আমার চোখে কবি নীরেন্দ্রনাথ
বৈজয়ন্ত রাহা
জীবন যখন রৌদ্র-ঝলোমল,
উচ্চকিত হাসির জের টেনে,
অনেক ভালোবাসার কথা জেনে,
সারাটা দিন দুরন্ত উচ্ছ্বল
নেশার ঘোরে কাটল। সব আশা
রাত্রি এলেই আবার কেড়ে নিও,
অন্ধকারে দু-চোখ ভরে দিও
আর কিছু নয়, আলোর ভালোবাসা।
একদম ছেলেবয়সে, পাড়ার মঞ্চে কবিতা আবৃত্তি করতে গিয়ে ভয়ে পা ঠকঠক করে কাঁপত, আর একটাই ছোট কবিতা মুখস্ত করার চেষ্টা করতাম... ‘শেষ প্রার্থনা’, কবি নীরেন্দ্রনাথ। উনি সেই থেকেই ভরসা। সত্যি কথা বলতে, কিছুই বুঝতাম না কবিতার অর্থ, কিন্তু পড়তে ভালো লাগতো। ছন্দের ব্যবহার, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত... তাঁর কবিতা থেকেই ধীরে ধীরে বুঝেছি; আজ তাই তাঁর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে হাত যে একটু কাঁপছে না, তা নয়।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে আমি চিনেছি তাঁর কবিতার মধ্য দিয়েই, তাঁর সাথে ব্যাক্তিগত আলাপ করার কোনো সৌভাগ্য আমার হয়নি। তাই এই লেখাটি তাঁর কবিতা ও গদ্য আমাকে কীভাবে সমৃদ্ধ করেছে, তারই একটি ছায়াপাত হবে।
তখন ক্লাস সেভেন-এ পড়ি, বাবা বাড়িতে নিয়ে এলেন ঝকঝকে মলাটের একটি শিশুপত্রিকা – ‘আনন্দমেলা’। ‘সন্দেশ’, ‘শুকতারা’ তো আসতই, এবার তার সাথে যুক্ত হলো ‘আনন্দমেলা’ -- সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। সেই থেকে মাসিক ‘আনান্দমেলা’র ভক্ত হয়ে ওঠা। শুধু মাসিক-এ চলত না, শারদীয়া সংখ্যাও চাইই চাই। অদ্ভুত সুন্দর মলাট, কী সুন্দর কাগজ, হরফগুলিও সুন্দর। আমি আর আমার ছোটবোন কাড়াকাড়ি করতাম -- আজও মনে পড়ে।
একদিন বাবা কিনে নিয়ে এলেন ‘সাদা বাঘ’ -- অবাক হয়ে পড়লাম -- কী অপূর্ব ঝরঝরে ভাষা, কী সাবলীল শব্দনির্মাণ! পড়ে, কয়েকদিন পরেই মাকে নিয়ে কলেজস্ট্রীট দৌড়লাম --‘পিতৃপুরুষ’ কিনব বলে। প্রতিটি কিশোরের পড়া উচিৎ তার শিশুপাঠ্য ও কিশোর পাঠ্য রচনা।
কবিতাকে ভালোবেসেছিলাম, একেবারে ছোট বয়স থেকেই; কী করে, আজও জানি না। জানি শুধু কবিতা পড়তে ও শুনতে ভালো লাগতো। কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, কী তার কারণ, আমি কোনো সদুত্তর দিতে পারব না... আর এটা আমি জানি -- সেই ভালো লাগার মূল সুরটি, লাটাই-এর সেই সুতোটি ছিল কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর হাতে।
তখন ক্লাস টেন-এ পড়ি। নিজে থেকেই গিয়ে ভর্তি হলাম পার্থ ঘোষের কাছে। বাড়ির কাছেই তাঁর আবৃত্তি শেখানোর ক্লাস। তিনি প্রথম দিনেই বললেন -- ‘খাতা খোলো, একটা কবিতা আগে লেখ, তারপর দেখাবো’। আমি উঁকি মেরে দেখলাম, তাঁর হাতের বইটার নাম ‘নীল নির্জন’ -- তিনি পড়তে শুরু করলেন,
কেন আর কান্নার ছায়ায়
অস্ফুট ব্যথার কানে কানে
কথা বলো, বেলা বয়ে যায়,
এসো এই রৌদ্রের বাগানে।
এসো অফুরন্ত হাওয়ায়,
স্তবকিত সবুজ পাতার
কিশোর মুঠির ফাঁকে ফাঁকে
সারাটা সকাল গায়ে গায়ে
যেখানে টগর জুঁই আর
সূর্যমুখীরা চেয়ে থাকে।...
কবির নাম পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করলাম না... আমি অফুরন্ত হাওয়ায় ভেসে যেতে যেতে মাঠের ঘাসের শিশিরের জল ছুঁয়ে, রোদ্দুর হয়ে ধু ধু আকাশের ঘরে নীরব ছলছল শুনতে লাগলাম...
এই আলো হাওয়ার সকাল--
শোনো ওগো সুখবিলাসিনী,
কতদিন এখানে আসিনি,
কত হাসি কত গান আশা
দূরে ঠেলে দিয়ে কতকাল
হয়নি তোমায় ভালোবাসা।
কী আশ্চর্য ভালোবাসার কথা প্রতি ছত্রে ছত্রে...
হ্যাঁ, সে এক আশ্চর্য কবি! কবি নীরেন্দ্রনাথ!সে এক পরম শিল্পী। সংশয়-দ্বিধার অন্ধকারে
সেই বারে বারে
আলোকবর্তিকা জ্বালে, দুঃখ তার পায়ে মাথা কোটে,
তারই তো চুম্বনে ফুল ফোটে,
সেই তো প্রাণের বন্যা ঢালে
তুঙ্গভদ্রায়, গঙ্গায় কি ভাকরা-নাঙ্গালে ।
সে এক আশ্চর্য কবি, পাথরের গায়ে
সেই ব্রহ্মকমল ফোটায়।
বাবা টিফিনের পয়সা দিতেন একটাকা করে। পঞ্চাশ পয়সার টিফিন করে বাকিটা জমানো ছিল স্বভাব। জমিয়ে জমিয়ে আট দশটাকা হলেই দৌড়, কলেজস্ট্রীট। সেবারে তিনবন্ধু গেলাম, আর কিনে নিয়ে এলাম ‘অন্ধকার বারান্দা’। বাংলার ক্লাসে শ্যামলবাবু বলেছিলেন, শুধু সুকান্তরই ‘প্রিয়তমাসু’ নেই, নীরেন্দ্রনাথেরও আছে। বইটা পরেরদিনই দেখালাম স্যারকে। তিনি বললেন, এই কবিতা থেকে শিখবি, গদ্যকবিতায় ছন্দ অন্তর্লীন থাকে, গদ্যকবিতায় এতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা খুব কম কবিরই আছে...
তুমি বলেছিলে ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই।
অথচ ক্ষমাই আছে।
প্রসন্ন হাতে কে ঢালে জীবন শীতের শীর্ণ গাছে।
অন্তরে তার কোনো ক্ষোভ জমা নেই।
তুমি বলেছিলে, তমিস্রা জয়ী হবে।
তমিস্রা জয়ী হলো না।
দিনের দেবতা ছিন্ন করেছে অমারাত্রির ছলনা;
ভরেছে হৃদয় শিশিরের সৌরভে।
তুমি বলেছিলে, বিচ্ছেদই শেষ কথা।
শেষ কথা কেউ জানে?
কথা যে ছড়িয়ে আছে হৃদয়ের সব গানে, সবখানে;
তারও পরে আছে বাঙময় নীরবতা।
এবং তুষার মৌলি পাহাড়ে কুয়াশা গিয়েছে টুটে,
এবং নীলাভ রৌদ্রকিরণে ঝরে প্রশান্ত ক্ষমা,
এবং পৃথিবী রৌদ্রকে ধরে প্রসন্ন করপুটে।
দ্যাখো, কোনোখানে কো্নো বিচ্ছেদ নেই।
আছে অনন্ত মিলনে অমেয় আনন্দ, প্রিয়তমা।
কী অপূর্ব ছন্দ, যার প্রকাশ নেই, যা অন্তর্লীন, এ এক অসামান্য গদ্যকবিতা, ‘প্রিয়তমাসু’।
১৯৮৫ সাল। তানপুরার বার্ষিক অনুষ্ঠান। পার্থবাবুর সব ছাত্ররা আলাদা আলাদা করে কবিতা উপস্থাপন করবে মঞ্চে। কেউ করবে সুনীল, কেউ শঙ্খ, কেউ রবীন্দ্রনাথ, কেউ নজরুল, আমি কী করব, পার্থদা জিজ্ঞেস করতেই আমি বললাম, কেন? ‘মৌলিক নিষাদ’--
পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর নদীর ঠিক পাশে
দাঁড়িয়ে রয়েছি। পিতামহ,
দাঁড়িয়ে রয়েছি, আর চেয়ে দেখছি রাত্রির আকাশে
ওঠেনি একটিও তারা আজ।
পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর মৃত্যুর কাছাকাছি
নিয়েছি আশ্রয়। আমি ভিতরে বাহিরে
যেদিকে তাকাই, আমি স্বদেশে বিদেশে
যেখানে তাকাই -- শুধু অন্ধকার, শুধু অন্ধকার।
পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর সময়ে বেঁচে আছি।
এ এক আশ্চর্য সময়।
যখন আশ্চর্য বলে কোনো কিছু নেই।
যখন নদীতে জল আছে কি না-আছে
কেউ তা জানে না।
যখন পাহাড়ে মেঘ আছে কি না-আছে
কেউ তা জানে না।
পিতামহ, আমি এক আশ্চর্য সময়ে বেঁচে আছি।
যখন আকাশে আলো নেই,
যখন মাটিতে আলো নেই,
যখন সন্দেহ জাগে, যাবতীয় আলোকিত ইচ্ছার উপরে
রেখেছে নিষ্ঠুর হাত পৃথিবীর মৌলিক নিষাদ -- ভয়।
কী অমোঘ কবিতা, কী চিরন্তন সত্য, যে কোনো সময়ে দাঁড়িয়ে সমসাময়িক। সমস্ত কলেজজীবন জুড়ে কবিতা চর্চা, আর কবিতা পাঠ, আর পাঠ মানেই অবিসংবাদিত ভাবে নীরেন্দ্রনাথ। তখন টিউশনি করি, নিজের উপার্জন আছে। বাবার কাছে হাত পাততে হয় না, প্রথম খরচাই হলো কবিতার বই কেনা। বইমেলায় যাই, আর অন্তত পক্ষে ৫০০, ১০০০ টাকার বই কিনবই। কিনে ফেললাম ‘নীরক্তকরবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘কলকাতার যিশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’; আর লক্ষ্য করতে লাগলাম, তাঁর কবিতার ভাব, ভাষা-শৈলীর কীভাবে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। ‘অন্ধকার বারান্দা’র অমলকান্তি প্রাক-যৌবনে কাঁধে হাত রেখেছিল রোদ্দুর হতে পারেনি বলে, যৌবনে পা দিয়েই পড়লাম—
আমরা দেখি না, কিন্তু অসংখ্য মানুষ একদিন
পূর্বাকাশে সেই শুদ্ধ উদ্ভাস দেখেছে,
যাকে দেখে মনে হতো, নিহত সিংহের পিঠে গর্বিত পা রেখে
স্বর্গের শিকারী দাঁড়িয়েছে।
আমরা এখন সেই উদ্ভাস দেখি না।(‘নীরক্ত করবী’)
পড়ে চমকে উঠলাম
তোমরা পুরনো বন্ধু। তোমরা আগের মতোই আছো।
আগের মতোই স্থির শান্ত স্বাভাবিক।
দেখে ভালো লাগে।
প্রাচীন প্রথার প্রতি আনুগত্যবশত তোমরা
এখনও প্রত্যহ দেখা দাও,
কুশল জিজ্ঞাসা করো আজও।
দেখে ভালো লাগে।
তোমরা এখনও সুস্থ অনুগত আলোকিত আছ। (‘নরকবাসের পর’)
অদ্ভুত এক গল্পগাঁথার মতো নিজস্ব কথোপকথন, কবিতার ধারা ঘুরে যাচ্ছে নতুন যুগের মোড়ে... বুঝলাম আরও অপেক্ষার পালা।
অথবারাস্তার দুইধারে আজ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছে অন্ধ সেনাদল;
আমি চক্ষুষ্মান হেঁটে যাই
প্রধান সড়কে। দেখি, বল্লমের ধাতু
রোদ্দুরের প্রেম পায়, বন্দুকের কুঁদোর উপরে
কেটে বসে কঠিন আঙুল। (‘অন্ধের সমাজে একা’)
ফুলেও সুগন্ধ নেই। অন্ততঃ আমার
যৌবনবয়সে ছিল যতখানি, আজ তার অর্ধেক পাই না।
এখন আকাশ পাংশু, পায়ের তলায় ঘাস
অর্ধেক সবুজ, নদী নীল নয়। তা ছাড়া দেখুন,
স্ট্রবেরি বিস্বাদ, মাংস রবারের মতো শক্ত। ভীষণ সেয়ানা
গোরুগুলি। (‘বার্মিংহামের বুড়ো’)
হাত ধরে কবিতার ভাষা শেখাচ্ছেন নীরেন্দ্রনাথ... যে কোনো শব্দের কত রকম যে ব্যবহার, বহুপ্রচলিত শব্দকে একটুও ক্লিশে না করে নতুন ভাবে প্রয়োগ, দেখাচ্ছেন নীরেন্দ্রনাথ...
কী অসম্ভব নাটকীয়তা তুলে এনেছেন তিনিভালোবাসলে শান্তি হয়, কিন্তু আমি কাকে আজ ভালোবাসতে পারি?
কবিতাকে? কবিতার অর্থ কি? কবিতা
বলতে কি এখনও আমি কল্পনালতার ছবি দেখে যাব? (‘কবিতা কল্পনালতা’)
তুলে নিয়ে আসেন কথ্য পরিমন্ডলে ছন্দের জাদু...‘বাতাসি, বাতাসি’! -- লোকটা ভয়ঙ্কর চেঁচাতে চেঁচাতে
গুমটির পিছন দিকে ছুটে গেল
ধাবিত ট্রেনের থেকে এই দৃশ্য চকিতে দেখলুম।
কে বাতাসি? জোয়ান লোকটা অত ভয়ঙ্করভাবে
তাকে ডাকে কেন? কেন
হাওয়ার ভিতরে বাবরি-চুল উড়িয়ে
পাগলের মতো
‘বাতাসি, বাতাসি’! বলে ছুটে যায়? (‘বাতাসি’)
কবির অন্তর্বর্তী যাত্রা আমাকে মোহিত করে রাখে দীর্ঘদিন, দীর্ঘকাল—অকস্মাৎ কে চেঁচিয়ে উঠল রক্তে ঝাঁকি দিয়ে
“নিলাম, নিলাম, নিলাম!”
আমি তোমার বুকের মধ্যে উঁকি মারতে গিয়ে
চমকে উঠেছিলাম (‘দুপুরবেলায় নিলাম’)
কোনো একটিও ছন্দের আভাস পর্যন্ত নেই, কিন্তু কোথাও যেন এক অদ্ভুত ছন্দের ইঙ্গিত। এই ইঙ্গিতময়তাই নতুন দিকের সূচনার আভাস নিয়ে এলো কবিতায়।বাইরে এসো, ...কে যেন বুকের মধ্যে
বলে ওঠে... বাইরে এসো... এখুনি আমার
বুকের ভিতরে কার
স্নান সমাপন হলো!
সারাদিন ঘুরেছি অনেক দূরে দূরে।
তবুও বাইরে যাওয়া হলো না। ঘরের
ভিতরে অনেক দূরে দূরে
পা ফেলেছি। ঘরের ভিতরে
দশ-বিশ মাইল আমি ঘুরেছি! এখন
সন্ধ্যায় কে যেন ফের বুকের ভিতরে
বলে উঠল : এসো।
বাইরে এসো... কে যেন বুকের ভিতর ঘড়ির ঘন্টায়
বলে যাচ্ছে। এখুনি আমার
বুকের ভিতর যেন কার
অবগাহনের পালা সমাপন হলো।
কলকাতার রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতেই কেনা ‘কলকাতার যিশু’
লালবাতির নিষেধ ছিল না,
তবুও ঝড়ের বেগে ধাবমান কলকাতা শহর
অতর্কিতে থেমে গেল;
ভয়ঙ্করভাবে টাল সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল
ট্যাক্সি ও প্রাইভেট, টেমপো, বাঘমার্কা ডবল-ডেকার।
‘গেল গেল’ আর্তনাদে রাস্তার দুদিক থেকে যারা
ছুটে এসেছিল---
ঝাঁকামুটে, ফিরিওয়ালা, দোকানি ও খরিদ্দার—
এখন তারাও যেন স্থির চিত্রটির মতো শিল্পীর ইজেলে
লগ্ন হয়ে আছে।
স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,
টালমাটাল পায়ে
রাস্তার এক-পার থেকে অন্য পারে হেঁটে চলে যায়
সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক শিশু...
নাটকীয়তা, দৃশ্যকল্প, ও এক অসাধারণ মেসেজ -- যান্ত্রিকতাকে বিদ্রুপ করে উঠল অকুন্ঠিত জীবন... একবার কলমের জোরটা ভাবতে হয়...
১৯৭১ সালের প্রকাশিত বই, আমার হাতে এলো ১৯৮৮তে, ‘উলঙ্গ রাজা’
পরিষ্কার দ্বিধাহীন চিত্তে রাজনৈতিক কবিতাটি উনি লেখেন... আর আমরা ভাবি এভাবেও লেখা যায়!নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়।
আবার হাততালি উঠছে মুহূর্মুহু;
জমে উঠছে স্তাবকবৃন্দের ভীড়।
কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি
ভিড়ের ভিতরে আজ কোথাও দেখছি না।
কবিতা ধীরে সাংকেতিক হয়ে উঠছে -- তিনি লিখে চলেছেন—
সময়টা মনে রাখতে হবে -- ১৯৭১ সাল। গোটা বাংলা বিপর্যস্ত, তরুণ যুবকের রক্তে ভেসে যাচ্ছে কলকাতা থেকে তামাম পশ্চিমবঙ্গ...এই তো আমার অঞ্জলিতেই মস্ত পুকুর,
কেউ আচমকা ছুঁড়লে ঢেলা
দেখতে থাকি কেমন করে প্রকাশ্য হয়
খুব নগণ্য ছেলেবেলা। ... সাংকেতিক কিন্তু দূর্বোধ্য নয়... তাই প্রিয়।
সমস্ত দেওয়ালে
এখন নিজস্ব হাতে নিজস্ব ভাষায় লিখবার সময়ে
কে ভালোবাসার দিকে তুলেছ বন্দুক,
দূরে যাও।
তাঁর লেখার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে উঠি... “স্রোতের টানে, আশির নখ শিউরে ওঠে অন্ধকারে”মুঠি খোল,
কী আছে দেখাও।
কিছু নেই,
পথে-পথে শিশুরা যা কুড়িয়ে বেড়ায়
বারো মাস,
তা ছাড়া কিছুই নেই।
তাঁর লেখাকে, তাঁর লেখক-জীবনকে যদি মাপতে চাই ১৯৭৪ সালের সাহিত্য আকাডেমী পুরস্কার দিয়ে, তাহলে এই ৮৯ বছরের ইতিহাসকে মাপতে বড় ভুল হয়ে যাবে। কবিকে, কবির জীবনকে মাপতে নেই, কারণ নীরেন্দ্রনাথের মতো কবিরা জীবনের থেকে অনেক বড় মাপের হন... লক্ষ মানুষের বুকের ভিতর অনেক অনেক নতুন জীবন তাঁদের ধরে রাখে..
তিনি চলতে থাকেন... তাঁর পিছনে চলতে থাকে অফুরন্ত জীবন... যার অপর নাম মৃত্যুহীন প্রাণ, যে কোনোদিন কোথাও পৌঁছয় না, শুধু চলাই যার জীবন, চলার পথে অগণিত ফুল ফোটানোই যাঁর ধ্যান... তাঁকে কী দিয়ে মাপা যায়?
কক্ষনো কি তোমাদের কাউকে
এমন কথা বলেছিলুম যে, আমি
পৌঁছে গেছি?
তাহলে তোমরা ধরেই নিও যে,
কথাটা মিথ্যে,
কিংবা আমার বিশ্বাসে অনেক
ভেজাল ছিল।
আমি শুধু যাওয়ার কথাই বলি
পৌঁছোবার কথা বলি না।
আসলে পৌঁছোনটা যে খুব জরুরী
এমন বিশ্বাসই আমার নেই।
যাওয়াতে যারা বিশ্বাস কর
তারা আমার সঙ্গে চল।
যারা পৌঁছতে চাও, তারা
এসো না।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন