কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০

শুভশ্রী পাল



কবিতার কালিমাটি ১০১



আশ্রয়বৃক্ষ


 (১)

প্রিয় অত্যাচারিত আশ্রয়বৃক্ষ, এছাড়া আর কীই বা সম্বোধন করি তোমাকে!  ফুল-ফল-ছায়া দেওয়া গাছ যেভাবে সভ্যতার কুঠারে ঝুঁকে পড়ে, সেভাবেই তোমার দেওয়া খেয়ালখুশির দেয়ালা পেরিয়ে, আমার অত্যাচার নতমুখে মেখে নাও তুমি। প্রেমিক না হয়েও আব্দারের কোল টের পাই তোমার প্রাচীন-প্রাজ্ঞ গুঁড়ি জুড়ে। জেনে বা না জেনে যে ছায়ার আশ্রয় তুমি দিয়েছ তা যে এই অস্থিরমতি মহিলার মতো বালিকার কাছে কতখানি তা বোঝাতেই এই সম্বোধন। 

তোমাকে আমি আমার প্রিয় তালিকাদের হদিশ দিতে পারিনি বলে আকাশে মেঘ করে এসেছিল। কী করে বলি বলো, ‘প্রিয়’ শব্দের স্থায়িত্বের প্রতি অপ্রকাশিত এক ভয়ের শিকড় কত গভীরে...

এত অশান্ত, নিম্নচাপের ঘূর্ণির মতো মন নিয়ে স্থায়ীর আলাপে গলা সাধা দুস্কর। 
আজ ধবধবে সাদা চাদর পেতেছি বিছানায়, ঘুমন্ত মায়ের গায়ে চাদর টেনে দিয়েছি সস্নেহে, অথচ এই আমিই কত কটু কথা বলে চলি মায়ের উদ্দেশ্যে, ঘরকে করে তুলি ভাগাড়। এই দুই সত্বাই ভীষণ সত্যি জানো তো? দুজনেই সৎ, প্রবল, প্রিয়। কীভাবে একজন আমি কে বেছে নিই বলো? 

মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় তোমাকে খুলে দেখাই যাবতীয় অস্থিরতার পাশে কীভাবে বয়ে চলে স্থির অন্তঃসলীলা, বালিঝড়ের থামার অপেক্ষা না করেই ফিরে গেছে প্রতিটি পর্যটক। 

অথচ ঝড় থেমে গেলে অত্যাচারের পর চিলেকোঠা থেকে বৃষ্টি হয়ে নেমে এসেছে স্নেহ,যত্নবোধ। সমর্পণ করে দেওয়ার মতো সম্পর্কবোধ। 

তবুও প্রতিবার আমি ছাদ থেকে দেখেছি তীব্র বালিঝড়ে যুঝতে না পারা পর্যটক ফিরে যাচ্ছে বেড়ানো মাটি হওয়ার শোক নিয়ে। আমার চুল শনশন করে উড়ে চলে, অট্টহাস্যে ভরিয়ে তুলি অট্টালিকা, গোপন কুঠুরি থেকে কে যেন গুনগুনিয়ে কাঁদে৷ ও কান্নায় বড় মায়া আছে, বড় সুরেলা। রুদালির রুহ ভর করে আছে ও কান্নায়।


(২)

আশ্রয় ভেবে ছুটে গেছি যেসব ছায়ার দিকে তা আসলে ছায়া-ছবির দৃশ্য মাত্র। দৃশ্য নিভে এলে খুলে পড়েছে ব্যাকগ্রাউন্ডের পর্দা। চরিত্ররা ফিরে গেছে ব্যক্তিগত আস্তানায়। আর আমি অন্ধকার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে অবিরাম আঁকড়ে ধরতে চেয়েছি লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনে থাকা সাজানো চরিত্রদের। স্টেজকেই ঘর ভেবে বসা আমি বুঝে উঠতে পারিনি আলোর নীচে থাকা চরিত্রদের ফেলে আসা অতীত অথবা আগামীর হাতছানি কত মাত্রায় প্রবল। আলোর কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে সংলাপ বলা হয়, সেসব ফুরিয়ে গেলে ক্লান্ত শরীরে তারা খুঁজে নেয় প্রিয় কোনও কোল।

আসলে আশ্রয় কোনও ছায়া নয়, ছায়া-ছবির পোস্টার মাত্র।


(৩) 

মাদারির খেল দেখাতে দেখাতে যখন নেমে যাচ্ছি খাদের অতলে, হুঁশ ফেরে তোমার শান্ত অথচ বিস্তৃত ক্যানোপির ছায়া দেখে। আমার বানজারা জীবন জেনে এসেছে একই পথে দু বার চলা যায় না, একই পুকুরের জল দ্বিতীয়বারের তৃষ্ণা মেটায় না। অথচ সহজ পাঠের মতো তোমার হাওয়া গেয়ে চলেছে স্থায়িত্বের গান। এ গানের সুর বড় পুরোনো, নস্টালজিয়ার রেণু ছড়াতে ছড়াতে বেয়ে ওঠে কানের লতি বেয়ে। মাথা জুড়ে ঘনিয়ে আসে ভালোলাগার গন্ধ। হারানোর ভীতি জ্বর লেপ্টে থাকে সারা কপাল জুড়ে। জলপট্টির পাশে বসি চুপটি করে, লীনতাপ গিলে গিলে জলও বদলে ফেলে ভৌতগঠন। বাটি হাতে বেঁহুশে স্বপ্নের ভিতর জেগে উঠি আমি। বানজারা জীবনে

2 কমেন্টস্:

  1. বর্তমান টালমাটাল অবস্থা ও ভিন্ন অবস্থানের মধ্যেও শুভশ্রীর এক অনন্য স্বাদের ভালোবাসার গান শোনা যাচ্ছে এই লেখার মধ্যে দিয়ে। সাম্প্রতিক ফেসবুকের মতো সামাজিক জালাধান ব্যবস্থা তে লেখক-লেখিকার বেশীরভাগই বুর্জোয়া শ্রেণীর এবং ভীষণ রকম অসৎ লেখায় ভরপুর হয়ে আছে, যেখানে আজ আর সঠিক মূল্যায়ন পাওয়া কঠিন ও দুষ্কর। এর মধ্যেও শুভশ্রীর বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা শব্দরা শুধু স্পন্দিত করে, তাই নয়, এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে বাংলা ভাষা সাহিত্যের ভবিষ্যতের দিকে, যা অত্যন্ত বিরল। ওঁর লেখায় ডার্ক থিম থেকে ভালোবাসার স্বপ্নে যাত্রার এই বিভোর অমলিন চেষ্টা কে কুর্নিশ।
    শুভশ্রী তুমি যেভাবে তোমার বুকের রক্ত ঢেলে যেভাবে একটার পর একটা ভালো লেখা এমন দুঃসহ দিনেও উপহার দিয়ে যাচ্ছো, তা শুধু অমলিন নয় তা অপ্রতীম স্বাক্ষর রাখে। শুভেচ্ছা আর অনেক আদর তোমাকে। - ইতি, তোমার ভালোবাসা।

    উত্তরমুছুন