কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০

চিরশ্রী দেবনাথ




সমকালীন ছোটগল্প


মণিপদ্মে


এই লোকটি এতক্ষণ যা বলে গেলো, তা কি সত্যিই! বিজনেস করছে বটে  দ্বৈপায়ন, তবে এতো প্যাঁচ তার জানা নেই। সহজেই লোকের কথায় বিশ্বাস করে, টাকা দিয়ে কন্ট্রাক্ট সাইন করে। তারপর ঠকে যায়। হয় টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় লোক, না হলে মুনাফার অতি সামান্য অংশই হাতে আসে তার। স্ত্রী আর এক মেয়ে নিয়ে সংসার দ্বৈপায়নের। দোকান কিনে বা ভাড়া করে বিজনেস দেওয়ার মতো ক্যাপিটাল জোগাড় করতে পারেনি এখনো সে। বাবার দেওয়া সামান্য বাড়িটিই  আছে শুধু, তাও শহর থেকে এত দূরে, আর সেটা কোনো বিজনেস এরিয়াও নয়।  তাই ফ্লাইং পদ্ধতিতেই বিভিন্ন রকম ব্যবসা চালাচ্ছিল সে। লাভ খারাপ হচ্ছিল না প্রথমদিকে, মোটামুটি স্টেডিই এগোচ্ছিল সব। তখনই বিয়ে করে নেয়। কিন্তু তারপরই লসের পর লস। তারা যে কয়েকজন একসঙ্গে বিজনেস শুরু করেছিল, তাদের মধ্যে সে ছিল সবচাইতে এগিয়ে, আজ সে সবচাইতে পিছিয়ে। কেন হচ্ছে না, কেন? সামনে এতক্ষণ যে  লোকটি বসেছিল তার  সাথে একমাস হলো পরিচয় হয়েছে। তিনি চাইছেন দুজনে মিলে একটি নতুন ব্যবসা হোক পার্টনারশিপে, কিন্তু  কী করে বুঝবে দ্বৈপায়ন, এই লোকটি ঠিকঠাক! দ্বৈপায়নরা যে টেবিলে বসে চা  খাচ্ছিল, তার পরের টেবিলেই বসেছিল একটা লোক, হলুদ গেঞ্জি, কালো জিনস্ পরা। চোখে ঘন কালো সানগ্লাস, চোখের দৃষ্টি বোঝার কোন সাধ্য না থাকলেও, লোকটি যে তাদের দিকে লক্ষ রাখছে, একথা বেশ বোঝা যাচ্ছিল।

হঠাৎ সামনে বাড়ানো হাত। ওহ্ সেই হলুদ গেঞ্জী। আমার নাম মণিপদ্ম। হাত বাড়ালে হ্যান্ডশেক করতে হয়, তাই সেও করলো। সরি, অনধিকার চর্চা করবো। আপনি মনে মনে ভাবছেন, এই লোকটির সাথে বিজনেস ভালো হবে কিনা। তাই তো? আমি কাউকেই চিনি না, না আপনাকে না এই লোকটাকে। তবে আমার একটি জন্মগত ক্ষমতা আছে, তা হলো মানুষের চোখের ভেতর দিয়ে তার ভবিষ্যৎ দেখতে পাই। এতক্ষণ ধরে আপনি যে লোকটির সঙ্গে কথা বলছিলেন, তার চোখের দিকে তাকিয়ে, সোজা গলি পেলাম, ঢুকে গেলাম। ভবিষ্যতের ঘটনাগুলো স্পষ্ট ঘটে গেলো সামনে। তিনি ঠকাবেন আপনাকে। হয়তো আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন না, নাই করুন। আমার ফোন নাম্বার রেখে দিন, দরকার পড়লে মানুষের উপকার  করি। প্রতিদান চাই না। চলে যাই ঠিকানা না রেখে।

দ্বৈপায়নকে একটিও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, হলুদ গেঞ্জী ওরফে মণিপদ্ম চলে গেলো। দ্বৈপায়ন যেন সম্মোহন থেকে উঠে এলো। দূর! এর আবার কি মতলব কে জানে! যথারীতি এসব বুজরুকবাজিতে বিশ্বাস না করে দ্বৈপায়ন ডিল সাইন করলো  ও তুলেমুলে লস খেল। পাঁচ পার্সেন্ট মুনাফাও সে তুলতে পারলো না।

একই রেস্টুরেন্টে বসে দ্বৈপায়ন বাজারের সবচেয়ে কমদামি সিগারেটে ধূমপানের পিপাসা মেটাচ্ছিল। অন্যমনস্ক ভাবেই হাত চলে গেলো মোবাইলের কন্টাক্ট লিস্টে।
কিছুদিন আগে সেইভ করা নাম্বার, ‘মণিপদ্ম’, ডায়াল করলো।

মাস ছয়েক কেটে গেছে। মণিপদ্ম কি কোন ছদ্মবেশী দেবদূত! ছ’ ছ’টা মাস সে   ছায়ার মতো দ্বৈপায়নের পাশে থেকেছে। শুধু সঠিক মানুষ চিনতে শিখিয়েছে। পর পর তিনটি পার্টনারশিপেই  প্রচুর লাভ হলো। অনেকটাই আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে দ্বৈপায়নের। সত্যিই তো, কে এই মণিপদ্ম, কোনদিন কিছু চায়নি। কিছু খাওয়াতেও পারেনি তাকে। খুব দামী সিগারেট ফোঁকে মণিপদ্ম, উল্টো দ্বৈপায়নই এই সুখটানের ভাগীদার হয়েছে। মানুষের চোখে চোখ পড়লেই নাকি একটি গলিরাস্তা দেখে ও, আর সব বুঝে নিতে পারে। অথচ নিজের কথা একবারও কিছু বলতে চায় না।  দ্বৈপায়ন বুঝতে পেরেছে চারপাশে টাকা ওড়ে, তবে কুশলী হতে হয়। স্থিতধী, বুদ্ধিমান এবং অবশ্যই সঠিক পার্টনার নির্বাচন। কোনমতেই মণিপদ্মকে সে হারাতে চায় না। তাকে আটকে রাখতে হবে । তাহলেই দ্বৈপায়নের উন্নতি।

একবছর কাটল, এখন তো ভীষণ ভালো কাটছে দ্বৈপায়নদের, সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি কেনা হল, ইনস্টলমেন্টে ফ্ল্যাট, মেয়ের ভালো স্কুল। ব্যাঙ্কে একটি গুড এমাউন্টের ফিক্সড ডিপোজিট। দ্বৈপায়নের স্ত্রী অনেকদিন বলেছে, মণিপদ্মকে যেন ওদের নতুন ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে। অবশেষে মণিপদ্ম রাজি হলো। কারণ সে নিজেও মনে মনে ডিসিশন নিয়েছে এখন চলে যাবার সময়। একজন হতাশ যুবককে পথ দেখাতে পেরেছে, আর কি। ঈশ্বর তাকে একটি অভিশপ্ত জীবন দিয়েছে। পরিবার ছেড়ে এসেছে, ভাই বোন, মা, বাবা। কোথাও থাকতে পারে না,  বন্ধু নেই একজনও। নিজেকেই প্রতি মুহূর্তে শত্রু মনে হয়।

একদিন শ্মশানে গিয়েছিল, বয়স তখন ত্রিশ। চাকরি করতো একটি স্কুলে। সেদিন মনে প্রচন্ড অশান্তি। একটি মেয়ে ছিল, ইংরেজি পড়াতো ওকে, মণিপদ্মের চোখের সামনেই মেয়েটি কিশোরী থেকে তরুণী হলো। যদিও  মণিপদ্ম  কাউকে ভালোবাসতে পারে না, তবুও ওকে ভালোবেসেছিল, ভেবেছিল সমস্ত কিছু নিয়েই ভালোবাসবে, দোষ ত্রুটি, এ এক পরীক্ষা তার। কিন্তু পারেনি। আজ মেয়েটিকে বিদায় দিয়েছে। আপাতত মুক্ত সে। কি করবে এখন?

কিছু দূরে লাল কাপড় পরা একটা লোক বিড়ি খাচ্ছিল। ওর দিকে অনেকক্ষণ ধরে  তাকিয়ে আছে। তারপর পরিস্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করলো খাবেন? গাঁজা কিন্তু।
মণিপদ্ম দুদিকে ঘাড় নাড়ল।
ওকে। আমি কিন্তু গ্র্যাজুয়েট আর আপনার মতই অভিশাপগ্রস্থ। তাই এখানেই আশ্রয়।
আপনার দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ তাই স্টাডি করলাম। অলস নন মনে হচ্ছে। আমি পারিনি। আপনি পারবেন। লোকের উপকার করুন, পথ দেখান। খাবারও জুটবে আপনার, উপরি হলো পুণ্য অর্জন, পরজনমের কড়ি। এছাড়া অদূর ভবিষ্যতে আপনার আর কোন পথ নেই। যান্। এ জায়গা আপনার নয়। লোকালয়ে থাকুন সন্ন্যাসীর মতো। কেউ যেন মণিপদ্মের ভেতর থেকে বলে দিল, ওর কি করা উচিত।

সেই থেকে এটাই মণিপদ্মের ব্রত। তবে যখনই মনে হয়, এখানে কাজ শেষ, সে চলে যায় ঠিকানা না রেখে অন্য কোনখানে। মাঝে মাঝে ছদ্মবেশও নেয়। খুব থ্রিলিং। কেটে যাচ্ছে জীবন। না কাটলে, সুইসাইড করবে। কি আর এমন এক মানুষ সে। কারো কিস্যু হবে না।

আজ দ্বৈপায়নের নতুন ফ্ল্যাটে নেমতন্ন। যেতেই হবে। বহুদিন কারো বাড়ি নেমতন্ন খায়নি। প্রচুর অস্বস্তি মনে। তবুও যাচ্ছে। ছেলেটা ভালো। সত্যিই ওনেস্ট। দ্বৈপায়নের আপত্তি সত্ত্বেও দামি চকলেট, মিষ্টি, আর ইয়া বড়ো একটি পুতুল কিনলো মণিপদ্ম।
কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলল বল্লরী, বছর পঁয়ত্রিশ, ঢলঢলে কোমল একটি মেয়ে, একঢাল কালো চুল, খয়েরী টিপ, মিষ্টি হাসি ... দ্বৈপায়নের বউ।

যদিও মণিপদ্মের চোখে কালো চশমা সবসময়ের মতো, তবুও দ্বৈপায়ন তার এতোদিনের অভিজ্ঞতায় বলছে, মণিপদ্ম এখন বল্লরীর চোখের গলিপথে ঢুকে গেছে।
মণিপদ্ম কথাই বললো না প্রায়। এতো পদ রান্না করেছে বল্লরী। প্লেটে তুলে নিয়ে কয়েক চামচ খেলো মাত্র মণিপদ্ম। ফিরে আসতে আসতে ভাবছে সে, তার কি দ্বৈপায়নকে বলা উচিত সব! না বললে বিশ্বাসঘাতকতা হবে। কিন্তু কী করে বলবে! এও কি সম্ভব! এইপ্রথম মণিপদ্ম ভেঙে পড়ল। কেন এই বিশেষ ক্ষমতা! কে সেই মহামহিম যে ভীষণ কষ্টকর, যন্ত্রণাদায়ক বিশেষ ক্ষমতাগুলো দিয়ে কয়েকটি মানুষকে পৃথিবীতে পাঠায়! মানুষের ভেতরের মতো অন্ধকার আর কিছু নেই।

বল্লরীর চোখের গলিপথ দিয়ে ঢুকে দেখা গেলো, একটি মস্ত বাড়ি। বল্লরী আর মণিপদ্ম সেখানে স্বামী স্ত্রী। বল্লরী হাসতে হাসতে বলছে, দ্বৈপায়নের মুখে তোমার  কথা শুনে শুনেই তো আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। তারপর  হঠাৎই দ্বৈপায়নের নিরুদ্দেশ হওয়া আর এখন আমি তোমার হয়ে গেছি। আচ্ছা, দ্বৈপায়নকে কে নিরুদ্দেশ করেছে বলো তো? খুব আহ্লাদ নিয়ে জিজ্ঞেস করছে বল্লরী।
ছিঃ ছিঃ, মণিপদ্ম এসব কী দেখছে! তাকে চলে যেতে হবে দূরে, অনেক দূরে। না হয় মরে যেতে হবে। খুব ভালো দ্বৈপায়ন। অন্ধের মতো বিশ্বাস করে তাকে। মণিপদ্ম কেন নিজের চোখে নিজের ভেতরের গলি দেখতে পায় না? ইচ্ছে করে, একদিন নিজের চোখদুটোকে আঘাত করতে, চিরজীবনের মতো অন্ধ হয়ে যেতে। তারপর ট্রেনে হারমনিয়ম বাজিয়ে লোকজনকে গান শোনাবে। টুক টুক পয়সা। ব্যস হয়ে গেল।

পরের দিন সকালবেলা একটি ব্যাগে সামান্য কিছু জিনিসপত্র নিয়ে, যেখানে থাকত সেই বাড়ির মালিকের সব ভাড়া শোধ করে, ঘর ছেড়ে দিয়ে, নিজের বাইকে তেল ভরে, দুরন্ত গতিতে বাইক ছোটাল মণিপদ্ম। কোথায় যাচ্ছে, জানে না সে। সারাদিন, সারারাত বাইকে করে ছুটছে শুধু।  ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই। একসময় মুখ থুবড়ে  অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে বাইক থেমে গেলো একটি হাউসিং কম্পপ্লেক্সের সামনে এসে। ঘোলাটে চোখে মণিপদ্ম দেখল এখানেই বল্লরী, দ্বৈপায়নের সুখের সংসার। 

2 কমেন্টস্: