কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০

স্বপনকুমার বিশ্বাস



সমকালীন ছোটগল্প



নেপোবাবু


নির্মলকান্তি পোদ্দারকে সবাই ‘নেপো’ বলে ডাকে। সামনে নয়, আড়ালে-আবডালে। তার সামনে তাকে নেপো বলার সাহস কারো হয় না। এই নামকরণের পিছনে একটি ঘটনা আছে।

কিছু কিছু লোক কিছু অন্যরকম ক্ষমতা বা ভাগ্য নিয়ে জন্মায়। নির্মলকান্তি সেরকম একজন। যেখানে অন্য কেউ লাভ দেখতে পায় না, সেখানে নির্মলকান্তি লাভ দেখতে পায় এবং তার অদ্ভুত ভাগ্য সে লাভের ড়ি ঘরে তুলে নেয়।  হুগলির মগরা-পান্ডুয়া এলাকা আলুর জন্য বিখ্যাত। যেবার আলু হিমঘরে তুলে সবাই লোকসান করে, সে বছর নির্মলকান্তি আলুর বদলে পেঁয়াজ তোলে এবং প্রচুর লাভ করে। আবার যে বছর লোকসানের আশঙ্কা করে অন্যরা, আলু তোলে না, সে বছর নির্মলকান্তি আলু তোলে এবং প্রচুর লাভ করে।

এছাড়াও আছে।  একসময় এই এলাকা বালির জন্য বিখ্যাত ছিল।  নির্মলকান্তি বুঝতে পারত মাটির কতফুট গভীরে কতটা বালি আছে।  তারপর সেই জমি কম পয়সায় কিনে তার কয়েকগুণ টাকা লাভ করত আর একটা বড়পুকুরও তৈরি হয়ে যেত। সেখান থেকে আরও কয়েকগুণ টাকা ঘরে তুলতো।

সব জায়গায় নিন্দুকলোকের সংখ্যা বেশি। আশে-পাশের লোকেরা তার এই বিশেষ ক্ষমতার কোন দাম দিল না বরং তাদের ধারণা হলো এসব টাকা তিনি অন্যায়ভাবে আয় করছেন। তার এগুলো প্রাপ্য নয়। টাকা থাকলে ক্ষমতা বাড়ে, প্রতিপত্তি বাড়ে, দম্ভ বাড়ে।  নির্মলকান্তির ক্ষমতা বাড়লো, প্রতিপত্তিও বাড়লো - কিন্তু দম্ভ বাড়ল না। কেউ নির্মলকান্তির কাছে কোন সাহায্য চাইতে গেলে তিনি তা অবশ্যই বিনয়ের সঙ্গে দেবেন, কিন্তু তাকে দিয়ে এমন শর্ত করিয়ে নেবেন যে পরে দেখা গেল তার ঘটের দায়ে মনসা বিক্রি হয়ে গেল।
এইজন্য সবাই  নির্মলকান্তিকে এড়িয়ে চলে। সামনে তার প্রতিপত্তির জন্য কেউ মুখ খোলে না। থানার বড়বাবু এসে তার বাড়িতে চা খায়, নেতারা তাকে মিটিংয়ে ডাকে। শোনা গিয়েছিল এবার তিনি ভোটে দাঁড়াবেন।
সবাই শুধু তাকে এড়িয়ে চলে তাই নয় তাকে অপছন্দও করে। একদিন হাটের মধ্যে  ডাকাত সনাতন তাকে  এই মারে তো সেই মারে।  কালো কুচকুচে দীর্ঘদেহী সনাতন ডাকাত নয়, তার চেহারা ও গলার স্বর ডাকাত সর্দারের মত। এইজন্য সবাই বলে ডাকাত সনাতন। এতগুলো লোকের সামনে চিৎকার করে সে বললো তুমি তো নির্মল পোদ্দার নও তুমি হলে গিয়ে ‘নেপো’।  শালা নেপোয় মারে দই। আমরা কষ্ট করি আর তুমি নেপোর মত দই খেয়ে যাও।

অনেকের হস্তক্ষেপে তখনকার মতো ব্যপারটা মিটলো, কিন্তু নির্মলকান্তির ‘নেপো’ নামটা মুখে মুখে চাউর হয়ে গেল। এখন সামনে তাকে যে যাই বলুক, পেছনে বলে নেপো। নির্মলকান্তি সেটা জানে। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারে না – সামনে কেউ কিছু বলে না বলে। তবে মনে মনে তার রাগ হয়, আর ভাবে সব ব্যাটাকে টাইট দেব। সেই টাইট দেবার অঙ্গ হিসাবে এলাকার অনেক গরীবলোকের জমি আজ নির্মলকান্তির নামে হয়েছে। তার কোন অর্থের অভাব নেই, তিনি নিজেও ঠিক জানেন না তার কত বিঘা জমি আছে, কোথায় কত মন ধান তোলা আছে। গুদামে কত বস্তা আলু বা পেঁয়াজ আছে। এসব যে তিনি হিসাব করে যক্ষের মতো আগলে আছেন, তা নয়। তবু রোজ সকালে উঠে টাকা আয় করার নেশা তাকে পেয়ে বসে। কি ভাবে, কোন যায়গা থেকে, কার কাছ থেকে টাকা আয় করা যায়, সকালে উঠে চা খেতে খেতে তিনি একথা ইভাবেন।

এক ধরনের মানুষ আছে যারা রোজ হিসাবে বসেন – কত ধনসম্পদ অর্জন করা গেল, তাই নিয়ে। আরেক ধরনের মানুষ আছে,  সম্পত্তি আহরণেই তাদের আনন্দ। তার কোথায় কতোটা কি আছে, সেই হিসাবে তাদের অতটা আগ্রহ নেই। নির্মলকান্তি এই দ্বিতীয় ধরনের মানুষ।

নির্মলকান্তিকে শুধুমাত্র আশেপাশের লোকই যে অপছন্দ করে তাই নয়। তিনি বোঝেন, বাড়ির লোকেরাও তাকে বিশেষ পছন্দ বা ভক্তি শ্রদ্ধা করে বলে মনে হয় না। স্থুলাঙ্গী স্ত্রী আর একটি বখে যাওয়া পুত্র নিয়ে তার সংসার। স্ত্রীকে তিনি যথেষ্ট সোনার গয়না বানিয়ে দিয়েছেন, তিনি সেগুলো পরেও থাকেন - তবু নির্মলকান্তি তার মন জয় করতে পারেননি। সে চেষ্টাও বিশেষ করেননি।  তার ছেলেটা লেখাপড়া বিশেষ না করে পাড়ায় আধা দাদা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। একটা ক্লাবও আছে। অনেক বন্ধু-বান্ধব ও সাকরেদ জুটিয়ে নিয়েছে। এটা সে বুঝে গেছে, সে-ই এই বিষয়-সম্পত্তির একমাত্র ভবিষ্যৎ মালিক। তাই এখন থেকেই টাকা আয়ের থেকে টাকা ওড়ানোর দিকেই তার ঝোঁক বেশি। এই একুশে পড়েছে, কিন্তু ডানা পুরোটাই গজিয়ে গেছে।

তা যাক্‌গে। নির্মলকান্তি ওসব নিয়ে অত ভাবেন না। অন্য অনেক চিন্তা ভাবনা তার মাথার মধ্যে ঘোরে। সংসারের ভিতরের চিন্তা করা মানে মাথার যন্ত্রণা বাড়ানো। কি দরকার...।
এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল, কিন্তু গোল বাধালো এই করোনা এসে। সারা পৃথিবীতে করোনা রোগে ছেয়ে গেছে। এ এমন ছোঁয়াচে, সবাই এমন আতঙ্কে আছে, এই বুঝি তার করোনা হলো! করোনা হলে নাকি বাঁচার আশা খুব কম। ষাট পেরোলে তার আর রক্ষে নেই। আর এই রোগের কোন ঔষধও নাকি নেই।

এলাকাটাও কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। কেউ আর ঘর থেকে বের হতে চাইছে না। সব যেন ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে। কেউ কেউ সকাল-বিকালে মাথ্য হাত দিয়ে দেখছে - জ্বর এলো না তো! জ্বর এলেও অনেকে ভয়ে বলছে না। বললে পুলিশ তাকে কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে নিয়ে যাবে। আর করোনা হলে কেউ তাকে দেখতেও যাবে না। মরে গেলেও পোড়ানোর লোক পাওয়া যাবে না। এ নাকি এমন মারাত্মক রোগ।

আশে-পাশের অনেক লোকে মারা গেছে। যারা রাজমিস্ত্রি কুলি মজুরের কাজ করতো, তাদের কাজ নেই। যারা বাইরে কাজ করে পয়সা আনতো, তারাও ফিরে এসেছে। যারা ছোট-খাট দোকান করতো, হকারি করতো, টুক-টাক ব্যবসা করতো, সবই এখন বন্ধ। সবাই বেকার। অভাব চারদিকে। এই এলাকাটা এমনিতেই গরীব, এখন আরো বেড়েছে। তাই অনেকেই এখন টাকা বা জিনিস-পত্র ধারের জন্য নির্মলকান্তির কাছে আসছে। কিন্তু দু’একজন ঘনিষ্ট লোক ছাড়া কেউ কিছু পাচ্ছে না। বরং মনে মনে নির্মলকান্তি বলছে -এবার দ্যাখ্‌, এই ‘নেপো’ তোদের কি করে। করোনা তাকে এই দেখিয়ে দেবার সুযোগ করে  দিয়েছে।

*

সকালে উঠে চা খেতে খেতে নেপোবাবুর মনে হলো, তার শরীরে আজ বিশেষ যুত নেই। বয়স তো একেবারে কম হয়নি, শরীর সব সময়ে সুস্থ্ থাকে তা না। তবুও আজ মনে হলো শরীরটা বেশ বে-যুত। চারদিকে এমনি করোণা আতঙ্ক চলছে, এর মধ্যে তার গতকাল বাজারে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। শুধু গতকাল কেন, গত কয়েকদিন ধরে হরিপদকে ধরার জন্যে বাজারে যেতে হচ্ছে সকালে। হরিপদ তাড়াতাড়ি দেব বলে সেই যে টাকাটা নিল, আর এ পথ মাড়ায় না। তার বাড়ীও তিন গ্রাম দূরে, সেখানে এখন যাওয়াও সমস্যা। তবে, সকালে নাকি সে তার পান বিড়ির দোকান খোলে - সেখানেই তাকে ধরতে হবে। কিন্তু ব্যাটা এমন ধাড়িবাজ - ও বোধ হয় নির্মলকান্তির গায়ের গন্ধ পায়, সেদিন দোকান খোলেনা।

অত বাজারে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। বেশ গা ম্যাজ ম্যাজ করছে। আজ আর কিছু ইচ্ছে করছে না। সমর উকিলকে ফোন করার কথা ছিল - কোর্ট কবে খুলবে, একটা দলিল করতে হবে। না, ইচ্ছে করছে না। বারান্দায় বসে থাকলে দেখা যায়, সাঁওতাল পাড়ার, বাগদী পাড়ার বেশ কয়েকটি বৌ-ঝি রোজ সকালে  বেরোয় ভিক্ষে করতে আর রাস্তার পাশের শাক-শব্জী বা কচু গাছ তুলতে। দু’একজন তার দরজায় ভিক্ষে চায়। তাদের নাকি এখন খুব অভাব চলছে। শাক-পাতা সেদ্ধ করে খায়। নির্মলকান্তি এগুলো দেখে না। তার স্ত্রী মাঝে-মধ্যে এদের এটা-ওটা দেয়, তার জন্যে তাদের লোভও বেড়ে গেছে। কমানো দরকার। কিন্তু গিন্নির কাজ-কর্মে তিনি বিশেষ বাঁধা দেন না – অশান্তি হয়।

না, শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে। একবার মাথায় হাত দিলেন। মাথাটা কি গরম? ঠিক বোঝা গেল না। মুখের মধ্যে জিভ ঘুরিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন, অন্য রকম লাগে কিনা! তেমন কিছু বুঝতে পারলেন না। কিন্তু শরীরের মধ্যে তাপ অনুভব করলেন। গলার মধ্যেও যেন কেমন ব্যথা ব্যথা করছে। দু’একবার হাল্কা কাশিও দিলেন। তার ভয় হলো। শরীর যতোটা না খারাপ, তার চেয়ে ভয়টা বেশী হলো। তিনি আস্তে আস্তে উঠে আবার নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।

জানালা খোলা। সেই জানালা দিয়ে বাইরের বাগানের গাছ-পালা, প্রকৃতি দেখা যাচ্ছে। দূরে মাঠে ধান। কয়েকদিন পরে সেই ধান পাকবে। কিন্তু তার যদি করোনা হয়, তিনি কি সেই ধান দেখতে পারবেন? মনে হয় না! তার বয়স অনেক। সুগারের ওষুধ, প্রেসারের ওষুধ নিয়মিত চলছে - তাই তার বাঁচার সম্ভাবনা কমই। নির্মলকান্তির মনটা খারা হয়ে গেল। একটা আতঙ্ক এবং হতাশা তাকে পেয়ে বসল। এই সব ছেড়ে, এই বিষয় আসয় ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে? আকাট ছেলেটা তো দু’দিনেই সব নষ্ট করে দেবে! কি হবে তার সারা  জীবনের এই উপার্জনের ভবিষ্যৎ!

মাথাটা তার আরো ভারি মনে হচ্ছে। গলার কাশিটা বার বার আসতে চাইছে। এর মধ্যে মনে হলো বুকের কোথাও কষ্ট হচ্ছে শ্বাস নিতে। সত্যিই করোনা হলো না তো? টিভিতে তিনি দেখেছেন, করোনা হলে জ্বর, কাশি, শ্বাস-কষ্ট হয়। তারও এরকম মনে হচ্ছে, তবে?

সত্যি সত্যি বিকালে তার জ্বর এলো, সাথে কাশির প্রকোপ বাড়লো। তার নিজের ওষুধের বাক্স থেকে একটা জ্বরের ওষুধ খেলেন। রাতে কিছু খেতে ইচ্ছে করলো না। স্ত্রী একবার জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কি শরীর খারাপ? খাবেনা কেন?’
তিনি বললেন, ‘তেমন কিছু না। আজ আর খাবার রুচি নেই। আমি তাড়াতাড়ি শোবো আজ, বিছানাটা করে দিও’।
পরদিন সকালে নির্মলকান্তির জ্বর ও কাশি বাড়লো। তিনি জানেন, করোনা সন্দেহ  হলে পুলিশ এসে নিয়ে যাবে কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে। বাড়ির লোককেও ঢুকতে দেবে না। সেখানে তেমন কোন ব্যবস্থাও নেই। আর বেশী হলে হাসপাতালে ভর্তি। সেখানেও এখন বেড নেই। তবে কি রাস্তায় বেঘোরেই মরতে হবে?

বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না।  মাথা ধরে আছে। গা বমি বমি করছে। মুখে একটা অরুচি ভাব। শুয়ে থাকতেই ভালো লাগছে। তবুও তার মধ্যে তিনি উঠে মুখ ধুলেন। প্রাতঃকৃত করলেন। এরপর তিনি বাইরে বসে চা খান। বাইরে তিনি গেলেনও। যাথারীতি গিন্নি চা নিয়ে এলো।
চা টেবিলে রেখেই তিনি নির্মলকান্তির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের নীচে কালি। সারা মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। তিনি উদ্বিগ্ন স্বরে  বললেন, ‘কিগো, তোমার শরীর খারাপ? দেখি’ - বলে কপালে হাত দিলেন। তারপরে বললেন, জ্বরে যে গা একেবারে পুড়ে যাচ্ছে!
নির্মলকান্তি স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন। এমন ভাবে তিনি অনেকদিন স্ত্রীর মুখের দিকে তাকান না। তার বয়স্ক, স্থুল শরীরের স্থুল হাতটাকেই পরম ভরসার হাত বলে মনে হলো। তিনি স্ত্রীর হাত দুটি ধরে কান্নার মতো করে বললেন - ‘আমার মনে হয় করোনা হয়েছে!’
‘সে কি! জ্বর হলেই করোনা হয় না। তুমি চা-টা খাও, আমি খোকাকে ডাকি’
‘ও কি বাড়ি আছে? দেখো ওর ইয়ার-দোস্তদের বাড়ী ঘুরে জনসেবা করছে! যতো সব আদিবাসী অশিক্ষিতরা ওর বন্ধু!’
‘তুমি চা খাও, আমি দেখছি’ বলে নির্মলকান্তির স্ত্রী ‘খোকা’ বলে ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে গেলেন।
নির্মলকান্তি কোন রকমে চা-টা খেয়ে আবার তার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।  এখন আর জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে ইচ্ছে করছে না।
স্ত্রী এসে বললেন ‘মাথায় জল দেবো?
‘না। তুমি জানালার পর্দাটা ফেলে দাও’ বলে তিনি অন্যদিকে পাশ ফিরলেন। স্ত্রী চলে গেলেন নিজের কাজে।

নির্মলকান্তির তন্দ্রা মত এলো। আধো ঘুম আধো জাগরণে তার মনে হলো, কেউ যেন রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। তাকে নেবার জন্যে এম্বুলেন্স এসেছে কিন্তু  আবছা আবছা অনেক লোক সেই এম্বুলেন্সেকে যেতে বাধা দিচ্ছে - আর এম্বুলেন্সের ড্রাইভার জোরে জোরে হর্ণ বাজাচ্ছে। কিন্তু কেউ রাস্তা ছাড়ছে না।
স্ত্রী ঘরে ঢুকে জোরে জোরে বললেন, ‘কি গো, ঘুমুলে নাকি? গাড়ি এসেছে - ওঠো। হাসপাতালে যেতে হবে।
নির্মলকান্তি ছোখ খুলে ক্লান্ত স্বরে বললেন, ‘কেন?’
‘তোমার পরীক্ষা করতে হবে। খোকা গাড়ি নিয়ে এসেছে’
অনিচ্ছে স্বত্বেও নির্মলকান্তিকে উঠতে হলো। তিনি মুখে জল দিয়ে ছেলে আর ছেলের বন্ধুদের সাথে গাড়িতে উঠলেন।

প্রথমে বাড়ির কাছের পান্ডুয়া হাতপাতাল, সেখান থেকে চুঁচুড়া জেলা হাসপাতাল। সেখানে ডাক্তার পরীক্ষা করে করোনা সন্দেহ করে একটা নির্জন আইসোলেশান ওয়ার্ডে ভর্তি করলেন। সেখানে যারা কাজ চালাবার মতো ডিউটি করছে, সেই ডাক্তার, নার্স, অন্য স্টাফ - সবাই সারা শরীর ঢেকে যথা সম্ভব ছোঁয়া-ছুঁয়ি বাঁচিয়ে কম কথা বলে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের অন্য গ্রহের জীব বলে মনে হচ্ছে। না যায় তাদের সাথে মন খুলে কথা বলা, না যায় তাদের চেহারা দেখা। নিজের মুখেও সবসময় মুখোস পরে থাকতে হয়।

সবই হচ্ছে, কিন্তু কোন কিছুতেই কোন উপশম নেই। নির্মলকান্তির কষ্ট বেড়েই চলেছে। শ্বাস নেবার ক্ষমতা কমে আসছে। দুই দিন পরে রিপোর্ট এলো, আশঙ্কা সত্যি, নির্মলকান্তির করোনা হয়েছে।
বাড়ীর লোকের সাথে দেখা নেই। কারো দেখা করা বারণ। সরকারি বিশেষ গাড়িতে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো টালিগঞ্জের বাঙ্গুর কোভিড হাসপাতালে। যাওয়ার আগে ফোনে শুনলেন, বাড়ির সবাইকে পুলিশ এসে কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে নিয়ে গেছে। এখন বাড়িতে কেউ নেই, ঘর তালাবন্ধ।

বাঙ্গুর করোনা হাসপাতালে একাকী তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় নির্মলকান্তি শুয়ে আছেন।  এখানে কেউ মোবাইল ব্যবহার করতে পারে না। গত দু’দিন... দু’দিন না চার দিন... সে হিসাব এখন আর নেই। মনে হলো, অনেকদিন তার বাড়ীর লোকের সাথে যোগাযোগ নেই। আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে, তার সদর দরজায় তালাবন্ধ। স্ত্রী-পুত্রের মুখ মাঝে মাঝে আবছা ভাবে মনে পড়ছে - তারাও যেন কতো দূরের লোক। কোন এক সময় তারা আপনার ছিল, আজ কে কোথায়, কি করছে, কে জানে! তাদের মুখগুলো ক্রমশঃ ঝাপশা হয়ে যাচ্ছে। বিষয় সম্পত্তি, টাকা পয়সার কথা আর কিছু মনে পড়ছে না। সব আবছা ধোঁয়াশা মতো লাগছে।

শারীরিক কষ্ট বাড়ছে। বুকে ব্যথা, শ্বাস-কষ্ট, দম ফুরিয়ে আসা, আশে-পাশে কিছু মুখোশ পরা লোকজনের চলা-ফেরা, তাদের ফিস-ফিসিয়ে কথা বলা শুনতে  শুনতে নির্মলকান্তির শরীর এক সময়ে খুব হাল্কা মনে হল। তার ব্যথা-কষ্টের অনুভুতি সব লোপ পেয়া গেল। তিনি আর শারীরিক যন্ত্রণা অনুভব করছেন না।  যেন তার আত্মাটা ভাসছে, বোধহীন শরীরটা পড়ে আছে নিথর হয়ে হাসপাতালের বিছানায়।

চঞ্চলতা শুরু হয়েছে মুখোস পরা লোকজনের মধ্যে। কিছুক্ষণ পরে তেমনি  মুখোস পরা দুটি লোক তার শরীরে একটা চাদর জড়িয়ে তাকে তুলে নিল ট্রলির উপর। নির্মলকান্তি চললেন ওই শরীরের সাথে।
এক সময় শরীরটাকে প্রায় ছুঁড়ে দেওয়া হলো পুলিশের গাড়ির মধ্যে।
কে একজন বাঁজখাই গলায় বললো, ‘বাড়ির লোকজন কেউ নেই?’
কে একজন উত্তর দিল, ‘তারা সব কোয়ারেন্টাই সেন্টারে, আসতে পারবে না’।
বাঁজখাই গলা বললো, ‘যা নিয়ে, পুড়িয়ে আয়’।
অন্য গলা বললো, ‘আর দুটো আসবে স্যার, একসাথে পোড়াবো’। বলে গাড়ির   দরজা ঠাস্‌ করে বন্ধ করে দিল।
নির্মলকান্তির শরীর পড়ে রইলো, একা নিঃসঙ্গ হয়ে পোড়ানোর অপেক্ষায়।

*

হঠাৎ নির্মলকান্তি অনূভব করলেন, কে যেন তাকে ঠেলছে।
‘কিগো, অনেক বেলা হয়ে গেল, উঠবে না?, সেই কখন থেকে ডাকছি!’
নির্মলকান্তি চোখ রগড়ালেন। তার সামনে তার স্থুলাঙ্গী স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। নিজের গায়ে একটা চিমটি কাটলে ন- হ্যাঁ, লাগছে। তার মানে তিনি বেঁচে আছেন। তিনি  এতক্ষণ তার নিজের বাড়িতে নিজের বিছানায় ঘুমাচ্ছিলেন। এতক্ষণ যা ঘটলো,  সব স্বপ্ন ছিল! নিজেই নিজের মাথায় হাত দিলেন, না জ্বর নেই। মাথা ধরাও নেই। আনন্দে তার নাচতে ইচ্ছে করলো।
স্ত্রী বললেন, কপালে হাত দাও কেন? জ্বর-টর এলো নাকি? বলে নিজেই নির্মলকান্তির কপালে হাত ছুঁইয়ে বললেন, ‘না, কপাল তো ঠান্ডা। এসো চা দিচ্ছি’ বলে তিনি দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
নির্মলকান্তি সেদিকে তাকিয়ে একটা পরিতৃপ্তির হাসি হাসলেন। তার পরে উঠে মুখ ধুয়ে বাইরের বারান্দায় এসে বসলেন।
স্ত্রী চা রেখে চলে যাচ্ছিলেন, তিনি বললেন, ‘বোসো’
‘কেন, কি হলো?’
‘আরে বোসোই না’
স্ত্রী বসলেন। নির্মলকান্তি স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন। সেই প্রথম যৌবনের কথা মনে পড়লো। এই মুখের সাথে সেই মুখের কোন মিল নেই। তবুও এই মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন একটা মায়া অনূভব করলেন।
‘কি বলবে বল? ভাত চাপিয়ে এসেছি।’
নির্মলকান্তি চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘তুমি তো অনেকদিন থেকে বলছো, ওই অভাবি আদিবাসিদের বা গ্রামে আরো যারা গরিব আছে... তাদের কিছু সাহায্য করতে... তা তুমি করো না! তোমার যাকে যেমন মনে হবে, দিও। ওরা যেন না খেতে পেয়ে কষ্ট না পায়।’
স্ত্রী সন্ধিগ্ধ চোখে তাকালেন। ‘তোমার কি হলো? উলটো কথা বলছ?’
‘না, আমি ভেবে দেখলাম, তুমি অনেকবার বলেছ... আর এখন করোনার  সময়... কারো কাজ-কর্ম নেই- তাই...’
‘বেশ’ বলে তিনি উঠে গেলেন।
নির্মলকান্তি বেশ আয়েশ করে চা-টা শেষ করলেন। তখনই দেখলেন ছেলে  বাইরে বেরোচ্ছে। বললেন, ‘খোকা, এই লকডাউনের সময় কোথায় যাস্‌?’
‘যাচ্ছি ওই পুব পাড়ায় ত্রাণ বিলি করতে’
‘আর কে যাবে?’
‘আছে আমার সব বন্ধু-বান্ধব। কেন?’
‘না এমনি জিজ্ঞাসা করছি। তোরা কি দিবি?’
‘নিজেরা চাঁদা দিয়ে ক্লাব থেকে কিছু চাল, আলু, ডাল কিনেছি। তাই দেবো।’
‘শোন্‌’ বলে তিনি একটু থামলেন। তারপর বললেন, ‘তোরা ভালোমতো ত্রাণ  বিলি কর। কিন্তু সাবধানে থাকিস বাবা! যেন বেশি ছোঁয়া-ছুঁয়ি না হয়। আর আমি তোদের ক্লাবকে এখন দশ হাজার টাকা সাহায্য দেবো। পরে দরকার হলে আরো দেবো।’
ছেলে অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকালো। যার হাতের আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে দশ টাকা গলতে চায় না, তিনি দেবেন দশ হাজার টাকা! সন্দেহ নিয়ে বললো,  ‘তুমি সত্যিই দেবে?’
স্মিত হাস্যে নির্মলকান্তি বললেন, ‘কেন বিশ্বাস হয় না?’ বলে বললেন, ‘দাঁড়া’। তারপর ঘরে গিয়ে ১০০ টাকার একটা বান্ডিল এনে ছেলের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এই নে। কিন্তু আমাকে ক্লাবের রিসিট দিবি’
ছেলে কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে থেকে ‘হুররে’ বলে দু’হাত ছাড়িয়ে চীৎকার করে উঠলো, ‘ইউ আর গ্রেট বাবা!’ বলে প্রায় নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেল।
ছেলের চীৎকার শুনে স্ত্রী এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘কি হলো গো? খোকা এমন চীৎকার করলো কেন?’
ছেলের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে নির্মলকান্তি হাসতে হাসতে বললেন,  ‘ও কিছু না’ বলে দাঁড়িয়ে ছেলের মতো দু’হাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গলেন।
দু’হাত ছড়িয়ে এখন নির্মলকান্তি হাওয়ায় ভাসছেন। তার মনটা এখন পালকের মতো হাল্কা লাগছে। নির্মলকান্তি এতদিন পরে ওই চেয়ারে বসে থাকা ‘নেপোবাবু’র শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন