প্রতিবেশী সাহিত্য
ফেলিসবের্তো
এরনান্দেস’র গল্প
(অনুবাদ : জয়া চৌধুরী)
লেখক পরিচিতি :
১৯০২ সালে উরুগুয়ের মন্টেভিডিওতে
ফেলিসবের্তো এরনান্দেস জন্মগ্রহণ করেন। সুরকার, পিয়ানোবাদক ও সাহিত্যিক হিসাবে
তিনি খ্যাত ছিলেন। তাঁর ছোটগল্প, উপন্যাস ইত্যাদির বিষয়বস্তু ছিল মন্টেভিডিও র
সাধারণ মানুষের জীবন থেকে নেওয়া। পিয়ানো শিক্ষক হিসাবে তাঁর খ্যাতি এতটাই ছিল যে
সেটি তাঁর সাহিত্যিক সত্ত্বার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মলাট
ছাড়া বই’ বা ‘লিব্রোস সিন তাপাস’, ‘এক মান্যিগণ্যি ব্যক্তি’ বা ‘ফুলানো দে তাল’ বা
‘আনার মুখ’ বা ‘লা কারা দে আনা’ ইত্যাদি। ইংরাজী, জার্মান, গ্রীক, ফরাসি, পর্তুগীজ ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর বই। মারকেস
বা কোর্তাসার-এর মত বিশ্ব বরেণ্য
সাহিত্যিকেরা তাঁদের ঋণ স্বীকার করেন ফেলিসবের্তো এরনান্দেস-এর সাহিত্যের কাছে। তাঁকে ইউরোপীয় বা লাতিন-আমেরিকান
কোনও বিশেষ শ্রেণীতেই নিরঙ্কুশ ফেলা যায়
না। তাঁর তিনটি বিবাহ, তার মধ্যে একজন কেজিবি-র চর সহ অসংখ্য নারীর সঙ্গে বিচিত্র
সম্পর্কে জড়িয়েছেন আজীবন। ১৯৬৪ সালে
মন্টেভিডিওতে প্রয়াত হন তিনি।
আইরিনের বাড়ি (La Casa de
Irene)
(১)
আজ একটা অল্পবয়সী মেয়ের বাড়ি গেলাম। মেয়েটার
নাম আইরিন। ওর বাড়িতে যাবার পরে একটা নতুন ধরনের রহস্যের মুখোমুখি হলাম। চিরকালই ভেবেছি রহস্যের রঙ কালো হয়। কিন্তু আজ একটা সাদা
রহস্য দেখলাম। এটার সঙ্গে অন্য রহস্যগুলোর তফাৎ হচ্ছে অন্যগুলোর প্রবণতা থাকে
ধ্বংস করবার, কিন্তু এটার কোন প্রবণতাই
ছিল না। যে কেউ এটাকে দেখবে ভাববে বাঃ এটি তো আগাগোড়া রহস্যে মোড়া... ব্যস আর কোন
কিছুই তাকে বিচলিত করবে না।
শুরুতেই বলে রাখি আইরিন এমন একজন মানুষ যাকে
খুব পছন্দ ক’রে আমরা সাধারণ সাদাসিধে
মানুষের পর্যায়ে ফেলতে পারি। সে খুব খোলামেলা, আবেগপ্রবণ, যে কোন বিষয়ে সে এমন
ভাবেই বলে যেমন কোন মানুষের মত মানুষ বলে থাকে। কিন্তু তাতে কোন যুক্তিহীন ব্যাপার
থাকে না। আবার বিষয়টার প্রতি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আগ্রহও থাকে না। বড়জোর এমন কিছু
শব্দ বলে ফেলে সেসব মানুষ কেবল উচ্ছ্বাসেই
বলে। আবার কখনও সেসব কথা ফিরিয়েও নেয় সে। যখন সে হাসে দেখে মনে হয় কী ভীষণ কাম্য
সে, আবার যখন কাঁদে তখনও... আসলে অনবরতই এরকমই।
যাইহোক ও কিন্তু নিজের স্বতঃস্ফূর্ততাতেই এক সাদা রহস্য।
হাতদুটোয় যখন ও কোনও জিনিষ তুলে নেয় এমন
স্বতঃস্ফূর্ততায় সেটা করে মনে হয় জিনিসগুলো ওকে ঠিক বোঝে ওকে, যেমন করে ও আমাদের বোঝে।
আমরাই বরং জিনিষগুলোকে সরাসরি বুঝে উঠতে পারি না।
(২)
আজ একটা অল্পবয়সী মেয়ের বাড়িতে আবার এলাম।
মেয়েটার নাম আইরিন। ও পিয়ানো বাজাচ্ছিল। আমাকে দেখেই বাজনা ছেড়ে উঠে এল। আর কয়েকজন
লেখকের কথা খুব বলতে লাগল। তখন সাদা রহস্যটার অন্য দিকও দেখতে পেলাম। প্রথমতঃ যতক্ষণ
কথা বলছিলাম চোখ সরাতে পারছিলাম না, এমন খোলামেলা
আর সাহসী শব্দগুলোকে ও ঠোঁট থেকে কেমন করে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারপর মুখটা খোলা আর বন্ধ
করার মধ্যে জট পাকিয়ে গেল। এবং তারও পরে দাঁতগুলো সাদা হয়ে গেল।
কথাবার্তা শেষ হবার পর ও আবার পিয়ানো বাজাতে
শুরু করল। ওর হাতগুলো ঠোঁটের মতই খুব খোলামেলা আর খামখেয়ালী ভাবে চলছিল। হাতদুটো
খুব আকর্ষণীয় লাগছিল, মহতী ও স্বতঃস্ফূর্ত চলাফেরায় পূর্ণ। কেবল ওর কোন নির্দিষ্ট
ভঙ্গী দেখা যেত না। ওগুলো কোন জোরও খাটাত না।
কোন সুর ও হয়ত হঠাত বেড়ে গেল কিংবা ভুল বাজাল... যাইহোক আইরিন বুঝত পিয়ানো
আর ওর মাঝে আর কেউ নেই। পিয়ানোটারও ওর সম্পর্কে এই কথাই মনে হোত।
ওরা দুজন অবিচ্ছিন্ন হয়ে জুড়ে থাকত। লেখকদের
সম্পর্কে খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই ও নাড়া খেত এবং সেগুলো খুবই আকর্ষণীয় ছিল। তারপর মনে
হল আমিও বাজাই। মনে হল পিয়ানোটার একটা ব্যক্তিত্ব আছে। আইরিন খুব যত্ন করেই আমাকে
ধার দিল ওটা। যেগুলো আমি বাজাচ্ছিলাম সেই সবকটা নোটেশনই আমার নতুন লাগছিল। ওদের
একটা রঙ ছিল, একটা আবেগ এমনকী একটা ছন্দও। ঠিক সেই সময় আমি খেয়াল করলাম যে ওইসব
জিনিষগুলো কাজে লাগছিল। আইরিন ওর বাড়ির সব কাজকর্ম সারছিল আর দেখলাম এক জায়গায়
বিশেষ করে পিয়ানোর রিডগুলো যেখানে শেষ হয়েছে সেইখানে কাঠের ফাঁকে উঁকি মারছিল একটা
সবুজ ফিতে।
(৩)
আজ আমি আবার আইরিনের বাড়ি এলাম। কারণ আজকের
দিনটা খুব সুন্দর।
মনে হয় আইরিন আমাকে ভালোবাসে। ওরও মনে হয়
আমি ওকে ভালবাসি। ওর হয়ত মনে কষ্ট হয় কেননা সেকথা আমি তো ওকে বলি না। আমারও মন
খারাপ লাগে ওকে বলতে না পেরে। কিন্তু ব্যাপারগুলোর এই অজড়ত্বটাকে ভেঙে ফেলতেও পারি
না। তাছাড়া ও কষ্ট পেতে থাকলে ওকে আরো আরো আকর্ষণীয় দেখায়। কি সব ঘটছে এবং
সেগুলিকে লক্ষ্য করাও বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে। আমি
যখন পৌঁছলাম আইরিন বসে বসে বই পড়ছিল। একারণেই ওর বিশাল বাগানের একটা দারুণ
কোণ ও বেছে রেখেছে। বাড়ির সামনের রাস্তা থেকেই ওকে দেখতে পেয়েছিলাম। জিজ্ঞেস না
করেই ওকে নিজের পরিচয় দিলাম। ও অবাক হয়ে গেল।
আমাকে দেখে ওর খুব আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু
পরক্ষণেই আমার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই ও দৌড়ে চলে গেল।
সাদা রহস্যটা চেয়ার ছেড়ে প্রায় উঠতই না।
চেয়ারটা ঘর থেকেই আনা। চেয়ারটারও একটা শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ছিল। বেশ একটা
গুরুগম্ভীর পজিশন, ভীষণ দৃঢ়। পিছনে ফাঁকা জায়গাটা, পেছনের পায়াগুলো আর ওর
স্বাভাবিক চেহারাটার বেশ একটা চরিত্র ছিলো। মনে হত যেখানে আমি আছি তার অপর প্রান্ত
থেকে তাকিয়ে আছে আর আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।
ভেতর ঘর থেকে আইরিন আমাকে ডাকছিল, কেননা
আমরা ঠিক করেই রেখেছিলাম পিয়ানো বাজাব। বাজানোর জন্য চেয়ারটা সঙ্গে করে নিয়ে
যেতাম। ওটা আগের মতই থাকত, ঘর থেকে ওটাকে টেনে নিয়ে যাবার আগে যেমন ছিল। আমার সঙ্গেই ওটাকে রাখতে হত। আমি আইরিনকে
বলেছিলাম পিয়ানোর ওপরে ও যখন ঝুঁকে বসে তখন যেন ঠিকঠাক ব্যবহার করে ওটা। ও যখন
বাজাত আমি আড়চোখে ওকে দেখতাম।
(৪)
আজ আইরিনের সঙ্গে দেখা হল ওর বাগানের ঠিক ঐ
জায়গাতেই। এবার কিন্তু আমার জন্য ও অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখেই হেসে গড়িয়ে পড়ে
প্রায় চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে আর কি। যে চেয়ারটায় ও বসেছিল সেটাকে আগের দিনের চেয়ে
অন্যরকম লাগছিল। ওটাকে আরও হাস্যকর আর মেরুদন্ডহীন লাগছিল। বেচারা চেয়ার। আগের দিন
ওটাকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলাম আজ ওকে তার চেয়ে বোকা আর গুরুত্বহীন লাগছিল। আমার
মনে হয় ও অপেক্ষা করছিল একটা মানুষের জন্য যে তার শরীরটাকে ভাঁজ করবে এবং তার ওপর
বসবে। চেয়ারটা ওর গঠনকে আরও একটু সাজিয়ে গুছিয়ে যতটা সম্ভব আরামপ্রদ করে নিল। তার
বেশি কিছু না। আইরিন ওটার পিঠটা ধরে ঘরে নিয়ে এল। ঠিক সেই সময় আইরিনের সেই সাদা
রহস্যটা বলে উঠল- “কিন্তু ওর কথা শুনছ না তুমি, ও একটা সামান্য চেয়ার, তার বেশি
কিছু না”। আইরিনের হাতে ধরা চেয়ারটা সত্যিই
লজ্জায় প্রায় মুখ লুকোল। যাইহোক চেয়ারটা আইরিনকে ক্ষমা করে দিল। ওকে তো ও ভালবাসত।
ঘরে ঢুকে এক মুহূর্ত রইলাম আমি। আমার এত কিছু হওয়া সত্ত্বেও মনে হল চেয়ারেরা
নিজেদের মধ্যে ব্যাপারটা ঠিকই বঝে নেবে। তারপর চেয়ারদের আর আমার বিরুদ্ধে
প্রতিবাদস্বরূপ আমি হাসতে শুরু করলাম।
তারপরেও মনে হতে লাগল চেয়ারগুলো আমাকে নিয়ে
হাসাহাসি করছে। কেননা ওদের মধ্যে কাউকে আমি প্রথমবার নজর করে দেখেছি, কাউকে আড়চোখে
তাকিয়ে দেখেছি আবার কাউকে নিয়েই বা হয়ত হাসাহাসি করেছি।
(৫)
আমি আইরিনের হাত ধরেছি আজ। সেমুহূর্তে আমি
অন্য কথা ভাবতেই পারছিলাম না। ব্যাপারটা
এমনই ঘটে গেল - পিয়ানোর রিডের ওপর ওর হাতদুটো যখন নাচছিল, ভাবছিলাম খপ করে যদি ধরে
ফেলি কেমন হয়! ও কি করবে, আর আমিই বা কি করব! মুহূর্তগুলো কেমন হবে? কি আশু ঘটনাই
বা ঘটাব আমরা? প্রথম ভাবনাটার সঙ্গে
বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলাম না। কেননা আইরিন কথাটা ওভাবে ভাবেই নি। তারপর আমি। ধকধক
করছিল বুকটা। একটা অসম্ভব, অপ্রত্যাশিত, অবিশ্বাস্য হিংসা দেখা দিল। আমার শক্ত
বাহুর আগ্রাসনে ও ভয় পেয়ে গেল। পরক্ষণেই থেমে গেল। খুব তাড়াতাড়ি ও প্রত্যাঘাত করল।
তারপরে অবশ্য আমার সপক্ষেই আচরণ করল। সেই মুহূর্তে ওর প্রতিক্রিয়াটা আমার অনুকূলেই
ছিল। দ্বিতীয় মুহূর্তে ওর ভালো লাগতে শুরু করল। মনে হল তার পরক্ষণেই আবার আমার
বিরুদ্ধে। ঠিক এমনি সময়ে ওকে চুমু খাওয়ার সুযোগটা আমি ছাড়লাম না।
ও দৌড়ে চলে গেল। আমি আমার টুপিটা নিলাম আর
এই মুহূর্তে আমি এখানে মানে আমার বাড়িতে বসে আছি।
বলে বোঝাতে পারব না কিভাবে সবকিছু এত দ্রুত
বদলে গেল আর এত অপ্রত্যাশিত ভাবে। কিভাবে হাতের আইডিয়াটা আমার মাথায় এল আর আমি
সেটা বাস্তবে করেও ফেললাম। সমস্ত ঘটনাটা মেনে নেবার সময় কিভাবে যেন একটা অনুভূতি
হল, হাতদুটো যেন আরো বেশি করে ওকে পেয়ে বসেছিল।
(৬)
গতকাল রাতে আমি ঘুমোতে পারি নি। যা ঘটেছে
সেগুলোই ভেবে যাচ্ছিলাম। তারপর হল কি ঘটনাগুলো ভাবতে ভাবতে অনেকটা সময় শুয়ে ঘুমিয়ে
কাটিয়ে দিলাম। পুরো ব্যাপারটা মনে করতে আমাকে বেশ শক্তি প্রয়োগ করতে হচ্ছিল। ফিরে
ফিরে দেখতে ইচ্ছে করছিল যে আমার হাতেরা ওকে কিভাবে জড়িয়ে ধরেছিল। সেগুলোর কথা
ভাবতে খুব ভালো লাগছিল। ওর সাদাটেপনা এক রকমের ছিল না। একটু বাড়াবাড়ি সাদা হয়ে
গিয়েছিল আর কাগজের মতই স্বাদহীন। ঠিকঠাক ভাবে আমি মনেই করতে পারছিলাম না। আমার
কাছে সেটা বিশ্বাসহীনতার মত দেখাচ্ছিল। অথচ আমি তো আমার হাতদুটোকে শ্রদ্ধা করি
ওদের কিছুতেই নিচু ভাবতে পারছিলাম না। মনে পড়ে নিজেকে আমি একটা কাগজের মত
দেখছিলাম। একবার মনেও হল অন্যমনস্ক। হাতদুটোকে আমি নগ্ন দেখেছিলাম। আর এখন
ভাবছিলাম ওর হাতদুটোকে যেন আমি ধরে রয়েছি। সেগুলোর রঙ ঠিক বিপরীত এবং বন্য। আমার
গর্ব হচ্ছিল। তবে নিজের হাতদুটোকে আমি ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছিলাম না। কারণ ঘরটা
অন্ধকার ছিল। তাছাড়া আলো জ্বালতেই ইচ্ছে করছিল না আমার। হাতদুটোকে দেখতেও ইচ্ছে
করছিল না। তারপর ইচ্ছে করল আইরিনের চোখের রঙ দেখি। কিন্তু ওগুলোকে যে আমি সবুজ
রঙের ভাবতাম আসলে ওগুলো তা নয়। মনে হচ্ছিল যেন ওগুলো ভেতর থেকে আঁকা। এই সকালবেলা
আমার মনে হচ্ছিল ওটা একটা স্বপ্নের জার্নি। আইরিন একা থাকত না। বরং একগাদা ভাইবোন
আর বাপ মায়ের সঙ্গে থাকত।
(৭)
অনেকদিন
হল আমি লিখি না। আইরিনের সঙ্গে আমি ভালো আছি। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে রহস্যময়
সাদাটাও মিলিয়ে যাচ্ছিল।
দুর্দান্ত অনুবাদ! মুগ্ধ হয়ে গেলাম। যে রকম চেয়ারটা হয়েছিল।
উত্তরমুছুনঅনুবাদক, ধন্যবা।
কী আশ্চর্য লেখা। চমৎকার অনুবাদ।
উত্তরমুছুনশ্রাবণী ।