কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০

মোহাম্মদ হোসাইন




কবিতার কালিমাটি ১০১



পাথরের জীবনবৃত্তান্ত

কারো জীবনের গল্প শুনে সন্তুষ্ট হয়ো না। খোলো তোমার নিজের পুরাণ।
-- জালালুদ্দিন রুমি

ভেতরে পোড়ামাটির গল্প, আর অন্তস্থিত সুর একদিন
প্রকৃতির গান হয়ে প্রকৃতিতেই মিলিয়ে যেতে থাকল।
আর সেই গান নদী তার ঠোঁটে ও পাঁজরে নিয়ে,
বয়ে যেতে থাকল অনন্ত স্রোতধারায়, ঝিরিঝিরি বাতাসের গতিময়তায়
বৃক্ষের বুক ফেঁড়ে, সমুদ্রের তলদেশে ডুব দিয়ে দিয়ে
কতদূর চলে যেতে থাকে বিষণ্ণতার আলো, জলচর প্রাণীদের অথই ডানা

আমি দেখেও
  অন্ধ হয়ে থাকি, অথচ, আমার ভালবাসা ব্যপ্ত হতে থাকে ভোরের লালিমায়, বিচ্ছুরিত কণার দ্যোতনায়।

আমি পাহাড়কে, সমুদ্রের তরঙ্গকে, আর অন্ধকারের যোনির ভেতর আমার আত্মাকে বিচরণ করতে দেখি, কখনও কখনও পেঁজাতুলোর মত উড়ে যেতে  দেখি মহাশূন্যের নিঃসীমতায়,
যেন এক আশ্চর্য ডানা আমাকে নিয়ে চলে অনন্তের প্রাঞ্জলতায় অথচ, শূন্যতাকে ভয় পেয়েছিল যারা, যারা ভেবেছিল পৃথিবী অনন্ত গহ্বর ছাড়া আর কিছু নয়, ঝড়ের গতি তাদের  দিকশূন্য করে দিয়েছিল
মৃত্যু এসে ঝাঁপসা করে দিয়েছিল তাদের,
অন্তঃকরণ আর বোধগম্যতা, তখন  কতিপয় মৌল মানুষ এসে সেইসব জাল ছিন্ন করে দিয়েছিল অশেষ প্রাজ্ঞতায়,
তখন থেকে গল্প এবং মিথ প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল আর গম্যতার দিকে নিয়ে এলো বোধ, বিজ্ঞান।

আমরা মোমবাতির আলোর প্রশংসাই করি, তার পুড়ে যাওয়া অন্তর্নিহিত গলনদৃশ্যটা দেখিনা, যেমন দেখিনা বৃক্ষের, ফুল-ফল, ছায়ার বাইরেও প্রকৃতিকে সজীব রাখার কৃৎকৌশল...

যে আমাকে ভালবেসেছিল
যে আমার আঙুল ছুঁয়ে, আত্মা ছুঁয়ে শপথ করেছিল
এমনকি, যে তার পূর্বপুরুষের কসম নিয়েছিল, সে জানতো, সে সত্যকে অস্বীকার করে, কিরণকে অস্বীকার করে তার ভেতর অসংলগ্ন,
পাপ এবং মিথ্যাচার তার প্রকৃত খাবার

আমার হৃৎপিণ্ড চিরে, গহীন শূন্যতাকে চিরে এবং ঔদার্যের অসীমতাকে অবজ্ঞা করে হারিয়ে গেল...

অথচ, আমি মাইল কি মাইল শুধু রৌদ্রকে সাথী করে, বিশ্বাসকে অবলম্বন করে হেঁটে চলেছি। তার স্বর, তার গান বিচ্ছুরিত হতে দেখি বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায়, মেঘের কণায় কণায়, তরঙ্গিত মাধুর্যের বিহবলতায়...

একটা কবিতাই লিখে যাচ্ছি আজীবন
একটা গল্পই বলে যাচ্ছি আজীবন
একটা ছবিই এঁকে যাচ্ছি নিরন্তর
সেই গল্পটার পাশে, সেই ছবিটার পাশে
বসে থেকে দেখি, টুপটাপ জল ঝরছে, টুপটাপ পাতা ঝরছে হলুদ হলুদ পাতা
আর তার বুক চিরে বেরিয়ে যাচ্ছে কত নদী, কত নাম না জানা স্রোতের ধারা...

প্রত্যেকেই সাম্রাজ্য চায়, নিজ নিজ সাম্রাজ্য, (অবশ্য ভূবনও বলা যায়
কিন্তু, ভূবন কথাটির মাঝে একধরনের কবিতা লুকানো থাকে, নম্রতা থাকে
তাই, সাম্রাজ্যই বলব)।
এবং সে ক্ষমতা চায়, ঘরের, পরের
সমাজের, রাষ্ট্রের
মূলত মানুষ বীর হতে চায়, বীর
সে বীরত্ব, অহংকারেরই অন্য নাম

আর অহম ছাড়া হয় না কিছুই
সৃষ্টি হয়না, ধ্বংসও হয় না

একজন ভিক্ষুকেরও সাম্রাজ্য আছে
একজন বেশ্যারও সাম্রাজ্য আছে
একজন ভবঘুরে, একজন মাতাল,
একজন কবি কিংবা একজন প্রেমিক বা
প্রেমিকারও সাম্রাজ্য আছে, আছে...

আমার সাম্রাজ্যে শুধু তুমি
একা, অন্তহীন...

যত ধরনের মুখবন্ধ আছে
যত ধরনের স্বপ্ন আছে কিংবা
পৃথিবীতে যত উৎসমুখ আছে, মোহনা আছে
আর আছে যত জ্বালামুখ, সবার কাছে
নতজানু হয়ে থেকেছি, কেউ পথ দেখায় নি
কেউ বলেনি, এই তুমি, এই তোমার রাস্তা
এইদিকে যাও, এখানেই তোমার প্রাপ্তি, পূর্ণতা
কেউ বলেনি, কেউ না, কখনও কেউ বলে না...

এমনকি, প্রত্যেকেই এক একটা লাশ বহন করে নিয়ে যায় মৃত্যু পর্যন্ত যে যার মত
কখনও কখনও নিজের শবদেহও কাঁধে করে ফিরে নিয়ে   দিনের পর দিন... দিনের পর দিন... দিনের পর দিন...

মানুষ আসলে আজ্ঞাবহ কখনও নিজের, কখনও অন্যের, কখনও নিয়তির
সে আসলে একটা প্রাকৃতিক রাবার
যতই তাকে টানা যায় ততই সে লম্বা হতে থাকে, আর এভাবেই সে ছোট থেকে বড়, বড় থেকে ছোট হতে হতে একসময় ছিঁড়ে যায়... নিঃশেষ হয়ে যায়...

অথচ, মা চিরকাল মা’ই থেকে যায়-
যেমন মাটি, যেমন বৃক্ষ, যেমন রাত, যেমন সূর্য...

দুঃখকে আমি মায়ের কাছে রেখে এসেছিলাম
দুঃখকে আমি রোপন করে এসেছিলাম গোপনে, নদীতে, সমুদ্রে, পাহাড়ের ঢালুতে
তারপর অনেক অনেকদিন পর গিয়ে দেখি, সেখানে হাজার হাজার গাছ, হাজার হাজার পাখি এসে বসেছে, গান হয়ে ঝরছে - বিলাবল আলাইয়া, আহিরি -ভৈরব...

দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে দিতে যে উপত্যকায় দাঁড়িয়েছি আজ, মনে হচ্ছে-
কারা ছিল আমার পূর্বপুরুষ? কেমন ছিল তারা?
কোনও পূর্বজনম কী ছিল আমার?

একটা শামুককে গড়িয়ে যেতে দেখে
একটা পাথরের জীবনবৃত্তান্ত মনে পড়ে গেল...



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন