কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

১৩ নবেন্দুবিকাশ রায়

এক বুড়ো মাঝির কেচ্ছা
নবেন্দুবিকাশ রায়



সে ছিল একটা বুড়ো মাঝি। আর ছিলো অনেকগুলো কেচ্ছা। তামাটে দাঁড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা খুশবুদার অভিযান। মানোয়ারি রশিতে লেগে থাকা নুনছাল আর এক টুকরো আয়না। ব্যাস। আর কী লাগে! বুড়ো মাঝির কেচ্ছা শুনতে শুনতে শ্রোতাদের কানগুলো টের পেতো। জোয়ার আসছে।

“হ্যাঁ... তারপর হইল কী... সে বাজনদার পার্টি তো জলে পড়ে নেস্তানাবুদ। হেডা তো আর আমাগো নালা নয় যে সাঁইতরে পাইর পাবা। দরিয়ায় তুমি আমি কলের নৌকা হক্কলই সমান। তো তেনারা বাজনদার মানুষ, আল্লার কিরে কাইট্যা কইলো,‘হে আল্লা এবারকার মতো মাপ করো। ইব্রাহিম তার সব থেকে পেয়ারের ছাওয়ালকে কোরবান দিয়েছিল, আমরাও নয় আমাদের বাজনা কোরবান দিলাম! ইনশাল্লা, এবারকার মতো বাঁচিয়ে দাও আল্লা...”

শ্রোতারা ঝামেলা শুরু করে দেয়। অবাস্তব সব দাবি করে। মূলত মেয়েরাই বলে যে, অতগুলো মানুষ যে নৌকাডুবি হলো তাতে মাত্র চারজন বাজনদারই বা বাঁচলো কী করে? বাচ্চারা চেঁচামেচি করে। জানতে চায়, বাজনদাররা যে দ্বীপে কোনও মতে আশ্রয় পেয়েছিল, সে দ্বীপে কোনও জিন ছিলো কি না! জিন থাকলে তারা দিনের বেলায় এ কেচ্ছা শুনবে। রাতে অন্য কেচ্ছা বলতে হবে। জোয়ানরা আবার নিজেদের মধ্যে বাজি লাগায়, চারজনের মধ্যে শেষপর্যন্ত কে টিঁকে থাকবে! চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার মধ্যেও বুড়ো তার গাম্ভীর্য হারায় না। ছিলিমে গাঁজা ঠাসতে ঠাসতে সে বলে যায়, কীভাবে সেই চারজন বাজনদার একটা কাঠ ধরে ভাসতে ভাসতে অজানা দ্বীপে এলো, দেখলো যেদিকে দু’চোখ যায় শুধু অথৈ পানি। একটুকরো শুকনো কাপড় নেই, আগুন জ্বালানোর মতো চকমকি নেই, শুধু পকেটে রয়ে গেছে একটা মাউথ-অর্গ্যান। তারা প্রথমে ধন্যবাদ জানালো আল্লাহকে, তারপর খাবার খুঁজতে শুরু করে দিলো।

তারপর? শ্রোতাদের আর তর সয় না। তারা দেখে গাঁজার ধোঁয়া বুড়োর বুকে ঢুকে কেমন হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে।

“উয়ারা খাবার পাইল কী কইর‍্যা?”

“বাঁচল নাকি?”

“জিন নেই তো?”

বুড়ো এবার অল্প বকুনি দেয়। এত প্রশ্ন করারই সখ যদি তাহলে সবাই দু’গাঁ পেরিয়ে মৌলবি সাহেবকে জিগ্যেস করে আসে না কেন? মাঝি তো সবার প্রশ্নের ইজারা নিয়ে রাখেনি! আর এ বয়সে এত খুঁটিনাটি মনে রাখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কেচ্ছা শুনতে হলে শোনো, নইলে পালাও।

দ্বীপে ছিল অতীত কালের কিছু পশু, অতিকায় ও হিংস্র। খিদে ছিল একমাত্র দেবতা।

বাচ্চারা কান্না জুড়ে দেয়।

বাজনদাররা ভাবতে লাগলো, কী করে ওই পশুদের থেকে রক্ষা পাওয়া যায়! আল্লাহ একবার দয়া করেছেন, আবার কি করবেন? তাছাড়া পকেটে মাউথ-অর্গ্যান আছে অথচ তারা সেটায় ফুঁ দিতে পারছে না। এরকম দুঃসহ অবস্থায় আল্লাহর কাছে আর কিছু না চাওয়াই বোধহয় ভালো।

“উদের মদ্যে একজন একদিন কইলো, ‘আমি বুইছি। উয়াদের গু গায়ে মেখে নিলে উয়ারা আমাদের চিনতা পারবা না।’ কোন উয়ারা? আরে হুই জানোয়ারগুলান গো। যেতে থুইতে মুখ দে নাল ঝরে, কাঁটা কাঁটা শরীল। মরদের যেমনি কথা তেমনি কাজ। পরদিন কোথা থিক্যা যেন জানোয়ারের গু জোগাড় কইর‍্যা আনলো আর সারাটা বেলা জুড়ে ভালো কইর‍্যা ঘইস্যা ঘইস্যা গায়ে মাখলো। সি একখান খোলতাই বাস হইছিলো বটে।”

রাত ঘন হলে সে চুপচাপ জানোয়ারগুলোর পাশে গিয়ে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। লক্ষ্য করে, জানোয়ারগুলো ঘুমের মধ্যেই মুখ ঘষছে তার গায়ে। তাদের লালাভ জিভ বাজনদারের নুনু ছুঁয়ে যায়, তাদের দুর্গন্ধময় নিঃশ্বাসে বাজনদারের চোখ নাক বন্ধ হয়ে আসে। সে নিশ্চিন্তে ওই পশুদের ঘন উষ্ণ বৃত্তের মধ্যে সেঁধিয়ে পড়ে এবং ঘুমায়।

মেয়েরা অবাক হয়ে যায়। “ইয়াল্লা! গুয়ের বাস দিয়ে মাইনষ গায়ের বাস ঢাকসে!” তারা প্রতিবাদ করে। বলে যে তাদের গা গুলিয়ে উঠছে এ কেচ্ছা শুনে। তারা অন্য পরস্তাব শুনতে চায়।

যুবকেরা ভাবে, জানোয়ারগুলো কতো বোকা। কিন্তু তারপর?

তারপর একদিন আরেকজন আবিষ্কার করলো, জানোয়ারগুলোর গুয়ের জায়গায় তাদের মুত একেবারে একইরকম কাজ দেয়। সে সারা গা ওই জানোয়ারের মুতে ভিজিয়ে রাখতে শুরু করলো। দেখলো, জানোয়ারগুলো আর তার দিকে তেড়ে আসছে না।

তারপর?

কেন? লালারস।

তারপর?

কেন? রজঃস্রাব।

এইখানে বুড়ো জানতো, সন্দেহ ও ঘৃণার তীরগুলো ছুটে আসবে তার দিকে। সে হাত পা নেড়ে বোঝাতে চেষ্টা করে, কীভাবে জানোয়ারগুলোর হিংস্র থাবা থেকে বেঁচে চতুর্থ বাজনদারটা মাদী পশুর রজঃস্রাব জোগাড় করে নিয়ে এসেছিলো। মাদী পশুর স্নানের জায়গা থেকে অনতি দূরে সে গায়ে মেখে নেয়, তাজা রক্ত ও তিরতিরে মাংসের টুকরোগুলো। তাকে ভয়ানক মনে হয়।

ধীরে ধীরে ভীরু শ্রোতাদের সামনে এক অসহায় ছবি ভেসে ওঠে। চারজন বাজনদার মানুষ, একটাই মাত্র মাউথ-অর্গ্যান, যা তারা বাজাবে না কখনো, গু মুত লালা ও রজঃ মেখে আশ্চর্য দ্বীপে অচেনা পশুদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি। মেয়েরা উঠে পড়ে। কাঁখে তুলে নেয় ছোট ছোট বাচ্চাদের। একজন ইতিমধ্যেই হুড়হুড়ে বমি করে ফেলেছে। এক নতুন বৌ সদ্য বাঁধা তাবিজের কথা স্মরণ করে। জোয়ান মরদেরা সব বোকা বনে যায় আর জুয়ায় হেরে বসে। কার কাছে হারলো তারা? বুড়ো মাঝি ভাবে, এবার কেচ্ছা জমলো বলে।

প্রশ্ন ওঠে, উঠতেই হয়, লিঙ্গের মতো, এর থেকে উমদা কোনও কাজ বা পদ্ধতি জানা নেই তার। কীভাবে চারজন রক্ষা পেল সেই দ্বীপ থেকে? বাইরের মানুষ(এখানে আসলে বুড়োকেই অবিশ্বাস করা হয়, বেতমিজরা মুচকি হাসে) কীভাবেই বা জানলো এই আজীব কেচ্ছা? বুড়োর বলিরেখাময় মুখ যেন নূর লেগে বেঁকে গেছে। বুড়ো জানায়, অনেক অনেক দিন পর... কত দিন বা বছর সে জানে না... কলের জাহাজ এসে ভিড়লো সেই দ্বীপে... জুতো পরা লোকজন নামলো... তাদের সঙ্গে জঙ্গল কাটার মেশিন... কলের গান ও বিলিতি মদ...

“সায়েব মাইনষ? মেম ছিলো সাথে?”

“বাজনদারগুলাকে খুঁইজ্যা পাইলো সায়েবেরা? আর উই জানোয়ারগুলান?”

গোটা দ্বীপে বাজনদারদের চিহ্নমাত্রও খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে সেই হিংস্র পশুগুলো ছিল তখনও। অবশ্য তারা প্রত্যেকেই এখন পালা করে সেই মাউথ-অর্গ্যানটা বাজায়। তাদের হিংস্রতাও যেন আগের থেকে কিছুটা কমে গেছে। দ্বীপের আকাশ তাদের সেই মাউথ-অর্গ্যানটার সুরে প্রায় সবসময় ভরে থাকে। বিশেষত চাঁদনী রাতে তারা আলাদা আলাদা শোয়, সমুদ্রের তীরে। শোনা যায়, সাহেবেরা নাকি তাদের মধ্য থেকে এক বা দু’জনকে শহরেও নিয়ে এসেছিলো। শহরের আমোদগেঁড়ে পয়সাওয়ালা মানুষেরা নাকি টিকিট কেটে তাদের ছবিও তুলে এনেছে।

অবিশ্বাস যায় না শ্রোতাদের।

বুড়ো ছিলিম নামিয়ে রাখে হাত থেকে। ছাপিটা খুলে নেয়। ঠুকে ঠুকে বার করে এঁটেল পুড়িয়ে শক্ত করা টিকলি। ফোকলা মুখে, না ঠিক ফোকলা নয়, কয়েকটি দাঁত রয়েছে এখনো, শ্রোতাদের জানায়, সে রামপুরের হারু মন্ডলের কাছ থেকে শুনেছে এ কেচ্ছা। হারু মন্ডল আজকালের চ্যাংড়া নয়, বুড়োর থেকেও বড়, দিনে পাঁচ বার নামাজ পড়ে। সে কি আর মিথ্যে কথা বলবে?


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন