তাদের দু/তিনজনকে কখনো কখনো... ক’দিনের জন্য হলেও তাকে মনে স্থান দিতে হয়েছে। অনেককে ত’ নির্মমভাবেই বাদ দিতে হয়েছে। রুগ্ন জোসেফ কে এত মেয়ের ভার নেবেই বা কিভাবে? এবং এই শরীরে তাকে ব্যঙ্কের কাজ ও পান্ডুলিপির কাজ করতে হয়। এরপর আবার নারী? সংসার? এই নারীদের ভেতর তাকে সবচেয়ে বেশি দিয়েছে কে? হে ঈশ্বর... নাতালীই ত’ ঝুড়ি উপুড় করে দিতে চেয়েছিল... বোঝেনি কেন জোসেফ কে? দরিদ্র দিনমজুর যেমন বুঝতেই পারে না যে সম্রাজ্ঞী তাকে সত্যিই ভালবাসে  কিনা, তেমনটা হয়েছিল? নাকি জোয়ার জন্যই আচ্ছন্ন ছিল সে? জোয়াই যে পরিচয়ের গত মোট ১৭ বছরে তার সাথে সবচেয়ে কৃপণ-বিরূপ-সন্ধিগ্ধ-ক্রুদ্ধ এবং সব দিক থেকে নেতিবাচক ব্যবহার করেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সোনিয়া হয়ত তাকে অনেক কিছুই দিতে চেয়েছিল তবে ইহুদি পাড়ার মেয়ে... দুই দিনে চার কথা হলেই বিয়ের কথা এসে পড়বেই আর সংসারে সে এখনি ঢুকবে না এমন নানা উদ্ভট চিন্তায় সোনিয়াকে সে কিছু করতেই দেয়নি তার জন্য? অথবা বলা অবলার ধার ধেরে কি হয়? নাতালীও ত’ তাকে চিনত না। এমনকি এই যে পোপোভাকে সে আজ দুষ্টা, চতুরা নারী ভাবছে... পোপোভাও কিন্ত ইতোমধ্যে তাকে না চাইতেই আশ্চর্য সব রঙ-রেখা উপহার দিয়েছে। পোপোভার সাথে যার মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল সেই মাদাম মার্ক্যুইস ত’ আরো বড় কাজ করেছিল জোসেফ কে-র জন্য। তবে কিনা মাদাম মার্ক্যুইসের বড়  তাড়া। কে-কে খানিকটা সাহায্য করেই সে এক্ষুনি যেন বিনিময়ে কিছু চায় এবং সেটা প্রেম যদিও তার বরও সবখানেই তার সাথে উপস্থিত... আর পোপোভার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার মুহূর্ত থেকেই পোপোভাকে নিয়ে সে উদ্বিগ্ন। তবু  অস্বীকার করা যাবে না যে নাতালীর পর পোপোভাই হাত খুলে কে-কে যেন দিতে চাচ্ছিল অনেক বিস্ময় ঝিনুক, জোনাক পোকা আর শঙ্খের সমাহার। কিন্ত  নিষ্ঠুর হয়ে উঠলো কে নিজেই। প্রবল আঘাতে অস্বীকার করলো সে পোপোভাকে। প্রিয় অপ্সরারা/পরীরা, তোমাদের পিতৃপুরুষেরা ইহুদিদের পূর্বপুরুষদের যে পবিত্রভূমি জেরুসালেম থেকে উচ্ছেদ করেছে আর শতাব্দীর পর শতাব্দী ইহুদিরা মার খাওয়া, বিতাড়িত ও উদ্বাস্ত... দুই সম্প্রদায়ের মাঝে অগণিত দাঙ্গা, লুণ্ঠন, হত্যা ও ধর্ষণের স্মৃতি এসে উভয়কেই বারবার পোড়ায়... আস্থায় অনাস্থা আনে... তবু তোমরা এই সংখ্যালঘুর ছেলেকে বড় কমও ত’ দিতে চাওনি। অনেক অনুরাগ, স্তুতি, কুর্ণিশ, সম্ভাষণ... হয়তো ইহুদির স্বদেশভূমি পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখা আমার সেসব আস্বাদ করা হয়নি... আবার সবই ত’ ঘৃণার ইতিহাসের তরবারীতে অস্বীকারও করা যায় না। এত কিছু আমার কাছে এমনিই কি করে এলো বা এসেছে? আমি ত’ খুব রূপবান নই, দুর্দ্ধর্ষ সৈনিক বা অশ্বারোহীও নই। তবে কি সত্যিই আমার কোন প্রতিভা ছিল বা আছে যার সামনে বিপরীত লিঙ্গের মানুষেরা এসে মাথা নুইয়েছে? জানি না - তবু বলি...এই প্রাগ আমাকে যা কিছু দিয়েছে, যতটা দিয়েছে তার জন্য আমি অনেক কৃতজ্ঞও বটে। আমি শুধু জেরুজালেমকে নয়, প্রাগকেও ভালবাসি - প্রাগকেই হয়তো বেশি ভালবাসি।


(৫)


তবুও জোসেফ কে… আমরা কি আমাদের জীবনের সত্য গল্পগুলো বলি?


দেখতে দেখতে আমাদের জীবনের গল্পগুলো ফুরিয়ে আসে। ক’দিনই বা বাঁচে মানুষ? জোসেফ কে ত’ জানে এই যে সোনিয়া-জোয়া-নাতালী-পোপোভার কথা ভাবাটা আসলে বোকামি ছাড়া কিছুই না। কারণ তার ক্ষয়কাশির অবস্থা দিন দিন খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। তুলনামূলক তরুণ বয়সে বা যখন তার স্বাস্থ্য আর একটু ভাল ছিল, তখনি সে কোন বিষয়েই নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। আর ত’ এখন? সোনিয়া... তার সম্পর্কে মামাতো বোন মিরানা কি সঠিক তথ্য দিয়েছে নাকি এক মেয়ের মুখে অন্য মেয়ের জুগুপ্সা? সত্যিই কি সোনিয়ার কোন দৈহিক বিচলন হয়েছিল? হলেই বা তোমার কষ্ট হবে কেন কে? তোমারও কি একাধিকবার মানসিক বিচলন হয়নি? কে-র বন্ধুরা অবশ্য বিশ্বাস করে না। সেদিন ত’ তার পান্ডুলিপি পড়ে শোনানোর পর পিটার হেসেই ফেললো, ‘আমরা আমাদের জীবনের সত্য গল্পগুলো আসলে বলি না। এত বয়সেও তোর কোন নারীর সাথে সত্যিকারের ঘনিষ্ঠতা হয়নি এটা হতেই পারে না।’
ইউজিন মজা করলো, ‘আমি কয়েকটা সত্য গল্প লিখেছি, পিটার।’

বেশ ত! কে মনে মনে ভাবে। তার একটি মাত্র বই গতবার যেটা বের হয়েছিল সেটা দশ কপির বেশি বিক্রি হয়নি বা লুকিয়ে সে জুয়া খেলতে গেছে বা অফিসে বসের সাথে ঝগড়া, একাধিক মানসিক বিচলনের গল্পগুলো বন্ধুরা গভীর আনন্দে বিশ্বাস করে, কিন্ত কে-এর এতটুকু ভাল কথা কেউ আর বিশ্বাস করে না। না করুক। নারী দেহ নিয়ে তার যে এই বয়সেও সত্যি বলতে ভীতি আছে সেটা সে কাকে বোঝাবে? মানসিক ভ্রষ্টতা বরং দৈহিক ভ্রষ্টতার চেয়ে বড় অপরাধ, একথা বলেছিলেন কে-র অনুষদের এক অধ্যাপক। ‘আমার স্ত্রীর কারো সাথে দৈহিক ঘনিষ্ঠতা হয়েছে এটা শুনলে আমি কষ্ট পাব না - কারণ রক্ত-মাংসের মানুষের হুট করে একটা ভুল হতেই পারে। তবে আমি যদি শুনি আমার স্ত্রী বছরের পর বছর কাউকে নিয়ে নিষ্কামভাবে শুধু মনে মনে ভেবে গেছে, তবে আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করবে।’ সবচেয়ে বেশি বছরের পর বছর কাকে ভেবেছে কে? জোয়াকেই ত’! কিন্তÍ জোয়া বিশ্বাস করেনি তাকে। একটি মুহূর্তের জন্যও  না। পরিচয়ের প্রথম পাঁচবছর ছিল নিষ্কাম পরিচয়ের বন্ধুত্ব। যেদিন থেকে অন্য কিছুর রং লাগলো, জোয়া কেনই বা তাকে এড়িয়ে যেত আবার তাকে অন্য কোন নারীর সাথে কথা বলতে দেখে অস্থির হত সেটাই এক ধাঁধাঁ। আবার কে পুরুষ হয়ে জোয়ার দু’বছরের ছোট বলেই যদি সরে যায়, তবে আজ সে চার বছরের ছোট ও বিবাহিত উইলহেলমের ভাল বন্ধু কি করে? বন্ধু হলেই প্রেম, তা’  নয়। তবে ওটুকু বা ওর চেয়ে অনেক কম সৌজন্য বিনিময়ের কারণে কেন সে নাতালীর সাথে কে-কে নিশ্চিত শয্যাসঙ্গী বলে ধরে নিয়ে বছরের পর বছর মনোবিকারে ভুগেছে? কে-র ডাকবাক্সে মাঝে মাঝেই অজানা প্রেরকের কাছ থেকে মোটা খামে যে নানা বিদ্রুপাত্মক কার্টুন ছবির সাথে কে একটি রাসপুটিন, লম্পট ইত্যাদি ইত্যাদি আসে, সেগুলো বোধ করি জোয়াই পাঠায়। প্রাগে আর কোন মেয়ের আজো কে-কে নিয়ে এতটা মাথা ব্যথা করার সময় আছে? এমনকি সোনিয়ারও নেই। সে ব্যঙ্ক নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর আনা? কে-র জীবন বা কল্পনার দ্বিতীয় ইহুদি নারীটি। যদিও থাকে বহু দূরে। মার্কিন দেশের ডালাসে। বাবা তার নামী ব্যবসায়ী। প্রাগের এক বাণিজ্য মেলায় পরিচয়। কে ইহুদি বলেই কিনা আনা একটা বছর নিয়মিত ফোন করত তাকে সুদূর ডালাস থেকে।
‘আনা- আর কথা বলতে হবে না । অনেক খরচ হবে।’
‘কিচ্ছু হবে না।’ বলতো আনা। হাসি-খুশি, মিষ্টি আর উচ্ছল গলা। কথায় কথায় হাসিতে গড়িয়ে পড়া স্বভাব ছিল মেয়েটির। তবে কোটিপতির মেয়ের ঘরজামাই হয়ে ডালাস গিয়ে কি করবে কে? এছাড়া তখনো তার বিশ্বাস ছিল যে জোয়ার হয়তো ভুল ভাঙ্গবে একসময়। এজীবনে তাদের আর কোনদিন স্বাভাবিক কথা না হোক, ভুলটা অন্তত: ভাঙুক। কিন্ত কেউ যদি ভুলটাকেই ভালবেসে রেখে দিতে চায়, তবে আর কিছু করার থাকে না। এছাড়া আনার আগেই সোনিয়ার কথা ত’ সে ভেবেছিল। কেমন গম্ভীর হয়ে যাওয়া সোনিয়া। বহুদিন হয় আনা আর তাকে ফোন করে না। কেনই বা করবে? কে কিছুক্ষণ কথা বলেই ক্লান্ত হয়ে যেত। পরের সকালের অফিস, কাজের চাপ, ভগ্ন স্বাস্থ্য... অথবা সে জানত যে হয়তো আনার কাছে যাবে না সে? যদিও আনাই এই সবার ভেতর সরলতমা? যে কাউকে অদ্ভুত খুশি করার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল আনার - জোয়ার একদম বিপরীত। জোয়া সত্যিই অদ্ভুত। অকারণে কোন মানুষ অন্য কারো প্রতি এত সন্দিগ্ধ, বিরূপ ও তিক্ত হতে পারে সেটা জোয়াকে না দেখলে সে বুঝত না। নাতালী কি চেয়েছিল আসলে তার কাছে? পুরো প্রাগের মানুষ নাতালী তাকে ভালবাসে বলে এক বছর বোঝানোর পর যেই না সে নাতালীর দিকে ঝুঁকেছিল, তখনি কিনা তার মার্কিনী ধনকুবের প্রেমিক এলো আর নাতালী প্রেমিকের অতীত বিচলন ক্ষমা করে ছুটলো? হা- হা কে-কে নিয়ে সে কি আসলে খেলতে চেয়েছিল? বোকা সোকা দেখতে কে-কে কোন নারীই এখনো একশো ভাগ বোকা বানাতে পারেনি, বুঝলে নাতালী? তুমিও না! আর পোপোভা? মাদাম মার্ক্যুইসের বান্ধবী? গত কয়েকদিনে পোপোভার সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন করেও হাল্কা অবসাদ যে লাগছে না তা’ নয়। মাদাম মার্ক্যুইস বোধ করি এটা আন্দাজ করতে পেরেই বহুদিন পর কে-কে ফোন করেছিলেন। আধা ঘন্টার মত কুশল আলাপের পর থেমে যায় কে। সে কেমন অবসন্নই বোধ করছিল আবার।
এই রে... বাসায় তর্কাতর্কি শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকদিন পর দিমিত্রফ এসেছে তার একার ব্যাচেলর কোয়ার্টার থেকে। উইক-এন্ডে। এ্যালেক্সেইয়ের সাথে ছোট-খাট বিষয়ে লাগে তার। এ্যালেক্সেই বাসায় ইহুদি ছাড়া কোন ভৃত্য রাখবে না আর দিমিত্রফ পারলে সব ইহুদিকেই বিদায় করে সবই ক্রিশ্চিয়ান ভৃত্য রাখবে। দু’জনকেই চরমপন্থী মনে হয় কে-র। এ্যালেক্সেইর ব্যবসার অংশীদার ত’ অনেকেই ক্রিশ্চিয়ান। ক্রিশ্চিয়ানদের এত অপছন্দ হলে সব ব্যবসার অংশীদার ত’ তারাই। আবার দিমিত্রফই বা কেন ইহুদি হয়েও জীবনসঙ্গী থেকে ভৃত্য... কোন ভূমিকাতেই ইহুদিদের দেখতে পারে না? ছোটবেলা থেকেই দিমিত্রফ শুধু ক্রিশ্চিয়ান পাড়াগুলোয় বেড়াতে যেতে চাইত। শুধু ক্রিশ্চিয়ানদের সাথে মিশবে। ‘একটা ক্রিশ্চিয়ান শক্ত-পোক্ত শ্বশুরবাড়ি পেলে আর কোন চিন্তা নেই, বুঝলি জোসেফ? তুই মূল ধারায় মিশে যেতে পারবি। ইহুদি হয়ে মরায় কোন গৌরব নেই।’
‘আমরা ত’ ইহুদিই। মানি একটি ইহুদি মেয়ে বিয়ে করলে তুই শক্ত শ্বশুরবাড়ি পাবি না। কিন্ত যে দুর্বল তার পাশেই ত’ বেশি থাকা উচিত।’ অবাক হয়ে বলত কে। পঁচিশের জোসেফ কে না বুঝলেও আজ উনচল্লিশে এসে কে বোঝে যে কোন দেশে সংখ্যালঘুর ভেতর দু’টো সত্বা দেখা দেয়। একটি এ্যালেক্সেইর মত নিজের অস্তিত্বকে আঁকড়ে ধরে আর একটি ঐ দিমিত্রফের মত পারলে নিজের সবটাই অস্বীকার করে সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে মিশে যেতে চায়। আবার পারলই বা কই দিমিত্রফ? শেষমেশ ক্রিশ্চিয়ান হবার সিদ্ধান্ত ত’ সে নিতে পারেনি। দিন কাটে তার এখন নানা কাজ আর সমাজসেবা করে। আর দুই বড় কাজিন বা ভাইয়ের ছায়ায় বেড়ে ওঠা জোসেফ কে হয়ে উঠেছে দু’জনের দুই সত্ত্বার টানাপোড়েনের ভারবাহী। একদিকে ইহুদি হিসেবে তার কর্তব্যবোধ তাকে রূপসী ক্রিশ্চিয়ান তরুণীদের দিকে ঠেলতে দিয়েও দেয় না, আর একটি সত্বা আবার তাদের কথা ভাবেও। সে শেষপর্যন্ত কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। দিমিত্রফের মন্ত্রণাতেই কিনা জানে না - সোনিয়াকে কষ্ট দিয়ে বা অবহেলা করে আবার প্রবল অনুতপ্তও হয়। কারো থেকে যোগ্যতা কম সোনিয়ার? কারো চেয়ে সে কম ভাল? তবু এক জীবনে শুধু ভুলই করা হলো কে-র আরো কারো প্রতিই তার হয়তো সুবিচার করা হয়নি। যদি না-ও করতে পারে, ওদের সবার গল্প এই দিনপঞ্জিতে লিখে ত’ রাখাই যায়।


(৬)


এপিলোগ


এই যে কে এত কিছু ভাবছে... বাস্তবে এত ভাবনাও অমূলক। সোনিয়াকে নিয়ে প্রথম তারুণ্যের দিনগুলোতে খানিকটা ভাবতে না ভাবতেই কে নিজেই ইনস্যুরেন্স কোম্পানীর কাজ বা পান্ডুলিপির প্রশ্নে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ে। বাড়িতে তখন দিমিত্রফকে নিয়ে ঝামেলাও চলছিল। দিমিত্রফের কাছে থেকেই কি তার আত্ম-ঘৃণা শেখা? ইহুদিরই ইহুদিকে অপছন্দ করা, যোগ্য না মনে হওয়া? যাক... সব কিছু দিমিত্রফের ঘাড়েই বা চাপানো কেন? আর কিছুদিন পরে বিয়ের বিষয়টি ভাবা যাবে এমন ভাবতে ভাবতেই জোয়ার সাথে পরিচয়। জোয়া বোধ করি অভিনয়ই করেছিল তার সাথে। অমন অভিনয় আজ তক অন্য কোন মেয়ে পারেনি। সেই একটা সন্ধ্যার অভিনয়েই আজো কি কে তার জন্য মনে মনে গোলামি করে? অথচ কি করলো জোয়া তার সাথে? না- এই সে কে-কে এড়ায় আবার তাকে ষোল বছরের কিশোরী থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধার সাথে কথা বলতে দেখলেও রাগ হয়, নাতালী কেন কে-র ভাল বলে তাই নাতালীকে জড়িয়ে যা হয়নি সেসব ভাবা এবং গত তিন/চার বছর ধরে প্রায় প্রতিদিনই ডাকে এক অদৃশ্য প্রেরকের কাছ থেকে কে যে লম্পট, দুশ্চরিত্র এসব ইঙ্গিতপূর্ণ কার্টুন বা গালাগালি সম্বলিত কাগজ-পত্র পাঠানো অথচ দিব্যি একাধিক বিবাহিত পুরুষের ভাল বান্ধবী এখন জোয়া। কোন মেয়ে কে-র সাথে কথা বললেও জোয়ার গায়ে ফোস্কা পড়ত, অথচ নিজেই কিনা এখন একাধিক বিবাহিত পুরুষের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বলে প্রাগে সবাই ঠাট্টা করে? তারপর নাতালীকে বুঝে ওঠার আগেই... নানা হট্টগোলে নাতালীর প্রতি মানসিক ভাবে ঝুঁকতে না ঝুঁকতেই নাতালী চলে গেল মার্কিনী মুল্লুক মার্কিনী প্রেমিকের সাথে? খুবই ভাল লেখার হাত ছিল নাতালীর। কিন্তÍ মার্কিনী মুল্লুকের মোহে বেচারীর জীবনে খরচ হয়ে গেল এতগুলো বছর। এক কি দু’টো বাচ্চার মা মনে হয় সে এখন। পনেরো বছর পর আবার প্রাগে এসেছে। কিন্তÍ পনেরো বছরে শিল্পের এই ভুবন ত’ থেমে থাকেনি। এখন কি আর পারবে নাতালী তার হারানো জায়গা পুনরুদ্ধার করতে? সোনিয়া কিন্ত একা একাই ব্যঙ্কে খুব ভাল কর্মজীবন গড়েছে। তাকে নিয়ে একটি ছেলের সাথে মাঝখানে তীব্র ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ কি সত্য? দূর- কে- তুমি নিজেই না তোমার একাধিক মানসিক বিচলনের পরিবর্তে সোনিয়ার একটি দৈহিক বিচলন ক্ষমা করতে প্রস্তত? তবে আর এসব কথা কেন? এছাড়া অভিযোগটা সত্য কিনা কে জানে। আবার ঐ যে প্রাগে বাণিজ্য মেলায় পরিচয় হওয়া আনা। ডালাসে ফিরে গিয়েও নিয়মিত ফোন করত। হাসি-খুলি,অমলিন স্বভাবের মেয়েটি। দু’টো অথবা বিশেষ করে একটি প্রবল মানসিক ধাক্কা খেয়েছিল সে। যা নিজেই স্বীকার করেছিল। তবে দৈহিক অভিঘাত তখনো কারো সাথে হয়নি বলে কথায় কথায় একবার জানিয়েছিল। বাবার বয়স হচ্ছে এবং ভাই নেই বলে বাবার বিশাল ব্যবসা আনাই এখন দেখা শুরু করেছে। তবু মাঝে মাঝে দু’টো মানসিক ধাক্কা তার পুরো পৃথিবী বিকল করে দিতে চায় বলেও জানিয়েছিল। সেই আনা অভিমান করে বহুদিন আর ফোন করে না। এতকিছুর পর কে-র ভাগ্যে আবার জুটলো কিনা মাদাম পোপোভার সাথে পরিচয়। পরিচয় হয়েছিল মাদাম মার্ক্যুইসের মাধ্যমে। মাদাম মার্ক্যুইস... কে-র একসময়ের পরিচিত দুই ছেলের প্রেমিকা। একজন ছিল সহপাঠী রবার্ট।  মুখে ঘন ব্রণ,  মোটা ও লম্বা ছিল অবশ্য রবার্ট। প্রায় প্রতিটি প্রেমেই ব্যর্থতা। তার কাছেই প্রথম মার্ক্যুইসের কথা শোনে। রবার্ট প্রেমে পড়েছে মাদাম মার্ক্যুইসের। মাদাম মার্ক্যুইসের বরকেও দেখিয়েছিল। আরে এই সুদর্শন বর আর একটি বাচ্চা ছেড়ে ভদ্রমহিলা রবার্টের কাছে আসবে কেন? তখনো মিস্টার মার্ক্যুইস ছিপছিপে ও সুন্দর ছিলেন। রবার্ট তখন হতাশ, বেকার ও এ্যালকোহলিক। কে-র সাথে পরিচয়ের পর কে-ই তাকে একটি ছোটখাট চাকরিতে ঢুকিয়ে দেয়। কৃপণ আর ঝগড়াটে ছিল রবার্ট। তার সাথে বন্ধুত্ব মানে একতরফা। ঐ কে-কেই প্রতিদিনের  কফি বা বীয়ারের দাম দিত আড্ডায়। পরে রবার্টের বাবার এক বন্ধুর মেয়ের সাথে পারিবারিক ভাবে কথা-বার্তার মাধ্যমে তার বিয়ে ঠিক হয়। শ্বশুরবাড়ি বিত্তশালী। ভালই আছে এখন রবার্ট। এরপরই পরিচয় হয় কে-র সাথে মাদাম মার্ক্যুইসের আর এক প্রাক্তন প্রেমিক মালদিনির সাথে। ইতালীয় বংশোদ্ভুত এই খেলোয়াড়ও বিবাহিত যাকে কোন কারণে মাদাম মার্ক্যুইসের মা পছন্দ করেনি। এক বিধবাকে বিয়ের পরও মালদিনি কষ্ট পেত মাদাম মার্ক্যুইসের জন্য। এসব গল্প যখন প্রথম শোনে কে... পনেরো বছর আগে... তখনি মাদাম মার্ক্যুইসকে মনে হত কে-র সাথে পরিচয়ে আগ্রহী। দু’জন বন্ধুর প্রেমিকা হিসেবে সামান্য কি এড়িয়েই যেত কে তাকে? গত বছর মাদাম মার্ক্যুইস কে এবং আরো কয়েকজন লেখকের কিছু লেখা নিয়ে একটি সঙ্কলণ প্রকাশের বিষয়ে আগ্রহী হলে খানিকটা যোগাযোগ ঘটেই। সেই সূত্রেই পোপোভার সাথে পরিচয়। পোপোভা পুরো সঙ্কলনের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণের কাজে জড়িত। একদিকে জোয়ার তিক্ত বিরূপতা  ও তার বিরুদ্ধে আনা মিথ্যে অভিযোগ, সোনিয়ার সাথে এত বছরের নি:সীম দূরত্ব, ফোনে আনার নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া... সব কিছুর ভেতরে পোপোভা কোথাও এক অলীক হাওয়া হয়ে ঢুকে পড়েছিল। সুগন্ধী সেই হাওয়া খানিকটা কে-কে উন্মনা করতে না করতেই সে সরেও আসে। মাদাম মার্ক্যুইস সেটা টের পেয়েই পরশু কে-কে ফোন করেছিলেন? মাঝখানে পোপোভাকে তিনি নিতেই পারছিলেন না? অথচ বহুদিনের সখী দু’জনেই। দূর... এই যে কে প্রতিটি ছোট-খাট মানসিক বিষয় নিয়েও এত ভাবছে, সোনিয়ার কাছে বা পারলে গোটা বিশ্ব-ব্রম্মান্ডের সামনে চেঁচিয়ে নিজের প্রতিটি মানসিক বিচলনের পাপ স্বীকার করবে বলে ভাবছে... এই যে তার দশ বছরের ছোট ছেলে রচেস্টার... ২৯ বছরের ছেলে... বিয়ে করেছে পাঁচ বছর... বউটি মোটা, ছোট ছোট চুল আর জিপসী  রক্তের কারণে খানিকটা কালো, চোখ দু’টো অবশ্য বড় বড়... অনেক বড়লোকের মেয়ে... রচেস্টার নিজে ত’ ছোট-খাট একটা কাজ করে আর দেখতে মোটামুটি ভাল... সে ত’ প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নতুন কোন নারীর শয্যায় গিয়ে পরে তার সফলতার গল্প কে-কে শোনায়।
‘কি একটা জীবন পার করলেন? আমার স্কুল শিক্ষিকা... ভাবতে পারেন আমার জুনিয়র সহকর্মী মেয়েটির মা’র সাথে আমার আজ হয়েছে? মেয়ে সুন্দরী না- মা বেশি সুন্দরী। তাকে আমার স্কুলে বালক বয়স থেকে ভাল লাগতো। আজ হয়েছে?’
‘তোমার বউ জানে?’
‘নাহ - বউকেও ভালবাসি ত’।’
কোন অজ্ঞাত কারণে রচেস্টার আবার সব সময়ই বয়সে বড় এবং বিশেষ করে নিদেনপক্ষে দশ বছরের বড় সব নারীতে আকৃষ্ট। তাদের প্রায় সবার সাথেই দৈহিক অভিযানের সফলতার গল্প সে শোনায়।
‘আর তোমার স্ত্রী?’
‘আমার সহপাঠীনি ছিল। ডানপিটে, ছেলেদের সাথে খেলা-ধূলা, মারপিট করতো।  এখন আমার বাচ্চার মা। ওর সাথে সংসার ভাঙ্গব না। তবে আমার নিত্য নতুন প্রেম লাগবে।’
রচেষ্টারের জন্যও মায়া হয় তার। মেধা আছে, চাইলে লিখতে পারত বা কেরিয়ারে ভাল করতে পারত। কিছুই হবে না। জীবনে ছেলেটির একমাত্র লক্ষ্য  কতজন প্রেমিকাকে সে বিছানায় নিতে পারবে। রচেস্টার আবার হয়তো কে-কে ভাবে ব্যর্থ।
‘এই যে এত ইন্স্যুরেন্সে কাজ করেন, পান্ডুলিপি নিয়ে পরিশ্রম করেন - কোন নারীর সাথে এত বছরের জীবনেও যদি কিছু না হয় তবে কি মানে জীবনের? কোন কমিউনিস্ট নারী আপনাকে দুশ্চরিত্র ভাবলো, কোন নারী কবে আপনাকে ফ্লবেয়ার বলেছিল, সোনিয়ার কাছে ক্ষমা চাইবেন কিনা, আনা আর ফোন করে  না কেন কিম্বা পোপোভা পিয়ানোতে আপনার জন্য একটা সিম্ফনী বাজিয়েছিল কিনা... এগুলো নিয়ে ভাবেন আপনি? রক্ত-মাংসের নারী না নিয়ে সব ভাবনার পুতুল নিয়ে খেলা। দূর- আমি ত’ প্রতি সপ্তাহে নতুন একটা নারীকে বিছানায় নিই। আর ছোট-খাট মানসিক বিষয় নিয়ে আপনার এত ভাবনা?’
এরপরে আর কি বলার থাকে? তবে তারপরও... কে ত’ আর রচেস্টার নয়। রচেস্টার হতে পারলেই কি ভাল ছিল?




0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন