সিদ্ধ গোকুল
বারীন ঘোষাল
অনেকদিন গোকুলদা’র দেখা নেই। কাল আরতির বিয়ে। আমার অমতে। অবশ্য আমার মতামত কে-ই বা পোঁছে! আরতির সাহস হয়নি, বিয়েটা যে তার পছন্দ নয়, সেকথা বাবাকে বলার। বলবেই বা কোন্ ভরসা? আমার না আছে চাকরি না হিম্মৎ, যে বুক ফুলিয়ে আসরে নেমে আরতির বাবাকে এই বলে চমকে দেব – সুখে রাখব, শান্তিতে, আরতিকে আমার চাই! ওই আমার ফিট বউ! এই মালটাকে ফোটান নয়তো বিলা হয়ে যাবে বলে দিলাম!
কতরকমের ক্ষমতা পায় মানুষ। ১) বেস্ট হলো মানি পাওয়ার। আমার নেই। ২) বংশ কৌলীণ্যেরর গৌরব। আমার নেই। ৩) রাজনৈতিক ক্ষমতা। আমার নেই। ৪) গুন্ডা বন্ধুবান্ধবের জোর। আমার নেই। ৫) দিওয়ানা-পাগলপনের ঝড়। আমার নেই। ৬) নায়কোচিত হাবভাবে কথায় বশীকরণের ক্ষমতা। আমার নেই। এরকম নেগেটিভ একটা লোককে আরতি যে কেন ভালোবেসেছে, সেকথা জিজ্ঞেস করেও জানতে পারিনি। চোখের সামনে আরতিকে নিয়ে আর একজন চলে যাবে আর আমি চেয়ে চেয়ে তাই দেখব? সেজন্যই গোকুলের কথা মনে পড়েছে এখন।
আমাদের মধ্যে গোকুলদা হলো ওয়েদার কক। গুণে বলে দেবে কখন কোথায় বৃষ্টি পড়বে, তুফান উঠবে, ছাতিফাটা রোদ -- আর সেদিন সেখানে কিছুই হবে না। আবহ অফিসে কাজ পেয়েছে। দু-পয়সা আলাদা রোজগার হয় এই নিয়ে। ধর তোমার চাই আগামী দু’দিন যেন খটখটে রোদ থাকে। গোকুলের হাতে পাঁচশ টাকা দিয়ে ব্যাপারটা বলো। গোকুল সেদিনের রিপোর্টে ঘোষণা করবে, ‘আগামী দু’দিন পুরো মেঘলা থাকবে আকাশ’। আর আশ্চর্য, রৌদ্রময় কাটবে দু’দিন! গোকুলদা যা ঘোষণা করে তার উল্টোটাই হয়। এজন্য তার নামই দিয়েছিলাম ‘সিদ্ধ গোকুল’। আজ তাকে খুঁজছি কাল আকাশভাঙা বর্ষা নামাবার জন্য, যাতে আরতির বিয়েটা ভেস্তে যায়, লগ্নভ্রষ্টা হয় সে।
গোকুলদার বাড়ি পৌঁছে দেখি বেজায় ভিড়। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে গোকুলদাকে খুব বিচ্ছিরি অবস্থায় পেলাম। চেয়ারে আধশোয়া, নাকে মুখে রক্ত, জামাকাপড় চুল বিপর্যস্ত। দুটো ছেলে তাকে কেলিয়ে চলেছে – ‘শালা, বললাম বৃষ্টি এনে বাগড়া দিতে, না বাঞ্চোৎ বৃষ্টিকে পাঠিয়ে দিলো জলপাইগুড়ি! আমরা তোকে মাল্লু দিয়েছি গান্ডু কী আমাদের বাঁড়া চুষতে? টাকাও খাবি হাগবিও না, আমাদের সমস্ত লোকসান শোধা এখন’। ভিড় গুনগুন। কেসটা কী? গোকুলদা কি অসিদ্ধ হয়ে গেল? যে রেটে মার খেয়েছে, মনে হয় না কালকের মধ্যে আমার কাজটা করে দিতে পারবে।
তবুও অপেক্ষা করলাম। ভিড়টা পাৎলা হয়ে আসতে কাছে গিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চাইলাম – ‘খুব লেগেছে, গোকুলদা’? গোকুল – ‘না, আদর করছিল। শালা, টাকা নিয়ে আর কারও কাজ যদি করেছি! টাকাই নষ্টের গোড়া’। -- ‘আচ্ছা, সে না হয় না করলে, তবে আমার একটা কাজ যে করে দিতে হবে দাদা! কাল বৃষ্টিতে সকাল থেকে শহর ভাসিয়ে দিতে হবে। সব গাড়ি ঘোড়া বন্ধ, শুধু নৌকো চলবে’। -- ‘পাগল! আমার কী হবে? যাব আসব কী করে? বন্যায় তোর লাভ’? -- ‘আরতির বিয়েটা আটকে যাবে। গিয়ে বলতে পারবো, আমার ক্ষমতা দেখলেন তো, কেমন জাদুটোনা জানি, সিদ্ধি জানি। আরতিকে নিয়ে আমি চললাম। এবার পারেন তো আটকান আমাকে! চলে এসো আরতি। তুমি আমার মাথায় থাকবে, কোলে থাকবে, আধপেটা থাকবে, কিন্তু স্বাধীন থাকবে ভালোবাসার নীল পতাকাতলে, যেখানে প্রতিবাদের ভাষা আছে, প্রেমের ভাষা আছে, মুখ বুজে মার হজম করতে হবে না। চলো। ছেড়ে দিন, সরে যান আপনারা, আপনাদের সব মার আমার গায়ে পুষ্পবৃষ্টির মতো ঝরছে। ঘুম পাচ্ছে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। এসো আরতি ঘুমোই আমরা। ঘুমোই।
সানাই, উলু, রোদ ঝলমল করছে ঘুমের ভেতর। গা নড়ছে না। ব্যথাও কত আরামের!
বারীন ঘোষাল
অনেকদিন গোকুলদা’র দেখা নেই। কাল আরতির বিয়ে। আমার অমতে। অবশ্য আমার মতামত কে-ই বা পোঁছে! আরতির সাহস হয়নি, বিয়েটা যে তার পছন্দ নয়, সেকথা বাবাকে বলার। বলবেই বা কোন্ ভরসা? আমার না আছে চাকরি না হিম্মৎ, যে বুক ফুলিয়ে আসরে নেমে আরতির বাবাকে এই বলে চমকে দেব – সুখে রাখব, শান্তিতে, আরতিকে আমার চাই! ওই আমার ফিট বউ! এই মালটাকে ফোটান নয়তো বিলা হয়ে যাবে বলে দিলাম!
কতরকমের ক্ষমতা পায় মানুষ। ১) বেস্ট হলো মানি পাওয়ার। আমার নেই। ২) বংশ কৌলীণ্যেরর গৌরব। আমার নেই। ৩) রাজনৈতিক ক্ষমতা। আমার নেই। ৪) গুন্ডা বন্ধুবান্ধবের জোর। আমার নেই। ৫) দিওয়ানা-পাগলপনের ঝড়। আমার নেই। ৬) নায়কোচিত হাবভাবে কথায় বশীকরণের ক্ষমতা। আমার নেই। এরকম নেগেটিভ একটা লোককে আরতি যে কেন ভালোবেসেছে, সেকথা জিজ্ঞেস করেও জানতে পারিনি। চোখের সামনে আরতিকে নিয়ে আর একজন চলে যাবে আর আমি চেয়ে চেয়ে তাই দেখব? সেজন্যই গোকুলের কথা মনে পড়েছে এখন।
আমাদের মধ্যে গোকুলদা হলো ওয়েদার কক। গুণে বলে দেবে কখন কোথায় বৃষ্টি পড়বে, তুফান উঠবে, ছাতিফাটা রোদ -- আর সেদিন সেখানে কিছুই হবে না। আবহ অফিসে কাজ পেয়েছে। দু-পয়সা আলাদা রোজগার হয় এই নিয়ে। ধর তোমার চাই আগামী দু’দিন যেন খটখটে রোদ থাকে। গোকুলের হাতে পাঁচশ টাকা দিয়ে ব্যাপারটা বলো। গোকুল সেদিনের রিপোর্টে ঘোষণা করবে, ‘আগামী দু’দিন পুরো মেঘলা থাকবে আকাশ’। আর আশ্চর্য, রৌদ্রময় কাটবে দু’দিন! গোকুলদা যা ঘোষণা করে তার উল্টোটাই হয়। এজন্য তার নামই দিয়েছিলাম ‘সিদ্ধ গোকুল’। আজ তাকে খুঁজছি কাল আকাশভাঙা বর্ষা নামাবার জন্য, যাতে আরতির বিয়েটা ভেস্তে যায়, লগ্নভ্রষ্টা হয় সে।
গোকুলদার বাড়ি পৌঁছে দেখি বেজায় ভিড়। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে গোকুলদাকে খুব বিচ্ছিরি অবস্থায় পেলাম। চেয়ারে আধশোয়া, নাকে মুখে রক্ত, জামাকাপড় চুল বিপর্যস্ত। দুটো ছেলে তাকে কেলিয়ে চলেছে – ‘শালা, বললাম বৃষ্টি এনে বাগড়া দিতে, না বাঞ্চোৎ বৃষ্টিকে পাঠিয়ে দিলো জলপাইগুড়ি! আমরা তোকে মাল্লু দিয়েছি গান্ডু কী আমাদের বাঁড়া চুষতে? টাকাও খাবি হাগবিও না, আমাদের সমস্ত লোকসান শোধা এখন’। ভিড় গুনগুন। কেসটা কী? গোকুলদা কি অসিদ্ধ হয়ে গেল? যে রেটে মার খেয়েছে, মনে হয় না কালকের মধ্যে আমার কাজটা করে দিতে পারবে।
তবুও অপেক্ষা করলাম। ভিড়টা পাৎলা হয়ে আসতে কাছে গিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চাইলাম – ‘খুব লেগেছে, গোকুলদা’? গোকুল – ‘না, আদর করছিল। শালা, টাকা নিয়ে আর কারও কাজ যদি করেছি! টাকাই নষ্টের গোড়া’। -- ‘আচ্ছা, সে না হয় না করলে, তবে আমার একটা কাজ যে করে দিতে হবে দাদা! কাল বৃষ্টিতে সকাল থেকে শহর ভাসিয়ে দিতে হবে। সব গাড়ি ঘোড়া বন্ধ, শুধু নৌকো চলবে’। -- ‘পাগল! আমার কী হবে? যাব আসব কী করে? বন্যায় তোর লাভ’? -- ‘আরতির বিয়েটা আটকে যাবে। গিয়ে বলতে পারবো, আমার ক্ষমতা দেখলেন তো, কেমন জাদুটোনা জানি, সিদ্ধি জানি। আরতিকে নিয়ে আমি চললাম। এবার পারেন তো আটকান আমাকে! চলে এসো আরতি। তুমি আমার মাথায় থাকবে, কোলে থাকবে, আধপেটা থাকবে, কিন্তু স্বাধীন থাকবে ভালোবাসার নীল পতাকাতলে, যেখানে প্রতিবাদের ভাষা আছে, প্রেমের ভাষা আছে, মুখ বুজে মার হজম করতে হবে না। চলো। ছেড়ে দিন, সরে যান আপনারা, আপনাদের সব মার আমার গায়ে পুষ্পবৃষ্টির মতো ঝরছে। ঘুম পাচ্ছে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। এসো আরতি ঘুমোই আমরা। ঘুমোই।
সানাই, উলু, রোদ ঝলমল করছে ঘুমের ভেতর। গা নড়ছে না। ব্যথাও কত আরামের!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন