কালিমাটির ঝুরোগল্প ৮৫ |
রুখসত
আশির কোঠায় পৌঁছোবার পর যখন আশেপাশের অনেককিছু ফিকে হয়ে
আসে, দিন-রাত গুলিয়ে যায়, তখনো দূরে ছোট ছোট কয়েকটা আলো স্পষ্ট হয়ে থাকে। কিসের আলো? তা কি
আর স্পষ্ট করে বোঝা যায়? মনে হয় ঐসব স্পষ্ট অস্পষ্ট আলো মৃত্যুর কাছে এক পশলা
বৃষ্টি চেয়ে হাপিত্যেশ করে বসে আছে।
--"বশির মিঞা, কি হালত বলো দেখি? বৃষ্টি তো থামছেই না। হয়ে যাচ্ছে,
হয়েই যাচ্ছে।"
--"তোমরা তো আর কলকাতায় বন্যা দেখোনি, তাই বলছো।
সাতের দশকের শেষের পালা। কি বারিশ কি বারিশ! আমি তখন সবে চল্লিশ পেরিয়েছি। যেদিন আকাশ জওয়াব
দিয়ে দিল, তার আগের রাতে আম্মার ইন্তেকাল। এতো পানি, এতো পানি, গোর দিতে যাওয়ার
উপায় নেই, ইয়া আল্লাহ!"
দূরের আলোগুলো একে অপরের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে অক্ষর তৈরী
করছিল। নিরঙ্কুশ অন্তরীক্ষ। নক্ষত্রের অক্ষরমালা আলোয় আলোয় একাকার। সময় চলে গেছে
আট আটখান দশকের পার। যেখানে
জোড় ছিল না, সেখানেও আলো জুড়ে যাচ্ছে আর যেখানে জোড়ার কথা দেওয়া ছিল সেখানে
অন্ধকার ঘিরে।
--"আম্মাকে রুখসত করলেন কি করে?"
--"ইন্তেজার। সব শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ইন্তেজার শেষ
হয়না। বারিশ তখন নিজের এক শহর গড়েছে কলকাতায়। বুঝলে জনাব! বাড়ির ভেতর আম্মার শরীর।
শক্ত হচ্ছে। শরীরে পানি জমছে। পানি। বাইরে ঝরছে, ভেতরে জমছে।"
--"তারপর?"
আলোগুলো সরতে শুরু করেছে। একে অপরের থেকে দূরে। অজ্ঞাত
কোন কারণে ওদের চলে যেতে হচ্ছে। কেউ কি ওদের শাসিয়েছে? চলে যেতে বলেছে? প্রায় এক
শতকের বসত ছেড়ে
চাপা অভিমান নিয়ে শহর ছাড়ছে মৃদুমন্দ দহনআলো।
বশির মিঞার নামাজ শেষ। টুপিটা উল্টানো। যেন হাঁ করে
তাকিয়ে আছে। তার ভেতর একটা পুরনো কার্ড। খুললে দেখা যাবে, কলকাতা মেডিকেল কলেজ ওয়ার্ড
মাস্টারের আইডি কার্ড। মিঞাকে চেনাই যাচ্ছে না। কম করে চল্লিশ বছর আগের ছবি। মুখে
তখনো তেমন একটা বয়েসের
ছাপ পড়েনি।
৭৮ এর বন্যায় মিঞার বাড়ির সবাই মারা যায়। তিনদিন মেডিকেল
কলেজ থেকে বেরোতে পারেননি বশির। একের পর এক রোগী আসছিল। সামলানো যাচ্ছিলো না। বেড
ভর্তি হয়ে মানুষ তখন হাসপাতালের মেঝেতে। ফোনলাইন কাজ করছিল না। তিনদিন পর ঘরে ফিরে
দেখেন, ঘর, বিবি, বেটিজান --কেউ নেই।
একমাত্র কার্ডটা রয়ে গেছে। সেবছরই নতুন করে করানো। এ শহর অনেক কিছু ভুলে যায়। তাই
অনেককে চলে যেতে বলে। বশির মিঞার নামাজ শেষ। আশেপাশের সবকিছু ফিকে হয়ে গেছে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন